ক্ষুধার্ত থেকো, বোকা থেকো। ইতিহাসের পাতায় মিটফোর্ড হাসপাতাল (Mitford Hospital) :
বুড়িগঙ্গা নদীর তীর থেকে তৎকালীন মিটফোর্ড হসপিটাল।
স্যার রবার্ট মিটফোর্ড প্রথম ১৮২০ সালে মিটফোর্ড হসপিটালটি প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। স্যার রবার্ট মিটফোর্ড তৎকালীন ঢাকার কালেক্টর ছিলেন এবং দীর্ঘদিন তিনি প্রাদেশিক আপীল বিভাগের বিচারপতি ছিলেন। তার সময়ে ঢাকাতে কলেরা ব্যাপকভাবে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রতিদিন প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ জন মারা যেত।
মেডিকেল সুবিধা তখন খুবই অপর্যাপ্ত ছিল। স্যার মিটফোর্ড এই অবস্থা দেখে খুবই ব্যথিত হন। তিনি ইংল্যান্ডে মৃত্যুর(১৮৩৬) আগে উইল করে তার প্রচুর সম্পত্তি (তখনকার সময় প্রায় ৮ লক্ষ টাকা) এই অঞ্চলে হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠাসহ অন্যান্য নানা উন্নয়ন কর্মের জন্য তৎকালীন বাংলার সরকারকে দান করে দিয়ে যান। কিন্তু পরবর্তীতে তার উত্তরাধিকারীদের জন্য এই উইল নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। কিন্তু ১৮৫০ সালে সর্ব্বোচ্চ আদালতের চ্যান্সারি বিভাগের (chancery court) রায় অনুযায়ী বাংলার সরকার মিটফোর্ডের সম্পত্তি থেকে ১ লক্ষ ৬৬ হাজার টাকা লাভ করে।
পরবরর্তীতে লর্ড ডালহৌসির উদ্যোগে এই ফান্ড দিয়ে ১৮৫৪ সালে বর্তমান স্থানে হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তারও আগে এই স্থানটি ডাচ কুঠি হিসেবে ব্যবসার কাজে ব্যবহৃত হত। হসপিটালটি প্রতিষ্ঠায় বেশ কয়েকজন স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যক্তিও অর্থসাহায্য প্রদান করেন। তাদের মধ্যে মিসেস সন্তোশ রানী দিন্ময় চৌধুরী, মিঃ রায় গৌর নেতাই সাহা শঙ্খনিধি, মিঃ সন্তোশ রাজা মন্মোথ রায় চৌধুরী এবং বাবু প্রতাপ চন্দ্র দাশ সুপেয় পানি ও স্যুয়ারেজ প্লান্ট স্থাপনের খরচ বহন করেন।
তৎকালীন মিটফোর্ড হসপিটালের একাংশ।
৪ বছর টানা কাজের পর ১৮৫৮ সালের ১লা মে মিটফোর্ড হসপিটাল আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। তখন এতে পুরুষদের জন্য দুটি ও মহিলাদের জন্য একটি ওয়ার্ডসহ ৮২টি বেড ছিল। এই হাসপাতালটিই হল ব্রিটিশ শাসিত তৎকালীন পূর্ব বাংলার প্রথম জেনারেল হসপিটাল। শুরু থেকে এই হাসপাতালটি ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির একটি বোর্ডের অধীনে ছিল। ঢাকার নবাব খাজা আহসানুল্লাহ ও ভাঁওয়ালের রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায়ের দানে ১৮৮২ সালে হাসপাতালে মহিলাদের জন্য পৃথক একটি ওয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়।
নবাব আহসানুল্লাহ ১৮৮৮-৮৯ সালে একই সাথে ৫০ হাজার টাকা দান করেন একই এলাকায় ''Lady Dufferin Hospital'' প্রতিষ্ঠার জন্য। ১৮৮৭ সালে হাসপাতালে একটি ইউরোপিয়ান ওয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৮৮৯-৯০ সালে ভাগ্যকুলের রাজা শ্রীনাথ রায় ৩ লক্ষ টাকা ব্যয়ে তার মায়ের স্মরণে হাসপাতালে একটি চক্ষু ইউনিট প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৭ সালে এটি প্রথম শ্রেণীর হাসপাতাল হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
বর্তমান মিটফোর্ড হসপিটালের একাংশ।
বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে প্রায় ১২.৮ একর জায়গা জুড়ে হাসপাতালটি অবস্থিত। হাসপাতালটি ইনডোর এবং আউটডোর ট্রিটমেন্টের পাশাপাশি প্যাথোলজিক্যাল ও ডায়াগনস্টিক সার্ভিস প্রদান করে থাকে। বর্তমানে হাসপাতালটি প্রতিদিন প্রায় ২৫০০ আউটডোর রোগীকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করছে। ১৯৯৯ সাল থেকে হাসপাতালে ৬০০ বেড (২৪০ টা পেয়িং) থাকলেও প্রতিদিন প্রায় ১০০০ জনেরও বেশি ইনডোর রোগী হাসপাতালে অবস্থান করে।
বর্তমান মিটফোর্ড হসপিটালের একাংশ।
এদেশের সবচেয়ে প্রাচীন এবং উপমহাদেশেরও প্রথমদিকের এই ঐতিহ্যবাহী হাসপাতালটি ২০০৮ সালের ১লা মে ১৫০ বছরে পদার্পণ করে। শুরু থেকেই এটি এদেশের মানুষদের বিশেষকরে অসহায়, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদেরকে চিকিৎসাসেবা প্রদানে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে আসছে। আমরা আশা করি, ভবিষ্যতেও এটি গৌরবের সাথে চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে থাকবে।
ইতিহাসের পাতায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (Sir Salimullah Medical College) :
তখনকার সময়ে এদেশে মেডিকেল পড়ার জন্য কোন ইন্সটিটিউশন ছিল না। এজন্য মিটফোর্ড হসপিটালের নিকটেই বর্তমান স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজটি ১৮৭৫ সালের ১৫ই জুন ঢাকা মেডিকেল স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
পরবর্তীতে ঢাকা বিভাগের ডিসি W.R. Larmini ১৮৮৭ সালের এপ্রিলে একাডেমিক বিল্ডিং এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং ১৮৮৯ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলার গভর্নর Sir Stuart Caulvin এটি উদ্বোধন করেন। প্রায় ১৬ জন স্থানীয় রাজা ও দাতাদের সহায়তায় ১৮৮৯ সালে মেডিকেল স্কুল বিল্ডিংটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রথম বছর প্রায় ৩৮৪ জন ভর্তি হয়। তখন এখান থেকে স্টেট মেডিকেল ফ্যাকাল্টির অধীনে চার বছর মেয়াদী LMF (Licentiate of Medical Faculty) কোর্সের ডিপ্লোমা ডিগ্রী প্রদান করা হত। ১৯৫৭ সাল থেকে LMF কোর্স বাতিল করা হয়।
১৯৬২ সালে এটি মেডিকেল কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নবাবদের দানশীলতার স্বীকৃতিস্বরূপ মেডিকেল কলেজটির নাম রাখা হয় নবাব স্যার সলিমুল্লাহর (১৮৭১-১৯১৫) নামানুসারে। Dr. AFM Nurul Islam ১৯৬৩ সালে প্রিন্সিপাল হয়ে শর্ট কোর্স চালু করেন। পরবর্তীতে প্রখ্যাত Professor Dr. Md Ibrahim প্রিন্সিপালের দায়িত্ব নেন এবং তার তত্বাবধানেই ১৯৭২ সালে এটি প্রথম পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল কলেজ হিসেবে যাত্রা শুরু করে এবং পরের বছর ১৯৭৩ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি এমবিবিএস ডিগ্রীর জন্য প্রথম ব্যাচের ক্লাস শুরু হয়। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে।
বর্তমানে মেডিকেল কলেজের একাডেমিক বিল্ডিং এর একাংশ।
১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ঢাকার সিভিল সার্জন এই হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। তারপর থেকে একজন করে প্রিন্সিপাল ও সুপারিন্টেনডেন্ট কে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৮৪ সালে সুপারিন্টেনডেন্ট কে হাসপাতালের ডিরেক্টর করা হয়। ২০০২ সালের জানুয়ারি থেকে প্রথম পোস্ট গ্রাজুয়েশনের কোর্স চালু হয়। বর্তমানে পোস্ট গ্রাজুয়েশন লেভেলে এই মেডিকেল কলেজ থেকে surgery, medicine, gynaecology, obstetrics প্রভৃতি বিষয়ে MD, MS and diploma প্রভৃতি ডিগ্রী নেয়া যায়।
গতবছর থেকে প্রায় ২০০জন স্টুডেন্ট এখানে এমবিবিএস কোর্সের জন্য ভর্তি হতে পারে। শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের পরেই স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেলের অবস্থান। বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের নানা দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র,কানাডা, পাকিস্তান, ইন্ডিয়া, নেপাল,মালয়েশিয়া, ভূটান থেকেও স্টুডেন্টরা এখানে পড়তে আসে।
বর্তমানে মেডিকেল কলেজের একাডেমিক বিল্ডিং এর একাংশ।
মেডিকেল কলেজটি নিম্নলিখিত ডিপার্টমেন্ট নিয়ে গঠিত : preclinical (anatomy, physiology, biochemistry, pharmacology), paraclinical (pathology, microbiology, forensic medicine, community medicine, pharmacology), clinical medicine (general medicine, psychiatry, neuromedicine, nephrology, cadiology, sexual-skin-and-venereal diseases), pediatrics, surgery (general surgery, orthopedic surgery, pediatric surgery, neurosurgery, cardiothoracic surgery), gynaecology and obstetrics, ophthalmology, otolaryngorhinology, anesthesiology and diagnostic (clinical laboratory, radiology and imaging).
পাদটীকাঃ আমি এই মেডিকেল কলেজের একজন ছাত্র।
আমার খারাপ লাগে যখন দেখি অন্যান্য লোকজন তো দূরের কথা, এই মেডিকেলের স্টুডেন্টরাই দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এই হসপিটাল ও মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস জানে না। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। নিজের খারাপ লাগা থেকে তাই ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করে সংক্ষেপে ঐতিহ্যবাহী এই হসপিটাল ও মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সংক্ষেপে লেখার চেষ্টা করলাম।
লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।