একবার তো লিখলাম । ড্রাগনটার নাম ছিল জারটিনপোল । সে থাকত স্লডিনববের এক বনে । স্লডিনববের সবাই তাকে খুব ভয় পেত । জারটিনপোলের বড় বড় সবুজ আঁশটে, কাঁটাওয়ালা লেজ, এসব দেখে ভয় পাওয়ারই কথা ।
তবে সবাই সবচেয়ে বেশি ভয় পেত ওর নাক দিয়ে আগুন বের হওয়াটা । সেই আগুনও আবার তিন রঙের । লাল, বেগুনী, নীল ।
কিন্তু আসল ব্যাপার হল জারটিনপোলের নাক দিয়ে তখনই আগুন বের হত যখন সে ভয় পেত । অবশ্য যখন হাঁচি হত তখনও হাঁচির সাথে আগুন বের হত ।
কিন্তু সবাই ভাবত সে সব কিছু পুড়িয়ে দেওয়ার জন্যই আগুন বের করে । আর এই জন্যেই সবাই ওকে এত ভয় পেত ।
একদিন শহরের লোকজন সবাই মিলে গেল রাজার কাছে । এই ড্রাগনের একটা হেস্তনেস্ত না করলেই নয় । রাজার কাছে তাদের আবদার একটাই যেভাবেই হোক এই ত্রাসকে বিদায় করতেই হবে ।
হেরল্ড নামে এক নেতা গোছের লোক বলল,”রাজা মশাই, আমাদের এখন জান নিয়ে টানাটানি, ওই ভয়ংকর ড্রাগন আমাদের ঘর-বাড়ির আশেপাশে ওঁত পেতে থাকে আর সব কিছু জ্বালিয়ে দেওয়ার ভয় দেখায় । ” প্রিছিলা নামের এক মহিলা বলল,”ওই বিরাট আর ভয়াল ড্রাগন যদি স্লডিনববে থাকতে থাকে তাহলে হয়তো কোন একদিন আমাদের সবকিছু এক নিমেষে শেষ হয়ে যাবে । ” আরো দুয়েক জন এরকম কথাবার্তা বলল ।
এরপর সবাই একসাথে "হ্যা হ্যা" করে উঠল । সবাই স্লোগান দিতে শুরু করল,”ড্রাগন তাড়াও ! ড্রাগন তাড়াও ! স্লাডিনবব বাঁচাও ।
স্লাডিনবব বাঁচাও । ”
রাজা মারসার ছিলেন ভালো মানুষ । সব শুনে গম্ভীর স্বরে বললেন,”আমি বুঝতে পারছি সবাই ড্রাগনের ভয়ে ভীত । আমি আর আমার স্ত্রী মেলিন্ডা এ ব্যাপারে সবার সাথে আলোচনা করব । তারপর আপনাদের সবাইকে ডেকে একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হবে ।
”
তারপর রানী মেলিন্ডা বললেন, “আপনারা চিন্তা করবেন না । আমরা অবশ্যই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা কিছু করব । আমরাও চাই ওই ভায়ংকর ড্রাগন কিছু করার আগেই কোন একটা সিদ্ধান্তে আসতে । ” শহরের লোকজন আশ্বস্ত হয়ে ফিরে গেল ।
সবাই চলে যাওয়ার পর মেলিন্ডা মারসারকে বললেন, “মেরিগোল্ডকে দেখেছ? অনেকক্ষন ওকে দেখছি না ।
”
“কই না তো...” মারসারের উত্তর ।
মেরিগোল্ড হল রাজকন্যা । রাজা-রানীর একমাত্র সন্তান । স্বভাবতই খুবই আদরের । মাঝে মাধ্যেই মেরিগোল্ড মা-বাবাকে খুব চিন্তায় ফেলে দিত ।
সে একা একা প্রাসাদের বাইরে যেত । বনের মধ্যে ঘোরাঘুরি করত ।
এবার মেরিগোল্ড ঘুরতে ঘুরতে স্লডিনববের কাছাকাছি চলে গেল । লাফালাফি, দৌড়াদৌড়িতে কখন যে কত সময় চলে গেছে সে নিজেও বোঝেনি ।
একসময় বাড়ির কথা মনে পড়ল ।
“হায়! হায়! আমি তো অনেকক্ষন হল বাড়ি থেকে বেরিয়েছি । সবাই নিশ্চয়ই খুব চিন্তা করছে । ” ততক্ষণে চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেছে । সে কোন ভাবেই বুঝে উঠতে পারলো না কিভাবে প্রসাদে ফিরবে । তার ভয় করতে লাগলো ।
ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করল ।
এই সময় একটা অনেক মোটা আর খুব আদুরে গলা বলে উঠল, “তুমি কি পথ হারিয়ে ফেলেছে? হেল্প লাগবে?”
রাজকন্যা মাথা তুলতেই জারটিনপলকে একবারে ওর সামনে দেখতে পেল । বিরাট গলা নামিয়ে সে মেরিগোল্ডের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে । মেরিগোল্ড বুঝল, সে ড্রাগনের সামনে দাঁড়িয়ে । আরো ভয় পেয়ে উল্টো ঘুরে দৌড় দিতে গিয়ে পড়ে গেল ।
তখন জারটিনপোল তার ডান পাখনা দিয়ে আস্তে করে তুলে মেরিগোল্ডকে তার পিঠে বসিয়ে দিল ।
“আমার আঁশটে গুলোতে ব্যাথা পাচ্ছ না নিশ্চয়ই? এতো রাতে তোমার বনের ভেতর থাকা ঠিক না । চলো তোমায় বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি । ভয় পেও না । আমি থাকতে তোমার কিচ্ছু হবে না ।
”
রাজকুমারী এখনও একটু ভয়ের মধ্যেই ছিল । ভয়ে ভয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কি সেই ড্রাগন যে সবাইকে ভয় দেখায়?”
“আল্লা মাফ করো, বলে কি এই মেয়ে ! অবশ্যই না ! আমি কোনদিন কাউকে কোনরকম কষ্ট দেওয়ার কথা চিন্তাও করিনি !”
“তাহলে সব্বাই তোমাকে এত ভয় পায় কেন?”
“কারন তারা আমাকে ভাল ভাবে চেনে না । কারো চেহারা দেখে তাকে বিচার করা উচিত না । যাই হোক আর কোন কথা না, চল তোমায় বাসায় রেখে আসি । ”
তারপর মেরিগোল্ডকে নিয়ে শো করে আকাশে উঠে গেল ।
ততক্ষণে মেরিগোল্ডের ভয় কেটে গেছে । সে আনন্দে চিৎকার করতে শুরু করল । কিছুক্ষনের মধ্যে ওরা প্রাসাদের সামনে পৌঁছে গেল । পাহারায় থাকা প্রহরী দুজন তাদের তলোয়ার বের করল । মেরির মনে হল ওরা জারটিনপোলকে আক্রমন করবে কিন্তু তা না করে দুজনেই তলোয়ের-টলোয়ার ফেলে উল্টো দৌড় দিয়ে প্রাসাদে ঢুকে গেল ।
“ঈশ ! তুমি কত ভাল । তবু সবাই তোমাকে ভয় যে পায়......। । আমি বাসায় গিয়ে মা-বাবাকে বলব তুমি কত্ত ভালো ড্রাগন । ”
ওর কথা শুনে জারটিনপলের চোখ ভিজে গেল ।
“সবাই যদি আমাকে এরকম বুঝত !”
সে যখন উড়ে যাচ্ছিল তখন রাজকন্যা হাত নেড়ে তাকে বিদায় জানাচ্ছিল । একসময় যখন আর তাকে দেখা যাচ্ছিল না তখন মেরিগোল্ড প্রাসাদে ঢুকে গেল ।
ভেতরে ঢুকেই ও মা-বাবার সামনে পড়ল । দুজনেই খুব রেগে ছিলেন । রাজা বললেন, “তোমার সাহস খুব বেড়ে গেছে তাই না? যখন খুশি যেখানে সেখানে যাওয়া, ইচ্ছে মত বাড়ি ফেরা, মানেটা কি? আবার ড্রাগনের পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়ানো হচ্ছে, না ?”
“কিন্তু বাবা জারটিনপোল খুব ভালো ড্রাগন ।
আমি বনের মধ্যে হারিয়ে...” মেরিগোল্ড বলতে শুরু করতেই ওর মা ওকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন ।
“যথেষ্ট হয়েছে মেরি । ” রানী শান্ত গলায় বললেন । “এই দুই সাহসী যোদ্ধা আমাদের সব বলেছে । ড্রাগনটা প্রাসাদ আক্রমন করার তালে ছিল ।
আর ওটা তোমাকেও জোর করে ধরে ছিল । তারা শুধু মাত্র দুজন অতবড় একটা জানোয়ারটার সাথে পেরে উঠত না । তাই তারা বাকি সবাইকে জানাতে শুরু করে । ’’
মেরিগোল্ডের কান্না পেয়ে গেল । ভাঙ্গা গলায় বলল, “ও তো আমাকে জোড় করে ধরে রাখেনি ।
আমিই পথ ভুলে...”
“চুপ । একদম চুপ । আজ থেকে তোমার প্রাসাদের বাইরে বের হওয়া বন্ধ । যাও, তোমার রুমে যাও । ”ভীষন রাগ হয়ে বললেন রাজা ।
ঠিক সেই মুহূর্তে এক সৈন্য এসে জানালো, “রাজা মশাই রাজা মশাই, ওই জানোয়ারটা চলে গেছে । কিন্তু আপনি চিন্তা করবেন না । আমরা ওটাকে খুজে বার করবই । ”
“একটা দল নিয়ে এখনই জঙ্গলের ভেতর যাও । চিরুনী অভিযান চালাও ।
দরকার হলে বনের প্রতিটা ইঞ্চি খোঁজ । যেভাবেই হোক ওকে খুজে বার কর । ওর মাথাটা আমার চাই । ” চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন রাজা ।
মেরিগোল্ড ঘরে যেতে যেতে বাবার কথা শুনতে পেল ।
মনে মনে ভাবল, “যে করেই হোক আমাকে সৈন্যদের আগে জারটিনপোলের কাছে পৌছতে হবে । ওকে সাবধান করাটা খুবই দরকার...”
সে চুপি চুপি প্রাসাদের গোপন দরজা দিয়ে বের হয়ে এলো । যত তাড়াতাড়ি পারল বনে পৌছল । কিন্তু কই জারটিনপোল? আশে পাশে কেউ নেই ।
হঠাৎ ও একটা গর্জন শুনতে পেল ।
চারপাশ ধোয়ায় ভরে গেল । পেছনে তাকাতেই ও জারটিনপোলকে দেখতে পেল ।
“তোমাকে ভয় পাইয়ে দিলাম নাকি? আসলে একটা সুন্দর ফুল দেখে গন্ধ শুকতে ইচ্ছে করল । একটু শুকলাম আর তাতেই ভীষণ হাঁচি পেয়ে গেল । ”
খুশিতে মেরিগোল্ড জারটিনোলের গলা জড়িয়ে ধরল ।
“উফ কতক্ষন ধরে তোমাকে খুজছি । ও হ্যা, আমি এখানে এসেছি তোমাকে সাবধান করতে,
বাবার সৈন্যরা তোমাকে খুঁজছে । বাবা আদেশ করেছেন তোমার মাথা নিয়ে ফিরতে । ” বলতে বলতে রাগে দুঃখে অভিমানে কেঁদে ফেলল মেরিগোল্ড ।
জারটিনপোল তার পাখনা দিয়ে মেরিকে জড়িয়ে ধরল ।
বলল, “এতে তোমার কোন দোষ নেই । ” সে মেরিকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করল ।
ঠিক সেই সময় রাজার এক লোক সেখানে হাজির হল । “প্রিন্সেস! প্রিন্সেস! ওই দানবটার কাছ থেকে সরে যান । তাড়াতাড়ি সরে যান ।
ওর কাছাকাছি থাকা মোটেও নিরাপদ না আপনার জন্য । সরে যান । ”
“না না...” কিছু একটা বলতে শুরু করছিল মেরিগোল্ড কিন্তু জারটিনপোল ওকে পাখা দিয়ে আস্তে আস্তে ঠেলে চলে যেতে বলল ।
অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে প্রায় বিশ জন সেনা জারটিনপোলকে ঘিরে ফেলল ।
“পাইছি তোরে শয়তান ড্রাগন ।
” একজন বলল ।
“ভুলেও পালাবার চেষ্টা করো না । ” পাশে থেকে আরেকজন বলে উঠল ।
“আজ থেকে তোর সব জারি জুরি খতম । এলাকার লোকজনকে ভয় দেখানো না......দাড়া...।
” তৃতীয় আরেকজন বলল ।
জারটিনপোল বুঝল, ভালো ঝামেলায় পরেছে । ওর ভয় লাগতে শুরু করল । ঠিক এমন সময় অনেক জোরে
বুম!!!!!!!!!!!!!!!!!!
চারপাশ ধোঁয়ায় ভরে গেল । কিছু দেখতে না পেয়ে সৈন্যরা সব চেঁচামেচি করল কিছুক্ষন ।
তারপর ধোঁয়া কমে যেতেই তারা জারটিনপোলকে দেখতে পেল । আর অস্ত্র বাগিয়ে তার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করল ।
হুস!!!!!!!
আগুনের হলকা বের হল জারটিনপোলের নাক দিয়ে । এক সৈন্যের ঢাল মোমের মত গলে গেল ।
সৈন্যরা ওর দিকে এগিয়ে যেতেই থাকল, ওর নিঃশ্বাসের সাথে আগুন বের হতেই থাকল ।
ও প্রাণপণ চেষ্টা করছিল যাতে নিঃশ্বাসের আগুন কারো গায়ে না লাগে । এই নাটক বেশ কিছুক্ষন চলল । হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলে উঠল ।
থামো !!!
সৈন্যরা রাজার গলা চিনতে পারল । ঘুরে তারা দেখল রাজা মারসার, রানি মেলিন্ডা আর রাজকুমারী মেরিগোল্ড দাঁড়িয়ে ।
“ভাগ্য ভালো সময় মত পৌঁছেছি । ” রাজা বলতে শুরু করলেন , “জাটিন! উহু......জারটেড! উহু...... জা...জা...জা...”
“জারটিনপোল । ” মেরিগোল্ড বাবার কানে কানে বলে দিল ।
“হ্যা, জারটিনপোল । এই মাত্র আমার মেয়ে মেরিগোল্ড আমায় সব বলেছে ।
আমরা ভেবেছিলাম জারটিনপোল বিপজ্জনক । কিন্তু যখন জানলাম সে কিভাবে মেরিগোল্ডকে বনের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছে তখন বুঝতে পারলাম, আমরা সবাই একটা বড় ভুল করতে চলেছি । তাই দেরী না করে চলে আসলাম । সৈন্যরা তোমরা ওকে ছেড়ে দাও, ব্যারাকে ফিরে যাও । জারটিনপোল মোটেও বিপজ্জনক নয় ।
”
সৈন্যরা সাথে সাথে আদেশ মেনে নিল । ওরা জারটিনপোলের ভয় কমে যেতেই ওর নাক দিয়ে আগুন বের হওয়া বন্ধ হয়ে গেল ।
রানি মেলিন্ডা খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে বললেন, “আমরা সত্যিই অনেক দুঃখিত, জারটিনপোল । আমাদের প্রথমেই মেরির কথা শোনা উচিত ছিল । ”
মেরিগোল্ড কাছে গিয়ে জারটিনপোলকে জড়িয়ে ধরল ।
খুশিতে জারটিনপোলের সবুজ চোখে পানি চলে আসলো ।
“এক কাজ কর জারটিনপোল, আমাদের সাথে চল । আমাদের সেনাবাহিনীতে যোগ দাও আর প্রাসাদের রাজকীয় প্রহরী জয়ে আমাদের সাথেই থেকো এখন থেকে । ” রাজা বললেন ।
“রাজা মারসার,আপনি সত্যিই মহান ।
কিন্তু আমি আপনার এই কথা রাখতে পারব না । এই জঙ্গলই আমার ঘর বাড়ি । এখানেই থাকতে চাই । এখানে থেকে যত শান্তি পাই আর কোথাও থেকে ততটা শান্তি পাব না । ” জারটিনপোল বিনয়ের সাথে উত্তর দিল ।
“তাহলে কি তোমার সাথে আর দেখা হবে না?” মেরিগোল্ডের গলায় খানিকটা অনুযোগ ।
জারটিনপোল আদুরে চোখে মেরিগোল্ডের দিকে তাকাল, বলল, “মন খারাপ করছ কেন? আমি তো সব সময় এখানেই থাকব । আমাকে সব সময় এখানেই পাবে । তোমার যখন ইচ্ছা হয় চলে আসবে । ”
অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল ।
মেরিগোল্ডরা জারটিনপোলের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে প্রাসাদের দিকে ফিরতে শুরু করল ।
জারটিনপোল তো তখন মহাখুশি । সে আনন্দে কয়েকটা লাফ দিল । তারপর আকাশে উড়তে শুরু করল । উড়তে উড়তে একসময় মেঘের ভেতরে ঢুকে গেল ।
A Dragon In The Forest
By- Paula E. Kirman
Translated by - Mith Da ……
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।