আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ব’ এর ত্রিভুজে যাবজ্জীবন

তুমি বৃথা কাকে সাজাই এই মৃত তরবারীতে দ্যাখো, এখানে এখোনো সারি সারি তাজা লাশ পড়ে আছে লিঙ্গের রাজনীতিতে ব’ এর ত্রিভুজে যাবজ্জীবন ২য় পর্ব-ব’তে বঙ্গ ব’তে বন্দী পার্হেলিয়ন মারমা পান্ডিত্য প্রচার বা শুধু লেখার প্রয়োজনে লেখা নয়, এই লেখাটি লিখেছি সমাজ-বাস্তবতার প্রয়োজনে এবং আমার অন্তর্দহন থেকে। আমার আগের লেখায় সহজ কথায় মনের কথা বলেছিলাম। সেটা কিছুটা satire ছিলো। এই লেখাটা আগের প্রসংগ ছাড়াও সামগ্রিকভাবে পাহাড়ে বর্তমানে রাষ্ট্রের আক্রমণের স্বরুপ খোঁজার চেষ্টা করেছি মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোকে। প্রবন্ধের মান ঠিক রাখতে গিয়ে যদি বিষয়বস্তুর আলোচনা-বিশ্লেষন বেশি জটিল করে থাকি তার দায় অবশ্যই আমার।

তবে আমি চাই যে বিষয়গুলো নিয়ে সর্বত্র আলোচনা হোক। এই লেখাকে সমৃদ্ধ করতে, আলোচনাকে প্রসারিত করতে আপনাদের মতামত প্রত্যাশা করছি। এখানে আমি বাংলাদেশের আদিবাসী সমাজে সাংস্কৃতিক Hegemony বা বঙ্গায়ন ধারণার অবতারণা করেছি। নতুন এই ধারনাটি নিয়ে আপনাদের কোন প্রশ্ন, ব্যাখ্যার প্রয়োজন থাকলে অনুগ্রহ করে যোগাযোগ করবেন। আপনারা নির্দ্বিধায় মতামত দিন, প্রশ্ন থাকলে জিজ্ঞেস করুন।

প্রবন্ধের নীচে আমার মেইল ঠিকানা দেওয়া হল। আমাদের মধ্যে সিরিয়াস লেখার প্রতি অনিহা আছে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরাও ক্লাস-লেকচারের বাইরে তাত্ত্বিক বিষয়গুলো সযত্নে এড়িয়ে চলেন। তাই নীচে বিষয়সুচী দেওয়া আছে যাতে আপনাদের আগ্রহের বিষয় ধরে আপনারা পড়তে পারেন। উল্লেখযোগ্য অংশগুলো কালারমার্ক করা হয়েছে।

আগেই বলেছি, আমার জন্য নয়- আপনাদের ভাবাতে চাই বলেই আমার এই লেখা। বিষয়সুচী: (১) পটভূমি/ ঐতিহাসিক ও বর্তমান প্রেক্ষাপট (২) আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর রাষ্ট্রের আক্রমণের ধরণ পালটে গেছে। ( বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রের অপ্রত্যক্ষ আগ্রাসনের(silent invasion) স্বরুপ উন্মোচন। (২-১) চিন্তার বঙ্গায়ন (bengalization of thought): বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আমাদের hegemonized, চেতনার দাসত্ব ও সংস্কৃতিশূন্যতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। (২.২) রাজনীতির যুক্তি-তক্কো আর গপ্পো (২.৩) বঙ্গায়িত আবেগ (আমার আগের লেখা “ব’তে বঙ্গ, ব’তে বন্দী”র দ্বিতীয় কিস্তি।

এখানে অপরাপর বিষয়গুলোর সাথে প্রাসঙ্গিক। ) (২-৪)পর্যটনের নামে পাহাড়, পাহাড়ের মানুষ ও আদিবাসী সংস্কৃতিকে পণ্য বানানো হচ্ছেঃ (MARKETIZATION OF HILLS, HILL PEOPLES AND NATURE) (১) পটভূমি/ ঐতিহাসিক ও বর্তমান প্রেক্ষাপটঃ জনসংখ্যা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিচারে বাংলাদেশের আদিবাসী জনজাতিসমূহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাতারে পড়ে। বাংলাদেশের আদিবাসীদের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে প্রসঙ্গক্রমে বিশ্বের আদিবাসী ও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর কথাও চলে আসে। সভ্যতার বিকাশ ও কালস্রোতে পৃথিবী থেকে একে একে হারিয়ে গেছে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী। ইউরোপীয় উপনিবেশিক( colonial) আগ্রাসনে হারিয়ে গেছে দক্ষিন আমেরিকার মায়া, ইনকা সভ্যতাসহ অপরাপর আদিবাসী জনগোষ্ঠী।

প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের আদিবাসীরা (aborigine/native)। উপনিবেশিক যুগের শেষে এখন উত্তর উপনিবেশিক যুগে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের রুপ-প্রকৃতি ও মাত্রাগত পরিবর্তন ঘটলেও আগ্রাসন থেমে নেই। বাংলাদেশের আদিবাসীদের উপর সাম্রাজ্যবাদী উত্তর উপনিবেশিক আক্রমণ এখনো প্রকট নয়। সবচেয়ে বেশি প্রকট ও ভয়ঙ্কর হল পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের অপর অংশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এক কথায় চতুর্মুখি সর্বগ্রাসী আক্রমণ। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে থেকেও গণহত্যার শিকার হয়েছি আমরা অনেকবার ।

বছর বছর পরিকল্পিত জাতিগত দাঙ্গা, পাহাড়ে সেটেলারদের পূণর্বাসন, বিভিন্ন সামরিক অপারেশনের মধ্য দিয়ে আমাদের প্রতি রাষ্ট্রের অভিপ্রায়(motive) স্পষ্ট হয়। পাহাড়িদের প্রতি রাষ্ট্রের সুদীর্ঘ বঞ্চনা, বৈষম্য, নিপীড়ন, অবিচার থেকে এটা পরিষ্কার বোঝা যায় যে, আমরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে অপাংক্তেয়। রাষ্ট্র আমাদের মাটি-পাহাড় ও প্রাকৃতিক সম্পদ চায়, আমাদের নয়। (২) আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর রাষ্ট্রের আক্রমণের ধরণ পালটে গেছে। ৯০ দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত জুম্ম জনতার উপর আর্মি-সেটেলাররা গণহত্যা চালিয়েছে।

সময় পালটেছে। এখন internet ¬¬এর প্রসার ও alternative media’র ¬¬¬¬¬উত্থান এর যুগে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের আগ্রহ, বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট তৎপরতা পুর্বের চাইতে বহুগুণ বেশি। তাই পূর্বের মত সেটেলার ও সামরিক-বেসামরিক বাহিনী দিয়ে গ্রাম উজার করে গণহত্যা চালানো সহজ নয়। কিন্তু রাষ্ট্রের ethnic cleansing policy’র বাস্তবায়ন থেমে নেই। রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভাবে আমাদের প্রান্তিকতায় (marginalization and alienation) ঠেলে দিতে রাষ্ট্রের সুদীর্ঘ প্রয়াস আমরা দেখি আমাদের সাংবিধানিকভাবে অস্বীকার করা, আমাদের উপর বাঙালি পরিচয় চাপিয়ে দেওয়া, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ethnic cleansing policy বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে।

রাষ্ট্র আমাদের “নিজভূমে পরবাসী” বানানো, আমাদের আত্মপরিচয় ভুলিয়ে দিয়ে আত্মমর্যাদাবোধ মেরে দেওয়া, সংখ্যালঘুকরন ( marginalizing and alienation), সাংস্কৃতিকভাবে নির্মূলিকরণ( cultural alienation and culturally annihilation), আমাদের বাজারজাতকরন( commercialization and marketizaton of cultures and peoples), “DIVIDE AND RULE” বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভ্রাতৃঘাতি সঙ্ঘাত উস্কে দেওয়া, আইনি-বেআইনি ভাবে হাজার হাজার একর পাহাড়িদের জমি বেদখল করার মাধ্যমে আমাদের ঠেলে দিচ্ছে বিলুপ্তির দিকে। একজন মানুষের পরিচয় তার সংস্কৃতিতে। বংশানুক্রমে লালিত, ঐতিহ্যগত উপায়ে প্রাপ্ত, যুগ সঞ্চিত জ্ঞান-অভিজ্ঞতা ও যাপিত জীবনের বিভিন্ন উপাদান তার ভাষায় প্রকাশিত হয়। সংস্কৃতি প্রকাশ পায় ভাষার মধ্য দিয়ে। প্রকৃতি, জীবন ও সমাজের মিথস্ক্রৃয়ায়, সংগ্রামে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সংরক্ষিত ও বিকশিত ভাবগত-মানবিক সম্পদের সঞ্চয়ে একেকটি জাতিসত্ত্বার ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, প্রথা, লোকাচার, বিশ্বাস, ঐতিহ্য গড়ে উঠে।

এই সম্পদ হারিয়ে যাওয়া মানে আত্মপরিচয় হারিয়ে যাওয়া, ছিন্নমূল হওয়া। নিজেকে হারিয়ে ফেলা। ব্যক্তির আমিত্বকে ছিনিয়ে নিলে তার আর আত্মমর্যাদা থাকে না। ছিন্নমূল সংস্কৃতি নিয়ে আত্মপরিচয়হীন ভাবে বাঁচার মানে আত্মমার্যাদাহীন ভাবে কায়েমী বাঙালি জাতির মহীরুহে পরাশ্রয়ী, অপাংক্তেয়, হীন হয়ে টিকে থাকা। সংস্কৃতিশুণ্যতার ফলাফল তাৎক্ষনিক নয় সুদূরপ্রসারী এবং মর্মান্তিক।

দিনের পর দিন যতই আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ধ্বংস হতে থাকবে ততই আমরা সংস্কৃতি শুণ্যতার প্রান্তে পৌঁছাবো। পৃথিবীর নিয়মে ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার আপন সত্ত্বা এভাবেই হারিয়ে যায়, মিশে যায় বৃহত্তর জাতির স্রোতে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে- আগামী কয়েক যুগ পরে বাংলাদেশের মাটিতে নাক চ্যাপ্টা-চোখ ছোট অর্থাৎ নৃতাত্ত্বিকভাবে মঙ্গোলয়েড কিছু মানুষ যাদের নামের শেষে চাকমা-মারমা-তঞ্চংগ্যা-ম্রো- টাইটেল আছে কিন্তু জীবন যাপনে, মননে, সংস্কৃতিতে, জাতিতাত্বিক পরিচয়ে বাঙালি জনগোষ্ঠী দেখা যাবে। অর্থাৎ নামে জুম্ম কিন্তু চিন্তা-মনন-সংস্কৃতি ও জীবন যাপনে বাঙালি। (২-১) চিন্তার বঙ্গায়ন (bengalization of thought): বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আমাদের hegemonized, চেতনার দাসত্ব ও সংস্কৃতিশূন্যতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে বৃটিশ যুগে উপমহাদেশে প্রথম শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছিলো শিক্ষাবিষয়ক কমিশনার লর্ড ম্যাকলে সাহেবের মাধ্যমে।

সেই শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য ছিল, “ এমন কিছু মানুষ তৈরি করা যারা রক্তে হবে ভারতীয় কিন্তু চিন্তায় হবে বৃটিশ। ’’ বৃটিশদের সেই শিক্ষাণীতির উদ্দেশ্য ছিল কিছু ভারতীয় কেরানি তৈরি করা যারা হবে তাদের একান্ত অনুগত, যারা স্বাধীনতাকামী হবে না, যারা চেতনায় তাদের দাসত্ব করবে। বৃটিশ ঢঙে বলন-চলন-জীবন যাপন করাকে আভিজাত্য এবং উন্নত মনে করে সেভাবেই জীবন যাপন করবে। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের মননকাঠামোয় আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব। বৃটিশরা তাই তাদের শিক্ষানীতি দিয়ে ভাববাদী দর্শণের সম্মোহক দাওয়ায় এবং অধিবিদ্যার গোঁজামিলে ভরা একটা পশ্চাৎপদ প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন।

তৎকালীন ভারতীয় অভিজাতদের মধ্যে এই বৃটিশ শিক্ষা-সংস্কৃতি ও জীবনব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য ও অনুকরণকে তাত্ত্বিক পরিভাষায় বলা যায় “cultural cringe”। cultural cringe একটি জনগোষ্ঠীকে নিয়ে যায় "cultural alienation" এর দিকে। তাত্ত্বিক পরিভাষায় বলা যায়, “The cultural cringe is tightly connected with "cultural alienation", that is, the process of devaluing or abandoning one's own culture or cultural background. A person who is culturally alienated places little value on their own or host culture, and instead hungers for that of a — sometimes imposed — colonising nation. The post-colonial theorists Bill Ashcroft, Gareth Griffiths and Helen Tiffin link alienation with a sense of dislocation or displacement some peoples (especially those from immigrant cultures) will feel when they look to a distant nation for their values. Culturally alienated societies often exhibit a weak sense of cultural self-identity and place little worth on themselves. The most common manifestation of this alienation among peoples from post-colonial nations at present is an appetite for all things American, from television and music, to clothing, slang, even names. Culturally alienated individuals will also exhibit little knowledge or interest in the history of their host society, placing no real value on such matters.” শহরের শিক্ষিত পরিবারের বাবা মা বাচ্চাদের শেকড়ের শিক্ষা বাদ দিয়ে “অ’তে অজগর” কিংবা “নোটন নোটন পায়রা” ছড়া শেখান। নাচ শেখান, গান শেখান, শেখান পরিমার্জিত বঙ্গীয় জীবনাচরণ। মনোবিজ্ঞানের Theories of Transactional Analysis এবং Cognition Theory অনুযায়ী শিশুদের মন এই সময়ে যে ছাঁচে তৈরি হয় পরবর্তী সময়ে এর সুস্পষ্ট ছাপ থেকে যায় সব ক্ষেত্রেঃ সিদ্ধান্ত গ্রহনে, আবেগ চর্চায়, জীবন যাপনে।

শিশু বড় হয় একটা multicultural dome এর মধ্যে। একটা Cross Cultural Functioning এর মধ্যে Dominating Culture অনুযায়ী সে জীবন বিন্যাস করে। এভাবেই এইসব পরিবারগুলোর উত্তর প্রজন্ম অর্থাৎ তরুনেরা বঙ্গীয় সংস্কৃতিতে hegemonized হয়ে যায়। জুম্ম সমাজের প্রতিদিনের জীবনযাপনে cultural alienation এর সুস্পষ্ট নমুনা দেখা যায়। আমরা যখন কথা বলি সেখানে অনেক বাংলা শব্দ ব্যবহার করি।

আজকাল আকছার উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠরত শিক্ষার্থিদের মধ্যে কুশলাদি বিনিময় থেকে শুরু করে সাধারণ বাক্যালাপেও বাংলা বলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এগুলো cultural alienation এর জ্বলন্ত প্রমাণ। আমরা বেঁচে আছি বাংলার এক অবিচ্ছেদ্য বলয়ে। বাজার, স্কুল, মাঠ, পাড়া, শ্মশ্মান জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বাংলার বলয় আমাদের ঘিরে রেখেছে। অ’ তে আজগর থেকে শুরু করে উচ্চতর শ্রেণীর পাঠ্য বই পর্যন্ত আমরা পড়াশোনা করছি বাংলায়।

সাহিত্য পরিচয় বাংলায়। গান শিখতে গেলে স্বরলিপি সহ ঠাট- রাগ-গান বাংলায়। ফলে হাতে খড়ি, গলায় গান, পায়ে নুপুরের নিক্কন, মঞ্চ-টিভির অনুষ্ঠান থেকে শুরু হয় আমাদের বাংলায় চিন্তা করা। আমরা যখন শিল্প ও সুকুমারবৃত্তির কথা ভাবি, একটা দৃশ্য দেখে কোন উপমা আরোপ করি সেটাও বাংলায়। সংসারে, প্রেমে,জীবনের কোন আনন্দের মুহুর্তে সুসঙ্গত কোন উক্তি, পংক্তি, সুন্দর কোন গানের চরণের কথা ভাবলে তাও আমরা বাংলা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির শিক্ষা থেকেই ভাবি।

ফলে জন্ম থেকে আমরা যারা বাংলায় মানুষ হলাম, আমাদের চিন্তন-চেতন-মনন-সৃজন সবই হচ্ছে বাংলায়। বাংলার বৃত্তে বেড়ে উঠায় আমরা অজান্তেই মগজে বঙ্গায়িত হয়েছি। এভাবেই আমরা বঙ্গায়িত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। কেউ একবারও কি ভেবেছেন- চেতনার কোন কোনায় আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি হারিয়ে গেল? অবচেতনে আমরা কোন সংস্কৃতিকে লালন করছি? কোন ধারার জীবন যাপন করছি? এভাবেই আমরা বাঙলায়িত বা বঙ্গায়িত বা বঙ্গীয় হেজেমোনাইজড হচ্ছি। যা প্রকারান্তরে চেতনার দাসত্বের সামিল কারণ আমার এখানে চিন্তার স্বাধীনতা নেই, স্বকীয় বোধ নেই, আত্মবোধ নেই।

আমরা সেভাবেই ছক কাটা চিন্তা করছি যেভাবে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক বাতাবরণ আমাদের ভাবায়। এই প্রক্রিয়ায় আমরা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে অজান্তেই ঠেলে দিচ্ছি কিছু সীমাবদ্ধ সামাজিক আচারে, সংসারের প্রত্যহিকতায়, গ্রামের কিছু সীমিত ব্যবহারে এবং কিছু পরিকল্পিত অনুষ্ঠানে। অফিস আদালতে প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজন ছাড়াও সভা-সেমিনার, সামাজিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে আমরা নিজস্ব ভাষার ব্যবহার আমরা ভুলে গেছি। আমাদের উপকথা, নাটক, গান, নৃত্য সব হারিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে অপমৃত্যু ঘটছে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির।

এখনই যদি আমরা আমাদের ভাষা-সংস্কৃতির উপর আক্রমণকে প্রতিহত না করি, মৃতপ্রায় আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে যদি না বাঁচাই অচিরেই তা মিউজিয়ামে চলে যাবে। নিজস্ব ভাষায়, নিজস্ব প্রকাশে, পাহাড়ের মাটি ও মানুষের জীবনসংগ্রাম, জীবনধারার সাথে সংগতি রেখে, শেকড়সন্ধানী প্রয়াসে শিক্ষাব্যবস্থা অন্তত জুনিয়র সেকেন্ডারী পর্যন্ত চালু হলে মননজগতের এই হেজেমনি থাকতো না। মগজের বঙ্গায়ন এর শিকার হতাম না। (২.২) রাজনীতির যুক্তি-তক্কো আর গপ্পো যে কোন সমাজের অর্থনীতি হচ্ছে বুনিয়াদ(Infrastructure)। তার উপরে উপরিকাঠামো (Suprastructure) হিসেবে গড়ে উঠে রাজনীতি, সংস্কৃতি, আচার, বিশ্বাস, মূল্যবোধ ইত্যাদি।

অর্থনীতি যে শাসকগোষ্ঠীর হাতে, তার হাতেই নিয়ন্ত্রিত হয় সমাজের উপরিকাঠামো। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আদিবাসীরা শুধু অর্থনৈতিক নয়, সংস্কৃতি সহ সমাজের উপরিকাঠামোর সবকিছুতেই বাঙালি শাসকদের হাতে নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশ একটি অনুন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্র যা সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির সাথে গাঁটছড়া বেঁধে বেঁচে আছে। পুঁজিবাদের নিয়মে দুর্বল শ্রেণীর রক্ত চুষে ধনী আরো ধনী হয়, ক্ষমতাশালী আরো ক্ষমতা লাভ হরে । এই শোষণতন্ত্রের নিয়মে দুর্বল জনগোষ্ঠী যারপরনায় শোষিত হয়, নিষ্পেষিত হয়।

জীবাণু বেঁচে থাকার প্রয়োজনে যেমন বাহককে রোগাক্রান্ত করে ও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়, সেভাবে পুঁজিবাদ টিকে থাকার প্রয়োজনে সমাজকে আক্রান্ত করে সাম্প্রদায়িকতা, জাতি-বিভেদ, গোষ্ঠী বিভেদ, শ্রেণী শোষণ, অশিক্ষা, নৈতিক-সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের এর মারণ রোগে। ফলে শোষণতন্ত্রের তান্ত্রিকেরা শোষণের স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতা ও বিভেদকে জিইয়ে রাখে। পরিকল্পিতভাবেই দাঙ্গা লাগায়। শোষন বজায় রাখতে হলে মানুষের চিন্তা-মগজকে নিয়ন্ত্রণ করাটা জরুরী তাই তারা মিডিয়া কে কাজে লাগিয়ে মানুষের মগজকে নিয়ন্ত্রন করতে চায়। সমাজ মননে যেন শ্রেণিচেতনা না গড়ে উঠতে পারে সেরকম জীবনব্যবস্থা, সংস্কৃতি দিয়ে সমাজজীবন বিন্যস্ত করে।

অর্থাৎ বুনিয়াদ অনুযায়ী উপরিকাঠামোকে সাজায়। একেই বলে cultural hegemony. পার্বত্য চট্টগ্রামে শিল্প পুঁজির কোন বিকাশই হয়নি। সমাজ মননে সামন্তীয় লোকাচার-বিশ্বাস, টোটেম-ট্যাবু যথেষ্ট ক্রিয়াশীল। জেলা শহরগুলোতে মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠেছে ৮০’র দশকে। তার প্রায় সম্পুর্ণই পাবলিক সেক্টরে কাজ করছেন।

এখানে প্রাইভেট সেক্টরের বিকাশ না হওয়াতে পুঁজির বিকাশ হয়নি। এমনকি পর্যাপ্ত ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পেরও বিকাশ হয়নি। পুঁজিবাদী অর্থনীতি চালিত বাংলাদেশে যে সমাজ পুঁজিবাদের সাথে শুরু থেকে সমান তালে চলছে তার সাথে পাহাড়ের সমাজের গতি কখনই সমান হতে পারে না। পাহাড়ের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারগুলো দেশ ও বিশ্বের অগ্রগতির সাথে তাল মেলাতে পরিবার, সমাজ ও ব্যক্তি পর্যায়ে তুলনামূলকভাবে অগ্রগামী ও নিকটবর্তী ( communicability and accessibility’র কারণে ) বাঙালি সমাজের আচার, সংস্কৃতি রপ্ত করে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই শ্রেণী নিজের সংস্কৃতিকে ত্যাগ করে ভিন্ন সংস্কৃতিতে জীবন যাপন করে।

পুঁজিবাদী বাংলাদেশে আদিবাসীদের শোষনের স্বার্থে আদিবাসীদের আত্মপরিচয়, কৃষ্টি-সংস্কৃতির স্বকীয়তাকে নির্মূল করা প্রয়োজন। যদি আদিবাসীরা আত্মসচেতন হয় তাহলে তা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের জন্য বিপদ। এই কারণেই রাষ্ট্র আমাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি না দিয়ে বাঙালি বানিয়ে রেখেছে। যাতে সংস্কৃতিতে বঙ্গায়িত ( Bengali Hegimonized) হয়ে আমরা সংস্কৃতিশুন্য হয়ে যাই ও প্রভাবশালী বঙ্গীয় খরস্রোতায় ভেসে বঙ্গীয় সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরি। তারপর বঙ্গীয় জীবনের খরস্রোতায় ভাসতে ভাসতে কালের যাত্রাপথে বাঙালি হয়ে যাই।

(২.৩)বঙ্গায়িত আবেগ আমাদের আবেগের প্রকাশ, আদান-প্রদান, গ্রহণীয়তা, মনস্ত্বাত্ত্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় (sensation and motor action) বঙ্গীয় সংস্কৃতির সুস্পষ্ট প্রভাব আছে। তরুন-তরুণীরা মোবাইলে “জান, জান্টূশ” বলে আদর করাটা কোত্থেকে শিখেছে? মেসেজে প্রেমের বুলিতে কোন পংক্তি ব্যবহার হচ্ছে? বর্তমানে পাহাড়ি তরুণীদের বাঙালীদের সাথে প্রেম করার প্রবণতা কেন বেড়ে গেছে? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় অগ্রসর এবং সুন্দরী পাহাড়ি তরুনীরাই বাঙালীর সাথে জড়িত হয়, কেন? দেখা যায়, যে তরুণী বাঙালী সংস্কৃতিতে বেশি প্রভাবিত অর্থাৎ বঙ্গায়িত জীবনাচরণে অনুরক্ত তার বাঙালী ছেলের সাথে সম্পর্কের প্রবণতা বেশি। কারণ সে যেভাবে আদর-সোহাগ পেতে চায়, যা শুনতে চায় এবং যেভাবে শুনতে চায়, যা দেখতে চায় এবং যেভাবে তা চায়, যে ঢঙয়ের আচরণ বা জীবনাচরণ চায় সেগুলো যথাযথভাবে একজন বাঙালিই দিতে পারে। আবেগ চর্চার এই বিশেষ ধাঁচাকে আমি এখানে আবেগের বঙ্গায়ন বলতে চাই( Bengalization of emotion or Bengali hegemonized emotional effect) অনেক পাহাড়ি তরুণকে বলতে শুনেছি, “আমরা তো বাঙালি ছেলেদের মত মিষ্টি করে পটাইতে পারি না, ছ্যাবলামি, ছিনালী করতে পারি না... আমাদের সুন্দরী পাহাড়ি মেয়েরা কেন পছন্দ করবে?” পাহাড়ি নারীদের বাঙালীদের সাথে প্রেম করার ক্ষেত্রে যেটা দেখা যায়, তারুণ্যের প্রথম অধ্যায়ে অবচেতনে যে আকাংক্ষার মানুষটা তারা খোঁজে সেরকম চলন, বলন, ধরণ, গড়ন (Attitude, traits, attributes, behavioral aspects, status, trend and lifestyle, mindset, )অর্থাৎ তথাকথিত কালচার্ড, লিবারেল, স্মার্ট, শিক্ষিত, মেধাবী, পরিশীলিত, পয়সাওয়ালা-পয়সা খরচ করনেওয়ালা ইত্যাদি কাংক্ষিত টাইপের হওয়াটা অধিকাংশ পাহাড়ির পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে পাহাড়িরা গড়ে বাঙালি ছেলেদের সাথে টেক্কা দিতে পারে না।

কারণ পাহাড়িদের সমাজ একটা পিছিয়ে পড়া সমাজ। আবেগের বঙ্গায়নের এই phenomena পাহাড়ি নারীদের ক্ষেত্রে শুধু নয় সমানভাবে পুরুষদের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। কিন্তু তার ফলে পাহাড়ি ছেলেদের বাঙালী মেয়েদের সাথে সম্পর্কে জড়ানো বিরলপ্রায়। বর্তমানে পাহাড়ি নারীদের বাঙালীদের সাথে সম্পর্কে জড়ানো মহামারীর মত দেখা দিয়েছে। পাহাড়ি নারীদের বাঙালীদের সম্পর্কে জড়ানোর সুদূরব্যাপী কুফল কি তা আগের একটা লেখায় আমি এবং অনেকে অনেক লেখায় দেখিয়েছেন।

এখানে আমি শুধু একটা long term consequence এর কথা বলবো। তার আগে আবেগের বঙ্গায়নের বিষয়টা পরিষ্কার করা দরকার। আবেগের প্রকাশ ও গ্রহণীয়তা সংস্কৃতির দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রভাবিত হয়। আমরা যে শিক্ষায় ও সাংস্কৃতিক বাতাবরণে বড় হয়েছি আমাদের আবেগের আদান-প্রদান ( share-exchange, transmission, submission and acceptance) তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে বাধ্য। বাহ্যিক পরিবেশ থেকে আমরা যে ধরণের আবেগ বা সম্পর্ক চর্চার ধারণা পাই বা পরিবেশ আমাদের জন্য একটা standard দাঁড় করায়।

নিজেদের আচরণ কে আমরা সেভাবেই optimize and adopt করি। বাইরের পরিবেশের সাথে আমাদের সম্পর্ক সব সময় দ্বান্দ্বিক( dialectical)। এভাবেই আমরা জীবনাচরণের উপাদানগুলো গ্রহন-বর্জনের সিদ্ধান্ত নিই। এই প্রক্রিয়াতেই আমরা আবেগ চর্চার ধরনটাও ঠিক করি এবং রপ্ত করি। সমাজে ভোগবাদ, কর্পোরেট প্রেসক্রাইব্ড লাইফস্টাইল, সমাজবিচ্ছিন্ন আত্মকেন্দ্রিক ভাবনা- ‘আমার জীবন আমার খুশি’ দৃষ্টিভঙ্গি, কিংবা আত্মকেন্দ্রিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সস্তা-পলকা জীবনবোধ আছে।

একটা শ্রেণিবিভক্ত পুঁজিবাদী সমাজে তা থাকাটাই স্বাভাবিক। এখানেও পুঁজির নিয়মে যেমন “বড় পুঁজি ছোট পুঁজিকে গিলে খায়” সেভাবে আমাদের সমাজের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস, মুল্যবোধ, সংস্কার, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভাঙছে। অন্যদিকে তরুন-তরুনীরা স্যাটেলাইট চ্যানেলে প্রোমো-নাটক-সিনেমা দেখছে, গান-পদ্য-গদ্য পড়ছে-শুনছে, দেখছে। ফলে শারীরিক পরিপক্কতা বা প্রাকৃতিক ভাবে যে বয়সে নারির পুরুষের প্রয়োজন অনুভব হওয়ার কথা বা পুরুষের নারীর প্রয়োজন বোধ হওয়ার কথা তা না হয়ে অনেক আগেই মনের মধ্যে “প্রেম প্রেম ভাব” এর উদয় হয়। ছোটবেলা থেকে সামগ্রিকভাবে বঙ্গীয় বলয়ে বড় হওয়াতে অবচেতনে প্রেম-ভালবাসা ইত্যাদির যে ধারণা আমরা টিভি নাটক, উপন্যাস-গল্প, সিনেমা, শিল্প মাধ্যম, সমাজ ও বন্ধুদের কাছ থেকে পাই তাতে উত্তর-উপনিবেশিক প্রেস্ক্রিপশনের এবং বঙ্গায়িত চিন্তনের প্রভাব আছে।

উত্তর-উপনিবেশিক(Post Colonial- in this context: Corporatism) মগজ ধোলাই এর অর্থ ভোগবাদী চিন্তা, সমাজ ও শিকড়ের প্রতি দায়হীন, স্বেচ্ছাচারী, নিস্কৃয়, উন্নাসিক, প্রতিকৃয়াশীল, চরম আত্মকেন্দ্রিক আকাংক্ষা (aspiration and ambition) ও জীবনব্যবস্থা। কর্পোরেট চিনি গুলানো জীবনাচরণ যা এয়ারটেল, ডি’ জুসের বিজ্ঞাপনে কিছুটা দেখা যায়। পিছিয়ে থাকা পাহাড়ি সমাজে যারা উন্নত জীবন বা অনুকরণীয় জীবনব্যবস্থা-সংস্কৃতি যাই হোক তা বাঙালীদের দেখেই শিখতে হয়। চলতি ফ্যাশনের কাপড় থেকে ছায়ানটের রবীন্দ্র সংগীত। ফলে এই বৈশিষ্ট্য পূরণ সাধারণত বাঙালীরাই করতে পারে কেননা বাংলাদেশে তারাই কর্পোরেটিজমের ধারক-বাহক।

বাংলাদেশে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ হয়েছে বৃটিশ উপনিবেশের সময় থেকে। পুঁজিবাদের পরিপূরক সংস্কৃতির বিকাশ হয়েছে তার হাত ধরে। অনেক প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাক্ষী বাংলাদেশ। এই বাস্তবতায় একজন তরুণী যে প্রকারে আবেগের আদান প্রদান, খুনসুটি, ভালোবাসার প্রকাশ, আদান-প্রদান চায় তা একজন বাঙালিই ভালো দিতে পারে, পাহাড়ি নয়। এবং কর্পোরেটিজমের যুগে ভোগবাদী, উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্বপ্নের পূরণ বাঙালীরাই ভালো করতে পারে।

অনেক ক্ষেত্রে, শ্রেণী নির্বিশেষে পাহাড়ি তরুনীদের বাঙালীদের সাথে পরিবার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আর্থিক লাভের হিসাবটাই আগে আসে। সমাজবদ্ধ মানুষের মানসকাঠামো সমাজকাঠামো অনুযায়ী হয়ে থাকে। ফলে উন্নত পুঁজিবাদী সমাজের সবকিছুর পেছনে ধাবমান পাহাড়িদের নিজস্ব যা কিছু আছে তা খুইয়ে যাচ্ছে। বকচ্ছপ, হাতিমি মার্কা হয়ে যাচ্ছে চেতন, মনন, আবেগ, জীবন। আবেগচর্চার জায়গাতেও নিজস্বতা না থাকা, আর্থিক কারণে এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সবকিছুকে ভালোবাসাতে পাহাড়ি নারীরা আকৃষ্ট হচ্ছে বাঙালী ছেলেদের প্রতি।

যারা উচ্চতর শিক্ষার জন্য পাহাড় ছেড়ে সমতল বঙ্গে যাচ্ছেন তাদের সিংহভাগ এই পাহাড়ের মধ্যবিত্ত পরিবারের। উপরের আলোচনায় দেখিয়েছি যে পাহাড়ের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারগুলো কিভাবে hegemonized , culturally assimilated হয়। ফলে এরকম বাস্তবতায় একজন পাহাড়ি তরুণীর আবেগে বঙ্গায়িত হওয়ার উপযোগিতা তৈরি হয়ে যায়। বঙ্গায়িত আবেগ নিয়ে বাইরের শহরে পড়তে এসে মুক্ত-স্বাধীন পরিবেশে সে বাঙালির সাথে প্রেম করতেই পারে। যে হারে পাহাড়ি মেয়েরা বাঙালিদের সাথে সম্পর্কে জড়াচ্ছে সমাজে তার প্রতিক্রিয়া (Consequence) কি হতে পারে? আজকাল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষিত তরুণীরাই বাঙালীদের সাথে সম্পর্কে জড়াচ্ছে।

একজন নারীর মধ্য দিয়েই উত্তর প্রজন্মের শিক্ষা পরের প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। ফলে একজন পাহাড়ি নারী বাঙালি পরিবারে অন্তর্ভুক্তির মানে একজন অনাগত পাহাড়ি সন্তানের সম্ভাবনা নষ্ট হওয়া; বিলুপ্তির মুখে থাকা একটি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতাকে রুদ্ধ করা। একজন শিক্ষিত মারমা বা চাকমা মা যেভাবে তার সন্তানদের শেকড়ের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে সঞ্চারিত করতে পারে অশিক্ষিত মা তা পারেন না। আমরা এক ক্রান্তিকালে জীবন যাপন করছি। এখন আমাদের দরকার সেই মা যিনি তার সন্তানদের শোনাবেন আমাদের অধিকার বঞ্চনার ইতিহাস, শেখাবেন আমাদের শেকড়ের সংস্কৃতি ও জীবন যাপন, শেখাবেন আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের শিক্ষা এবং সঞ্চারিত করবেন মর্যাদা ও অধিকারের চেতনা,রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চেতনা।

এটা সময়ের প্রয়োজন। যদি আমাদের তরুণীরা এই সময়ের প্রয়োজনে সাড়া না দেয় এবং জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে শুধু নিজের সুখকেই বড় মনে করে তাহলে মানুষ হিসেবে তার বাঁচার অধিকার থাকে না। কেননা মানুষ হতে হলে তার মনুষ্যত্বের দায় থাকে। মনুষ্যত্বের দায় মানে পিতৃভূমি-পাহাড় এবং তার মানুষ, তার সংস্কৃতিকে রক্ষার্থে ভূমিকা রাখা। মনুষ্যত্বের দায় মানে যুগের পর যুগ ধরে আমাদের উপর যে নিপীড়ন, অন্যায় হয়েছে তার প্রতিকার চাওয়া।

মনুষ্যত্বের দায় মানে আমার যে সমাজে জন্ম, যাদের কোলে আমি মানুষ হয়েছি, যে সমাজের শিক্ষা-সংস্কৃতি-আচারে আমার মনের পুষ্টি, তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা এবং তা রক্ষার্থে প্রতিরোধের সংগ্রাম করা অথবা সেই সংগ্রামে যথাসম্ভব সহযোগিতা করা। তা না করে যদি কোন জুম্ম নারী যদি বঙ্গায়িত আবেগ থেকে বাঙালিই হয়ে যায় তাহলে তার আর পাহাড়ে ফেরার কোন নৈতিক অধিকার থাকে না বলে আমি মনে করি। যত ব্যাপক হারে পাহাড়ি তরুণীরা বাঙালীদের সাথে সম্পর্কে জড়াবে ততই পাহাড়ি সংস্কৃতির সংরক্ষন ও বিকাশের সম্ভাবনা নষ্ট হবে। একদিন পাহাড়ি তরুনীর গর্ভে বাঙালি সন্তানের জন্ম হবে, পাহাড়ি নয়। কেননা বাঙালি সমাজ পশ্চিমাদের মত উদারনৈতিক নয়।

পুরুষতান্ত্রিক এবং মুসলমান। মুসলমানদের ধর্মীয় আচার আগ্রাসি। তারা ধর্মান্তরিত করাকে পবিত্র দায়িত্ব মনে করে, যাতে তার এবং পরিবারকে আল্লাহ বেহেস্ত নসিব করেন। (২-৩)পর্যটনের নামে পাহাড়, পাহাড়ের মানুষ ও আদিবাসী সংস্কৃতিকে পণ্য বানানো হচ্ছেঃ (MARKETIZATION OF HILLS, HILL PEOPLES AND NATURE) দূর্গম বান্দরবানের অনেক জায়গা এখন রীতিমত পাল্টে গেছে। নীলগিরি, নীলাচল, বগালেক, ঝাঁ-চকচকে রিসোর্ট ইত্যাদি মিলে বান্দরবান এখন পর্যটকদের কাছে এক লোভনীয় স্থান।

রাষ্ট্র এবং আর্মিরা এখন প্রোমোটারের ভূমিকায় নেমে বান্দরবানকে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মত পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করতে চায়। বান্দরবানে এখন কক্সবাজারের মতই পর্যটকের ভীর হয়। শহরের কর্মক্লান্ত মানুষ একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচার জন্য বান্দরবানে হাজির হয়। অনেকের সখ হয় পাহাড়ি মদ আর পাহাড়ি নারি ভোগ করার। পড়ালেখা এবং কর্মসূত্রে আমি পাহাড়ের বাইরে প্রায় ৯ বছর ছিলাম।

তাদের কাছে পাহাড়, পাহাড়ের মানুষ তাদের জীবন যাপন, সংস্কৃতি সবই আকর্ষনীয়, exotic. বান্দরবান, রাঙ্গামাটি সহ গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামই সমতলের মানুষের কাছে পাহাড়ি মোড়কে মোড়া একটা লোভনীয় ভোগ্য পণ্য। প্রশ্ন হচ্ছে বান্দরবান সহ পার্বত্য চট্টগ্রাম যদি সমৃদ্ধ পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয় তাতে পাহাড়ি আদিবাসিদের কি লাভ, কি ক্ষতি? প্রচুর আর্থিক লেনদেন হবে। কিছু দালাল পুঁজির মালিক পাহাড়ি এর সুযোগে পয়সা কড়ি বানাবে। পাহাড়ের ব্যবসা বাঙালীদের নিয়ন্ত্রনে থাকার কারণে পর্যটন শিল্পের বেশিরভাগ মুনাফা তাদের পকেটেই যাবে। কিন্তু প্রান্তিক পাহাড়িদে তাতে কোন লাভ হবে না।

তারা আগের মতই জুম চাষ নিয়েই থাকবে। কেউ কেউ লাভের গুড়ের তলানী চাটবে অর্থাৎ দালালী করবে। শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা চিরাচরিত নির্লিপ্ততা কিংবা দূরদর্শী যুথবদ্ধ আন্দোলনহীনতায় সুশীল সমাজের দায় হিসাবে সভা-সেমিনার করবে। এন জি ও ওয়ালারা সেমিনার-অয়ার্কশপ করার খোরাক পাবে। নৈসর্গিক পাহাড়ের সাথে পাহাড়িরা পর্যটকদের কৌতুহলের খোরাক জোগাবে চিড়িয়াখানার চিড়িয়ার মত।

তারা দেখবে আর বলবেঃ “ইন্টারেস্টিং পাহাড়ি- দেখো দেখো তাদের ড্রেস দেখো, দেখ তাদের বাড়ি দেখো, ইস! কি প্রিমিটিভ! কি পিকুলিয়ার !! জানো এরা কিন্তু সাপ-ব্যাং-কেঁচো সব খায়। মদ এবং দেহব্যবসার প্রচলন বাড়বে, প্রাতিষ্ঠানিক রুপ লাভ করবে। অবাধ কাঁচা পয়সার প্রচলন ফাটকা পুঁজির জন্ম দেবে। আদিবাসিদের মধ্যে একটা দালাল, ফাটবাজ, সুবিধাবাদী শ্রেণী তৈরী হবে। জনমানসে এরকম মনন কাঠামো তৈরী করবে।

সাংস্কৃতিক ও নৈতিক অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করবে। মহামারি আকারে সমাজকে আক্রান্ত করবে। সমাজে সাংস্কৃতিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের বিষক্রিয়া ধীর কিন্তু সুদূরপ্রসারী। সাংস্কৃতিক ও নৈতিক অবক্ষয় সমাজকে ক্যান্সারের মত অদৃশ্যভাবে ধীরে ধিরে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। এখানে তা হবে আন্তঃ সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়ার প্রক্রিয়ায়।

অর্থাৎ, “ Cross cultural interaction”. আমাদের সংস্কৃতি এখন বহুমুখী আক্রমণে নাজুক ও ভঙ্গুর (vulnerable) অবস্থায় আছে। এই অবস্থায় প্রভাবশালী ও কায়েমি সংস্কৃতির সাথে অবাধ interaction এর ফলে indigenous culture ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। কর্পোরেট সংস্কৃতির প্রভাবে মুনাফা ও ভোগবাদী উদ্দেশ্য থেকে আমাদের সংস্কৃতির বিশেষ কোন অংশকে এখানে promote করা হবে। যেমন মদ পান, পানি খেলা ইত্যাদি। বছরখানেক আগে রাজপূন্যাহের সময় বান্দরবানে গিয়ে আমি খুব হতাশ হয়েছিলাম।

সেখানে অলি-গলি জুড়ে মদের দোকান, সারি বেঁধে মদের পসরা, একটু খেয়াল করলে কোন মারমা নারীর যৌনতার ফেরী করে বেড়ানোও নজরে আসে। পাড়ার অভাবী ঘরের মেয়েটা স্বচ্ছলতার জন্য এখন শরীর বেচে। পর্যটনের ভরা মৌসুমে অনেক হাভাতের ঘরেই এখন ভাত পঁচিয়ে মদ তৈরী হচ্ছে। বান্দরবান হয়েছে নাগরিক পর্যটকদের আমোদ-প্রমোদের স্থান। মদ, বেশ্যাবৃত্তির হাত ধরে একদিন সেখানে বৈধ ক্যাসিনো (casino- জুয়া খেলার স্থান যেখানে মদ বিক্রির সাথে খোলামেলা দেহব্যবসাও চলে) গড়ে উঠবে।

শাসক চক্রের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম একদিন উদোম যৌনতা আর পানশালা, আমোদ প্রমোদে ভরা লাস ভেগাস কিংবা Sex Tourism এর দেশ থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ফিলিপিনের মত হবে। বেশিদিন লাগবে না, হয়তো আর এক যুগের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে এরকম প্রমোদস্থল গড়ে উঠবে যেখানে পাহাড়ি ব্রান্ডেড মদ সার্ভ করবে পাহাড়ি বারবনিতারা, মঞ্চে মদির আলোয় নগ্ন উরুতে ঝড় তুলবে চাকমা, মারমা, তঞ্চংগ্যা মেয়েরা যাদের আমরা চিনি, যারা আমাদের পাড়ার গরিব ঘরের মেয়ে, কিংবা চরিত্রহীন হিসাবে পাহাড়ি সমাজে পরিচিত। পরিশেষে... পাহাড়ি সমাজে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনে মধ্যবিত্তের সমর্থনহীনতা ও অংশগ্রহনহীনতা, প্রগতিশীল রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের স্থবিরতা মানুষকে ঠেলে দিয়েছে সামাজিক দায়হীন আত্মকেন্দ্রিক জীবনের গর্তে। সাংস্কৃতিক আন্দোলন গতিহীন এবং তা অসুস্থ রাজনীতির পাঁকে আটকে আছে। এই বাস্তবতায় ব্যক্তি সমাজবিচ্ছিন্ন আত্মকেন্দ্রিকতায় মুখ গুঁজে আছে।

সমাজবদ্ধ কিন্তু ব্যক্তিতে বিভক্ত, জাতীয় চেতনাহীন, সামাজিক দায়বদ্ধতাহীন মনন নিয়ে শুধু ইন্দ্রিয় বিলাসিতায় এবং আত্মপ্রতিষ্ঠা-আত্মপ্রসাদের জন্য বেঁচে আছে জুম্ম সমাজের তথাকথিত শিক্ষিত সুশীল সমাজ। শরীর দুর্বল হলে যেমন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, এবং রোগআক্রান্ত হয় তেমনি এই পরিস্থিতিতে একটি জনগোষ্ঠীও মননের জায়গা থেকে শুরু করে আবেগের জায়গাতেও কায়েমি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হয়। উপরের আলোচনা থেকে আমি বলতে চাই যে, রাষ্ট্র ধর্মে ইসলাম এই বাংলাদেশ রাষ্ট্র আমাদের নির্মূল করবে আমাদের সংস্কৃতি ও স্বকিয়তাবোধ কে নির্মূল করে। যদি আমাদের আত্মবোধ, আত্মমর্যাদাবোধ, জাতীয়বোধ, অধিকারবোধ নাই থাকে তাহলে কে প্রতিবাদ করবে? এদিকে দিগভ্রান্ত ছাত্র-তরুন সমাজ Hegemonized, bengalized হয়ে কর্পোরেট জীবনবোধে দিক্ষিত হয়ে প্রেমের মর্ফিনে বুঁদ হয়ে আছে। যদি প্রতিবাদের বোধ না থাকে কারা প্রতিবাদ করবে? যদি প্রতিরোধের চেতনা না থাকে কে লড়বে? এই তরুন সমাজ ভুলে গেছে আমাদের উপরে রাষ্ট্র গনহত্যা চালিয়েছে।

দেশান্তরিত হয়েছে আমাদের বাপ-দাদা। আমাদের মা-বোনেরা ধর্ষিত হয়েছে শুধুমাত্র জুম্ম হওয়ার অপরাধে। এখন জনসংখ্যার অনুপাত ৫০:৫০। এখনই আমাদের ভিটেমাটি হুমকির মুখে। দাঙ্গা বাঁধিয়ে সেটেলাররা আমাদের জমি কেড়ে নেয় বছর বছর।

যদি তা ৩০ ভাগ জুম্ম আর ৭০ ভাগ বাঙালি হয় আমরা কি আ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।