চার সিটি করপোরেশনে চার মেয়রের সবাই যে মেয়র হিসেবে ব্যর্থ ছিলেন, এ কথা তাঁদের পরম শত্রুরাও হয়তো বলবেন না। তাঁদের প্রত্যেকেরই অল্পবেশি ভুলভ্রান্তি ছিল, দোষত্রুটি ছিল, কারণে-অকারণে হয়তো ছিল হম্বিতম্বি। চারজনই কিন্তু অল্পবিস্তর ভালো কাজ কম করেননি। লোকমুখে শুনেছি, দু-একটা সিটিতে বিদায়ী মেয়র প্রচুর ভালো কাজ করেছেন। তবে এও শুনেছি, অন্য দু-একটা সিটিতে ভালো কাজ তত বেশি হয়নি।
মোদ্দা কথা, স্থানীয় কাজের বিবেচনায় প্রত্যেকেই এত বেশি ভোটের ব্যবধানে হারার মতো ব্যর্থ মেয়র ছিলেন না। অর্থাৎ ভোটের হিসাবে যত খারাপ, আসলে হয়তো স্থানীয় কাজের হিসাবে অত খারাপ তাঁরা ছিলেন না। ভোট যদি হতো মেয়র হিসেবে তাঁদের কাজের মূল্যায়নের নিরিখে, তাহলে তার জোরেই তাঁরা হয়তো নির্বাচিত হতে পারতেন।
যেহেতু নির্বাচিত হননি এবং একজন বাদে তিনজনই হেরেছেন বড় ভোটের ব্যবধানে তাহলে প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে মোটামুটি ভালো কাজ করা সত্ত্বেও এত কম ভোট তাঁরা কেন পেলেন? উত্তরে যাওয়ার আগে সিটি করপোরেশন ভোটারদের একটা বৈশিষ্ট্য আমলে নিতে হবে। পৌরসভা, উপজেলা বা ইউনিয়ন পরিষদের গ্রামাঞ্চলে এবং সেই সঙ্গে ছোট জেলা শহরে বস্তি এবং বস্তিবাসী নেই বললেই চলে।
শহর যত বড়, যেমন ঢাকায় হতদরিদ্র বস্তিবাসীও তত বেশি। এই চার সিটি করপোরেশনে, বড় বড় শহরগুলোয় বেশ বড়সংখ্যক বস্তিবাসী ভোটার ছিল। আমরা সাধারণভাবে ধরে নিই, বস্তিবাসী ভোটাররা সবচেয়ে বেশি হতদরিদ্র, অসহায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত, অর্থাৎ সব মিলিয়ে রাজনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত কম সচেতন। তাই হয়তো অনেকেই ধরে নেবেন, স্থানীয়ভাবে বস্তিতে মেয়রের কৃপায় কিছু সুযোগ-সুবিধা পেলে, হয়তো কিছু টাকাপয়সা নগদ জুটলে তাঁদের ভোট পক্ষে টানা যাবে।
এই চারটা শহরের মধ্যে অন্তত দুটিতে বস্তিবাসীদের জন্য মেয়ররা বেশ কিছু কাজ করেছিলেন, ভোটের আগে টাকাপয়সা লেনদেনেরও গুজব/অভিযোগ এসেছে।
কিন্তু ভোটের দিন শেষে ভোটবাক্সের হিসাব মিলেছে অন্য রকম।
সব মিলিয়ে দাঁড়াচ্ছে, চার সিটি করপোরেশনের ভোটাররা যদি স্থানীয় ইস্যুকে প্রাধান্য দিয়ে ভোট দিতেন, তাহলে চার মেয়রের অন্তত একজন হলেও পুনর্নির্বাচিত হতেন। সুতরাং সন্দেহের অবকাশ নেই, চার সিটির ভোটাররা ভোট দিয়েছেন জাতীয় ইস্যু মাথায় রেখে। তাঁরা সরকারি দলের সদ্য বিদায়ী চার মেয়রের বিপক্ষে যতটা না ভোট দিয়েছেন, তার থেকে বেশি ভোট দিয়েছেন ওই চার মেয়রের সরকারি দলের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে।
আরেকটা ব্যাপার নিশ্চয়ই প্রাধান্য পেয়ে থাকবে, সেটা হলো ২০০৮ সালের মেয়র নির্বাচনের আগে বিগত চার মেয়রের নির্বাচনী হলফনামায় দেওয়া আয়-ব্যয় ও সম্পত্তির হিসাবের সঙ্গে সাড়ে চার বছরের মাথায় এবারের নির্বাচনের সময় দেওয়া হলফনামায় ভীষণভাবে ফুলেফেঁপে ওঠা আয়-ব্যয় ও সম্পদের পাহাড়ের কুৎসিত হিসাব।
আমাদের ধারণা, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবির অন্যতম প্রধান কারণ ছিল অল্প কয়েক বছরে ফুলেফেঁপে ওঠা সম্পদশালীদের সংসদ সদস্য পদে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া। জনগণ ওই ধরনের প্রার্থীদের পছন্দ করেনি। এবারও সাড়ে চার বছরে ফুলেফেঁপে ওঠা প্রার্থীদের ভোটাররা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
সরকারি দলের অনেক কর্মকাণ্ডেই ভোটাররা নিঃসন্দেহে প্রীত নন। প্রধানমন্ত্রী যতই অপছন্দ করেন না কেন বেশির ভাগ ভোটার আসলেই নির্বাচনকালে একটা নিরপেক্ষ সরকার চান।
অর্থমন্ত্রী যতই এই দাবিকে ‘রাবিশ’ আর ‘বোগাস’ বলেন না কেন, হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনাকে জনগণ সহজভাবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি ‘হয় নাই হয় নাই’ এ দাবি এবং দেশপ্রেমিকতার যত বড়াই করা হোক না কেন, জনগণের ধারণা করতে বাকি নেই, আসল ব্যাপারটা কী হয়েছিল ও হতে যাচ্ছিল? ধর্ম নিয়ে সাপলুডু খেলা হচ্ছে পক্ষে-বিপক্ষে, একবার আদর করে আনা, আরেকবার লাঠিপেটা করা, সবকিছুতেই ধর্মান্ধতা খোঁজা—এসব অনেক অনেক ভোটারের বিশাল অপছন্দ। সেই সঙ্গে সবাইকে নিয়ে বক্রোক্তি, বিদ্রূপ, কটাক্ষ এবং পদে পদে হেয় ও ছোট করার প্রাণান্তকর চেষ্টায় ভোটাররা ত্যক্তবিরক্ত।
তাই এই ভোট হয়েছে সরকারের ব্যর্থতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। ভোটারদের যেটা সবচেয়ে বেশি অপছন্দ, সেটা ক্ষমতার বড়াই ও দম্ভ।
অত্যাচারিত জনগণের অত্যাচারীকে শায়েস্তা করার হাতিয়ার একটাই। সেটা হলো, তাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া। এই সুযোগ জনগণ প্রতি পাঁচ বছরে একবার পায়। এবং ওই একটা সুযোগ সহজে তারা হাতছাড়া করে না। আর বাকি মাস ছয়েকের মধ্যে ক্ষমতাসীন দল কি হঠাৎ করে ব্যাপক ভদ্র, নম্র, জনসেবক হতে পারবে? সম্ভাবনা অতিশয় কম।
তবে সরকার যদি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মেনে নেয়, তাহলে আমাদের ধারণা জনগণ সেটাকে সাদরে গ্রহণ করবে সরকারের একটা ভুলের স্বীকারোক্তি হিসেবে। আমরা বাঙালিরা কেউ ভুল করলে এবং স্বীকার করলে তাকে অতি সহজেই ক্ষমা করে দিই।
শাহদীন মালিক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট; পরিচালক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।