আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বুক রিভিউঃ ইনফার্নো বাই ড্যান ব্রাউন

দিতে পারো একশ ফানুস এনে...আজন্ম সালজ্জ সাধ একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই... আগে থেকেই প্রিঅর্ডার করা ছিলো, সেজন্য প্রকাশ হবার দেড়দিনের মাথায় বাসায় বই এসে হাজির। মোটাসোটা বিশাল প্যাকেট; পাশের ছেলেটি ভেতরে বই জেনে একটু আঁতকেই উঠলো। আমি প্যাকেট খুলে দেখলাম অনলাইনে যা দেখেছি সেই প্রচ্ছদের বইই এসেছে। ড্যান ব্রাউনের জন্য বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা এমন কিছু না, ইতিহাস আর রহস্য একত্রিত করতে গেলে এতটুকু লাগবেই। বৃষ্টি বৃষ্টি দিন ছিলো, এখনকার নিয়ম অনুযায়ী ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়ে কফি বানিয়ে বই নিয়ে বসে পড়লাম।

সত্যি বলতে কি, একটু টেনশন নিয়েই বই খুললাম। কোন সন্দেহ নেই The Vinci Code পড়া শেষ করার আগেই আমি রবার্ট ল্যাংডন আর ড্যান ব্রাউন দুইজনেরই পাঙ্খা হয়ে গিয়েছিলাম আর তার বাকি বই সবই একটানে পড়েছি, কিন্তু The Lost symbol মোটামোটি একটা ধাক্কা দিয়েছিলো। কিছু অংশ তো রীতিমত কষ্টকর ভাবে বোরিং ছিলো। যাই হোক, প্রথমেই যে লাইনটা চোখে পড়ল সেটা হচ্ছে, “The darkest places in hell are reserved for those who maintain their neutrality in times of moral crisis”.. একটু নড়ে চড়ে বসলাম, কঠিন কথা বইকি। দান্তের অসংখ্য টনক নড়া লাইনের মাঝে একটি।

ইতালিয় শব্দ ইনফার্নোর অর্থ হচ্ছে নরক। লাইনটা পড়েই দান্তের The Devine Comedy এর প্রথম ভাগ Inferno পড়ার জন্য মন আঁকুপাঁকু করতে লাগলো, জোর করে তা সরিয়ে ড্যান ব্রাউনে মনোনিবেশ করলাম। “Seek and ye shall find” – দান্তের এই একটিমাত্র লাইন মাথার মাঝে নিয়ে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরের এক আধুনিক হাসপাতালে বিখ্যাত আমেরিকান প্রফেসর রবার্ট ল্যাংডনের জেগে ওঠা দিয়ে গল্পের শুরু। Retrograde Amnesia* (সোজা কথায় স্মৃতিশক্তির বিলোপ) এর জন্য কিছু টুকরো টুকরো ছবি ছাড়া সে কিছুই মনে করতে পারে না, আর এই ইমেজগুলো জোড়া লাগানোর মাঝ দিয়েই গল্পের টুইস্ট এন্ড টার্ন শুরু। ড্যান ব্রাউনের গতানুগতিক স্ট্যাটেজি অনুসারে হাসপাতালেই তার পরিচয় হয় অপূর্ব সুন্দরী ব্লন্ড ডাক্তার সিয়েনা ব্রুক্সের সাথে, যে পরবর্তীকালে পুরো উপন্যাসে ল্যাংডনের সাথী।

সিয়েনা প্রকৃতি প্রদত্ত বিষ্ময়কর মেধা নিয়ে জন্মেছে এবং ছোটবেলা থেকেই তার আইকিউ ২০৮। বিশেষজ্ঞরা তার মস্তিস্ক পরীক্ষা করে বলেছেন যে ক্যানসার রোগের মতই দ্রুত বাড়ে তার মস্তস্কের নিউরন যে কারনে অসাধারন স্মৃতি শক্তি সম্পন্ন সিয়েনার নতুন কিছুতে দক্ষতা অর্জন করতে নামমাত্র সময় লাগে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ল্যাংডনের জীবন নেয়ার জন্য শুরু হয়ে যায় একের পর এক আক্রমন। কড়া ঘুমের ঔষধের প্রভাবে থাকা ল্যাংডন বাধ্য হয় সিয়েনার সাহায্যে হাসপাতাল থেকে পালাতে। অবাক হয়ে সে আবিস্কার করে তার প্রিয় টুইডের জ্যাকেটের সেলাই খুলে কে যেন বিপদজনক জৈব পদার্থের প্রতীক সম্বলিত বেশ ভারী এবং মসৃন ছয় ইঞ্চির একটা সিলিন্ডার ঢুকিয়ে দিয়েছে।

অল্পক্ষণ পরেই তারা ধরে ফেলে যে সিলিন্ডারটা আসলে একটা প্রজেক্টর যার মাঝে আছে ইতালির রেঁনেসা যুগের বিখ্যাত চিত্রশিল্পি সান্দ্রো বত্তিচেলির আঁকা চিত্রকর্ম... L’inferno di Dante অথবা সহজ করে বললে ‘দান্তের দর্শনে নরক’। তবে চিত্রকর্মটি কেউ একজন সতর্কতার সাথে পরিবর্তন করে তাতে ঢুকিয়ে দিয়েছে কিছু অক্ষর এবং প্রতীকচিহ্ন। ল্যাংডন চায় আমেরিকান দূতাবাসের সাহায্যে দেশে ফিরতে কিন্তু এর জবাবে আসে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত এক গাড়ি সেনা বাহিনী। জৈবিক তাড়নায় ল্যাংডন এবার সিদ্ধান্ত নেয় যে তাকে জানতে হবে কি আছে এই চিত্রকর্মে যার জন্য তার জীবন আজ সংশয়ের মুখে। জীবন বাজী রেখে সে ঘুরতে থাকে ফ্লোরেন্সের মহাসড়ক থেকে সরু গলিতে, এক জাদুঘর থেকে অপর প্লাজায়, রেঁনেসা যুগের বিখ্যাত সব স্থাপত্যকলার নিদর্শনগুলোতে।

সংকেত পাঠোদ্ধারের এক পর্যায়ে সে আতংকের সাথে লক্ষ্য করে যে এক অসম যুদ্ধে কোন হাতিয়ার ছাড়াই সে নেমেছে যেখানে তার প্রতিপক্ষ পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত জৈবরাসায়নবিদ যে একই সাথে মানবদেহের দুর্বলতা দূরীকরনের জন্য জিনের পরিবর্তন সাধন তত্ত্বের শক্তিশালী প্রবর্তক। মেধাবী বিজ্ঞানীর মতে বর্তমানে পৃথিবীর মানুষের যাবতীয় কষ্টের মূল হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদের স্বল্পতা এবং যথেচ্ছ ব্যবহার। সম্পদ বাড়ানো সম্ভব নয় তবে মানবজাতির ক্রমবর্ধমান সংখ্যা কমিয়ে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। দান্তের একনিষ্ঠ ভক্ত হিসেবে সে বিশ্বাস করে স্বর্গের উচ্চতায় উঠতে গেলে প্রতিটি মানুষকে প্রথমে পতিত হতে হবে নরকে, অতঃপর প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে তার কৃত পাপসমূহের। তেরশ শতাব্দির ব্লাক ডেথ নামে কুখ্যাত প্লেগ ছিল সে সময়ের ত্রাণকর্তা।

প্লেগের ফলে ইউরোপের ৭৫-৮০ ভাগ মানুষের মৃত্যু ঘটলে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যে রেঁনেসা যুগের আবির্ভাব হয় যেটা স্বর্গের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। মানব জাতির কল্যাণসাধনে বর্তমানের ৭ বিলিয়ন জনসংখ্যা ৪ বিলিয়নে নামিয়ে আনার জন্য সে পৃথিবীর কোন এক অংশে লুকিয়ে রেখেছে তার ভয়াবহ জৈব অস্ত্র যা প্লেগ থেকে কোন অংশে কম নয়। মরার ওপর খাঁড়ার ঘার মত ল্যাংডনের পিছনে লেগেছে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা(WHO) এবং এক অজ্ঞাত গুপ্তসংগঠন “কনসোর্টিয়াম” যে শক্তিতে WHO এর চেয়ে কোন অংশে কম নয়। বিজ্ঞানী আত্মহত্যার পূর্বে রেখে গেছে এই ছয় ইঞ্চির সিলিন্ডারের মাঝে কিছু সাংকেতিক চিহ্ন যা আর একদিনের মাঝে পাঠোদ্ধার না করলে মানব জাতির উপরে নামবে মৃত্যুর কালো ছায়া। এরকম টান টান উত্তেজনা বলতে গেলে উপন্যাসটির প্রথম থেকে প্রায় শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন মিস্টার ব্রাউন।

কলমের খোঁচায় মূহুর্তে মূহুর্তে যেমন শত্রুকে বানিয়েছেন বন্ধু তেমনি বিপরীতটিও করেছেন দক্ষভাবে। এক চ্যাপ্টার শেষ করতে না করতেই পরের চ্যাপ্টারে কি যে হবে সেটা নিয়ে টেনশন শুরু হয়ে যায়। পুরো বইটি লেখা হয়েছে দান্তের ইনফার্নোর ছায়ায়, সাথে ব্রাউনীয় সুলভ অ্যাডভেঞ্চার। এই জাতীয় বইয়ের জন্যই ইংরেজী শব্দটির জন্ম- unputdownable! আমার কথাঃ পাঠক হিসেবে আমি খুব উঁচু মানের নই। বলছি না যে আমার বইয়ের তাকে ক্রাচের কর্ণেল বা ওরহান পামুকের বই নেই, তবে অ্যাডভেঞ্চার, হরর, ভ্রমন আর গোয়েন্দাগল্প আমাকে টানে বেশী।

একারনে ড্যান ব্রাউন যথেষ্ট সমালোচনার মুখে পড়লেও এখনো রবার্ট ল্যাংডন চরিত্র আমার বেশ প্রিয়। দ্য লস্ট সিম্বলে ব্রাউন পাঠকদের যেরকম নিরাশ করেছেন, তার থেকে বের হবার আন্তরিক প্রচেষ্টা বইটিতে দেখা যায়। যদিও বেশ কিছু দৃশ্যে পাঠকের মনে হবে যে এরকম বর্ণনা তারা আগেও পড়েছেন অন্য কোন বইতে। গল্পের কাহিনী জমাতে পারলেও শেষটা করেছেন একেবারে নিরামিষ ভাবে এবং তা কিছুটা অসমাপ্তও। “শেষ হইয়াও হইলো না শেষ” ছোট গল্পে মানায়, প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার রোমাঞ্চ উপন্যাসে তা বেমানান।

সত্যি বলতে কি, বইটি পড়ার পরে মনের ভেতর অতৃপ্ততাই কাজ করে বেশী। তারপরেও রোমাঞ্চপ্রিয় পাঠকদের আমি বইটি অবশ্যই পড়ার জন্য সুপারিশ করবো কারন ড্যান ব্রাউনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনাযুক্ত সাবলীল লেখনী এবারেও পাঠকের মন কাড়তে বাধ্য। *********************************************** এক নজরে বইটিঃ নামঃ ইনফার্নো লেখকঃ ড্যান ব্রাউন ধরনঃ রহস্যোপন্যাস/ গোয়েন্দা উপন্যাস/ রোমাঞ্চ উপন্যাস প্রকাশকালঃ ১৪ই মে, ২০১৩ পৃষ্ঠাঃ ৪৬১ মূল্যঃ নীলক্ষেতে কিনলে খুব বেশী হবার কথা না! ************************************************ ********** *Retrograde Amnesia: অ্যামনেশিয়া অর্থ স্মৃতিশক্তি বিলুপ্ত হওয়া। Retrograde amnesia বা পশ্চাৎগামী স্মৃতিভ্রংশের রোগী যে সময়ে স্মৃতি হারিয়েছে সেই সময় এবং তার পূর্বের বেশ কিছু সময়ের (নির্দিষ্ট নেই, দিন, মাস এমনকি বছরও হতে পারে) স্মৃতি ভুলে যায়। কিন্তু জ্ঞান ফিরে পাবার পর থেকে তার নতুন স্মৃতি তৈরীতে কোন সমস্যা হয়না।

এটা বিভিন্ন কারনে হতে পারে; যেমন- দুর্ঘটনা, ব্রেন ড্যামেজ অথবা মানসিক আঘাত। কিছু ঘুমের ঔষধ অথবা নেশার ঔষধ উচ্চমাত্রায় সেবনের ফলেও এই রোগ দেখা দিতে পারে।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৭ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।