আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর

স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি । তবে স্বপ্ন দেখা নিয়ে কিছুদিন যাবত একটা সমস্যা হয়ে গেছে । নতুন দেখা স্বপ্নগুলো কেন যেন পূরণ হচ্ছে না খুব শীঘ্রই এই সমস্যা কেটে যাবে এই আশাতেই আছি । ইউনিভার্সিটি গিয়ে শুনি ক্লাস হবে না । একটাই মাত্র ক্লাস ছিল আজ ।

বাস থেকে উঠা আর নামার সময় ভিজে গেছি অনেকখানি । কারণ সকাল থেকেই হাল্কা বৃষ্টি । নিজের বসার টেবিলটাতে ব্যাগ রেখে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ । সবাই বেশ আনন্দ করতে করতে আশপাশ দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে । একজন মার্কার দিয়ে হোয়াইট বোর্ডে কি যেন লিখে রেখে যাচ্ছে ।

কি করবো ভেবে পেলাম না । এতো সকাল সকাল বাসায় ফিরে যাবার কোন মানে হয় না , আবার এইদিকে একসাথে ঘুরার মতও কেউ নেই । একা একা ঘুরতে কার-ইবা ভালো লাগে ? সব মিলিয়ে মেজাজ এমন খারাপ হল যে বলার মত না । আর হবে নাই বা কেন ? ১ ঘণ্টা ২০ মিনিটের ক্লাসে টিচার আসেন ৩০ মিনিট পর আর যান ১৫ মিনিট আগে । ক্লাস না করে যেহেতু উপায় নেই আসতেই হয় ।

বাসা অনেক দূরে বলে লম্বা একটা সময় বাসে কাটাতে হয় আসা যাওয়ায় । আর এর উপর যেদিন সকাল ৮ টার ক্লাস থাকে সেদিন ঘুম থেকে উঠতে হয় অনেকটা সূর্যের সাথে সাথে , অথচ রাতে আমার ঘুম হয় না । ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে কোন মতে দাঁতে দুই তিনটা ঘষা দিয়ে রাতের জামা গায়েই ঘুমঘুম চোখে বাস ধরার জন্য তাড়াহুড়া করে বের হয়ে পরতে হয় । ক্লাস আছে এমন দিনে শেষ কবে নাস্তা করে বাসা থেকে বের হতে পেরেছি তা অনেক সময় নিয়ে চিন্তা ভাবনা করলে হয়তো মনে পড়তে পারে । ইউনিভার্সিটির বাস মিস করি নিয়মিত , আসতে হয় বাইরের বাসে ।

আজও ঐ সকাল ৮ টার ক্লাসই ছিল । অসম্ভব বিরক্ত লাগার কারণ সেটাই । রুম ফাঁকা হয়ে গেল । অহেতুক বসে থাকার মানে হয় না । ইচ্ছা করছে বোর্ডে মনের মাধুরী মিশিয়ে মাথায় তিন শিং সহ স্যারের একটা ছবি এঁকে হাওয়া হয়ে যাই ।

মনের সব চাওয়া পূরণ করা ঠিক না । বারান্দায় চলে এলাম । বারান্দা না বলে করিডোর বলাই ভালো । ক্লাসের সামনে আসা যাওয়া করার জন্য লম্বা এক ফালি রাস্তা । ঐখানেই আড্ডা চলে আমাদের ।

আসলে বলা উচিত অন্যদের । কারণ আড্ডায় আমি মোটেই চলনসই না । সবাই যখন দল বেঁধে রেলিং-এ হেলান দিয়ে হাত নেড়ে হাসতে হাসতে গল্প করে আমি একটু দূর থেকে দাঁড়িয়ে তাদের আড্ডা দেওয়া দেখি । আগে মাঝে মাঝে আড্ডায় ঢোকার চেষ্টা করতাম । কিন্তু প্রতিবার লক্ষ্য করে দেখেছি আমি যাওয়ার একটু পরই অবধারিত ভাবে কেটে গেছে আড্ডার সুর ।

সবাই এতক্ষণ আগ্রহ নিয়ে যার কথা শুনছিল সে কথা খুঁজে না পেয়ে আমতা আমতা করতে করতে থেমে যাচ্ছে । এতো সুন্দর সময়টাই সবার মাটি । তাই এখন মাঝখানে গিয়ে হাজির হওয়ার অভ্যাস বাদ দিয়েছি । আর দেখতেও ভালই লাগে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে । আড্ডা দেওয়া যে মজার সেটা সবাই জানে , কিন্তু দেখার আনন্দের সাথে খুব বেশি মানুষের পরিচয় আছে বলে মনে হয় না ।

বারান্দার কালচে মেঝেতে বেশ পানি জমে গেছে । অনেক সকাল বলে আশেপাশের রুমগুলোতেও কেউ নেই । পুরো করিডোর ফাঁকা । সকালের টিপটিপ বৃষ্টিটা বেড়ে গেছে অনেকখানি । এখানে চারতলার উপর থেকেও আকাশ পুরোপুরি দেখা যায় না ।

দৃষ্টি আটকে যায় বিল্ডিংয়ের জন্য । গুমোট আকাশকে তখন আরও গুমোট লাগে । তবে একটানা ঝিরঝির শব্দটা শুনতে বেশ ভালো লাগছে । মনে হচ্ছে সময় ধীর হয়ে গেছে অনেক । হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানিতে কিছুক্ষণ ভেজালাম ।

কিছুটা মেয়েলি হলেও আমার খুব পছন্দের একটা কাজ । আশেপাশে অন্যরা থাকলে এটা করার প্রশ্নই আসে না । খ্যাপিয়ে মেরে ফেলবে সবাই মিলে । এখন তো কেউ-ই নেই । শূন্য করিডোরে একা দাড়িয়ে মেঘলা আকাশ দেখতে দেখতে বৃষ্টির পানিতে হাত ভেজানো , পুরো দৃশ্যটার মধ্যে কোথায় যেন একটা মন খারাপ করিয়ে দেওয়ার ব্যাপার আছে ।

মনতো খারাপই থাকে সবসময় , আরও বেশি খারাপ হয়ে গেল । মন খারাপ থাকাটা ইদানীং আমাকে আর ভোগায় না , অভ্যস্ত হয়ে গেছি । নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করি কিছু মানুষ আসলে মনের দিক থেকে একাই , তা সে যেখানেই থাকুক না কেন , পিষ্ট করে ফেলা হাজার মানুষের ভিড়ে কিংবা কোন জনশূন্য নির্জন রাস্তায় । নিজের মন খারাপ থাকা নিয়ে আমার দুঃখ নেই । কিন্তু একটু কষ্ট লাগে তখনি যখন দেখি আমার মন খারাপটা কারো চোখেই পড়ছে না ।

সবাই কি খুব বেশি উদাসীন আমার প্রতি ? নাকি আমিই খুব বড় মাপের ইচ্ছা-অভিনেতা ? নিজের কথা ভাবলে গল্পের টেনটেলাসের কথা মনে হয় । আকণ্ঠ পানিতে থেকেও যে পিপাসা মেটাতে একফোঁটা পানি না পেয়ে চিৎকার করে যাবে চিরকাল । গ্রিক পুরাণের দেবতারা এই শাস্তি-ই দিয়েছিলেন টেনটেলাসকে । তার পাপের শাস্তি । কিন্তু কোন পাপ না করেও মানুষের অবস্থাও কি অনেক সময় তেমন না ? আশেপাশে কত হাজার মানুষ , কিন্তু কাছে কেউই নেই ।

সবাই যেন পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া অচেনা পথিক যারা হারিয়ে যায় এক নিমিষেই । রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম । মন হঠাৎ বিষণ্ণ হয়ে গেছে খুব , বুঝতে পারছি সহজে আর ভালো হবেও না । জীবন তো একটাই । তবু এখানে কেন এতো না পাওয়ার কষ্ট , অপূর্ণতা , নিঃসঙ্গতা ? প্রশ্নের জবাবটা খুঁজতে ভেবেছি অনেক ।

ভালো না থাকতে পারার কারণটা সম্ভবত আমরা সবসময়ই অন্যদের থেকে কিছুনা কিছু প্রত্যাশা করি যা খুব কম সময়ই পূর্ণতা পায় । যারা একান্তই অসামাজিক ভাবে নিজেকে নিয়ে বাঁচতে পারে তাদের জীবনে সুখ বেশি না থাকলেও কষ্ট অন্তত কম । কোন চাওয়া নেই , আশা ভঙ্গের হতাশাও নেই । নিজেকে সবার প্রতি এমন নিঃস্পৃহ করে ফেলার চেষ্টা করছি দিন দিন । পেরেছিও খানিকটা ।

এতে অবশ্য অন্যদের চোখে আরও অদৃশ্য হয়ে গেছি , না হলে আমার এতো লম্বা সময় একা দাড়িয়ে থাকার মধ্যে কেউ না কেউ পাশে এসে দাঁড়াতোই । কারো সঙ্গ পেতে ইচ্ছা করছে । চোখ বন্ধ করে কল্পনা করা শুরু করলাম । স্বপ্নভঙ্গের কঠিন বাস্তব এক জগতে বাস করতে হয় বলেই হয়ত খুব বেশি কল্পনা করতে শেখা । নিমেষে বদলে গেল চারপাশ ।

ঝুম বৃষ্টি । চোখের সামনে যেন অস্বচ্ছ সাদা একটা পর্দা নেমেছে। দুরে দেখতে কষ্ট হয় । বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে বৃষ্টির ফোঁটারা দিক পাল্টাচ্ছে ক্ষণেক্ষণে । নিচের বেশ বড় ঝাউ গাছটা দুলছে অনেক ।

বাঁ পাশের রেলিঙের উপর ভিজে চুপসে যাওয়া একটা শালিক বসা । এই মাত্র গা ঝাড়া দিয়ে পানি ঝরিয়ে দিল পালক থেকে । কেমন ডাগর ডাগর ভাবে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখছে চারপাশ । দৃশ্যটা মনে ধরল খুব । তন্ময় হয়ে গেলাম তাকিয়ে থাকতে থাকতে ।

হঠাৎ নিজের হাতে অন্য কারো হাতের স্পর্শে শব্দে পাশে ফিরে তাকালাম । একজন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । আমার অতি পরিচিত একজন । চঞ্চল , দুষ্টুমিতে ভরা হাসিখুশি একটা মুখ । নীল যে আমার পছন্দের রং তাও সে জানে ।

নীল শাড়ির সাথে চোখের কাজল আর কপালের লাল টিপে কি অপূর্বই না লাগছে তাকে ! বৃষ্টি দেখার আগ্রহ চলে গেল পুরোপুরি । চোখের সামনে কেউ যদি পৃথিবীর সব সৌন্দর্য নিয়ে দাড়ায় তবে বৃষ্টি , জোছনা , সূর্যাস্ত বা অন্য কোনকিছুরই কি আর খোঁজ করার দরকার পড়ে ? মুখোমুখি হয়ে কি যেন বললাম তাকে । শ্রাবণের সব মেঘ জড়ো হল তার মুখে । মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইলো অন্যদিকে । আমাকে চোখের জল দেখতে দিতে চায় না ।

আবারও যেন ফিসফিস করে কি বলে শব্দ করে হাঁসতে লাগলাম আমি নিজেই । তার মনের মেঘও কেটে গেল সহসাই । হাসতে হাসতে ভেঙ্গে পড়লো সে আমার সাথে । তাকে আমি যেমন কাঁদাতে পারি , হাসাতেও পারি এক মুহূর্তে । এই মেঘ , রৌদ্র , ছায়া তার মনের আকাশ যার রং বদলায় খুব সামান্য কারণেই ।

নূপুরের নিক্বণের মতো হাসির শব্দ । এত সুন্দর হতে পারে মানুষের হাসি ! তার ঐ এক হাসিতেই যেন পৃথিবী থেকে বিদায় নিলো সমস্ত বিষাদ । আজ শুধুই আনন্দ । আজ পৃথিবীর কোথাও কোন দুঃখ নেই , কোন হতাশা নেই । কাঁদবে না কেউ আজ ।

আজ শুধুই প্রানখুলে হাসার দিন , নিজেকে নতুন করে ফিরে পাওয়ার দিন । এখন আর একা হাত ভেজাচ্ছি না , আমার পাশে গা ঘেঁষে দাড়িয়ে বৃষ্টির পানিতে সেও হাত বাড়িয়ে দিয়েছে । তার হাত ভর্তি লাল , নীল কাঁচের চুড়ির টুং টাং শব্দ পাচ্ছি । বৃষ্টির তীব্র শব্দ যেন ঢাকা পড়ে যাচ্ছে সে শব্দের আড়ালে । বাতাস কোথা থেকে যেন ভাসিয়ে এনেছে বেলী ফুলের মিষ্টি সুবাস ।

ছোট ছোট পানির কণা ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাদের সারা শরীর । একটু একটু করে ভোরের শিশির বিন্দু যেন জমছে তার মুখে । নিজের হাতের আঁজলা ভর্তি পানি সে ঢেলে দেয় আমার হাতে । এক বিন্দু পানিও ঝরে যেতে দেই না । নিজের হাতের তালুতে ধরে রাখি গভীর মমতায় ।

চোখ দুটো ভিজে উঠে কেন যেন । সে যেন আগে থেকেই জানতো সব । চোখের পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই চোখ মুছিয়ে দেয় । আশ্বাসের হাসি হেসে চোখের ভাষায় প্রবোধ দেয় আমাকে; বোকা , সবসময় একা কেন ভাবো নিজেকে ? আমি তো আছি । .......আসলেই তো একা কেন ভাবি নিজেকে ? তুমি তো আছোই পাশে ।

কোথায় পড়া সুন্দর একটা কবিতার লাইন মনে পড়ে যায় । ভারি হয়ে আসা গলায় তাকে শোনাই , “ আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর । " - “ শুভ জন্মদিন । আপনি একা একা দাড়িয়ে কাঁদছেন কেন ? আমাকে বলা যায় ?” খুব কোমল স্বরে পাশ থেকে কে যেন বলে উঠলো । কল্পনার ঘোর কাটিয়ে বাস্তবে ফিরতে সময় লেগে যায় একটু ।

করিডোরে একা দাড়িয়ে নেই এখন আর , কখন যে একজন এসে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করি নি । প্রায় অপরিচিত একজন মানুষ ছেলেদের কান্নার মত একান্ত নিজস্ব একটা সময়ে আমাকে দেখে ফেলেছে । কিন্তু কেন যেন অস্বস্তি লাগলো না । - “ এমনি । মনটা একটু খারাপ কেন যেন ।

কখন যে চোখে পানি চলে এসেছে বুঝতে পারি নি । “- “ ঐ কবিতাটা আরেকবার বলবেন ?” প্রায় অস্পষ্ট স্বরে মাথা নিচু করে ফিসফিস বলে সে । ধাক্কার মত লাগলো । কিছুটা চমকে তাকাই তার দিকে । নাহ , এ মুখ আমার কল্পনার সেই নীল শাড়ির মানুষটার নয় , কিন্তু এ মুখ বাস্তবের কোন মায়াবতীর ।

কি বলব কথা খুঁজে পাই না । - সত্যিই কি শুনতে চাচ্ছো ? - “ হ্যাঁ “ । মাথা তুলে আমার চোখে চোখ রেখে জবাব দেয় সে । আবেগে গলার স্বর কেঁপে অস্পষ্ট হয়ে গেল যেন একটু , তবুও কতই না স্পষ্টতা এই একটা শব্দে ! চোখে চোখ রেখে বুঝতে চেষ্টা করি ভুল হচ্ছে না তো কোথাও । তার ছলছল চোখের তারায় খেলে যায় অদ্ভুত এক অপার্থিব আলোর ঝিলিক যার জন্ম অন্য কোন জগতে ।

অবাক হয়ে যাই যখন বুঝতে পারি এ আলোর দ্যুতি আমার জন্যই । নাহ , ভুল হয় নি আমার । নিজের সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে তা জানি । পৃথিবীর কোথাও হঠাৎ যেন বদলে যায় কিছু একটা । আমি ঠিক জানি না , জানতেও চাই না ।

কিন্তু বুঝতে পারি তা বিষণ্ণ মেঘের ফাঁক গলিয়ে নিয়ে এসেছে এক চিলতে ভোরের আলো । আমার হয়ে নিজের মনই যেন কণ্ঠ পেয়ে আরও একবার বলে উঠে , “ আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর । “ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।