আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তিন বিপ্লবী- বিনয়, বাদল, দীনেশ

প্রবাসী ওরা বীর, ওরা আকাশে জাগাত ঝড় ওদের কাহিনী বিদেশীর খুনে গুলি বন্দুক বোমার আগুনে আজও রোমাঞ্চকর। – বিশ্ব বিশ্বাস ভারতবর্ষ তখন পরাধীন। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর যুদ্ধে স্বাধীনতার যে সুর্য্য অস্ত গেছিল, যে বিদেশী বেনিয়া কুচক্রী বৃটিশরা সেদিন আমাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছিল, তারা ক্রমে ক্রমে গ্রাস করে নিয়েছিল এখনকার ভারত,পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং বার্মা দেশগুলোকে। ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে স্বাধীনতার দাবী ক্রমে ক্রমে দানা বেধে উঠছিলো বৃটিশ ভারতে। ১৮৮৫ সালের কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হল।

১৯১৫ সালে মহাত্মা গান্ধী দক্ষিন আফ্রিকা থেকে ফিরে কংগ্রেসে যোগ দিলেন। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির সাথে দ্বিমত পোষন করতেন নেতাজী সুভাষ বোস। তিনি বিশ্বাস করতেন শুধুমাত্র সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই পরাধীনতার শিকল ছিড়ে ফেলা সম্ভব। তারই প্রস্তুতি হিসেবে ১৯২৮ সালের কোলকাতার জাতীয় কংগ্রেসের সম্মেলনে থেকে তিনি গোড়া পত্তন করলেন “বেঙ্গল ভোলান্টিয়ার্স” এর। এই বেংগল ভোলান্টিয়ার্সরাই সেদিন সশস্ত্র বিপ্লবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

সে দিনের সে আন্দোলনে গোটা ভারতবর্ষকে নেতৃত্ব দিয়েছিল বাংলা। যে তিন অকুতোভয় বাঙ্গালী বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন , দেশপ্রেমের বিরল দৃস্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তারা হলেন বিনয়, বাদল, দীনেশ। তারা আমাদের বাংলাদেশেরই সন্তান। তারা বিশ্বাস করতেন সাইমন বলিভারের সে উক্তিকে “স্বাধীনতা ছাড়া কারো পিতৃভুমি থাকতে পারে না” বাদল গুপ্ত- ১৯১২ সালে ঢাকার বিক্রমপুরের পূর্ব শিমুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। বিক্রমপুরের বানারীপাড়া স্কুলে পড়ার সময় শিক্ষক নিকুঞ্জ সেনের সংস্পর্শে এসে বিপ্লবে অনুপ্রানিত হন এবং নেতাজীর বেঙ্গল ভোলান্টিয়ার্স এ যোগ দেন।

বাদল গুপ্ত। দীনেশ গুপ্ত- ১৯১১ সালে মুন্সীগঞ্জের যশলং এ জন্ম নেন দীনেশ। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় বেঙ্গল ভোলান্টিয়ার্স এ যোগ দেন। কিছুদিন মেদেনীপুরে বিপ্লবীদেরকে আগ্নেয়াস্ত্র চালনার প্রশিক্ষন দেন দীনেশ। দীনেশ গুপ্ত।

বিনয় বসু - ১৯০৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর মুন্সীগঞ্জের রোহিতভোগ গ্রামে জন্ম নেন। পিতা রেবতীমোহন বসু ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। মেধাবী ছাত্র ছিলেন বিনয়। ম্যাট্রিক পাশ করে মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হন। ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু সেদিনের সে তরুন সমস্ত কিছুকে উপেক্ষা করে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবে , স্বদেশী আন্দোলনে। সে সময়ে বাংলাদেশ প্রধান দুটি বিপ্লবী সঙ্গঠন ছিল “যুগান্তর” এবং “ অনুশীলন” দল। মেডিকেল স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থাতে বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের কাছে বিপ্লবের দীক্ষা নেন। বেঙ্গল ভোলান্টিয়ার্স ঢাকা শাখায় যোগ দেন বিনয়। বিনয় বসু।

বিপ্লবীদের উপর পুলিসের অকথ্য অত্যাচারের বদলা নেওয়ার সংকল্প নেন। ১৯৩০ সালের ২৯শে আগস্ট পুলিসের ইন্সপেক্টর জেনারেল লোম্যান(Lowman ) গেছেন অসুস্থ্য বৃটিশ অফিসারকে দেখতে মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুল হাসপাতালে। প্রকাশ্য দিবালোকে মেডিকেল ছাত্র বিনয় গুলি করে হত্যা করলেন লোম্যানকে। লোম্যানের সঙ্গী পুলিস সুপারিনটেন্ডেন্ট হডসন গুরুতরভাবে আহত হলেন। পুলিস ঘিরে ফেলল এলাকা।

কে খুন করল? কোথায় সে? একে একে সবাইকে জেরা করল পুলিস। যে ঝাড়ুদার হাসপাতালের মেঝে ঝাড়ু দিচ্ছিল তাকেও জেরা কর হল। কিন্তু মুহুর্তের মধ্যে ঝাড়ুদার বনে যাওয়া বিনয়কে চিনতে পারল না পুলিস। পালালেন বিনয়। বিনয়ের সন্ধানদাতার জন্য ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষনা করল পুলিস।

কলেজ ম্যাগাজিন থেকে তার ছবি নিয়ে সমস্ত রেল স্টেশানে, ফেরীঘাটে টানিয়ে রাখা হল যাতে পালাতে না পারে বিনয়। আগস্ট মাস বাংলাদেশে বর্ষাকাল। ঢাকা নারায়নগঞ্জ রেলপথের মধ্যবর্তী স্টেশান দোলাইগঞ্জ। বর্ষায় জমে থাকা হাটু পানির মধ্য দিয়ে সকালবেলা ছেড়াখোড়া গেঞ্জী গায়ে দুজন দিনমজুর হেটে চলেছেন রেল স্টেশানের দিকে। রেলস্টেশনে পুলিসের সতর্ক পাহারা।

ট্রেনের প্রত্যেক কামরা তন্ন তন্ন করে পরীক্ষার করল পুলিস। দিনমজুর দুজন পুলিসের চোখকে ফাকি দিয়ে উঠে পড়লেন ৩য় শ্রেনীর কামরায়। বিনয় ভাল ভাবেই জানতেন নারায়নগঞ্জ স্টেশানে পুলিসের পাহারা থাকবে। সিগন্যালের কাছে ট্রেন গতি কমাতেই সঙ্গীকে নিয়ে নেমে পড়লেন বিনয়। পালাচ্ছেন বিনয়।

এবার স্টিমারে করে নারায়নঞ্জ থেকে গোয়ালন্দ, সেখান থেকে ট্রেনে করে কোলকাতা। স্টীমারে এবার জমিদারের চাপরাশি হলেন বিনয়। সঙ্গী জমিদার ছিলেন অপর বিপ্লবী সুপতি রায়। কোলকাতা পৌছে কেন্দ্রীয় স্টেশান শিয়ালদহের আগেই নেমে পড়লেন দমদমে। ঠাই হল মধ্য কোলকাতার ৭ নং ওয়ালিউল্লাহ লেন এর বস্তিতে।

বেশীদিন একজায়গায় থাকা নিরাপদ নয়। পুলিস তার পিছে লেগে আছে ভাল মতই আঁচ করতে পেরেছিলেন। ডেরা বদল করলেন। চলে গেলেন কাত্রস গড় কোলিয়ারীতে। সেখানে অল্প কিছুদিন থেকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ উত্তর কোলকাতার বাড়িতে আশ্রয় নিলেন তিনি।

বিনয় ভালভাবেই জানতেন পুলিস লেগে আছে পিছুপিছু। কোলকাতা পুলিসের কুখ্যাত সুপারিনটেন্ডেন্ট চার্লস টেগার্ট এর নেত্রীত্বে সেখানেও হানা দিল পুলিস। আগেভাগে আঁচ করতে পেরে পালিয়েছিলেন বিনয়। এই সময় সুভাষ বসু এবং স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বিনয়কে দেশত্যাগ করতে পরামর্শ দেন । লেডী রায় বিনয়ের বিদেশ যাওয়ার সমস্ত খরচ বহন করার প্রস্তাব দেন।

সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন বিনয়। তার কাছে ব্যাক্তিগত নিরাপত্তা ছিল তুচ্ছ। বারান্দার যুদ্ধ- কোলকাতায় বিনয় এর পরবর্তী লক্ষ্য হল রাইটার্স বিল্ডিং। ১৯১১ সালের আগ পর্যন্ত সারা ভারতবর্ষের রাজধানী ছিল কোলকাতা। তার সচিবালয় হল রাইটার্স বিল্ডিং।

ইনস্পেক্টর জেনারেল (প্রিজন) ছিলেন কর্নেল সিম্পসন ( Col NS Simpson )। জেলে বিপ্লবীদের উপর অতাচারে সিদ্ধহস্ত ছিলেন এই পুলিস অফিসার। বিপ্লবীরা সিদ্ধান্ত নিলেন সিম্পসনকে হত্যা করার। বেছে নেওয়া হল তিন তরুন বিপ্লবী বিনয়, বাদল এবং দীনেশকে। ১৯৩০ সালের ১০ই ডিসেম্বর।

আগের দিন দুই বিপ্লবী বাদল এবং দীনেশ সরেজমিনে দেখে এসেছেন রাইটার্স বিল্ডিঙ্গয়ের আশপাশ। বিনয়ের পক্ষে সম্ভব ছিল না প্রকাশ্য দিবালোকে রাইটার্স বিল্ডিং এলাকায় যাওয়া। প্রফুল্ল দত্ত, সুপতি রায়, নিকুঞ্জ সেন এবং রসময় সুর সবাই মিলে ছবি একে বিপ্লবীদের বুঝিয়ে দিলেন রাইটার্স বিল্ডিংয়ের ভিতরটা। রসময় সুরকে সাথে নিয়ে ট্যাক্সি বদল করে ঠিক দুপুর বারোটায় রাইটার্স বিল্ডিং পৌছলেন তিন বিপ্লবী। তিনজনেই ইউরোপীয় পোষাক পরা সাহেব।

পিওনের হাতে ধরিয়ে দিলেন নতুন ভিজিটিং কার্ড “ মিঃ বি,এন, দে” অনুমতি মিলল ভেতরে যাওয়ার। সাহেব সিম্পসন তখন টেবিলে ঝুকে পড়ে কাগজ দেখছেন। তিনজন ভিতরে ঢুকতেই মুখ তুলে চাইলেন সাহেব। “ফায়ার” চিৎকার করে উঠলেন বিনয়। গুলি চালালেন তারা।

মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন সিম্পসন। সাহেবের পি,এ টেবিলের নীচে লুকিয়ে বেচে গেলেন। তিনজনে বেরিয়ে এলেন সিম্পসনের ঘর থেকে। কিন্তু ততক্ষনে পাহারা রত পুলিস এগিয়ে আসছে বারান্দা দিয়ে। এগিয়ে আসছেন কুখ্যাত পুলিস কমিশনার চার্লস টেগার্ট।

বৃটিশদের হাতে ধরা দেবেন না তারা এমন সংকল্প ছিল তাদের। যতক্ষন রিভলভারে গুলি ছিল তারা এই অসম যুদ্ধ করে গেলেন। সামনে যে বৃটিশকে পেলেন তাকেই গুলি করলেন তারা। তাদের গুলিতে আহত হলেন অপর দুইজন বৃটিশ সাহেব- নেলসন এবং টিয়ানম্যান। রাইটার্স বিল্ডিং থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব ছিল না তা ভাল ভাবেই জানতেন তিন বিপ্লবী।

তারা জানতেন মৃত্যুকেই তারা বরন করতে যাচ্ছেন। ফুরিয়ে এসেছে গুলি। আশ্রয় নিলেন সচিবালয়ের খালি পাসপোর্ট ঘরে। সেখানে চেয়ারে বসেই সায়ানাইডের ক্যাপসুল খেলেন বাদল। আর নিজেদের রিভলভার দিয়ে নিজেদেরকে গুলি করে আত্মহত্যার চেস্টা করলেন বিনয় এবং দীনেশ।

হাসপাতালে মারা যান বিনয়। হাসপাতালে অজ্ঞান অবস্থায় বিনয় উচ্চারন করেছিলেন দুর্বোধ্য শব্দ “লেফট রাইট লেফট। দীনেশ বেচে ওঠেন। তাকে বিচার করে ফাসি দেয় ইংরেজ সরকার ১৯৩১ সালের ৭ই জুলাই । জেলখানা থেকে অনেকগুলো চিঠি লেখেন দীনেশ।

সে চিঠিতে জেলে নেতাজী সুভাস বোসের পদধুলি নিতে পারার কারনে নিজেকে ভাগ্যবান হিসেবে বর্ননা করেন দীনেশ। এই তিন বিপ্লবী স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরন করে, দেশের জন্য জীবন দিয়ে আজ অমর। স্বাধীন ভারতে কোলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং এর সন্নিকটবর্তী ডালহৌসী স্কোয়ারের নাম করন করা হয়েছে বিনয় বাদল দীনেশ বাগ বা সংক্ষেপে “বি,বা, দী বাগ” সূত্রঃ- ১)এখানে ২) এখানে ৩) এখানে ৪) এখানে ৫) এখানে ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।