আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেখ ফয়জুল্লাহ: মধ্যযুগের বাংলার এক অসাম্প্রদায়িক মুসলিম কবি

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ একুশ শতকে পৌঁছে যখন আমরা নিজস্ব ধর্ম পালনের পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক থাকাটাও জরুরি বলে ভাবছি, তখন ষোড়শ শতকের বাংলার অসাম্প্রদায়িক মুসলিম কবি শেখ ফয়জুল্লাহর চিন্তাধারা সম্বন্ধে আমাদের জানা জরুরি । শেখ ফয়জুল্লাহর কাব্যে প্রতিফলিত হয়েছে মুসলিম জীবনের বিশ্বাস ও ঐতিহ্য । তা সত্ত্বেও তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী ছিলেন।

এই বিষয়টি আমাদের বিস্মিত করে বৈ কী। শেখ ফয়জুল্লাহ ছিলেন ষোড়শ শতকের মানুষ। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং ডক্টর আহমদ শরীফ তাঁর জীবনকাল ১৫৭৫-৭৬ খ্রিস্টাব্দ বলে নির্ধারণ করেছেন। অর্থাৎ যে সময়টায় বাংলায় কররানী বংশের (১৫৫৯ থেকে ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দ ) শাসনের অবসান ঘটছে। যে কররানী বংশের শাসক ছিলেন সোলায়মান এবং দাউদ কররানী।

১৫৭৫ খ্রীস্টাব্দে বাংলায় আরম্ভ হয় মুঘল আমল । এমনই একটা সময়ে শেখ ফয়জুল্লাহ বেঁচে ছিলেন। শেখ ফয়জুল্লারর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের পাচনা গ্রামে। এই মতটি ডক্টর সুকুমার সেন- এর। অবশ্য আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে এক জায়গায় শেখ ফয়জুল্লাহ লিখেছেন: ‘বলে ফয়জুল্লাহ কবি পাচনায় বসতি।

’ শেখ ফয়জুল্লাহর সব মিলিয়ে পাঁচটি কাব্যের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। গাজীবিজয়, সত্যপীর, জয়নাবের চৌতিশা, রাগনামা এবং গোরক্ষবিজয়। রংপুরের খোঁট দুয়ায়ের পীর ইসমাইল গাজীর জীবন গাজীবিজয় কাব্যের মূলবিষয় । এ প্রসঙ্গে শেখ ফয়জুল্লাহ লিখেছেন: খোঁটদুয়ারের পীর ইসমাইল গাজী গাজীর বিজএ সেহ মোক হইল রাজি। সত্যপীরের আধ্যাত্মিক সাধনা অবলম্বনে গড়ে উঠেছে সত্যপীর কাব্যটি ।

সত্যপীরের মা নাকি হুসেন শাহের বাঁদীর গর্ভে জন্মে ছিলেন- এরকম এক জনশ্রুতি ছিল তৎকালে। বেদনাবোধের কারণেই হয়তো সত্যপীর আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন হন। ‘জয়নাবের চৌতিশা’-র বিষয় মহরম- এর মর্মান্তিক ঘটনা। ‘রাগনামা’ সম্পর্কে আমি কোনও তথ্য পাইনি। তবে দেখা যাচ্ছে, শেখ ফয়জুল্লাহর প্রায় সব কটি কাব্যের বিষয়ই পীরদরবেশ এবং কারবালার মতন মুসলিম ঐতিহ্য।

আর একজন মুসলিম হিসেবে সেরকমই তো হওয়ার কথা। তবে শেখ ফয়জুল্লাহর ‘গোরক্ষবিজয়’ কাব্যে সম্বন্ধে এই কথা প্রয়োজ্য নয়। এবং এখানেই আমাদের সমস্ত আগ্রহ নিহিত। কেননা, শেখ ফয়জুল্লাহর লেখা ‘গোরক্ষবিজয়’ কাব্য নাথসাহিত্যের অর্ন্তভূক্ত। অথচ নাথসাহিত্য লিখেছিলেন শিবপন্থি নাথযোগীরা।

যে নাথযোগীরা মধ্যযুগের বাংলায় দেহকেন্দ্রীক সুবিশাল এক ধর্মীয় আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সেই সঙ্গে নাথধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল নাথসাহিত্য । উল্লেখযোগ্য নাথসাহিত্য হল দশম- একাদশ শতকের ‘গোরক্ষবিজয়’ এবং ‘ময়নামতীর গান’। নাথধর্মের উত্থান হয়েছিল বাংলায়। কারণ, এই ধর্মমতের প্রবর্তক মীননাথ ছিলেন বাঙালি।

‘কৌলজ্ঞান’ নামে প্রাচীন এক গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে মীননাথ চন্দ্রদ্বীপ- এর অধিবাসী ছিলেন। চন্দ্রদ্বীপ বরিশাল- এর প্রাচীন নাম। তার মানে বাংলার অন্যতম এক লোকগুরুর জন্ম- বরিশাল। যে কারণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন,‘বাঙালির ইহা একটি গৌরবময় বিষয় যে একজন বাঙালি গোটা ভারতবর্ষকে একটি ধর্মমত দিয়াছিলেন। ’ নাথধর্মটি ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং ভারতবর্ষের মানুষ নাথধর্ম গ্রহন করেছিল।

নাথধর্মের ব্যাপ্তি সপ্তম থেকে একাদশ দ্বাদশ শতক। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মনে করেন যে মীননাথ- এর সময়কাল খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক। নীহাররঞ্জন অবশ্য ১০ম থেকে ১২ শতক বলে মত দিয়েছেন । (দেখুন: বাঙালির ইতিহাস। পৃষ্ঠা।

৫৩১) ফরাসি পন্ডিত সিলভাঁ লেভী অবশ্য লিখেছেন: মীননাথ ৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে যান। এই মতটি দ্বারা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বক্তব্যই প্রতিষ্ঠিত হয়। মীননাথ অবশ্য মৎস্যেন্দ্রনাথ, মচ্ছিন্দ্রনাথ নামেও পরিচিত ছিলেন। মীননাথ বলতেন, ‘মানুষের দুঃখ শোকের কারণ অপক্ক দেহ। যোগরূপ অগ্নিদ্বারা এই দেহকে পক্ক করে সিদ্ধদেহ বা দিব্যদেহের অধিকারী হয়ে সিদ্ধি বা শিবত্ব বা অমরত্ম লাভ করা যায়।

’ মীননাথ এর শিষদেরই বলা হয় নাথযোগী। কেবল ধর্ম নয়, বাংলা সাহিত্যেও মীননাথ এর অবদান ছিল গভীর। ঐতিহাসিকদের মতে, মীননাথ বাংলা ভাষার আদিকবিদের অন্যতম । তিনি ‘বাহ্যান্তর-বোধিচিত্ত বঙ্গোপদেশ ’ শিরোনামে একটি বই লিখেছিলেন। তাঁর ভাষাই বাংলা ভাষার প্রথম নিদর্শন।

নাথসাহিত্যের সঙ্গে চর্যাপদের সর্ম্পকও গভীর। এ প্রসঙ্গে শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায় তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা’ বইতে লিখেছেন: ‘ নাথসাহিত্য ও চর্যাপদ এই উভয় ধারাতেই সিদ্ধদিগের কয়েকটি সাধারণ নাম পাওয়া যায়। এই ঘটনা দ্বারা দু’য়ের মধ্যে যে সর্ম্পক ছিল তা প্রমানিত হয়। ’ অর্থাৎ নাথধর্ম ও চর্যাপদ এর মধ্যে সর্ম্পক গভীর । চর্যাচর্য্যবিনিশ্চয়ের টীকায় মীননাথের নামে একটি কবিতা উল্লেখ রয়েছে- কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।

কর্ম্ম কুরঙ্গ সমাধিক পাঠ। কমল বিকসিল কহিহ ণ জমরা। কমল মধু পিবিবি ধোকে ন ভোমরা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর বাংলা অনুবাদ করেছেন- কহেন গুরু পরমার্থের বাট। কর্মের রঙ্গ সমাধির পাট।

কমল বিকশিত, কহিও না জোংড়াকে (শামুককে) কমল মধু পান করিতে ক্লান্ত হয় না ভোমরা। গুরুর নির্দেশে সহজিয়া বৌদ্ধ সাধক পরমার্থ লাভ করেন। এই পদে পরমার্থকে কমলমধু বলা হয়েছে। যে কমল মধু গুরু শিক্ষা দেন। নাথধর্ম বাংলার তান্ত্রিক বৌদ্ধদের সহজযানী মতবাদ থেকে উদ্ভূত।

যে দর্শনের মূলকথা হল ‘সৃষ্টির আদি ও অকৃত্রিম উৎপত্তিস্থল একমাত্র শূন্য। এই শূন্য মহাসুখ এবং আনন্দস্বরূপ। এই শূন্য ঘনীভূত হয়ে প্রথমে শব্দরূপে দেখা দেন পরে শব্দ হতে পুনরায় ঘনীভূত হয়ে দেবতা রূপ গ্রহন করেন। ’ নাথদের উপাস্য ছিলেন নিরঞ্জন বা শূন্য। তবে নাথযোগীদের সাধনা ছিল দেহকেন্দ্রীক।

যে কারণে মীননাথ বলতেন, ‘মানুষের দুঃখ শোকের কারণ অপক্ক দেহ। যোগরূপ অগ্নিদ্বারা এই দেহকে পক্ক করে সিদ্ধদেহ বা দিব্যদেহের অধিকারী হয়ে সিদ্ধি বা শিবত্ব বা অমরত্ম লাভ করা যায়। ’ বাংলার বৌদ্ধ সহজযানীরা মনে করতেন :দেহবা বা কায়সাধনই একমাত্র সত্য। রস-রসায়নের সাহায্যে কায়সিদ্ধি লাভ করে জড় দেহকেই সিদ্ধদেহ এবং সিদ্ধদেহকে দিব্যদেহে রুপান্তরিত সম্ভব। কিন্তু শেখ ফয়জুল্লাহর মতো একজন ঐতিহ্য সচেতন মুসলিমের সঙ্গে নাথধর্মের কি সর্ম্পক? এই প্রশ্নটিই যেমন চিত্তাকর্ষক তেমনি তাৎপর্যপূর্ণ।

তখন লিখেছি যে নাথধর্মের ব্যাপ্তি সপ্তম থেকে একাদশ দ্বাদশ শতক। তথ্যটি মনে হয় অভ্রান্ত নয়। কেননা, কবীন্দ্রদাস নামে একজন নাথযোগী সঙ্গে শেখ ফয়জুল্লাহর দেখা হয়েছিল। শেখ ফয়জুল্লাহর সময়কাল ষোড়শ শতক। তার মানে নাথধর্মটি ষোড়শ শতকেও বাংলায় টিকে ছিল।

কেননা, নাথগুরু কবীন্দ্রদাস ওই সময়ের লোক। শেখ ফয়জুল্লাহ নাথযোগী কবীন্দ্রদাস এর কাছে নাথধর্মটি সম্পর্কে জানেন এবং (দশম শতকে রচিত) গোরক্ষনাথ এর কাহিনী শোনেন। তারপরই শেখ ফয়জুল্লাহ নিজের মত করে ‘গোরক্ষবিজয়’ লেখার সিদ্ধান্ত নেন। এই ঘটনাটি একটি আকস্মিক ঘটনার মাধ্যমে জানা গেছে। ‘বঙ্গে সুফি প্রভাব’ বইটির লেখক ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক।

তিনি চব্বিশ পরগনার বারাসতে সরকারি শিক্ষক হিসেবে চাকরি করতেন। সেই সময় তিনি বারাসতের এক বাড়িতে অনেকটা আকস্মিকভাবেই প্রাচীন পুথির কয়েকটি ছেঁড়া পৃষ্ঠা পেয়ে যান। একটি পৃষ্ঠায় লেখা ছিল- গোর্খবিজএ আদ্যে মুনি সিদ্ধা কত। কহিলাম সব কথা শুনিলাম যত। খোঁটদুয়ারের পীর ইসমাইল গাজী গাজীর বিজএ সেহ মোক হইল রাজি।

এবে কহি সত্য পীর অপূর্ব কথন। ধন বাড়ে শুনিলে পাতক খন্ডন। মুনি-রস-বেদ-শশী- শাকে কহি সন শেখ ফয়জুল্লাহ ভণে ভাবি দেখ মন। গোর্খবিজএ আদ্যে মুনি সিদ্ধা কত। /কহিলাম সব কথা শুনিলাম যত।

এই লাইন দুটি পড়ে মনে হয় নাথযোগী কবীন্দ্রদাস এর কাছে গোরক্ষের কাহিনী শুনে শেখ ফয়জুল্লাহ তা নিয়ে লিখতে সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু, কে গোরক্ষনাথ? গোরক্ষনাথ ছিলেন নাথধর্মের প্রবর্তক মীননাথ এর শিষ্য। গবেষকদের মতে, গোরক্ষনাথ ঐতিহাসিক ব্যক্তি। নাথযোগীরা মনে করেন, গোরক্ষনাথ- এর জন্ম পাঞ্জাবে। পরে বিহারের গোরক্ষপুরে তাঁর প্রতিষ্ঠা হয়।

অস্টম শতাব্দী থেকে চতুদর্শ শতাব্দীতে তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল বলে মনে করা হয়। ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেন এর মতে গোরক্ষনাথ এর সময়কাল একাদশ শতাব্দী। তবে গোরক্ষনাথ মীননাথ- এর সরাসরি শিষ্য ছিলেন কিনা এই প্রশ্নটি উঠতে পারে। কেননা, তখন একবার উল্লেখ করেছিলাম যে: ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মনে করেন যে মীননাথ- এর সময়কাল খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় অবশ্য মীননাথ- এর সময়কাল ১০ম থেকে ১২ শতক বলে মত দিয়েছেন ।

ফরাসি পন্ডিত সিলভাঁ লেভী অবশ্য লিখেছেন: মীননাথ ৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্রদেবের রাজত্বকালে নেপালে যান। এই মতটি দ্বারা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বক্তব্যই প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এ তথ্যটি সঠিক হলে গোরক্ষনাথ মীননাথ এর প্রত্যক্ষ শিষ্য ছিলেন না। অবশ্য নীহাররঞ্জন রায়ের বক্তব্য সঠিক হলে গোরক্ষনাথ মীননাথ এর প্রত্যক্ষ শিষ্য ছিলেন। কিন্তু নাথযোগী কবীন্দ্রদাস শেখ ফয়জুল্লাহ কে গোরক্ষনাথ সম্বন্ধে কি কাহিনী বলেছিলেন? বলেছিলেন, গোরক্ষনাথের গুরু ছিলেন মীননাথ।

মীননাথ ছিলেন প্রাজ্ঞ যোগী এবং মহাজ্ঞানের অধিকারী । মীননাথ নাথধর্ম প্রচারের জন্য একদা কদলীনগরে যান। সে নগরে পৌঁছে নারীদের দেখে মীননাথ -এর কামভাব জাগ্রত হয়। এবং তিনি ধর্মচূত হন। শেখ ফয়জুল্লাহ তাঁর ‘গোরক্ষবিজয়’ কাব্যে মীননাথ এর অবস্থা এভাবে তুলে ধরেছেন: কহিলেন মীননাথ মনে মায়া ধরি।

জগতেও পাই যদি এমন সুন্দরী। বিচিত্র শয্যাতে থাকি হেন নারী লই। রঙ্গ কৌতুকরসে রজনী পোয়াই। নাথযোগী কবীন্দ্রদাস শেখ ফয়জুল্লাহ কে আরও বললেন, আত্মবিস্মৃত মীননাথ- এর অধপতিত অবস্থা শিষ্য গোরক্ষনাথ জানতে পারলেন। গুরুর এহেন চরম নৈতিক অধঃপতনের সংবাদে গোরক্ষনাথ ভীষণ অস্থির হয়ে উঠলেন।

কেননা, শিবপন্থী নাথযোগীদের বিশ্বাস ছিল: কামচর্চা জীবন ধ্বংসের উৎস। জীবন উৎপাদী শুক্র বা বিন্দুকে ধারণ করার শক্তিই হচ্ছে অমরত্ব লাভের উপায়। গোরক্ষনাথ গুরুকে উদ্ধার করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই উদ্দেশ্যে গোরক্ষনাথ নর্তকীর ছদ্মবেশ ধারণ করে কদলীনগরে যান। তারপর গুরুর মধুকুঞ্জে প্রবেশ করে ইন্দ্রিয়পরায়ণ গুরু মীননাথের সামনে মৃদঙ্গের বোল বাজাতে থাকেন।

মৃদঙ্গের জলদ গম্ভীর আওয়াজে মীননাথের পূর্বস্মৃতি জেগে ওঠে। তিনি হীন ইন্দ্রিয়জ তৃপ্তির জগৎ থেকে আত্মসাধনার জগতে ফিরে আসেন । এভাবে শিষ্য গোরক্ষনাথের বিজয় হয়। নাথযোগী কবীন্দ্রদাস এর কাছে শোনা এই আখ্যানটি মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও গভীরভাবে শেখ ফয়জুল্লাহর হৃদয় র্স্পশ করেছিল। তিনি এ নিয়ে লেখার সিন্ধান্ত নিলেন।

তবে মুসলিম পরিমন্ডলে বাস করার কারণে সে সিদ্ধান্তটি সহজ ছিল না। কেননা নাথপন্থিগণ ছিলেন শিবানুসারী, তার মানে দেবতা শিব- এর পূজারী। শিব অনার্য দেবতা। শিবভক্তরা শিবকে অনেক নামে ডাকে। তার মধ্যে একটি হল আদিনাথ।

(এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের মহেশখালিতে অবস্থিত আদিনাথ মন্দিরের কথা উল্লেখ করা যায়। ) ড. দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন, ‘ নাথধর্ম বৌদ্ধ ও শৈবধর্মের শ্রেষ্ঠ উপকরণে গঠিত। (বঙ্গ ভাষা ও সাহিত্য। প্রথম খন্ড) দশম শতকের নাথসাহিত্যের ‘গোরক্ষ বিজয়’ কাব্যে শিব- এর বর্ননা এরকম - মুন্ডে আর হাড়ে তুমি কেনে পৈর মালা ঝলমল করে গায়ে ভস্ম ঝুলি ছালা। পুনরপি যোগী হৈব কর্ণে কড়ি দিয়া।

এ হল শিব এর বর্ণনা। যে শিব নাথপন্থিদের উপাস্য। ৮ম ও ৯ম শতকের দিকে বৌদ্ধধর্ম তন্ত্র ও যোগদর্শনের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়। উল্লেখ্য, বাংলায় যোগ সাধনা দ্রাবিড় জাতির অবদান। দ্রাবিড়মনন ছিল রহস্যবাদী।

যোগমার্গ ছিল তাদের সাধনমার্গ। নাথধর্মকে বলা হয়েছে The Nath tradition is a heterodox siddha tradition containing many sub-sects. এই ‘সিদ্ধা’ শব্দটি তামিল ভাষার একটি শব্দ। পাঠ করুন:A Siddham in Tamil means "one who is accomplished" and refers to perfected masters who, according to Hindu belief, have transcended the ahamkara (ego or I-maker) দ্রাবিড় শব্দ দিয়ে দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কার তামিল ভাষা ও জাতিকে বোঝানো হয়। সে যাই হোক। বাংলায় শৈবপন্থিদের ( তার মানে শিবভক্তদের) ওপর তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের প্রভাবেই নাথধর্মের উত্থান ঘটেছিল।

তখন একবার বলেছি- নাথধর্মটিকে ভারতবর্ষের মানুষ গ্রহন করেছিল। কি এর কারণ? ভারতবর্ষজুড়ে নাথধর্মের জনপ্রিয়তার কারণও শিব। কেননা শিব আর্যদের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে একটি বিরাট লোকশক্তি। যোগ দর্শন প্রসঙ্গে ড. আহমদ শরীফ লিখেছেন: ‘যোগ আদিম অস্ট্রিক (নিষাদ)- কিরাত মনন -উদ্ভূত। ’ (বাঙলা বাঙালি ও বাঙালীত্ব: ; পৃষ্ঠা,৪১) তবে পরবর্তী পর্যায়ে যোগ দর্শনটি আরও পরিশ্রুত হয়েছে।

যোগের মূলে অনার্য দেবতা শিব। যোগের উদ্দেশ্য কায়ার মাধ্যমের সিদ্ধিলাভ বা শিবত্ব লাভ। শেখ ফয়জুল্লাহ তার সময়ে ‘নাথযোগীদের দেখেছেন। মাথায় থাকত জটা। সর্বাঙ্গে ছাইভস্ম, কানে কড়ি ও কুন্ডল, গলায় সুতা, বাহুতে রুদ্রাক্ষ, হাতে ত্রিশূল, পায়ে নূপুর, কাঁধে ঝুলি ও কাথাঁ।

এদের কুলবৃক্ষ ছিল বকুল; প্রধান আহার্য কচুশাক। ’ (আনোয়ারুল করিম। বাংলাপিডিয়া। ) হয়তো নাথযোগী কবীন্দ্রদাস এমনই দেখতে ছিলেন। সে যাই হোক।

শেখ ফয়জুল্লাহ সম্ভবত নাথযোগী কবীন্দ্রদাস এর কাছেই নাথধর্মটি সম্বন্ধে বিস্তারিত জেনেছেন। জেনেছেন- নাথধর্মটি গুরুপন্থি। নাথযোগীরা গুরুর কাছে তিন দিন দীক্ষা নিতেন। প্রথম দিন গুরু শিষ্যের চুল কেটে দিতেন। পরের দিন তার কানে কুন্ডুল পরিয়ে দিতেন।

তৃতীয় দিনের দীক্ষা ছিল উপদেশী। তখন নানা পূজা-অর্চনা হত। সে সময় সারারাত দীপ জ্বলত ও নানা অনুষ্ঠান হত। এর নাম ‘জ্যো¯œা-জাগান। ’ বিয়ের ক্ষেত্রে নাথপন্থিরা সনাতন হিন্দু ধর্মালম্বীদের অনুসরণ করে।

নাথসমাজে বাল্যবিহাব ছিল তবে বিধবাবিবাহের প্রচলন ছিল না। নাথধর্মের অনুসারীদের কবর দেওয়া হত। তবে সংকারের ক্ষেত্রে নিয়মকানুন অনেকটা সনাতন ধর্মালম্বীদের মতো। এ ছাড়া শিবপন্থী নাথযোগীদের বিশ্বাস ছিল: কামচর্চা জীবন ধ্বংসের উৎস। জীবন উৎপাদী শুক্র বা বিন্দুকে ধারণ করার শক্তিই হচ্ছে অমরত্ব লাভের উপায়।

নাথযোগীদের এই বিশ্বাস তো শেখ ফয়জুল্লাহর ধর্মীয় বিশ্বাসের বিপরীত। তাই বলছিলাম শেখ ফয়জুল্লাহর পক্ষে মুসলিম পরিবেশে বসবাস করার জন্য ‘গোরক্ষবিজয়’ লেখা সহজ ছিল না। তারপরও তিনি ‘গোরক্ষবিজয়’ লিখেছেন। এবং নাথসাহিত্যের একজন উল্লেখযোগ্য কবি হিসেবে পরিচিত পেয়েছেন। এসব কারণেই এই পোস্টের শুরুতে লিখেছি: একুশ শতকে পৌঁছে যখন আমরা নিজস্ব ধর্ম পালনের পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক থাকাটাও জরুরি বলে ভাবছি, তখন ষোড়শ শতকের বাংলার অসাম্প্রদায়িক মুসলিম কবি শেখ ফয়জুল্লাহর চিন্তাধারা সম্বন্ধে আমাদের জানা জরুরি ।

শেখ ফয়জুল্লাহর কাব্যে প্রতিফলিত হয়েছে মুসলিম-জীবনের বিভিন্ন উপাদান। তা সত্ত্বেও তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী ছিলেন। এই বিষয়টি আমাদের বিস্মিত করে বৈ কী। শেখ ফয়জুল্লাহ আমাদের একটি বড় শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন। তা হল- যেটা জানা ও বোঝার বিষয় সেটি কখনোই কনফ্লিক্ট কিংবা দ্বন্দের বিষয় হতে পারে না।

হিন্দু মুসলমানের ঈমান-আকিদা- দ্বীন বোঝার চেষ্টা করবে; মুসলমান হিন্দুর বেদান্ত দর্শন- শিবতত্ত্ব- কৃষ্ণত্ত্ব বোঝার চেষ্টা করবে; নারী পুরুষকে বোঝার চেষ্টা করবে; পুরুষ নারীকে বোঝার চেষ্টা করবে। অথচ এসব আপাত বিপরীত বিষয়গুলি না-বোঝার ফলেই বিষয়গুলি বর্তমানে কনফ্লিক্টের বিষয় তৈরি হয়ে গেছে। ষোড়শ শতকের বাংলার অসাম্প্রদায়িক মুসলিম কবি শেখ ফয়জুল্লাহ এ ক্ষেত্রে ব্যাতিক্রমী মানুষ ছিলেন। তিনি চিরায়ত কনফ্লিক্ট কে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। তথ্যসূত্র: দীনেশচন্দ্র সেন, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য আজহার ইসলাম: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস।

প্রাচীন ও মধ্যযুগ। গোপাল হালদার, বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৯ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।