নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা যাওয়ার দরকার পড়লেই গায়ে জ্বর আসে। আজ তবু যেতে হলো। সকাল ৬,৫০ এ বের হয়ে রিক্সা>বাস>অটো>রিক্সা ৮,৩০ এ অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিসন। গুলশান এভিনিউ, গুলশান-২ ... অপেক্ষা করছি ...... এদিক ওদিক দেখছি .... হঠাত চোখ গেলো রাস্তার নাম লেখা প্রস্তর ফলকের দিকে, অবহেলায় এক কোনে আবর্জনার পাশে। রাস্তার নামটা অদ্ভুত লাগলো।
নামটা বিদেশী ব্যক্তির নাম, উপরন্তু বীর প্রতীক !! 'বীর প্রতীক Wilhelmus A.S. Ouderland সড়ক' ভাবছিলাম কে এই বিদেশী? ধারণা করলাম, অস্ট্রেলিয়ান হতে পারেন - কেননা এই সড়কের উপরই অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিসন বিল্ডিং। কিন্তু, কিভাবে পেলেন এই খেতাব?
ঢাকার রাস্তায় আজ যানজট নেই, বেশ একটা ফুরফুরে অবস্থা। কাজ সেরে বাসায় ফিরে এলাম ১১,৩০ এ !! সমস্ত প্রশংসা.........
তারপর কাপড় বদলে বসে গেলাম গুগল...গুগল... আর তারপর তথ্য যাচাই বাছাই, অনুবাদ, ইত্যাদি ... ফলাফল ...
বর্ণাঢ্য জীবন, সাহস আর সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক ওডারল্যান্ডের জন্ম ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে, ৬ ডিসেম্বর ১৯১৭ সাল। বিপ্লবের স্বর্ণযুগে জন্ম নেয়া ওডারল্যান্ডের শৈশব কাটে প্রথম মহাযুদ্ধের কঠিন আবহে। ১৯৩৪ সালে বাটা জুতা কোম্পানিতে সু-সাইনার হিসাবে যোগ দেন।
দু বছর পরেই কাজ ছেড়ে দেন এবং যোগ দেন ন্যাশনাল সার্ভিসে। স্বদেশের হয়ে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাঁর ভাষায় 'এক ফুতকারে' উড়ে যায় মিত্র বাহিনী। এক হপ্তাতেই ফ্রান্স, বেলজিয়াম আর হল্যান্ড দখল করে নেয় হিটলার বাহিনী। POW ক্যাম্প থেকে পালিয়ে ওডারল্যান্ড গোয়েন্দাগীরিতে নিয়োজিত হন। উভয় দেশের ভাষা আয়ত্বে থাকায় এ ব্যাপারে কোনো বেগ পেতে হয়নি তাঁকে।
১৯৪০ সালে তিনি ডাচ সেনাবাহিনীর একজন গেরিলা কমান্ডো হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তার সব অভিজ্ঞতা ১৯৭১ এ ঢাকায় সার্থক ভাবে কাজে লেগেছিলো।
ওডারল্যান্ড প্রথম ঢাকা আসেন ১৯৭০ সালে বাটা জুতা কোম্পানিতে কাজের সুবাদে। ১৯৭১ এ স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে কোম্পানি ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ওডারল্যান্ড ব্যস্ত হয়ে পড়েন গোয়েন্দা কর্মকান্ডে। দখলদার পাক-বাহিনীর গোপন যুদ্ধ পরিকল্পনা সংগ্রহ করে তা মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠিয়ে দিতেন।
একজন বিদেশী হিসেবে পাক-বাহিনীর সদর দফতরে যাতায়াত এবং উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাত দুঃসাধ্য না হলেও খুব একটা সহজ ছিল না। তাই তিনি ২২ বালুচ রেজিমেন্ট এর ক্যাপ্টেন সুলতান নেওয়াজের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অবাধে যাতায়াতের ব্যবস্থা করে ফেলেন। ধীরে ধীরে গভর্নর জেনারেল টিক্কা খান এবং তার উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরী হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ইস্টার্ন কমান্ড সদর দফতরের এ,এ,কে, নিয়াজির বিশেষ বন্ধুতে পরিণত হন এবং তাদের সাথে যখন তখন দেখা করার সুবিধা সম্বলিত একটি ‘নিরাপত্তা পাস’ সংগ্রহ করেন। এই সিকিউরিটি পাস খুলে দেয় গোপন তথ্যের ভান্ডার।
ওডারল্যান্ড মুক্তিবাহিনীর জন্য তথ্য সংগ্রহ করে তা পাঠিয়ে দিতেন ২ নং সেক্টরের মেজর এ,টি,এম হায়দারের কাছে পড়ে মেজর জিয়াউর রহমানের কাছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের যতভাবে সম্ভব তিনি সহায়তা করেছেন। কখনো রসদ সরবরাহ করে, কখনো টাকা-পয়সা দিয়ে। ২য় বিশ্বযুদ্ধে গেরিলা যোদ্ধার অভিজ্ঞতার কারণে তিনি ২ নং সেক্টর-এর গেরিলা শাখার সাথে জড়িয়ে পড়েন, এমনকি তিনি টঙ্গির বিভিন্ন গোপন ক্যাম্পে (বাটা জুতা ফ্যাক্টরির ভেতরেও) নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং দিতেন।
তিনি দখলদার পাক-বাহিনীর নানা অত্যাচার আর গণহত্যার (২৫ মার্চ+অন্যান্য) ছবি সংগ্রহ করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার কাছে প্রেরণ করেন।
তিনি লিখেছিলেন, “ইউরোপে আমার যৌবনের সেইসব অভিজ্ঞতা আমার ভেতর আবার ডালপালা মেলছে, এবং আমার মনে হচ্ছে বাংলাদেশে কি ঘটছে তা বিশ্বকে জানানো উচিত। ”
উইলহেলমুস এ, এস, ওডারল্যান্ড ১৯৭৮ সালের জুন মাসে বাটা শু-কোম্পানীর ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস শুরু করেন। ইতোমধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ সাহসিকতাপুর্ণ অবদানের জন্য তাকে ‘বীর প্রতীক’ উপাধীতে ভূষিত করেন। তিনিই একমাত্র বিদেশী যিনি এই বিরল সম্মানের অধিকারী হয়েছেন।
ওডারল্যান্ড প্রায়ই তাঁর স্ত্রী মারিয়া এবং একমাত্র মেয়েকে বলতেন, “Bangladesh mon amor (Bangladesh is our love). Maintain this flow of emotion for the generation to come.” ২০০১ সালের ১৮ মে Wilhelmus A.S. Ouderland পার্থের এক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
২০১০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিসনের সম্মুখের সড়কটির নামকরণ তার নামে করা হয়। ২০১১ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অস্ট্রেলিয়ার পার্থে ২১তম কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দেন। তিনি সম্মেলনের মাঝে সময় করে কারাকাট্টা সিমেটারিতে এই মহান বীরের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
যদি সবকিছু ঠিকঠাক ঘটে, তাহলে আগামি ২৫ আগস্ট আমি অস্ট্রেলিয়ার পার্থে থাকবো। Coincidence !!! ‘Swan River’ হংস নদীর পাড়ের বন্দর শহর ফ্রিম্যান্টেল আমার এবারের গন্তব্য।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।