আমি লেখক খারাপ হতে পারি কিন্তু ছেলে ভাল আমার নাম নাফিজ।
আমি একজন ড্রাগ এডিক্ট।
এই মুহূর্তে আমি নগ্ন দেহে রাজপথে ছুটে চলেছি। গায়ে একটা সুতাও নেই।
এখন ঘড়িতে ক’টা বাজে আমি জানি না।
তবে সময়টা গভির রাত। রাজপথ নির্জন, নিশ্চুপ।
আমি এখন ঠিক কোথায় আছি বলতে পারব না। কেন এই গভির রাতে আমি রাস্তায় ছুটাছুটি করছি তাও বলতে পারব না। আমি এমনকি জানি না কেন আমার পড়নে কোন কাপড় চোপর নেই।
আমি শুধু জানি আমাকে ছুটে যেতে হবে; কেন, কোথায় এসব প্রশ্ন মুখ্য নয়। আকাশের ভরা যৌবনা চাঁদটা তার আঁচল বিছিয়ে আমাকে বেশ্যার মত আহ্বান করছে। আর আমি সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছুটে চলেছি। যেন মোমবাতির আলোর মোহে বাঁধা পড়া মৃত্যু পথযাত্রি পতঙ্গ আমি।
না, আমি নেশা করিনি।
গত দুই সপ্তাহ আমি হাত দিয়ে একটা সিরিঞ্জ ছুয়ে দেখিনি। আমার এই বিস্মৃতির শেকড় অন্যকোনখানে।
হুইসেল বাজছে। কালো একটি কায়া আমার দিকে এগিয়ে আসছে। একটি মানুষ।
সম্ভবত টহল পুলিশ। সে এক হাতে বাশি ফুঁকছে, আরেক হাতে ধরা টর্চ লাইটটা তাগ করছে আমার উপর। মোটা সাদা একটা আলোক রশ্মি এসে আঘাত করে আমাকে। আমি চিৎকার করে উঠি। না না আমি আলো চাই না, এখন অন্ধকারের সময়।
নিজের চিৎকারে আমি নিজেই চমকে উঠি। মুখ দিয়ে একটা আহত পশুর আর্তনাদ ছাড়া আর কিছু বের হয় না।
আমার জান্তব চিৎকারে না আমার ভয়ঙ্কর নগ্ন মুর্তি দেখে কে জানে, পুলিশটি তার হাতের টর্চ লাইটটি ফেলে দেয়। আমার চিৎকার থামে না। প্রবল হিংস্রতার সাথে আমি পুলিশটির দিকে ছুটে যাই।
পুলিশটির চোখে নির্জলা আতঙ্ক দেখে আমার উল্লাস হয়। ব্যটা পড়ি কি মড়ি করে ছুট লাগায়। আমি কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ি। আমি কি ওকে তাড়া করে যাব? না আবার চাঁদের আলোর যাত্রা শুরু করব?
রাস্তা থেকে আমি পাশের অন্ধকার পার্কে ঢুকে পরি। পার্কের ঘাস ভেজা, রাতে কি শিশির পড়ছিল? পার্কগুলো বোধ হয় কখনই সম্পূর্ণ নির্জন হয় না।
আমি একটি ঝপের আরালে একজোড়া ছায়ামুর্তি দেখতে পাই। ড্রাগ এডিক্ট। ঠিক আমার মতই। ছায়ামূর্তি দুটো আমার চলার সাড়া পেয়ে নড়ে উঠে। ঝোপ থেকে গলা বাড়িয়ে আমাকে দেখার চেষ্টা করে।
আমি ভ্রুক্ষেপ না করে এগিয়ে যাই। কিছু দূর যেতেই এরকম আরও কিছু মাতাল ও মাদকাসক্ত চোখে পরে। আচ্ছা ওদের তো নেশার ঘোরে বেহুশ থাকার কথা। কিন্তু ওরা আমার চলাচল লক্ষ করছে। আমি বুঝতে পারছি আমার উপস্থিতি ওদের মনে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে।
কিন্তু ভয় পেয়ে ওরা সরে যাচ্ছে না। বরং নিজেদের অন্ধকার কোন থেকে বেরিয়ে আসছে। আমার মধ্যে কিছু একটা ওদেরকে আকর্ষণ করছে। চাঁদ আমাকে যেভাবে আকর্ষণ করে।
ওরা আমাকে আস্তে আস্তে ঘিরে ফেলছে।
ওরা সবাই নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। ওদের সবার চোখ লাল। ওদের কারো হাতে ভাঙা কাঁচের বোতল, কারো হাতে ভোতা ছুরি, কেউবা খালি হাতেই এগিয়ে আসছে। কেউ কোন কথা বলছে না, শুধু আস্তে আস্তে আমাকে ঘিরে ফেলছে। সঙ্খায় ওরা এখন অনেক।
ওদের সবার রক্ত চক্ষু আমার উপর নিবদ্ধ।
ওদের আতঙ্ক অতি দ্রুত আক্রোশে পরিনত হয়। ময়লা ধারালো দাঁতের উপর থেকে ঠোট সরে যায়। রক্ত লোভি হায়নার মত ওরা আমার উপর ঝাঁপিয়ে পরে।
আমি হেসে উঠি।
ভোর হচ্ছে।
ভেজা ঘাসের উপর আমি শুয়ে আছি। আমার চারপাশের ঘাসে ছোপ ছোপ রক্ত। আমার রক্ত নয়।
একটা টোকাই টাইপের বাচ্চা আমাকে আগ্রহ নিয়ে দেখছে।
আমি একটু নড়ে উঠতেই সে ছিটকে সরে গেল।
ঘাসের উপর লম্বা লম্বা পা ফেলে কেউ একজন এগিয়ে আসছে। মানুষটি দুহাতে আমাকে তুলে ধরে। তারপর একরকম কাঁধে বয়ে নিয়ে যায় রাস্তার ধারে পার্ক করা একটা গাড়ির কাছে। সে আমাকে গাড়ির ব্যক সিটে শুইয়ে একটা চাদরে আমার নগ্ন শরীরটা ঢেকে দেয়।
মানুষটার মুখ আমার কাছে পরিষ্কার হয়। জসিম চাচা। চাচা গাড়ি স্টার্ট দেয়। গভির অবসাদে আমি
আবার চোখ বন্ধ করি।
***
সন্ধ্যায় বাবার সাথে দেখা হয়।
হাতের মোটা কফির মগে চুমুক দিতে দিতে সে বলে, “তোমার কন্ডিশন দিন কে দিন আরও ক্রিটিক্যাল হচ্ছে। ” আমার বাবা নুরুল হুদা। প্রতিভাবান বায়োকেমিস্ট। দির্ঘ দিন টেক্সাসের ক্রুজ-রেইস ল্যব্রেটরিতে কাজ করেছে। অবশেষে সহকর্মীদের সাথে কি নিয়ে ঝগড়া ঝাটি করে দেশে চলে এসেছে।
বাবা আবার বলল, “তোমাকে আরও চেষ্টা করতে হবে নাফিজ। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালে চলবে না। ”
আমি উত্তর দিলাম না। বাবার বেশির ভাগ প্রশ্নেরই আমি উত্তর দেই না। দুনিয়ায় আমি যে কয়টা পোকাকে সবচে বেশি ঘৃণা করি তার মধ্যে দুই নম্বরে আছে তেলাপোকা, আর এক নম্বর হল আমার বাবা নুরুল হুদা।
আমি ঘরে ঢুকে দরোজা আটকে দেই। হালকা ভলিউমে পোয়েটস অফ দ্য ফল এর লেট গুডবাই চালিয়ে দেই। দিনের বেশির ভাগ সময় আমার নিজের ঘরে গান শুনেই কাটে।
“নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালে চলবে না” বাবার কথাগুলো কানে বাজছে। মেজাজ খিঁচরে যাচ্ছে।
আমার এই দশার জন্যে বাবাই দায়ি। তার জন্যেই আমি ড্রাগ এডিক্ট হয়েছি, তার জন্যেই এখন আমার গভির রাতে নগ্ন হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হয়। অথচ এখন উপদেশ দেয়া হচ্ছে, “তোমাকে আরও চেষ্টা করতে হবে। ” ফাক ইউ।
আমার বাবা আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছে।
সে শুধু আমার জীবনই শেষ করেনি, আমার মায়ের জীবনটাও ছারখার করে দিয়েছে। তার কারনেই মা সুইসাইড করেছে। আমার বাবার কাছে তার কাজের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পুর্ন আর কিছু নেই। সায়েন্স তার কাছে ধর্মীয় উপাসনার মত, হয়তো তার চেয়েও বেশি কিছু। টেক্সাসে থাকতে দেখেছে বাবার চরম অবহেলায় মা একটু একটু করে স্লিপিং পিলে আসক্ত হয়ে পড়তে।
মা মারা গেল তাদের বিবাহ বার্ষিকীর দিন। একসাথে অতিরিক্ত হুইস্কি আর স্লিপিং পিল গিলে।
মায়ের মৃত্যুর পর আমার জীবনটা পুরা এলমেল হয়ে গেল। কিচ্ছু ভালো লাগত না। এই সময় ত্রানকর্তার ভুমিকায় আবির্ভূত হল জেনি।
জেনি আমার এক ক্লাস উপরে পড়ত। গথ টাইপের মেয়ে, দারুন সেক্সি। ওদের একটা গথ ব্যন্ড ছিল, গান বাজনায় তেমন ভালো ছিল না। সারা দিন মেথ নিয়ে হাই হয়ে থাকত। ওদের গথিক লাইফ স্টাইলের প্রতি আকর্ষণ আর জেনির শরীরের লোভে আমি ওদের ব্যন্ডে ভিরে গেলাম।
আর সেই সাথে অফুরন্ত মেথ আর পট তো ছিলই। জীবন আবার সহজ হয়ে উঠল।
কিন্তু আমার সুখ তো আমার বাবার সইবে না। সে ক্রুজ রেইসে নিজের সহকর্মিদের সাথে কথা কাটাকাটি করে কাজে ইস্তফা দিয়ে দিল। নিজের চারটা প্যটেন্টর কল্যানে ব্যঙ্কে তার মোটা অঙ্কের অর্থ জমা ছিল।
সে সব টাকা তুলে আমাকে নিয়ে সোজা বাংলাদেশে চলে এল। আমার সাজানো পৃথিবীটা আবার তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ল।
আমি ড্রয়ার খুলে হলুদ একটা বাধানো নোটবুক বের করলাম। এটা আমার উইশ-বুক। আমি লাইফে যে যে কাজগুলো করতে চাই তা এই উইশ-বুকে টুকে রাখি।
নোটবুকটা অনেক পুরনো। আমার সপ্তম জন্মদিনে মা গিফট করেছিল। অনেক দিন আর উইস-বুকে নতুন কোন উইশ লেখা হয় না। তবে আমি মাঝে মাঝেই বই খুলে পুরনো উইশ গুলো পরি। এটলান্টিক পাড়ি দেয়া, ফায়ার ম্যান হয়া... কত উইশ।
বইয়ের সব শেষের উইশটি হচ্ছে... বাবাকে খুন করা...
অডিও সিস্টেমে বাজছে ... I can't breathe easy here, less our trail's gone cold behind us...Till' in the john mirror you stare at yourself grown old and weak... And we keep driving into the night...It's a late goodbye, such a late goodbye...
***
প্রায় এক সপ্তাহ পর ক্যম্পাসে আসলাম। বাংলাদেশে এসে আমরা উঠেছি আজিমপুরে দাদার বাড়িতে। দাদা দাদি অনেক আগেই মারা গেছে। বাড়িতে থাকে শুধু জসিম চাচা। মানুষটা বিয়ে-থা করেনি।
কোন কারনে তিনি আমাকে অসম্ভব পছন্দ করলেন। বাবার অবহেলার জায়গাটুকু তিনি নানা ভাবে আদর পুরন করার হাস্যকর চেষ্টা করেন। চাচার চেষ্টায় বুয়েটে চান্স পেয়ে গেলাম। অবশ্য চাচাকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। টেক্সাসে মিউজিক আর মেথ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও কোন এক আশ্চর্য কারনে আমার গ্রেড বরাবরই ভালো ছিল।
ডিপার্টমেন্ট অফ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রথম বর্ষের ক্লাস। বুড়ো মতন একজন টিচার ক্লাস নিচ্ছান। উনি ফিসফিস করে কি যে পড়াচ্ছেন সেটা উনার নিজের কান অব্দি পৌচাচ্ছে কিনা সন্দেহ। তা যা হোক, আমি উনার লেকচার শুনার জন্যে ক্লাসে আসিনি। আমি ক্লাসে এসেছি সুস্মিতাকে দেখতে।
সুস্মিতা সামনের সাড়িতে বসে। সব সময় চুল খোলা রাখে। আজ একটা নিল কামিজ পরে এসেছে। ওর মুখটা দেখতে লাগছে লাইক আ ডিউ ড্রপ অন আ ব্লু রোজ। সুস্মিতাকে দেখতে দেখতে আমি উদাস হয়ে যাই।
মেয়েটার সাথে কখনো কথা বলিনি। কখনো কথা বলা হবে না। ক্লাসের প্রায় কারোর সাথেই আমার কথা হয় না। এরা সবাই আমাকে কোন এক অজানা কারনে এড়িয়ে চলে। ওরা আমাকে যে অপছন্দ করে বা ভয় পায়, তা নয়।
তবুও আমার উপস্থিতি কেন জানি না ওদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি সৃষ্টি করে। আমি টের পাই। আমি নিজে গায়ে পরে কারো সাথে কথা বলতে যাই না। আমি হপ্তায় এক-দুই দিন ক্লাসে আসি। পেছনের দিকের একটা ডেস্কে বসে সুস্মিতাকে দেখি ক্লাস শেষে কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরে বাড়ি চলে যাই।
কারো সাথে কথা হয় না, কারো সাতে-পাচে নেই। ক্লাসের অনেকেই আমার হেরোইন এডিকশনের কথা জানে। বুয়েটে ভর্তি হয়ার সাথে সাথেই জসিম চাচার প্রবল আপত্তি সত্তেও আমি হলে উঠে যাই। বাবার সাথে এক ছাদের নিচে থাকার রুচি হয় না। হলে আমার রুম মেট ছিল হায়দার ভাই।
আর্কিটেকচারে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। বাম রাজনীতির সাথে জড়িত। মানুষ হিসেবে অসাধারণ। তবে হায়দার ভাইয়ের আরও একটা পরিচয় ছিল যে কারনে আমরা সবাই তাকে ভালবাসতাম। দুনিয়ার সকল প্রকার ড্রাগ তার হাতের নাগালে ছিল।
যখন যা চাইতাম হায়দার ভাই এনে দিতেন। তার মাধ্যমে একদিন পরিচয় হল চারুকলার শামিম ভাইয়ের সাথে। স্কাল্পচার নিয়ে পড়াশুনা করেন। শামিম ভাইয়ের হাত ধরেই আমার হিরোইন নেয়া শুরু। মাস তিনেকের ভেতরেই আমি সম্পূর্ণ আসক্ত হয়ে গেলাম।
হলের ছেলেরা আমাকে বাড়িতে রেখে এল। জসিম চাচা আমাকে রিহ্যবিটেশন সেন্টারে ভর্তি করে দিলেন। আমার নিজের বাবা আমার খোঁজও নিল না। দুই দিন রিহ্যাবে থেকেই আবার পালালাম আমি। গিয়ে উঠলাম শামিম ভাইয়ের মেসে।
চলল হিরোইন সেবন।
ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। সবাই ব্যগ গুছিয়ে উঠে পড়ছে। আমার উঠতে ইচ্ছে করছে না। সুস্মিতাও ব্যগ গুছিয়ে নিয়েছে।
ও এখন কি কি করবে আমি জানি। বন্ধুরা মিলে ক্যম্পাসে কিছুক্ষণ আড্ডা দেবে। তারপর একটা রিক্সা নিয়ে মল চত্বর যাবে। সেখানে ওর জন্যে সাইমুম অপেক্ষা করে আছে। ওরা দু’জন মিলে কিছুক্ষণ এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াবে, কার্জন হলের পুকুর পারে বসে থাকবে, ভেল পুড়ি খাবে।
আর আমি দূর থেকে ওদের অনুসরণ করব।
সাইমুমের সাথে সুস্মিতার পুরানো সম্পর্ক। ছেলেটা ফাইন্যান্সে পড়ে। তেমন একটা লম্বা না, কিন্তু চমৎকার চেহারা। ব্যপক ব্রিলিয়ান্ট।
প্রায়ই এখান সেখান থেকে মেডেল জিতে আসছে। গত মাসেও ইউএসের কোন এক ইউনিভার্সিটি থেকে বিজনেস কম্পিটিশনে চ্যম্পিয়ন হয়ে এসেছে। ডিবেটিং, ফুটবল সব কিছুতেই এক নাম্বার। সবাই ওকে পছন্দ করে। প্রেমে পড়ার মতই ছেলে।
ছেলেটাকে দেখলেই আমার পায়ের বুড়ো আঙুল থেকে মাথার তালু পর্যন্ত আগুন ধরে যায়। ইচ্ছে করে একটা ইট দিয়ে ওর মাথাটা ছেচে দেই। কিন্তু সমস্যা হল এই যে সাইমুম ছেলেটা আসলেই ভাল। সুস্মিতা এমন ছেলেরই যোগ্য। তাই ওর মাথা ছেচে দিলেও আমি সত্যিকারের শান্তি পাব বলে মনে হয় না।
সুস্মিতা মল চত্বরের গেটে পৌছে গেছে। সাইমুম ওকে দেখে হাত নাড়ছে। সুস্মিতা রিক্সা থেকে নেমে হাসিমুখে সাইমুমের হাত ধরল। আমার ব্রহ্মতালু জ্বলে গেল। মুখে একটা তিক্ত স্বাদ নিয়ে আমি সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে চায়ের দোকানে বসলাম।
আজ আর ওদের পিছু নিতে মন চাইছে না। চায়ের সাথে একটা সিগারেট ধরিয়ে আমি নিজের মধ্যে ডুব দিলাম।
আচ্ছা সাইমুম যদি আমার মত ড্রাগ ধরে! সুস্মিতাকে কি তখনও ওকে এমনি করে ভালোবাসবে? তবে সাইমুম যতই ড্রাগ নেক আমার মত অবস্থা তো আর ওর হবে না। ওকে কখনো জ্যোৎস্না রাতে ন্যেংটো হয়ে রাস্তায় দৌড়াতে হবে না। টহল পুলিশ আর নেশাখোরদের সাথে কামড়া-কামড়ি করতে হবে না।
আমার ভেতর এখন অন্য কিছু একটা আছে। সেই অন্য কিছুটা প্রতি রাতে জেগে উঠে। আমি চেষ্টা করি নিজেকে ধরে রাখতে। কিন্তু অমাবস্যা পূর্ণিমায় আমার ভেতরের সেই অন্য কিছুটা প্রচন্ড শক্তিশালী হয়ে উঠে। তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারি না।
আমার সারা শরীর ভেঙে চুরে পাল্টে যায়। তখন আর আমি আমার মধ্যে থাকি না। কি অসাধারণ কি প্রচন্ড মাদকতাময় সেই পরিবর্তন। একমাত্র জসিম চাচা ছাড়া আর কেউ আমাকে সেই রুপে দেখেনি। সেই রাতে জসিম চাচার চোখের দৃষ্টি আমার এখনো মনে আছে।
রোদ বাড়ছে। সিগারেট ফেলে যখন উঠতে যাব তখন বিপত্তি বাঁধল। আমি হেঁটে চলে আসছি এই সময় পেছন থেকে কেউ আমার কাঁধে হাত রাখল, “এই যে শুনেন”
আমি ফিরে তাকালাম।
“সিগারেটটা কই ফেলসেন, দেখসেন?” প্রশ্নকর্তা মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা একটা ছেলে।
আমি বললাম “না দেখি নাই”
“আপনার সিগারেট যে ভাইয়ের পায়ে গিয়া পড়ছে খেয়াল আছে?”
“তাই নাকি? তো এখন কি করতে হবে?”
“যান গিয়া ভাইয়ের কাছে মাফ চাইয়া আসেন”
আমি গলা বাড়িয়ে দাড়িওয়ালার ‘ভাই’কে দেখার চেষ্টা করলাম।
সম্ভবত চায়ের দোকানে বেঞ্চে বসা লাল শার্ট পড়া মানুষটা। আমি কথা না বলে ফিরে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। দাড়িওয়ালা আমার হাত চেপে ধরল, “আরে কই যান? ভাইরে চিনেন? তার লগে বেয়াদবি কইরা আবার গটগটায়া হাইটা চইলা যান। আপনার এত সাহস”
আমি দেখলাম আশে পাশের কিছু মানুষ কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। তাদের কেউ কেউ একটু ভয় পেয়েছে বলেও মনে হল।
এই ‘ভাই’ মানুষটি সম্ভবত হলের কোন পাতি নেতা। আমার কাছে এসবের সময় নেই। আমি কোন কথা না বাড়িয়ে ঠাস করে দাড়িওয়ালার গালে একটা চড় বসালাম। তারপর হাত ছারিয়ে নিয়ে নিজের পথে হাঁটতে শুরু করলাম। আমি পেছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারছি দাড়িওয়ালা গালে হাত দিয়ে মহা বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
দুপুরে আরেকটা ক্লাস আছে। সুস্মিতাকে আরেক দফা দেখার লোভে থেকে গেলাম। ক্লাস শেষে ফুলার রোড ধরে হেঁটে ফিরছি এই সময় সকালের ওই দাড়িওয়ালা আমার পথ রুখে দাঁড়াল। “আপনি আমার সাথে আসেন, ভাই ডাকে”
আমি শান্ত ভাবে বললাম, “তোমার ভাইকে বল আমার কাছে এসে কথা বলতে”
ছেলেটি এবার দুপুরের মত উত্তেজিত হল না, বলল “একটু এসে ভাইয়ের সাথে পরিচিত হয়ে যান বেশিক্ষন লাগবে না”
অন্য কেউ হলে ছেলেটিকে দেখেই উল্টো পথে হাটা দিত। কিন্তু আমি অন্য সবার মত নই।
আমার রক্ত ছলাত করে উঠল। মুখে নিজের অজান্তেই এক চিলতে হাসি খেলে গেল। বললাম, “চল তোমার ভাইয়ের কাছে”
ছেলেটি আমাকে জিয়া হলের এক নির্জন চিপায় নিয়ে গেল। গিয়ে দেখলাম সেখানে ‘ভাই’ গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। তার আশেপাশে আরও পাঁচ সাতটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।
হুম, ‘ভাই’ তাহলে পাতি নেতা না, রাঘব বোয়াল টাইপের কেউ। দাড়িওয়ালা আমার মাথায় চাটি বসিয়ে বলল, “যা, ভাইয়ের পা ধইরা মাফ চা। ” বাহ, আপনি থেকে তুই তে নেমে এসেছে।
আমার বুক উত্তেজনায় ধ্বক ধ্বক করছে। সারা শরিরে একটা উষ্ণ অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছে।
আমি সহজ ভাবে হেঁটে ভাইয়ের সামনে গেলাম। তারপর চট করে তার ঠোঁট থেকে সিগারেটটা কেড়ে নিয়ে তার গালে চেপে ধরলাম। গগন বিদারি চিৎকার দিয়ে ভাই ছিটকে সরে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় গোল হয়ে দাঁড়ানো বাকিরা কিছুটা হতচকিত হয়ে গেল। আবশ্য আমি ওদের সময় দিলাম না।
নিজেই সবচে কাছের জনের গলা লক্ষ করে লাফ দিলাম। তা দেখে বোধ হয় বাকিরা হুশ ফিরে পেল। সবাই একসাথে আমার দিকে ছুটে এল। তারপর কি হল আর মনে নেই।
সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা।
আঙুল নাড়াবার ক্ষমতা নেই। ভাসা ভাসা ভাবে কিছু কথা শুনতে পাচ্ছি। কেউ একজন চিৎকার করে বলছে, “ওই খবরদার কেউ এই পোলারে ধরবি না। ও এইখানেই পইড়া থাকব। যে ওরে ধরবি তারে কবর দিয়া ফালামু।
”
আবার অনেকক্ষণ কোন সাড়া শব্দ নেই। আমি কিন্তু জ্ঞান হারাইনি। কিন্তু চোখ খুলে তাকাতে পারছি না। রক্তে আমার চোখ ঢেকে গেছে। বুঝতে পারছি আশেপাশে দুই একটা ছেলে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছে।
কারুর এগিয়ে আসার সাহস হচ্ছে না। আরও কিছুটা সময় কেটে গেল, কতক্ষন আমি বলতে পারব না। হয়তো এক মিনিট, হয়তো এক ঘন্টা।
একটা চশমা পড়া পরিচিত মুখ আমাকে ঝুঁকে দেখল। তারপর দুহাতে মাটি থেকে টেনে তুলল।
ছেলেটির কাঁধে মাথা রেখে আমি জ্ঞান হারালাম।
***
শুয়ে আছি হাসপাতালের বেডে। আজকে হসপিটালে আমার ষষ্ঠ দিন। সাইমুম আমাকে প্রথমে রিক্সা করে নিয়ে এসেছিল ঢাকা মেডিক্যল। খবর শুনে জসিম চাচা ছুটে আসেন।
আমাকে ভর্তি করান সেন্ট্রাল হসপিটালে। সেখানেই চিকিৎসা চলছে। ডাক্তারের মুখে আমার আঘাতের যা বিবরন শুনলাম তা হল, ফ্র্যকচারড স্কাল, ফ্র্যকচারড আই সকেট, ডিসলোকেটেড শোল্ডার, ডবল ফ্র্যকচার রিব, সেমি-পাঙ্কচারড লাংস... আমি যে বেঁচে গেছি এটাই নাকি মিরাকল। জসিম চাচার মুখে শুনেছি যদি আমাকে হাসপাতালে আনতে আর একটু দেরি হত তাহলে আর দেখতে হত না। জসিম চাচা সারাক্ষন হাসপাতালে আমার সাথে আছেন।
রাতে আমার কেবিনেই ঘুমান। বাবা একদিন এসেছিল। কেবিনের দরোজায় দশ মিণিট দাঁড়িয়ে থেকে আবার চলে গেছে। সাইমুম এসেছিল একদিন। জসিম চাচা বারবার করে বললেন, সাইমুমের কাছে আমরা কতটা কৃতজ্ঞ।
সাইমুম আমার প্রান বাচিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার সারা মুখে ব্যন্ডেজ, কথা বলার উপায় নেই। খালি শুনে গেলাম। সাইমুম আমার হাত ধরে বলল, “জলদি ভালো হয়ে উঠো। ” ও আরও জানালো আমাকে নাকি প্রায় ছয় জন মিলে রড দিয়ে পিটিয়েছে।
ওদের ভাইয়ের আসল নাম কিবরিয়া। ছাত্রলীগের বড় ক্যডার। পিটিয়ে ফেলে যাওয়ার আগে সে সবাইকে শাশিয়ে বলেছিল কেউ যেন আমার কাছে না আসে, আমাকে যে সাহায্য করতে আসবে তারও একই অবস্থা করা হবে। সাইমুম আসার আগে আমি প্রায় ঘন্টাখানেক ওখানে পড়েছিলাম। ভয়ে কেউ আমার কাছে ঘেসার সাহস পায়নি।
সাইমুমের বাবা আর্মির কর্নেল। ও এসব ছাত্রনেতাদের পরোয়া করে না। খবর পাবার সঙে সঙে ছুটে এসেছে।
আমার রিকভারি দেখে ডক্টররা ভ্যবাচেকা খেয়ে গেল। আমার ক্ষত শুকাতেই নাকি এক মাস লাগার কথা।
আর মাস ছয়েকের আগে ফুল রিকভারি অসম্ভব। সেখানে মাত্র ছয় দিনে আমি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলাম। হাসপাতালের দিনগুলো দারুন ক্লান্তিকর হয়ে উঠল। খালি মনে হত আহা সুস্মিতা যদি একবার এসে দেখে যেত!
এখন গভির রাত। জসিম চাচা ভোস ভোস করে ঘুমাচ্ছে।
জানালার বাইরে ঘন অন্ধকার। আজ ঘোর অমাবস্যা। আমার ঘুম আসছে না। আজ রাতে আমার ঘুম হবে না। আমি অনুভব করতে পারছি আমার ভেতর কিছু একটা ধিরে ধিরে জেগে উঠছে।
আমার শরীরের পেশিগুলো টানটান হয়ে আসছে। আমার শরীরে পরিবর্তন আসছে, প্রতিটি কোষে তার সাড়া পরে গেছে। আমার মেরুদন্ডে যেন বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। প্রচন্ড একটা শক্তি আমার ভেতরে ফেটে পড়তে চাইছে। আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না।
জানালার বাইরের ওই নিশ্ছিদ্র আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
পরিবর্তন আসছে। পরিবর্তন।
আমি হাত থেকে আইভি-টা খুলে ফেললাম। তারপর চাদর ফেলে উঠে দাঁড়ালাম।
জসিম চাচা ঘুমাচ্ছে। তাকে না জাগিয়ে আস্তে আস্তে জানালাটা খুললাম। আমরা আছি চতুর্থ তলায়। নিচে ল্যম্প পোস্টের মড়া আলোয় পিচ ঢাকা রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে। আমি জানালা থেকে লাফ দিলাম।
প্রায় পঞ্চাশ ফিট উঁচু থেকে পতন, আমার জন্যে কিছু নয়। হাত ঝেড়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম। আজ আর আগের মত আমি তাল হারিয়ে ফেলিনি। এই প্রথমবারের মত নিজের উপর আমার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে। আমি জানি আমাকে কোথায় যেতে হবে।
দ্রুত আমি গায়ের কাপড় খুলে ফেললাম। তারপর ছুট লাগালাম মুল ফটকের দিকে। আমার গন্তব্য জিয়া হল।
***
পরের দিন কিবরিয়াসহ পাঁচ ছাত্রলিগ কর্মিকে মল চত্বরে বটগাছের বিভিন্ন শাখায় অচেতন অবস্থায় লটকে থাকতে দেখা গেল। তাদের অবস্থা মৃতপ্রায়, পড়নের কাপড় শতছিন্ন, শরীরের বিভিন্ন স্থানে গভির ক্ষতচিহ্ন।
কে তাদের এই দশা করেছে কেউ জানে না।
প্রায় দুই সপ্তাহ পর ক্যম্পাসে গেলাম। ডিপার্টমেন্টের বারান্দায় সুস্মিতাকে দেখলাম, দেয়ালে হেলান দিয়ে সাইমুমের সাথে গল্প করছে। সাইমুম সুস্মিতার চুল নিয়ে খেলা করছে, আমাকে দেখেই এগিয়ে এল, “আরে, তুমি এত তাড়াতাড়ি সেরে গেছ!” আমি সোজা এগিয়ে গিয়ে ওর শার্টের কলার চেপে ধরলাম। তারপর ওকে ঠেলে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বললাম, “তোর ধারনা তুই মহাপুরুষ হয়ে গেছিস? আমার জান বাঁচাতে তোকে কে বলেছে? আর যদি কখনো তোকে আমার সামনে দেখি তাহলে একবারে খুন করে ফেলব।
” আমি সাইমুমকে ছেরে দিয়ে সুস্মিতার দিকে তাকালাম। ওর অপূর্ব চোখ দুটোতে একই সাথে বিস্ময় ও ঘৃণা মিশে আছে।
আমি হাঁটতে শুরু করলাম। মাথার ভেতর সেই গানটা ঘুরছে ... And we keep driving into the night...It's a late goodbye, such a late goodbye...
(চলবে)
পরের পর্বঃ নিশাচর (Naked Phantom) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।