আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভুল স্বর্গ

ভুল স্বর্গ --- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লোকটি নেহাত বেকার ছিল। তার কোনো কাজ ছিল না, কেবল শখ ছিল নানা রকমের। ছোটো ছোটো কাঠের চৌকোয় মাটি ঢেলে তার উপরে সে ছোটো ছোটো ঝিনুক সাজাত। দূর থেকে দেখে মনে হত যেন একটা এলোমেলো ছবি, তার মধ্যে পাখির ঝাঁক; কিম্বা এবড়ো-খেবড়ো মাঠ, সেখানে গোরু চরছে, কিম্বা উঁচুনিচু পাহাড়, তার গা দিয়ে ওটা বুঝি ঝর্ণা হবে কিম্বা পায়ে-চলা পথ। বাড়ির লোকের কাছে তার লাঞ্ছনার সীমা ছিল না।

মাঝে মাঝে পণ করত পাগলামি ছেড়ে দেবে, কিন্তু পাগলামি তাকে ছাড়ত না। ২ কোনো কোনো ছেলে আছে সারা বছর পড়ায় ফাঁকি দেয়, অথচ পরীক্ষায় খামকা পাস করে ফেলে। এর সেই দশা হল। সমস্ত জীবনটা অকাজে গেল, অথচ মৃত্যুর পরে খবর পেলে যে, তার স্বর্গে যাওয়া মঞ্জুর। কিন্তু নিয়তি স্বর্গের পথেও মানুষের সঙ্গ ছাড়ে না।

দূতগুলো মার্কা ভুল করে তাকে কেজো লোকের স্বর্গে রেখে এল। এই স্বর্গে আর সবই আছে, কেবল অবকাশ নেই। এখানে পুরুষরা বলছে `হাঁফ ছাড়বার সময় কোথা?' মেয়েরা বলছে, `চললুম ভাই, কাজ রয়েছে পড়ে। ' সবাই বলে, `সময়ের মূল্য আছে। ' কেউ বলে না `সময় অমূল্য'।

`আর তো পারা যায় না' বলে সবাই আক্ষেপ করে, আর ভারি খুশি হয়। `খেটে খেটে হয়রান হলুম' এই নালিশটাই সেখানকার সংগীত। এ বেচারা কোথাও ফাঁক পায় না, কোথাও খাপ খায় না। রাস্তায় অন্যমনস্ক হয়ে চলে, তাতে ব্যস্ত লোকের পথ আটক করে। চাদরটি পেতে যেখানেই আরাম করে বসতে চায়, শুনতে পায়, সেখানেই ফসলের খেত, বীজ পোঁতা হয়ে গেছে।

কেবলই উঠে যেতে হয়, সরে যেতে হয়। ৩ ভারি এক ব্যস্ত মেয়ে স্বর্গের উত্#স থেকে রোজ জল নিতে আসে। পথের উপর দিয়ে সে চলে যায় যেন সেতারের দ্রুত তালের গতের মতো। তাড়াতাড়ি সে এলো-খোঁপা বেঁধে নিয়েছে। তবু দু-চারটে দুরন্ত অলক কপালের উপর ঝুঁকে প'ড়ে তার চোখের কালো তারা দেখবে ব'লে উঁকি মারছে।

স্বর্গীয় বেকার মানুষটি এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, চঞ্চল ঝর্নার ধারে তমাল গাছটির মতো স্থির। জানলা দিয়ে ভিক্ষুককে দেখে রাজকন্যার যেমন দয়া হয়, একে দেখে মেয়েটির তেমনি দয়া হল। `আহা তোমার হাতে বুঝি কাজ নেই?' নিশ্বাস ছেড়ে বেকার বললে, `কাজ করব তার সময় নেই। ' মেয়েটি ওর কথা কিছুই বুঝতে পারলে না। বললে, `আমার হাত থেকে কিছু কাজ নিতে চাও?' বেকার বললে, `তোমার হাত থেকেই কাজ নেব ব'লে দাঁড়িয়ে আছি।

' `কী কাজ দেব?' `তুমি যে ঘড়া কাঁখে করে জল তুলে নিয়ে যাও তারই একটি যদি আমাকে দিতে পারো---' `ঘড়া নিয়ে কী হবে? জল তুলবে?' `না, আমি তার গায়ে চিত্র করব। ' মেয়েটি বিরক্ত হয়ে বললে, `আমার সময় নেই, আমি চললুম। ' কিন্তু, বেকার লোকের সঙ্গে কাজের লোক পারবে কেন? রোজ ওদের উত্#সতলায় দেখা হয়, আর রোজ সেই একই কথা, `তোমার কাঁখের একটি ঘড়া দাও, তাতে চিত্র করব। ' হার মানতে হল, ঘড়া দিলে। সেইটিকে ঘিরে ঘিরে বেকার আঁকতে লাগল কত রঙের পাক, কত রেখার ঘের।

আঁকা শেষ হলে মেয়েটি ঘড়া তুলে ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলে। ভুরু বাঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, `এর মানে?' বেকার লোকটি বললে, `এর কোনো মানে নেই। ' ঘড়া নিয়ে মেয়েটি বাড়ি গেল। সবার চোখের আড়ালে বসে সেটিকে সে নানা আলোতে নানা রকমে হেলিয়ে ঘুরিয়ে দেখলে। রাত্রে থেকে-থেকে বিছানা ছেড়ে উঠে দীপ জ্বেলে চুপ করে বসে সেই চিত্রটা দেখতে লাগল।

তার বয়সে এই সে প্রথম এমন-কিছু দেখেছে যার কোনো মানে নেই। তার পরদিন যখন সে উত্#সতলায় এল তখন তার দুটি পায়ের ব্যস্ততায় একটু যেন বাধা পড়েছে। পা দুটি যেন চলতে চলতে আনমনা হয়ে ভাবছে--- যা ভাবছে তার কোনো মানে নেই। সেদিনও বেকার মানুষ এক পাশে দাঁড়িয়ে। মেয়েটি বললে, `কী চাও?' বললে, `তোমার হাত থেকে আরো কাজ চাই।

' `কী কাজ দেব?' `যদি রাজি হও, রঙিন সুতো বুনে বুনে তোমার বেণী বাঁধবার দড়ি তৈরি করে দেব। ' `কী হবে?' `কিছুই হবে না। ' নানা রঙের নানা কাজ করা দড়ি তৈরি হল। এখন থেকে আয়না হাতে নিয়ে বেণী বাঁধতে মেয়ের অনেক সময় লাগে। কাজ পড়ে থাকে, বেলা বয়ে যায়।

৪ এ দিকে দেখতে দেখতে কেজো স্বর্গে কাজের মধ্যে বড়ো বড়ো ফাঁক পড়তে লাগল। কান্নায় আর গানে সেই ফাঁক ভরে উঠল। স্বর্গীয় প্রবীণেরা বড়ো চিন্তিত হল। সভা ডাকলে। তারা বললে, `এখানকার ইতিহাসে কখনো এমন ঘটে নি।

' স্বর্গের দূত এসে অপরাধ স্বীকার করলে। সে বললে, `আমি ভুল লোককে ভুল স্বর্গে এনেছি। ' ভুল লোকটিকে সভায় আনা হল। তার রঙিন পাগড়ি আর কোমরবন্ধের বাহার দেখেই সবাই বুঝলে, বিষম ভুল হয়েছে। সভাপতি তাকে বললে, `তোমাকে পৃথিবীতে ফিরে যেতে হবে।

সে তার রঙের ঝুলি আর তুলি কোমরে বেঁধে হাঁফ ছেড়ে বললে, `তবে চললুম। ' মেয়েটি এসে বললে, `আমিও যাব। ' প্রবীণ সভাপতি কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। এই সে প্রথম দেখলে এমন একটা কাণ্ড যার কোনো মানে নেই। কার্তিক ১৩২৮ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।