আমি বসে আআছি গ্রিন রোড এর একটি ক্লিনিক । সকাল সাত টার কিছু বেশি বাজে। সকাল ৯ টায় আমার একটা ক্লাশ আছে তাই সকাল সকাল আসতে হল । গতকাল আমার রুমমেট এর এক বন্ধু ফোন করে A+ রক্তের জন্য। খুবই না কি জরুরি।
আমি রাজি হয়ে গেলাম। কিন্তু বললাম আমাকে সকাল ৯ টার আগে ছাড়তে হবে। সে বলল ঠিক আছে। আমাকে উত্তরা থেকে আস্তে হয়েছে তাই সকাল সাড়ে ছয়টায় রওনা দিয়েছিলাম। সকালের ঢাকা র রাস্তায় তখন যানজট শুরু হয়নি।
তাই ২৫মিনিটে অনিক পরিবহনের বাস টি আমাকে পান্থপথে নামিয়ে দিয়েছে। ঐ সময় এর পর বের হলে এক দেড় ঘন্টার বেশি লেগে যেত।
যা হোক , ক্লিনিক টি তেমন বড় নয়। দোতলা থেকে পাঁচ তলা পর্যন্ত ক্লিনিক এর যাবতীয় কাজ চলে। ক্লিনিক এর রিসিপশন ডেস্ক এর সামনে কিছু চেয়ার আছে।
তার একটা তে বসে ঘরের এক কোনায় ঝোলান টিভি তে সকালের খবর শুনছিলাম। রিসিপশন ডেস্ক খালি। রাতের ডিউটির নার্স রা ঘুম ঘুম চোখে বসে আছে। কয়েক জন রোগীর সাথে আসা নিকটাত্মীয় চেয়ারেই মাথা ঝুলিয়ে ঘুমুচ্ছে। এখন ক্লিনিক এর ব্যাস্ততা শুরু হয় নি।
কয়েকটি ঘর এর সামনে ডাঃ এর নাম তার পাশে দেশি বিদেশী অনেক ডিগ্রী লেখা। ঘর গুল তালা বন্ধ। রাতে কোন ডাঃ থাকে কি না কে জানে? আমি যাকে রক্ত দিতে এসেছি সে ব্লাড ক্যান্সার এ আক্রান্ত। বয়স ১২ অথবা ১৩ হবে। তাকে এখন দেখিনি।
যে আমাকে ফোন করেছিল সেও এখন আসেনি। অন্য কাউকেও দেখতে পারছি না। একটু বিরক্তি নিয়েই অপেক্ষা করছিলাম।
একটু পর উপর তলায় একটু গুঞ্জন শুনতে পেলাম। একজন নার্স ছুটে গেল।
আর এক জন হন্ত দন্ত হয়ে এদিক ওদিক যাচ্ছে। এর দশ মিনিট এর মাথায় এক মহিলা বিলাপ করে কেঁদে উঠলেন। সাথে এক পুরুষ কন্ঠের চিৎকার ভেসে এল। কি হয়েছে দেখার জন্য আমি একটু সামনে গেলাম। দেখলাম সিড়ির কাছে এক ভদ্র লোক বিলাপ করে কাঁদছেন।
বোঝা যাচ্ছে তার কেউ মারা গেছে। পাশে এক মহিলা দাঁড়িয়ে ছিল একটু কৌতূহল নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে?
সে বলল যে কাঁদছে তার মেয়ে মারা গেল এক্ষুনি। মেয়ে টার বয়স বেশি না ১৮ বা ১৯ হবে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল, ভাল ফলাফল নিয়ে পাশ করেছে। ডাঃ হতে চেয়েছিল মেয়েটি।
মহিলার কাছ থেকে এত কিছু শোনার পর খারাপ লাগছিল। ঐ ভীর এর মাঝে আমি মেয়েটির কেবিনের দরজার সামনে গিয়ে দাড়ালাম। সাদা বিছানায় শুয়ে আছে মেয়েটি। সাদা চাদরে শরীর ঢাকা। মুখটি তখন ঢাকা হয়নি।
তার চোখ টি একটু খোলা। কিন্তু সে চোখে দৃষ্টি নেই। এ শরীর এ প্রান নেই। পাশে বসে তার মা কাঁদছিলেন। অনেকেই পাশে দাঁড়িয়ে ছিল কেউ সান্তনা দেয়ার ভাষা খুজে পাচ্ছে না।
এমন দৃশ্য দেখার পর অশ্রু সামলানো খুবই কঠিন ব্যাপার। পারলাম না। চোখের পানিতে সব ঝাপ্সা হয়ে গেল।
একটু আগেও সে বেচে ছিল এখন নেই। হয়ত ডাঃ হত বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত।
কিছুই হল না। হারিয়ে গেল। যে মেয়েটি ডাঃ হতে চেয়েছিল তার মারা যাওয়ার সময় কোন ডাঃ তার মরন যন্ত্রণার সাথে লড়াই করল না। কত টা অভিমান নিয়ে সে চলে গেল? যে বয়স এ তার প্রিয় মানুষ টির সাথে অভিমান করার কথা বড় ভাই টি তাকে আইস্ক্রিম খাওয়ায়নি বলে তার সাথে অভিমান করার কথা সেই বয়সে সে আমাদের সবার উপর উপর অভিমান করে চলে গেল। তার অভিমান আমরা কি কেউ ভাঙ্গাতে পারব?
একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম।
এরই মাঝে কে যেন আমাকে আমার নাম ধরে ডাকলেন। নিজেকে দাম্লে তার কাছে গেলাম। উনি জিম এর মা। জিম হল আমি যাকে রক্ত দিতে এসেছি সেই ছেলের নাম। মহিলার বয়স ৩৫ এর মত হবে।
তার চোখে মুখে ক্লান্তির স্পষ্ট ছাপ। তারপরও কথায় বেশ তরতাজা মনে হল। আমার সাথে টুকটাক কথা বলে রিসিপ শন থেকে রক্ত দেয়ার আগে যে ফর্ম ফিল আপ করতে হয় সেটি নিয়ে আমাকে দিলেন। পরে জানতে পারলাম আজ আরো ১০ ব্যাগ রক্ত লাগবে। সাত দিন পর আবার।
আমি জানি ডোনার ম্যানেজ করা কত কঠিন। তার উপর এত গুল খুবই চিন্তার বিষয়। সব প্রক্রিয়া শেষ করে আমি যখন রক্ত নেয়ার ঘরে যাচ্ছি তখন তিনি আমার হাত টি ধরে কৃতজ্ঞতায় কিছু বলতে চাছিলেন কিন্তু পারছিলেন না। আমি বললাম ভাববেন না ও সুস্থ হয়ে উঠবে। আর রক্তের ব্যাবস্থা করার জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব বলে আশ্বস্ত করলাম।
উনি প্রায় কেঁদে ফেলছিলেন। এক সকালে এত মায়ের কান্না সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি হাত টি ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেলাম। রক্ত নেয়া শেষ হলে বের হয়ে এসে দেখি আমার জন্য জুস ফল সহ নানা হাবিজাবি এনেছে। আমি জুস টি নিলাম অন্য গুলো বললাম ওগুল থাক লাগবে না।
তারপরও উনি আমাকে জোর করে দিবেনই আমি একটা কমলা তুলে নিয়ে বললাম বাকি গুল জিম কে দেবেন অ খাবে। জিম কে আমার দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। তাকে বললাম আমি একটু অর সাথে দেখা করতে চাই। উনি খুশি হলেন। আমাকে পাঠিয়ে দিলেন যে আমাকে ফোন্ন করেছিল তার সাথে।
সিড়ি দিয়ে উপরে এসে দেখলাম কিছুক্ষন আগে যে মেয়েটি মারা গিয়েছিল তার পাশের কেবিনটি জিমের। দরজায় টোকা দিয়ে আমরা ভিতরে ঢুকলাম। ১২,১৩ বছরের একটা ছেলে হাতে ক্যানুলা লাগানো। বিছানায় বসে আছে। স্বাস্থ বেশ ভালই মনে হল।
তার পাশে এক মহিলা বসে ওকে খাওয়াচ্ছিল। আমাকে দেখে খাওয়া থামিয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে। ওর গলায় একটি সুতার মালা। মালার সাথে লকেট এর মত একটা কাঠি ঝুলছে। মনে হয় কবিরাজি চিকিৎসাও চলছে।
ওর যখন ৪ বছর বয়স তখন তার এ রোগটি ধরা পরে। ভারতে দীর্ঘ ২ বছর চিকিৎসায় সেড়েও ওঠে কিন্তু ডাঃ রা বলেছিল এ সেড়ে ওঠা সাময়িক ও হতে পারে। যদি ১৮ বৎসর এর আগে আবার ফিরে আসে তাহলে হয়ত আর বাচান যাবে না। বার তের তে আবার ঘাতক ফিরে আসে। শুনলাম ওদের বাড়ি রংপুর এ।
আমি রংপুর এ এক সময় লেখা পড়া করেছি। তাই আরো বেশ আপন মনে হল। আসলে এ মনে হওয়ার পেছনে কোন যুক্তি নেই। জিম পড়ে রংপুর ক্যান্টঃপাবলিক স্কুল এ। বাংলাদেশের মাঝে নাম করা স্কুল এ টি।
এত টুকুন ছেলে মৃত্যকে সাথে করে ঘুমুচ্ছে। ওর সাথে আমি কি কথা বলব ভেবে পেলাম না। জিজ্ঞেস করলাম বই পড়তে পছন্দ কর। ও মাথা নাড়ল। আরো দু একটা কথা বলে ফ্রি হতে চাচ্ছিলাম কিন্তু পারছিলাম না।
সেদিনের মত বেরিয়ে আসলাম।
রাস্তায় হাটছিলাম অন্যমনস্ক ভাবে। মেনে নিতে পারছিলাম না সকালের অচেনা মেয়েটির মৃত্যু আর জিম এর মৃত্যুর সাথে প্রায় অসম্ভব এক লড়াই। এই ছেলেটি পাশের ঘর এর মেয়েটির মৃত্যুর সময় গুলো প্রত্যক্ষ করেছে। হয়ত অনেক আত্মীয় স্বজন আসে নানা কথায় আফসোস করে তার মৃত্যকেই স্মরন করিয়ে দেয়।
মৃত্যু ত চরম সত্য কিন্তু এ নবিন প্রান গুলোর জন্য এ মৃত্য কি একটু বেশি মাত্রায় নিষ্ঠুর নয়?
এরপর আর একবার গিয়েছিলাম জিমের সাথে দেখা করতে সাথে কয়েকটা বই নিয়ে। এরপর আমি দেশের বাইরে চলে আসি কাজের চাপে জিম কে না ভুললেও খোঁজখবর নিতে পারি নি। কয়েকদিন আগে শুনলাম জিম মারা গেছে। খবর টা শুনে কিছুক্ষইন এর জন্য চুপ হয়ে গেলাম। কাদতে গিয়েও পারলাম না।
মনে মনে বললাম
“ জিম তুমি ভাল থেক অবিনশ্বর জগতে”।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।