আজ ২ দিন ধরে ট্রলার চলছে। ট্রলার এর দায়িত্তে আছে ১ জন মাঝি ও তার ২ সাগরেদ। আর রঞ্জুদের দায়িত্তে আছে ২ জন লোক। দেখতে আফ্রিকানদের মতো হলেও কথা-বার্তা,চাল-চলনে বুঝা যায় আফ্রিকান না। খুব অল্প পরিমান ইংলিশ আর মূলত ইশারা ইঙ্গিতে তাদের সাথে কথা বার্তা চলছে।
২জন-ই খুব রুক্ষ প্রকৃতির। কথার চাইতে ধমক আর মারামা্রিতে সাচ্চন্দ বোধ করত বেশি। অলরেডি সবাইকে একবার জানিয়ে দিলো ,কেউ যাতে কোন ঝামেলা না করে। সে এই সব কাজ সামলাতে সে খুব দক্ষ। রঞ্জু শুধু একবার জিজ্ঞেস করেছিল,ওস্তাদ এই যে আপনি এত এত লোককে দক্ষতার সাথে ইটালি তে নিয়ে যাচ্ছেন,আপনার কি একবার-ও ইটালি যেতে ইচ্ছে করেনি?এত লোকের ভাগ্য গড়তে সহায়তা করছেন,অথচ ঘুরে ফিরে আপনি এই ভাঙ্গা ট্রলারে ফিরে আসছেন কেন?ওস্তাদ ওর দিকে এমন রাগত ভাবে তাকাল যে রঞ্জু আর কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলল।
ওস্তাদ ওর সাগরেদের কানে কানে কিছু বলল। তার মানে রঞ্জু যা বুজল তা হল,রঞ্জুকে যাতে সবাই নজরদারিতে রাখে। রঞ্জু ইতিমধ্যে বুঝতে শুরু করলো যে,ট্রলারে উঠে সে কতো বড় ভুল ই-না করলো। আগের জীবনটা এত সুন্দর ছিল তা আগে কখনও জানা ছিল না।
ট্রলারের মধ্যে খাওয়া বলতে শুধু ২ বেলা ভাত আর সাথে কিছু শুকনো মাছ।
পানি ছিল সীমিত। প্রতিদিন শুধু নির্দিষ্ট সময়ে পানি পাওয়া যেত। এর পর মারা গেলেও আর পানি পাওয়া যাবে না। পানির জন্য বেশি জোর করতে গেলে সাথে আছে সঙ্গিদের খবরদারি,মাতব্বরি আর গালাগালি। তাদের কথা হল,ভাই পানি কি শুধু আপনি একলাই খাবেন?আমাদের সবারি তো বাচতে হবে।
ট্রলার চলছে তো চলছে। ওস্তাদ এর সারাদিন-ই মেজাজ খারাপ থাকত। ঝাল মেটাত ওর সাগরেদ এর উপর আর তার সাগরেদ রা ঝাল মেটাত আমাদের উপর। সকাল থেকে রাত অব্দি ট্রলার চলত। রাতে ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়া হতো।
টানা ৭ দিন চলার পর ট্রলার কোন এক দ্বীপে এসে থামল। সব লোক দেখতে কালো কালো টাইপ এর। ট্রলারের সবাই জায়গাটাকে আফ্রিকা বলে চালিয়ে দিলো। ট্রলার আধা বেলা ওই দ্বীপে ছিল। ওই আধা বেলা ওস্তাদ আর তার সঙ্গিদের ট্রলারের উপর ছিল করা নজরদারি।
কারন কেউ যাতে ওই দ্বীপে নেমে যেতে না পারে। আসলে কেউ নেমে গেলে ওস্তাদদেরই সুবিধা। ট্রলারের রসদ কম বেবহার হবে। কিন্তু তাদের ভয় ছিল তাদের কথা জানাজানি হয়ে যাবে এবং এতে তারা বিপদে পরবে। দীর্ঘদিনের রসদ নিয়ে ট্রলার আবার চলতে শুরু করলো।
গতকাল থেকেই রঞ্জু লক্ষ্য করছে সবার মধ্যেই কেমন যেন একটা হিংস্র হিংস্র ভাব চলে এসেছে। সামান্য কথায় মারামারি,ছোটখাটো বিষয় থেকে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যেতে লাগলো। অথচ রঞ্জু তার মাঝে কোন চেঞ্জ খুজে পাচ্চে না। শুধু গোঁফদাড়ি একটু লম্বা হয়ে গেছে। মুখ দিয়েও তিব্র গন্ধ আসছে আর চুল গুলো কেমন যেন কুকরিয়ে যাচ্ছে।
সে ভাবল,”সি-সিকনেস” আস্তে আস্তে সবার মাঝেই আসছে। কারো আসছে মনে আর কারো আসছে শরীরে। সারাদিন শুধু রঞ্জু ট্রলারের আগায় যে গাছের পাটাতন টা আছে সেখানে বসে থাকতো,সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকত আর গুনগুন করে গান গাইত “আমায় ভাসাইলি রে...আমায় ডুবাইলি রে...আকুল দরিয়ার বুজি কুল নাই রে...”
ট্রলার চলছে সম্ভবত আজ ১২ দিন হবে। দিন তারিখের হিসাব অনেক আগেই ভুলে গেছে। ভাতের চালগুলো এখন দেয়া হচ্ছে আধা-সেদ্ধ অবস্থায়।
গলা দিয়ে ঢুকতে কষ্ট হয়। সাগরেদকে জানাতেই বলল এভাবে খেলে খেতে আর না খেলে নাই। এই চাউল পেটে গিয়ে জমাটবদ্ধ হয়ে গেছে। আজ ২ দিন ধরে রঞ্জু টয়লেটে যেতে পারছে না। পেটের ভিতর কেমন যেন সুক্ষ ব্যাথা।
টয়লেটে গিয়ে হাল্কা চেষ্টা করলো কিন্তু লাভ হল না। পেটের ব্যাথা মনে হয় আরও বাড়বে। হটাত কানে এলো ট্রলারে কেমন যেন চেঁচামেচি শুনা যাচ্ছে। দৌড়িয়ে বের হয়ে এলো এবং দেখল সাগরেদরা সবার কাছে যা যা আছে সব জোর করে কেঁড়ে নিয়ে নিচ্চে আর সমুদ্রে ফেলে দিচ্ছে। কারন জিজ্ঞেস করতেই বলল,ট্রলারের ওজন নাকিবেশী হয়ে গেছে যা এই মদ্ধ সমুদ্রে খুব-ই ভয়ঙ্কর।
রঞ্জু দৌড়িয়ে গেলো তার ব্যাগের কাছে এবং ব্যাগ থেকে সিডি গুলো বের করে কাঠের পাটাতনের নিচে লুকিয়ে রাখল। যথাসময়ে সাগরেদ এসে তার কাছ থেকে ব্যাগ কেঁড়ে নিলো। সুদুমাত্র তাকে ভালভাবে চেক করলো আর তার অসাবধানতার দরুন সিডি গুলো ডেকে ফেলল। সিডি গুলো নিয়ে ফেলার সময় রঞ্জু অনেক কাকুতি মিনতি করলো শুধু সিডি গুলো দিয়ে দেয়ার জন্য এবং সেই সাথে বাধাও দিতে লাগলো। এক পর্যায়ে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে রঞ্জুকে চড় মেরে দিলো এবং সিডি গুলো সমুদ্রে ফেলে দিলো।
রঞ্জুর দু-চোখ বেয়ে পানি নেমে এলো।
তার আশা ছিল শেষ সম্ভল হিসেবে সিডি গুলো তার কাছে রাখবে এবং কোনও এক দিন সে গানগুলো শুনবে। একেই বলে আশাবাদি। সময়ের সাথে সাথে মানুষের আশা গুলো কতো তুচ্ছ হয়ে যায়, আবার সেই তুচ্ছ আশা মানুষকে নতুন করে বাচাতে শেখায়।
ট্রলারের এই ঘটনার পর থেকে রঞ্জুর আর কিছু ভাল লাগে না।
অথই সমুদ্রে খড়কুটো ধরে বাচার যে আশা ছিল তাও নষ্ট হয়ে গেল। সারাদিন শুধু ট্রলারের পাটাতন এর উপর বসে সমুদ্রের দিকে চেয়ে থাকতো। চোখের দৃষ্টি ধীরে ধীরে হয়ে পড়ছিল অসহায়। সেদিন রাতে সে তার বাবাকে স্বপ্ন দেখল। স্বপ্নে তার বাবা তাকে হাত বাডিয়ে ভাত খেতে ডাকছে আর বলছে এত রাগ করে থাকিস কেন বাবা,দুনিয়াটা তো দুদিনের।
মন শক্ত করো। মধ্যরাতেই রঞ্জুর ঘুম ভেঙ্গে গেলো। উঠেই হাউ মাউ করে কান্না। সে মানসিকভাবে পুরোপুরি ভেঙ্গে গেছে। হাউ মাউ করে কাঁদছে আর অন্ধকারে হাতড়াচ্ছে,যেন আর একটু হাত বাডালেই বাবাকে ছোঁয়া যাবে।
সকাল বেলা ট্রলারের এক লোক এসে জিজ্ঞেস করলো, কাল রাতে কি হয়েছিল ,দেখলাম কান্না করছেন। কোন দুঃস্বপ্ন দেকেছেন?সে লোকটাকে স্বপ্নটি বলল। লোকটি বলল খুবই ভালো স্বপ্ন। আপনার বাবা আপনাকে বলতে চেয়েছেন যে মন শক্ত রাখতে। আপনি এই বিপদ থেকে রক্ষা পাবেন।
উনার কথা শুনে রঞ্জুর মনে হল লোকটা নিজেকেই সান্তনা দিচ্ছে। সবাই শুধু আশা খুঁজছে।
আনলাকি ১৩ বোধ হয় একেই বলে। ১৩তম দিনের দিন মাঝি ঘোষণা দিলো, ট্রলার আর আগে যাবে না। তারা এখন গভীর সমুদ্রে আছে,সামনের পানির অবস্থা দেখে তার ধারনা হচ্ছে সামনে তিমি মাছের আখড়া।
ওখানে তিমি ঘোরাফেরা করছে। আর সামনে যাওয়া যাবে না। ট্রলারের ওস্তাদও দেখি মাঝির সাথে তাল মিলিয়েছে। আপাতত কাজ হচ্ছে ইঞ্জিন বন্ধ করে বসে থাকা। কতদিন লাগবে তা ও টিক নাই।
ট্রলার চললে মনে হয় যেন ট্রলার দাড়িয়ে আছে,আর ট্রলার দাড়িয়ে থাকলে মনে হয় যেন পৃথিবী যেন থমকে আছে। অদ্ভুত অনুভুতি। মোটামুটি স্বপ্ন দেখার পর থেকেই রঞ্জু নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। সে চিন্তা করে রেখেছে মরবই যখন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পৃথিবীর আনন্দ উপভোগ করে মরব।
মাঝিদের গতিবিধি কেমন যেন সন্দেহজনক মনে হতে লাগল।
২ দিন ধরে একই জায়গাই দাড়িয়ে আছে। কেউ একজন বলছিল, ওই সব তিমি টিমি কিছুই না। আমাদের ট্রলার পথ হারিয়ে ফেলেছে। এ তো দেখি মরার উপর খারার ঘা। যা হবার হোক,ট্রলার পথ খুজে পাক আর না পাক রঞ্জু তার নিজের পথ খুজে পেয়েছে।
দিন যায়...হঠাত করে ট্রলার এর একজনের চোখে পড়লো খুব দূরে আলো দেখা যাচ্ছে। জলচে-নিভচে। কিন্তু জলার আর নিভার মদ্দে ছন্দ নেই। আলো একবার ছোট আর একবার বড় দেখা যায়। ট্রলারের সবাই বাতি নিভিয়ে ধীরে ধীরে এগুতে লাগলো।
এই টুকু পথ পাডি দিতে তাদের দেড় দিনের মতো লাগলো।
রাতের বেলা একটা ব্যপশা,গুমোটএলাকায়,বড় বড় প্রবাল এ ভরপুর জাইগায় তাদের সবাইকে নেমে যেতে বলল। রঞ্জু নেমেই টের পেল যে তার গলা সমান পানি আর হাটতে গিয়ে পা কেটে যাচ্ছে প্রবালের কারনে। ট্রলার এর সবাই কার আগে কে নামবে এই নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হল। মাঝি শুধু একবার সবাই কে সতর্ক করে দিলো যে, ইটালির নেভাল গার্ড এই সময় সমুদ্রে চেকিং চলে।
সবাই যেন সাবধান থাকে।
নামার পরপরই সবাই নিকটবর্তী তীর কে লক্ষ্য করে দৌড় দিল। সুধু রঞ্জু ছিল ব্যতিক্রম। এত লোক এক্ সাথে এক জায়গা দিয়ে ডুকলে সমস্যা। তাই সে কিছু দূর ঘুরে তীরে উঠবে চিন্তা করলো।
তার সাথে আছে সেই লোকটা যাকে তার বাবার সপ্নের কথা বলেছিল।
রঞ্জু অনেকক্ষণ হল তীরবর্তী একটা বড় প্রবালের পিছনে,কোমর পানিতে মাথা নিচু করে বসে আছে। সমুদ্র থেকে নেভাল গার্ডের লোকজন খুব পাওয়ারফুল সার্চলাইট নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। লাইট তার কাচাকাচি আসা মাত্র মাতা নিচু করে ফেলে আর লাইট চলে গেলে মাথা তুলে মুক হা করে শ্বাস নেয়।
রঞ্জু প্রবালের আড়াল থেকে বের হল টিক মধ্য দুপুরে।
ও কোন রিস্ক নিতে চাচ্ছে না। সাথে থাকা লোকটাকে বলল আলাদা হয়ে যেতে। লোকটা ওকে অনুনয় করলো যাতে ওকে আলাদা না করে। ও যেখানে যায় লোকটা সেখানে যেতে রাজি। কিন্তু রঞ্জু এসব ইমোশন কে পাত্তা দিলো না।
শহরে ঢুকার মুখে দুজন আলাদা হয়ে গেলো। রঞ্জু কিছুদুর হেটে গিয়ে পৌছাল একটা বাস স্ট্যান্ড এ। সেখানে সে দুজন রমনির পথ আঁটকে ইসারা করে বুঝাতে চাইল যে ও খুব খুদারত। রমনি দুজন প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। পরে রঞ্জু বুঝাল যে সে কয়েকদিন ধরে না খেয়ে আছে।
খুব খারাপ অবস্থা। তখন মেয়ে দুটোর খুব মায়া হল। তারা তাকে ২ টা বার্গার কিনে দিলো,সাথে কিছু টাকা ও ফোন নম্বরও দিলো। এবং বলল যে কোন সাহায্য লাগলে তাদের যেন এই নম্বরে কল করে।
বার্গার খেয়ে রঞ্জু বাহিরে বের হতেই পুলিশ এর গাড়ি এসে তার সামনে থামল এবং তার চুলদাড়ি দেখে তাকে সন্দেহজনক হিসেবে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে গেলো।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।