ঈসপ নামটিকে আমাদের শিক্ষিত প্রজন্মের কাছে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই। তাঁর নীতিগল্পগুলোর সাথে আমাদের প্রায় সবারই পরিচয় ছেলেবেলা থেকেই। মনে আছে যখন নার্সারিতে পড়তাম তখন মা'র কাছ থেকে জন্মদিনে 'ঈশপের গল্পসমগ্র' নামের বহুরঙা হার্ডকভারের বই পেয়েছিলাম। অনেকদিন দেশের বাইরে থাকার কারনে বইমেলায় যাওয়া হয়ে উঠেনি। আর এখন কর্মব্যস্ততায় শিশুতোষ রচনা বা ঈসপ কেউই আমার অবসরের অনুসঙ্গ হয়ে উঠেনা।
কিন্তু তারপর হঠাৎ করেই আবার এলো ঈসপ। সে প্রসঙ্গে যাবার আগে ঈসপ ইতিহাসে চোখ বুলাই।
কথিত আছে ঈসপ গ্রীসের সামোস অঞ্চলে জ্যানথাস নামে ভূস্বামীর ক্রীতদাস ছিলেন। কয়েকবার মালিকানা বদলের পর তিনি মুক্তি পান। পরিনত বয়সে তিনি লিডিয়ার রাজা ক্রসোসের কূটনীতিক হয়েছিলেন।
তাঁর গল্পকথনের শুরু কবে কিংবা তিনি কতটি গল্প 'লিখেছিলেন' কালের বিবর্তনে আর অন্যান্য অনুঘটকের কারনে তা আজ সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। যাদের প্যারী ইনডেক্স সম্বন্ধে ধারনা আছে তারা জানেন এই সংখ্যা অন্তত সাত শতাধিক। ঈসপের ব্যক্তিস্বত্তার ঐতিহাসিক সত্যতা থাকলেও তাঁর গল্প হিসেবে যে কাহিনিগুলোর সাথে আমাদের পরিচয় তার সবগুলোই কিন্তু তাঁর রচনা নয়। বরং নীতিজ্ঞানমূলক গল্পকথনের যে ধারা তিনি শুরু করেছিলেন তা লোকগল্প হিসেবে শতাব্দীর পর শতাব্দী নানা দেশে নানা ভাষায় বিভিন্ন লেখকের সংকলিত হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো এসব রচনা ঈসপের নামে পরিচিতি পেয়েছে।
তাইতো খ্রিস্টপূর্ব ৬২০ সালে প্রাচীন গ্রীসে জন্ম নেয়া ঈসপ দু'হাজার বছর পর সপ্তদশ শতকের জাপানি সংস্করনে চিত্রিত হয়েছেন জাপানি পোশাকে। হাজার প্রজন্মান্তরে ভূগোল, কাল কিংবা জাতিবিভেদের সীমা ছাড়িয়ে ঈসপের আখ্যানের আবেদন পরবর্তী হাজার বছরেও বিলীন হবার নয়।
এইতো সেদিন স্টোরে রাখা বইয়ের ট্রাংকে বইটি দেখে কেমন নস্টালজিক হয়ে গিয়েছিলাম। সাথে মনে পড়লো মিলো উইন্টারের বিখ্যাত “The Aesop for Children” বইটির কথা। সৌভাগ্যবশত আপাত দূর্লভ বইটির সত্তর দশকের রিপ্রিন্ট আমার দখলে আছে।
সেদিনের পুরনো বইয়ের ট্রাংকে ঈসপ পুনরাবিষ্কার আমাকে উৎসাহিত করলো আজকের এই লেখায়। বলে নেয়া ভাল আমার ঈসপ উৎসাহের যে অংশটুকু আপনারা পাঠকরা উপভোগ করবেন তার প্রাথমিক ভিত্তি মিলো উইন্টারের বইটি। আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি বইটি ১৯১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে র্যান্ড, ম্যাকনেলি এন্ড কোম্পানি প্রথম প্রকাশ করেছিল যা লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসের তথ্যানুযায়ী এখন 'পাবলিক ডোমেইন'র অন্তর্গত। সে হিসেবে তা যুক্তরাষ্ট্রে কপিরাইট আইনের আওতার বাইরে। আমার জানামতে বইটির বাংলাদেশ সংস্করন বা অনুবাদ প্রকাশিত হয়নি।
সেদিক দিয়ে বইটির অনুবাদ বা তা প্রকাশে কোনো আইনি বাধা নেই। আর ভাষান্তর সম্পূর্ন হলে আমি তা কপিরাইট করিয়ে নিব।
আমার ইচ্ছে একের পর এক গল্পগুলোর বাংলা ভাষান্তর সিরিজ হিসেবে ব্লগে প্রকাশ করা। এর পেছনে মূল লক্ষ্য দু'টি। প্রথমতঃ নতুন শিশু প্রজন্মসহ যারা ঈসপের গল্প সম্পর্কে এখনও তেমন কিছুই জানেন না তাদেরকে 'আঙুর ফল টক' কিংবা 'নির্বোধ কৌতুহল আর আত্নগরিমা কেবল দুর্বিপাক ডেকে আনে' - গল্পের মাধ্যমে এমন অনেক নৈতিক শিক্ষার পরিচয় করিয়ে দেয়া।
দ্বিতীয়তঃ ঈসপের অনেক গল্প নিয়ে বাংলায় একটা ই-বুকের বিষয়বস্তু তৈরী। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এখন পর্যন্ত ইন্টারনেটে বাংলা ই-বুকের নামে আমরা যা পাই তা হলো বইয়ের স্ক্যানড পিডিএফ বা হেইচটিএমএল সংস্করন। ইচ্ছে আছে বাংলা ভাষায় ই-বুক ওয়েবসাইট তৈরি করা যেখানে ওয়েবের পাশাপাশি এপ্লিকেশনের মাধ্যমে আইপ্যাড কিংবা মোবাইলে যে কেউ ই-বুক পড়তে পারবে। জানি যেতে হবে অনেক দুর এবং সেক্ষেত্রে আপনাদের সাহায্য চাইবো। তাই আর দেরি না করে শুরু করতে চাই।
কারন শুরু করা মানে অর্ধেক শেষ করা। নাহ এটি আমার কথা নয় - বহুল প্রচলিত একটি ফরাসী প্রবচনের বাংলা তা-ই দাড়ায়।
আমার অনুবাদ প্রচেষ্টা কতটুকু সফল তা বিচারের দায় পাঠকদের ঘাড়েই চাপালাম। আপনাদের সবাইকে শুভকামনা জানিয়ে ঈসপ সংগ্রহের প্রথম কিস্তি পেশ করছি।
রাজা অভিলাষী ব্যাঙেরা
ভেকরাজ্যের ব্যাঙেরা নিজেদের শাসন পরিচালনাতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল।
এত্তো স্বাধীনতাই তাদের বিগড়ে দিল যে তারা উদাস ভঙ্গিতে বসে চ্যাঁচাতো আর চাইতো এমন সরকার আসুক যার আড়ম্বর ও ক্ষমতা প্রদর্শন তাদের আমোদিত করবে আর তাদেরকে শাসনের মতো শাসন করবে। তারা ঘোষনা করলো এমন পানসে সরকার আর নয়। দেবরাজ জুপিটারের কাছে 'রাজা'র জন্য আকুল আবেদন জানাল তারা।
জুপিটার দেখলেন কেমন বোকা এই প্রানীগুলো। তাদের নিরস্ত করতে এবং তাদের বোঝাতে যে তারা তাদের 'রাজা' পেয়েছে সে লক্ষ্যে জুপিটার বিশাল এক গাছের গুড়ি ছুড়ে মারলেন পানিতে।
পানির ভীষন জাঁক থেকে বাচতে ব্যাঙেরা শর আর ঘাসে লুকালো। তারা ভাবল কি ভীষন অসুর টাইনা তাদের নতুন রাজা। কিন্তু শীঘ্রই তারা আবিষ্কার করল 'গুড়িরাজা' কতই না নিস্তেজ আর শান্তিপ্রবণ । অলপসময়ের মাঝে গাছের গুড়িটি ছেলে ব্যাঙদের পানিতে ঝাপ দেয়ার মাচায় আর বুড়ো ব্যাঙদের আড্ডাখানার রূপ পেল যেখান থেকে সরকারের ব্যাপারে জোরালো অভিযোগ গেল জুপিটারের কাছে।
ব্যাঙদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে এবার দেবতাদের অধিপতি এক সারস পাখিকে পাঠালেন ভেকরাজ্যের নৃপতি করে।
নতুন রাজা প্রমাণ দিল যে সে পুরনো গুড়িরাজা থেকে কতটা ভিন্ন ধাতুতে গড়া। সে ডানে বামে ব্যাঙদের ধরে গপাগপ মুখে পুরলো। তখন ব্যাঙরা বুঝল কি বোকামীই না তারা করেছে। তাদের বিলাপে জুপিটার শুনলেন নিষ্ঠুর অত্যাচারী শাসক সরিয়ে নেয়ার আকুতি।
"এখন কেন?" রেগে বললেন দেবরাজ, "এখনও তোমরা তুষ্ট নও? তোমরা যা চেয়েছিলে তা-ই পেয়েছ।
তোমাদের দুর্দশার জন্য তোমরাই দায়ী। "
গল্পটির দর্শনঃ যখন তোমার অবস্থার পরিবর্তন করতে চাইবে তখন এটা নিশ্চিত করা জরুরী যে তা যেন হয় ভালোর জন্য।
সিরিজের পরের গল্পগুলোঃ
নেকড়ে এবং তার ছায়া
ইঁদুর ও হাতি
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।