আজ থেকে তিন-চার বছর আগে যখন কুমিল্লার চিরচেনা পুরানো চেহারার নিউমার্কেটটি ভেঙে নতুন বহুতল ভবন নির্মান শুরু হয়েছিলো, তখন সবচেয়ে বেশী ফিল করছিলাম একটি জিনিস। আর সেটা হলো শওকত লিয়াকত হোটেলটির ভবিষ্যৎ। হোটেলটি থাকবে তো? নাহ, থাকলো না। ভাঙা হোটেলটা নিউমার্কেটের আধা ভাঙা যায়গার একটি অংশে জোড়াতালি দিয়ে কিছুদিন চালানো হলো। তবে অল্প কিছুদিন এভাবে চলার পর হারিয়ে গেলো কুমিল্লার কয়েক জেনারেশনের ভালোবাসার হোটেলটি।
নিউমার্কেটে ঢোকার পথের একই সারিতে এক কোনার সেই ট্রেডমার্ক যায়গায় অবস্থিত শওকত-লিয়াকত হোটেলটি শুধু তার খাবার দিয়ে নয়, আমাদের ছাত্রজীবনের ভীষণ নস্টালজিক সব স্মৃতি দিয়ে তা আমাদের মন জয় করে নিয়েছিলো। গত তিন চার বছরের কথা বাদ দিয়ে বিগত কয়েক দশক ধরে কুমিল্লাবাসীর মধ্যে এমন একজনও পাওয়া মুশকিল হবে যে শওকত-লিয়াকতের পরোটা ভাজি খায়নি।
ছেলেবেলার কুমিল্লা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বহু যায়গা ঘুরে পরোটা-ভাজি খেয়েছি, কিন্তু শওকত-লিয়াকতের মতো মুখরোচক কোনটাই এ পর্যন্ত খাইনি তা শতভাগ নিশ্চিত। আমার স্কুল জীবনে দেখেছি প্রতিটি পরোটা এক টাকা আর ভাজি দুই টাকা। আস্তে আস্তে সেটা পাঁচ আর দশে পৌঁছেছিলো, তবে স্বাদ কমেনি একটুও।
দোকানে ঢোকার মুখেই ছিলো পরোটার কারিগরি। বড় তাওয়াতে ডুবো তেলে পাতলা করে ভাজা হতো সে পরোটা। ঊঠানোর পর তা তলে চপচপে মনে হতো না বরং ছিলো খুবই ঝরঝরে এবং লঘু পাক ধরণের। বাইরে একটা ক্রিস্পি আবরণের ভেতর থাকতো নরম সুস্বাদু পরোটার মূল অংশটি। সাধারণতঃ সকল হোটেলে পরোটা চলে সকালে আর রাতের সময়টাতে।
কিন্তু শওকত-লিয়াকতের পরোটার কোন টাইম টেবিল ছিলো না। কাক ডাকা ভোরে শুরু হয়ে বন্ধের আগ পর্যন্ত চলতো পরোটা বানানো, বিরামহীন। এমনটাই বেশী হয়েছে যে, পরোটার অর্ডার দিয়ে আমরা গ্রুপ বাই গ্রুপ বসে আছি ভাজি নিয়ে, ওয়েটার সাপ্লাই দিয়ে কুলাতে পারছে না। পরোটা আনতে ভাজি ফুরায় অবস্থা।
ভাজিটাও ছিলো অনবদ্য।
আলু, পেঁপেঁ সহ আরো কয়েকটা সব্জির অনন্য এক মিশেল সে ভাজি, যার ভেতর আলুটাই বেশী ছিলো। সাথে মাখা মাখা ঝোল আর তিল দিয়ে সাজানো। এর গন্ধটাও ছিলো একেবারে অন্য ভাজি থেকে আলাদা। নিয়মিত আর পরিচিত কাস্টমার ছিলাম বলে সব ওয়েটার আমাদের একটু ‘এক্সট্রা খাতির’ করতো। আলাদা করে দিতো গরুর একটা সুস্বাদু ঝোল।
আমরা বন্ধুদের কেউ তিনটা, কেউ চারটা কেউবা পাঁচ-ছয়টা পর্যন্ত পরোটা খেয়ে উঠতাম এক বসায়। বলা বাহুল্য, এ শুধু বিকালের নাস্তা হিসাবেই আমরা খেতাম বেশীর ভাগ দিন, আর ভরা পেট নিয়ে বাসায় ফিরতাম। রাতের খাওয়ার জন্য আর যায়গা পেটে অবশিষ্ট থাকতো না।
আজও কুমিল্লা গেলে শওকত-লিয়াকতের জন্য মন কাঁদে আমাদের কয়েকটি প্রজন্মের। ভালোবাসা মাখা খাবার আর আড্ডার সে স্বাদ আর কোন রেস্টুরেন্টে বোধ হয় আমরা আর খুঁজে পাবো না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।