আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

৪-০: ফল মোটেও অপ্রত্যাশিত নয়

শনিবার সকালে আমার বন্ধুরা, সহকর্মীরা আমাকে জিগ্যেস করছিলেন, চার সিটি করপোরেশনের ভোটের ফল কী হবে বলে আমি মনে করি। আমি বলেছিলাম, যদি ভোট হয়, আর ভোট গোনা হয়, ফল হবে ০-৪, চারটাতেই আওয়ামী লীগ হারবে। আমার বিজ্ঞ বন্ধুরা তখন একেকজন একেকভাবে বলেছিলেন। কেউ বলেছিলেন, রাজশাহীতে খায়রুজ্জামান লিটন খুব জনপ্রিয়, বরিশালে শওকত হোসেন নগরীর চেহারা পাল্টে দিয়েছেন। আমি বলেছিলাম, ‘আমি এই ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারছি, কারণ আমি পত্রিকায় সিটি নির্বাচনের ফলের পূর্বাভাসগুলো পড়িনি।

আমি পড়ার চেষ্টা করছি বাংলাদেশের ভোটারদের মন। কাজেই আমি এটা বলব। তারপর দেখা যাক কী হয়। ’
সন্ধ্যার পরপরই আমার সেই বন্ধুরা আমাকে ফোন করতে লাগলেন, ‘ভাই, আপনার কথাই তো বুঝি ঠিক হতে যাচ্ছে। ’
আমার কথা যে ঠিক হতে যাচ্ছে, এই নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না।

ফলে আমি ব্রাজিল-জাপান ফুটবল ম্যাচ নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলাম। ব্রাজিল ৩-০ গোলে জিতেছে।
আমি জানি, অনেকের পক্ষেই এই ফলটা বেশ একটা আঘাত হিসেবে এসেছে। অন্যদের কথা বাদ দিন, যাঁরা চার সিটিতে সরকারি প্রার্থীদের ভোট দিয়েছিলেন, তাঁদের জন্য তো ব্যাপারটা বেশ একটা অপ্রত্যাশিত আঘাত। কিন্তু আমি বলি, ফলটা কারও কারও জন্য দুঃসংবাদ হতে পারে, এই ফল মোটেও অপ্রত্যাশিত কিছু নয়।

এটা বাংলাদেশের ভোটারদের ভোট দেওয়ার রীতি।
এই দেশে যেই সরকারে আসে, সেই বাড়াবাড়ির চূড়ান্ত করতে থাকে, আর এই দেশের মানুষ বাড়াবাড়িকে খুবই অপছন্দ করে। তারা উপায় খুঁজতে থাকে তাদের দেওয়া ভোটকে অপমান করার বদলা নেওয়ার জন্য। ভোটারদের জন্য ভোট দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই সরকারি চোটপাট, অন্যায়-জুলুম, দুর্নীতি-দলীয়করণের জবাব দেওয়ার। তারা অপেক্ষা করে ভোটের দিনের জন্য।

আজকে আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দলের শাসনের (সুশাসন, দুঃশাসন কিংবা অপশাসন) সাড়ে চার বছরের মাথায় যেকোনো নির্বাচনে হারা ছাড়া আর কোনো ভবিতব্য অপেক্ষা করে নেই। সিটি নির্বাচনের এই ৪-০ ফলে আমি মোটেও বিস্মিত নই। কিন্তু আমি বিস্মিত, অনেকেই এই ফলটা যে ঘটবেই, তা বুঝতে পারেননি কেন? এখন তো মহাজোট সরকারের জনপ্রিয়তা অনেক কমেছে। একাধিক জরিপে সেটার প্রতিফলন ঘটেছে। এখন যেকোনো জরিপে আওয়ামী লীগের চেয়ে জনপ্রিয়তায় বিএনপি এগিয়ে, কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন যখন হয়েছিল, তখন তো সরকার এতটা অজনপ্রিয় ছিল না, তখন জনমত জরিপে আওয়ামী লীগ এগিয়ে ছিল বিএনপির চেয়ে, তখনও কি চট্টগ্রামে প্রবল পরাক্রমশালী এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী অখ্যাত-প্রায় ধার করে পাওয়া বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী মোহাম্মদ মনজুর আলমের কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হেরে বসেননি? আজ থেকে ঠিক তিন বছর আগে, ২০১০ সালের ১৭ জুন সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

সরকারের বয়স তখন সবে দেড়।
এই দেশের ভোটাররা কাউকেই দেশের ক্ষমতা চিরদিনের জন্য দিয়ে দেন না। তাঁরা সব সময়ই চান, সরকারি দল যেন মনে রাখে, ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়, আর ক্ষমতার উত্স জনগণ। আর এই দেশের মানুষ খুব দূর অতীতের কথা মনে রাখতে পারে না। মনে রাখা সম্ভব নয়।

আমার আজ যদি দাঁতে ব্যথা করে, তাহলে তিন বছর আগে যে আমার পেটের ব্যথা এর চেয়েও মারাত্মক ছিল, সেটা মনে করে আমি সান্ত্বনা পাব না। বর্তমানের ব্যথায় আমরা সব সময় জর্জরিত থাকি। এখনো তা-ই আছি। শেয়ার মার্কেট ধসে গেছে, লাখ লাখ মানুষ সর্বহারা হয়েছে, ডেসটিনিতে লাখো মানুষ টাকা খাটিয়েছে, এখন হায় হায় করছে, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, পুরো দেশের মানুষের মুখে চুনকালি পড়েছে, বিশ্বজিত্ হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য টেলিভিশনের কারণে সারা দেশের মানুষ দেখেছে ও আঁতকে উঠেছে, তার ওপর স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের বাড়াবাড়ি আছে! কিন্তু সবকিছুর মধ্যেই দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীনেরা বড়লোক হয়ে যাচ্ছেন, যাঁদের টিনের বাড়ি ছিল, তাঁরা এখন অট্টালিকার মালিক। সীমান্তে বিএসএফের গুলি থামেনি, তিস্তা নদীর পানি পাওয়া যায়নি।

মানুষ এই নগদ দুঃখগুলো মনে পুষে রেখে ভোটকেন্দ্রে গেছে, অতীতের কথা তার মনেও নেই। মনেও নেই যে, এই দেশে বাংলাভাই নামের এক জিনিস কারা পয়দা করেছিল কিংবা রাজশাহীর অধ্যাপক ইউনূস কিংবা চট্টগ্রামের গোপালকৃষ্ণ মুহুরিকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছিল। কিংবা কীভাবে সাত বছর আগে সচিবালয়ের বাইরে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বাইরে একটা হাওয়াই ক্ষমতাকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছিল। কিংবা কীভাবে শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড মেরে আইভি রহমানসহ অনেককে হত্যা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের ভোটাররা ভোট দেন বি-এ, বি-এ, বি-এ পদ্ধতিতে।

২০০৯-এর নির্বাচনে তাঁরা ‘এ’-দলকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন, এবার ‘বি’ দলই হবে তাঁদের পছন্দ। তাঁরা ‘এ’ দলকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য ‘বি’ দলকে ভোট দেবেন, বড় আশায় বুক বেঁধে এবং ছয় মাসের মধ্যে তাঁরা বুঝে ফেলবেন তাঁরা কত বড় ভুল করেছেন। তখন তাঁরা সরকারকে একটা জবাব দেওয়ার উপায় খুঁজবেন।
একই ঘটনা ঘটেছিল ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পরেও। বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে তাঁরা উপায় খুঁজছিলেন সরকারকে তাঁদের বিরক্তির কথা জানিয়ে দেওয়ার, যখনই মেয়র নির্বাচন এল, তাঁরা ঢাকায় মির্জা আব্বাসের বদলে মেয়র বানালেন আওয়ামী লীগের মোহাম্মদ হানিফকে, চট্টগ্রামে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে (১৯৯৪)।

আবার বর্তমান সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনেও বিএনপি খুব ভালো করেছে।
বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা খুব ভালো নয়। কিন্তু বিএনপির নির্বাচন করতে দল লাগে না, তাদের আছে এক বিশাল ভোটার দল। আসলে এই দেশে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয় দলেরই ৩০ শতাংশ বাঁধা ভোটার আছেন। বাকি ৪০ শতাংশ ভোটার একবার এ-দলকে আরেকবার ও-দলকে ভোট দেন।

এবার সিটি নির্বাচনে এই ৪০ শতাংশের মধ্যে ৩০ শতাংশ সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, ১০ শতাংশ সরকারের পক্ষে। ফলে মোটামুটিভাবে, সরকারি প্রার্থী ভোট পেয়েছেন ৪০ শতাংশ, আর বিএনপির প্রার্থী পেয়েছেন ৬০ শতাংশ। ফলে বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করেছেন বিএনপির প্রার্থীরা। এইটা সাধারণভাবে দেশের মানুষের মনোভাব। দেশের মানুষ কী চায়, এটা এখন উভয় পক্ষই বুঝে নিক।


সরকার অবশ্য একটা ব্যাপারে সাধুবাদ পাবে। এই ফলটা তারা উল্টে দেওয়ার জন্য কোনো রকমের অপচেষ্টা করেনি বলে। আমাদের মনে আছে, ঢাকা থেকে আমরা শুনেছিলাম, বিএনপির আমলে রাজশাহীর মেয়র নির্বাচনে বিরোধী জোটের প্রার্থী ফজলে হোসেন বাদশা জিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সেটা বদলে মিজানুর রহমান মিনুকে বিজয়ী বানানো হয়েছিল। এই নির্বাচনের ফল দেশে আপাতত শান্তি নিয়ে আসবে, কয়েকটা হরতাল থেকে জাতি বাঁচল এবং আমি যতদূর জানি, বিএনপি পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে এবং তা-ই তাদের করা উচিত। যেভাবেই নির্বাচন করা হোক না কেন, পরের নির্বাচনে তারা জয়লাভ করবে, এটা মোটামুটি বলে দেওয়া যায়।

পরের নির্বাচন বিএনপি যদি বর্জন করে, সেটাই হবে আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে ভালো সুযোগ।
জাতীয় নির্বাচনের জন্য আর মাস ছয়েক সময় হাতে আছে। আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে কোনো জাদুর কাঠি থাকলে সেটা তাকে ব্যবহার করতে হবে জনচিত্ত জয় করার জন্য। সে রকম কিছু আছে বলে মনে হয় না। ফলে আওয়ামী লীগকে এখন প্রস্তুত হতে হবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে খুব খারাপভাবে হারার।

আওয়ামী লীগ বিদায় নেবে, বিএনপি ও তার জোটসঙ্গীরা ক্ষমতায় আসবে। তাতে যে দেশের সুখের নহর বয়ে যাবে, তা নয়। বর্তমানের শাসকদের হম্বিতম্বি থেকে তো বাঁচা যাবে, এই হলো ভোটারদের মনোভাব। এই মনোভাব দিয়ে চালিত হয়েই সাড়ে চার বছর আগের নির্বাচনে লোকে দল বেঁধে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছিল।
এটা কিন্তু এক দিক থেকে ভালোই।

ক্ষমতায় কে আসবে, তা নির্ধারণ করে জনগণ। এটা আমি বহুবার বলেছি, এই দেশে ক্ষমতায় কে আসবে, তা আমেরিকা নির্ধারণ করে না, ভারত কিংবা পাকিস্তান নির্ধারণ করে না, সেনাবাহিনী নির্ধারণ করে না, এটা নির্ধারণ করেন এই দেশের ভোটাররা। যদি কেউ ভোটে জিততে চায়, তাকে জনগণের কাছে হাত পাততে হবে, জনগণকে খুশি করতে হবে।
অবশ্য এই দেশে জনগণকে খুশি করে ভোট পেতে হয় না, একপক্ষ জনগণকে বেশি অখুশি করায় অপরপক্ষ সহজেই জিতে যায়। ভালো না জিনিসটা? ভালো তো।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।