আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জল্পনা-কল্পনায় তৃতীয় নয়ন

জল্পনা-কল্পনায় তৃতীয় নয়ন_[০1] কালকে অনেক মজা হবে। কারণ, আগামীকাল আমরা সবাই মিলে কক্সবাজার বেড়াতে যাচ্ছি। আমরা মানে, আমাদের ক্লাবের সবাই। গত বছর ডিসেম্বরে বাবা, মা, আর ভাইয়ার সাথে গিয়েছিলাম। যাওয়ার পর মনটাই খারাপ হয়ে গেল।

কক্সবাজার শহর মানুষে গিজগিজ করছে। মনে হয়েছিল—এর চেয়ে গাউসিয়া মার্কটে গেলে ভাল করতাম। এবার সেইরকম হওয়ার কথা না। এখন অফ-সিজন চলছে। মানুষ-জন তেমন নাকি যায় না।

আবাহাওয়া কেমন থাকবে আগে থেকে বলা মুসকিল। তাতে কি? পরিচিত বন্ধু-বান্ধব সবাই মিলে একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার চেয়ে মজার কিছু আছে নাকি পৃথীবিতে? সবচেয়ে বড় কথা হলো সঙ্গে বাবা-মা থাকবে না। পাঁচ মিনিট পর পর এটা করা যাবে না, ওটা খাওয়া যাবে না—এসব বিজ্ঞ-বাণী-চিরন্তনি টাইপ কথা বলার কেউ থাকবে না। সঙ্গে মুরুব্বি বলতে থাকবে আমাদের দুই-তিন জন ফ্যাকাল্টি। ওনাদের ম্যানেজ করা কোন ব্যাপার না।

মাঝে মাঝে ওনাদেরকেই দেখে-শুনে রাখতে ক্লাবের ছেলে-মেয়েদের বেশি কষ্ট করতে হয়। গতবার কুয়াকাটা গিয়ে নাকি আজহার স্যার পানি থেকে আর উঠতে চায় না। এদিকে রাত এগারোটা বেজে গেছে, বেশি রাতে জায়গাটা নাকি খারাপ। মাস্তান-ফাস্তান ছাড়াও ভূত-প্রেতের আসরও নাকি আছে ওইখানে। শেষ পর্যন্ত মাসুদ আর ইরফান ভাই মিলে স্যারকে পানি থেকে অনেক কষ্টে টেনে তুলেছে।

এবারো আজহার স্যার যাবে। দুই-একটা পাগলামি এবারো নিশ্চই করবে গিয়ে। সেটাও ওনেক মজার ঘটনা হওয়ার কথা। জীবনে মজার ঘটনার দরকার আছে, এগুলো বারবার ঘটে না। ঘটার পর এসব ঘটনার গল্প করতে ভালো লাগে।

যা ঘটেছে, সেটাকে বাড়িয়ে বলার ব্যাপারে মাসুদ ওস্তাদ। আজহার স্যারকে পানি থেকে তোলার ঘটনার চার-পাঁচটা ভার্সন ও ইতিমধ্যে তৈরি করে ফেলেছে। অবস্থা বুঝে এক-একটা একেক জায়গায় শুনায়। এর মধ্যে দুটোয় নাকি আশ্লীল কিছু ব্যাপার আছে। আমি একটা শুনেছি, আরেকটা শোনা এখনো বাকি।

মাসুদকে অনেকবার করে বলেছি, বজ্জাতটা বলতে চাচ্ছে না। তবে যেটা শুনেছি, সেটা শোনার পর আমার মাথা ঝিমঝিম করছিল। জানা কথা, এখানে বানানো কথাই বেশি। তারপরও, একটা মানুষ এত খারাপ কথা কিভাবে চিন্তা করতে পারে এটাই অবাক হয়ে ভাবি। মৌ-কে নিশ্চই মাসুদ এই ধরণের গল্প অনেক শুনিয়েছে।

ওর কি অবস্থা কে জানে। অবশ্য আমার ধারণা মৌ-এর এসব গল্প শুনতে ভালোই লাগে। তা নাহলে এতদিন ওর গার্লফ্রন্ড হয়ে থাকতে পারতো না। আমার ব্যাগ মোটামুটি গুছানো শেষ। পাহাড়ে ট্রাকিং করার প্লান আছে আমাদের।

কাজেই কেডস নিয়ে যেতে বলা হয়েছে সবাইকে। আমারগুলো ঠিকঠাক থাকার কথা। আজকে সকালে বাক্স খুলে দেখি বাম পায়ের জুতার ফিতা ছেড়া। জুতার যে ফিতা ছিড়তে পারে, এটাই জীবনে প্রথম দেখছি। এটা নিশ্চই ইরার কাজ।

ইরা হলো আমার ছোট বোন। শারীরিক যত রকম খেলাধুলা আমাদের দেশে মেয়েদের পক্ষে করা সম্ভব তার কোনটাই ওর বোধহয় বাকি নেই। ফুটবল থেকে শুরু করে নিয়ে কুতকুত পর্যন্ত সবকিছু খেলে। এখন জুতার কথা জিজ্ঞাস করলে আকাশ থেকে এই মাত্র মাটিতে ল্যান্ড করলো এমন ভাব নিয়ে বলবে “তোমার জুতা ছিড়লো কিভাবে সেটা আমি কিভাবে বলবো?” এই উত্তর শোনা মাত্র আমার মাথায় রক্ত উঠে যাবে, তাই কিছু বলছি না। এখন মন-মেজাজ খারাপ করতে ইচ্ছা করছে না।

জীবনে যেহেতু আনন্দের মুহূর্ত খুব বেশি নেই, অল্প-সল্প আনন্দের সময়গুলো মন খারাপ করে নষ্ট করা ঠিক হবে না। বেড়ানো শেষ করে আসি, এর পর এটা নিয়ে রাগারাগি করা যাবে। কিন্তু জুতার ফিতা এখন কোথায় পাই? জুতার দোকানে আমি জীবনে ফিতা বিক্রি করতে দেখি নি। ফার্মগেটের ফুটপাথে একবার দেখেছিলাম জুতাওয়ালার কাছে, কিন্তু এখন ফার্মগেটেই বা কে যাবে? এদিকে রাহিল গতকাল বিশাল এক লিস্ট ইমেইল করে পাঠিয়েছে। এই লিস্টের সমস্ত জিনিস একদিনের মধ্যে ওর জন্য জোগাড় করতে হবে।

সেই লিস্ট দেখে যে কারো মনে হতে পারে আমরা এভারেস্টের চুড়ায় উঠতে যাচ্ছি। আমাকে সবচেয়ে অবাক করেছে যে আইটেমগুলো সেগুলোর মধ্য অন্যতম হলো উলেন বডি-ওয়ার্মার আন্ডার গার্মেন্টস। একটা ছেলে কিভাবে একটা মেয়েকে এই জিনিস জোগাড় করার কথা বলতে পারে, এটা জিজ্ঞাস করার জন্য ওকে সঙ্গেসঙ্গে ফোন করেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম আমাকে রাগানোর জন্য এসব মেইল পাঠাচ্ছে। কথা বলে মনে হলো ও আসলেই সিরিয়াস।

ওর বক্তব্য হলো “ধর, ওখানে হঠাৎ ঠান্ডা পরে গেল। তখন এসব তো লাগতেই পারে। ” আমাদের দেশে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতেও ঠান্ডার জন্য এসব কিনতে হয় না। যে ছেলে জুন মাসে ঠান্ডার ভয়ে এসব নিতে চায়, তার সাথে আর কি তর্ক করবো? এমন পাগল-ছাগলও আমাদের আসেপাশে আছে। কত বিচিত্র মানুষ থাকতে পারে এই পৃথীবিতে! শেষ পর্যন্ত জুতার ফিতা কেনার ব্যাবস্থা হয়েছে।

মাসুদ কোত্থেকে যেন জোগাড় করেছ দিয়েছে। অবশ্য এমনিতে জোগাড় করে দেয় নি। এমনি এমনি কাজ করার ছেলে ও না। কথা দিতে হয়েছে এই সেমিস্টারের দুইটা অ্যাসাইনমেন্ট-এর ওর সব কাজ আমাকে করে দিতে হবে। সময় আসলে ওকেও একটা বাঁশ দেয়া হবে।

এখন যেহেতু আমার ঠ্যাকা, কাজেই চুপ করে আছি। কারো জন্য কাজ করে দিতে আমার খারাপ লাগে না, কিন্তু বিপদে পড়লে কিছু আদায় করে নেয়ার ব্যাপারটা আমার মেনে নিতে খারাপ লাগে। জল্পনা-কল্পনায় তৃতীয় নয়ন_[০২] আমার বাবার সবকিছুতেই বেশি বেশি টেনশন। ইলেক্ট্রিসিটি নেই, এক ঘন্টা হয়ত পার হয়ে গেছে, কারেন্ট আসছে না, এদিকে বাবার টেনশনের শেষ নেই। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে ফোন করে চেঁচামেচি শুরু করে দেয়।

–আমার বাবা হচ্ছে এই রকম মানুষ। বন্ধু-বান্ধব-এর সাথে কক্সবাজার বেড়াতে যাচ্ছি, এই অবস্থায় তার টেনশন যে সপ্তম আকাশ ছুঁইছুঁই করছে সেটা তো জানা কথা। মেঝ মামার কল্যাণে বাবাকে রাজি করানো গেছে, তা নাহলে এবার যাওয়াই হতো না। মেঝ মামা হচ্ছে আমাদের পরিবারের সকল মুসকিল আসান-টাইপ মানুষ। বাবা-মা দুই জনই ওনার কথার উপর কিছু বলে না।

কাজেই পারিবারিক কোন সিদ্ধান্ত নিজের পক্ষে আনতে উনিই ভরসা। শুধু পারিবারিক সমস্যা সমাধান নয়, আমাদের ভাই-বোনদের কোন আবদার ওনার কাছে ঠিকমতো পেশ করতে পারলে কেল্লা ফতে। সঠিক সময় জিনিস পৌছে যাবে। ভাইয়ার ল্যাপটপ কম্পিউটার, ইরার প্লে-স্টেশন সবই মামার দেয়া। বরং আমি মামার কাছ থেকে তেমন কিছু আদায় করতে পারিনি এখন পর্যন্ত।

কারো কাছে কিছু চাইতে আমার কেন যেন ভালো লাগে না। বাসা থেকে বের হয়েছি দশ মিনিটও হয়নি, এর মধ্যেই বাবার ফোন এসেছে দুই বার। এখনো কেন বাস-টার্মিনালে পৌছাইনি এটা নিয়ে এর মধ্যেই টেনশন শুরু হয়ে গেছে। বাসা থেকে বের হওয়ার পর থেকে আবার ফেরত আসা পর্যন্ত কি কি করতে পারবো না, সেটার সমস্ত ডিটেইল আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। তারপরও প্রত্তেকবার ফোন করার পর একবার করে শুনতে হচ্ছে।

গত বছর বাবার হার্টে একটা ব্লক ধরা পড়েছে, এই জন্য এই অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছি। তা নাহলে এতক্ষণে মোবাইল ফোন বন্ধ করে ফেলতাম। কতক্ষণ সহ্য করতে পারবো সেটাই বুঝতে পারছি না। বেড়াতে বের হয়েছি, কাজেই মন-মেজাজ খারাপ করার কোন মানে হয় না, বরং আশেপাশের মানুষজন দেখে সময় কাটাতে চেষ্টা করি। বিজয়-স্মরনীতে বিরাট জ্যাম লেগে আছে।

আমি গাড়িতে বসে চারপাশে গাড়ি, বাস, সিএনজি আর দুই-একটা মটরসাইকেল ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের গাড়ির বাম পাশের মটরসাইকেল চালক ফুটপাথের উপর দিয়ে একটান দিয়ে বের হয়ে গেলো। তাকে দেখে দেখে পিছনের মটরসাইকেলও গেল। কিছুদিন আগে আইন হয়েছে—ফুটপাথের উপর দিয়ে মটরসাইকেল চালালে জরিমানা হবে। এরা সেই আইনকে পাত্তা দিচ্ছে না।

বিজয়-স্মরনীর দুই মাথায় ট্রাফিক পুলিশ আছে। ওনারাও বোধহয় এসব ছোটখাটো জরিমানা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। এখন রাত নয়টা বেজে গেছে। বড় বড় ট্রাক ধরতে পারলে আয়-রোজগার ভাল হয়। ওনারা সেই ধান্দায় আছেন।

পাশের এক সিএনজি-তে এক বাচ্চা সমস্ত শক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদছে। বাচ্চাটার কি দোষ, আমার নিজেরইতো এভাবে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। জ্যামের মধ্যে বসে থাকেতে কার ভালো লাগে? আমি দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু এতক্ষণ পিছনে কোথায় যেন একটা অ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজাচ্ছিল। এখন বন্ধ হয়ে গেছে। অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার বুঝে গেছে—সাইরেনে কাজ হবে না।

ঢাকা শহরের মানুষ অ্যাম্বুলেন্সকে পাত্তা দেয় না। এর মধ্যে পাশের ফুটপাথ দিয়ে আরো তিনটা মটরসাইকেল পার হয়ে গেলো। এখন মনে হচ্ছে ঢাকার রাস্তায় মটরসাইকেলওয়ালারাই ভাল আছে। এক রিক্সাওয়ালাকেও দেখা যাচ্ছে ফুটপাথ দিয়ে রিক্সা চালিয়ে যাচ্ছে। বিজয়স্মরণীতে রিক্সা চলা নিষধ।

রিক্সাওয়ালা ভাই রিক্সা নিয়ে কোথায় যাচ্ছে দেখতে পারলে ভালো হতো। সেটা সম্ভব না। আমি গাড়ির হাতে বন্দি হয়ে বসে আছি। যন্ত্রের কাছে মানুষের পরাজয়। এতক্ষণ পপকর্ন বিক্রেতাদের দেখা যায় নি।

এখন একদল পিচ্চি পপকর্নের প্যাকেট নিয়ে ছুটাছুটি করছে। এই জিনিস এখন খেতে ইচ্ছে করছে না, তারপরও দুই প্যাকেট নিয়ে নিলাম। বাস হাইওয়েতে উঠলে হয়ত খেতে ইচ্ছা করবে। শেষ পর্যন্ত খেতে ইচ্ছা না করলেও সমস্যা নেই। ক্লাবের এতগুলো ছেলে-মেয়ে যাচ্ছে, কেউ না কেউ ঠিকই খেয়ে ফেলবে।

পাশের সিএনজি-র পিচ্চিটা এখন চুপ হয়ে গেছে। অ্যাম্বুলেন্সের মতো পিচ্চিটাও বুঝে গেছে চেঁচেমেচি করে লাভ হবে না। ইমার্জেন্সি রুগিই যেখানে ভাত পায় না, বাচ্চার কান্না সেখানে কোন ছার? আমি পপকর্নওয়ালা পিচ্চিটাকে ভাংতি দিতে পারছি না। আমার ব্যাগে সবগুলো একশ টাকার নোট। একটা পাঁচ টাকার নোট অবশ্য আছে, কিন্তু আমার দরকার বিশ টাকা।

আপা আমার কাসে পঞ্চাশ টাকার নোট আসে। আরো তিনটা নিয়া যান। জ্যাম ছুটতে দেরি আসে। এই জ্যামে বইসাই পাঁচটা খাইয়া ফেলতে পারবেন। আর না খাইলে বাসায় নিয়া গিয়া খাইয়েন।

আমার এখন উপায় নেই। ভাংতি যখন নেই, হয় পাঁচটাই নেয়া লাগবে, নইলে একটাও না। না কিনলে খুব একটা ক্ষতি হবেনা। কিন্তু পিচ্চিটা অনেক্ষণ ধরে এক গাড়ি থেকে আরেক গাড়িতে ছুটাছুটি করেছে, একটাও বিক্রি করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত পাঁচটাই নিয়ে নিলাম।

এখন পিচ্চিটার মুখে রাজ্য জয়ের হাসি। একসঙ্গে পাঁচটা প্যাকেট বিক্রি করতে পারা বিরাট সাফল্যের ব্যাপার। পিচ্চিটার আনন্দ দেখতে ভালো লাগছে। আমার বড় খালুর চারটা গার্মেন্টস আছে। বিরাট বড়লোক।

মাসে কোটি কোটি টাকার ব্যাবসা করে। অথচ কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, “কি ব্যাপার, ব্যাবসা কেমন যাচ্ছে?”, ওনার উত্তর হলো “আর বলবেন না, ব্যাবসাপাতির অবস্থা খুবই খারাপ। মাঝে মাঝে মনে হয় বনে চলে যাই। বনে গিয়ে টারজানের মতো গাছের উপর বাস করি। ” ওনার মুখ দেখে যে কারো মনে হবে টারজানের জীবন-যাপন না করতে পারায় উনি খুবই দুঃখিত।

সেই তুলনায় এই পিচ্চিটার পঞ্চাশ টাকার ব্যাবসায়িক আনন্দ অনেক বেশি। বেশি বললে কম বলা হয়, বলা উচিত সিমাহীন। জ্যাম ছুটে গেছে। সমস্ত যানবাহন একসঙ্গে হর্ন বাজানো শুরু করেছে। ভাবটা এমন, যেন হর্ন বাজালেই সামনের সব গাড়ি সরে গিয়ে রাস্তা খালি করে দিবে।

আসলে দিবে না। আমরা ঢাকা শহরের মানুষরা এত বোকা না। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।