আমি আমাকে নিয়েই তো এখনও বেচে আছি । একদিনআমাকে নিয়েই চলে যাব । সেদিন খুঁজলেও আর পাবি না..........আমার ভার্চুয়াল ফ্যাক্টরিতে স্বাগতম । আমার মন খারাপের সময়টা এখানে আর ফেসবুকে কাটে । মাঝে মাঝে দু একটা লেখা তৈরি করতে ইচ্ছা হলে চলে আসি এখানে ।
https://www.facebo (১)
প্রসস্থ রাজপথের কোথাও কি কোন অনুভূতি লুকিয়ে আছে ? এই যে হটাত্ই কালো পিচ ঢালা রাস্তায় ঝিলিক দেখা যায় , কিসের ঝিলিক সেটা ? সেটা কি রাস্তার হাসি ? আচ্ছা রাজপথের যদি হাসি থাকে তাহলে তার কি দুঃখও আছে ? কতো যে উদ্ভট চিন্তা আসছে আমার মাথায় ! স্বাভাবিক যে কোন মানুষ এসব শুনলে নিশ্চিত আমাকে মস্তিস্ক বিকৃত ভাববে । অবশ্য এখন আমি মস্তিস্ক বিকৃতই । প্রচন্ড মানসিক চাপে আধা পাগল হয়ে গিয়েছি । নিজের সব অনুভূতি ভোতা হয়ে গেছে । তাই হয়তো অন্যান্য সবকিছুর অব্যাক্ত অনুভূতি নিয়ে চিন্তা ভাবনার ফুসরত মিলে ।
এখন আমি ঢাকা চট্ট্রোগ্রাম মহাসড়কের উপর হাটছি । আমার সবসময় উদার হতে ইচ্ছা করে । কিন্তু আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম সেটা আমার পক্ষে তেমন সহজ হবে । কিন্তু মাঝে মাঝে উদার হওয়ার ইচ্ছাটা বেশ উথলে উঠে । যেমন এখন ভাবতেছি রাস্তার যদি কোন দুঃখ না থাকে তাহলে তাকে কি আমার কিছু দুঃখ দেওয়া যায় ? চিন্তাটার মাঝে একটা সূক্ষ স্বার্থপর ভাব লুকিয়ে থাকে ।
সহজে হয়তো ধরা যায় না । ব্যাপারটাকে বিশেষ পাত্তা দিই না । এ জগত্ সংসারে সবাই কোন না কোন দিক দিয়ে স্বার্থপর । আমিও না হয় একটু হলাম । আপনমনেই বলে উঠলাম "কি রাস্তা মিয়া দুঃখ খাবা ?" ।
আকাশে সাদা মেঘ ভেসে যাচ্ছিলো । কোথায় যায় জানা হয়নি । মেঘের দল রাস্তাটাকে একবার নিজের ছায়ায় আড়াল করে , পরক্ষনেই আবার সরে যায় ।
আমি ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি সেদিকে । রাস্তার ধারে বালু চিক চিক করছে ।
সেই চিক চিক করা বালুর দিকে তাকিয়ে আমার চোখ জোড়া চিক চিক করছে কিনা দেখতে ইচ্ছা হলো খুব । আমি অপ্রকৃতস্থ হয়ে গিয়েছি নাকি ! আমার চিন্তা ভাবনা এতো উদ্ভট কেনো ? কেমন যেনো অনুভূতিহীন খাপছাড়া লাগছে সব । ঠিক যেন একটা ইসিজি মেশিনে মুমূর্ষ কোন রোগীর পালস্ রেট একবার দৃশ্যমান হচ্ছে আরেকবার হারিয়ে যাচ্ছে । তবে হারিয়ে যাওয়ার মাত্রাটা একটু বেশি । অর্থাত্ আমার কল্পনাপ্রবনতা বাস্তবতার চেয়ে বেশি ।
ঘামে চুল ভিজে গিয়েছে । চুল থেকে টপাটপ কয়েক ফোটা ঘাম পড়লো ঘাড়ের উপর । আমি এখন রাস্তার উপর ঠায় দাড়িয়ে আছি । হটাত্ আমার বাম কাধ কেউ জড়িয়ে ধরলো । পাশ ফিরে তাকাতেই হাসানকে দেখতে পেলাম ।
একবার দেখেই মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকালাম আমি । হাসান আমার কাধে টোকা দিল একটা । আবার মুখ ফিরালাম তার দিকে । হাসান মৃদু হেসে বলল "চল" । আমি জিজ্ঞেস করিনি কোথায় যাব অথবা কেন যাব ।
হাসান আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু । সেই হাইস্কুল জীবন থেকে বন্ধুত্ব । মাঝে মাঝে মনে হয় আমাকে আমি যতটুকু চিনি তার চেয়েও বেশি চিনে হাসান ।
(২)
"কি নবাবজাদা কোথা থেকে আসলেন ?" খেকিয়ে উঠলেন চাচি । কি জবাব দিব বুঝে উঠতে পারছি না ।
কারন চাচিকে কোন উত্তর দিলেও লাভ হয় না । তিনি তার বয়ান চালু রাখবেন । আমার ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুল তখন টাইলস দিয়ে বাধাই করা অদৃশ্য সাদা আর্ট পেপারে অদৃশ্য আকিবুকিতে ব্যাস্ত । প্রতিদিন বাসায় ঢুকতেই চাচি এসব কথা শুরু করেন । আমি তখন চুপচাপ দাড়িয়েই থাকি ।
বাসাটার ভিতরে ঢুকলেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে । কিন্তু নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেদের এতো ইগো থাকলে চলে না । বাবা গত হয়েছেন দু বছর । বাড়িতে অসহায় মা আর ছোট বোনটা অসম্ভব কষ্টে দিন যাপন করছে । চাচার বাসায় থেকে ভার্সিটির ক্লাসগুলো করে যাচ্ছি চুপচাপ ।
হলে সিট পেয়ে গেলে সেখানেই চলে যেতাম । কিন্তু সেটা যখন পাচ্ছি না তখন প্রতিদিন আহারের সাথে সাথে কটু কথার তুবড়িও গিলতে হয় । কে যেনো বলেছিল "বোবার শত্রু নেই" । কথাটা সব ক্ষেত্রে সত্য নয় । চুপচাপ থাকলে চাচির কথার মাত্রা আরো প্রসারিত হয় ।
আমতা আমতা করে তাই আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করি ।
চাচা বাসায় ফেরেন রাতে । বাসায় আসা মাত্র চাচার কাছে আমার নামে হাজারটা অভিযোগ আসে । পাশের বাসার ইন্টার পড়ুয়া মেয়েটা কালকে খুব করে রিকোয়েস্ট করেছিল যেনো তাকে ফিজিক্সের কিছু অংক বুঝিয়ে দিই । আজকে সকালে মেয়েটাকে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছিলাম অংকগুলো ।
চাচি সেই ঘটনার অনাহূত বিপদ সর্ম্পকে চাচার কাছে বয়ান করছেন যে যদি আমি মেয়েটার সাথে কোন ধরনের সর্ম্পকে জড়িয়ে যাই তাহলে তাদের স্ট্যাটাস কোথায় নামবে ? চাচা একসময় বিরক্ত হয়ে যান , আমাকে ডেকে বলে দেন যেন এহেন ভালমানুষ সাজার চেষ্টা না করি অন্যকে সাহায্য করতে গিয়ে । ফলাফল সরূপ মেয়েটাকে দেখামাত্রই এর পর থেকে লজ্জায় কুকড়ে যেতাম । চাচাতো ভাইটা একটা বেসরকারী ভার্সিটিতে বিবিএ পড়ছে । উগ্রতার সকল সূত্র প্রমাণ করে বসে আছে সে । তার কাছে আমি স্রেফ গেঁয়ো ভূত ।
আর ভাল লাগে না এখানে । হাসান অবশ্য অনেকবার বলেছে তাদের বাসায় চলে যেতে । কিন্তু আমার এখন কারো বাসায় থাকার ব্যাপারটার উপর থেকে রুচি উঠে গিয়েছে । মায়ের কথা খুব মনে পরে । কিন্তু তেমন একটা কথা হয় না ।
কারন টাকার হিসেবটা খুব ভালই জানা আছে মা ছেলের । মাঝে মাঝে ভাবি এতো গরীব হলাম কেনো ? এ পৃথিবীতে গরীব হয়ে জন্মানোটা একটা অভিশাপ ।
(৩)
হাসান আর ফারিহাকে দেখতে পেলাম একটা গাছের নিচে বসে কথা বলতে । হাসানের সাথে কিছু কথা ছিল । মেয়েটাকে দেখে সেদিকে আর গেলাম না ।
কেমন যেনো অস্বস্থি লাগে । এক মাস আগে হলো দুটো টিউশুনি পেয়েছি । বেতনের টাকা এখনো পাইনি । চার হাজারের মধ্যে তিন হাজার বাড়িতে পাঠাতে হবে । বোনটার সামনেই পরিক্ষা ।
স্কুলের বেতন দেয়া লাগবে । এসব নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলাম হাসানের সাথে । ফারিহা মেয়েটার সাথে প্রথম যেদিন পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল হাসান সেদিন মেয়েটার চোখে অদ্ভুত একটা দৃষ্টি লক্ষ্য করেছিলাম । খুব ভালভাবেই জানা আছে যে সেই দৃষ্টি করুনার । আর আমি চাই না কেউ আমাকে করুনা করুক ।
ক্যাফেটেরিয়াতে গিয়ে বসে রইলাম । পকেটে শুধু বিশ টাকা আছে । এক কাপ চা খেতে খুব ইচ্ছা করছে । কিন্তু চা খেতে গেলে বাস ভাড়া হবে না । বিরক্তিতে ছেয়ে গেল মন ।
আমার জীবন খাতায় প্রতিদিন হাজার হিসাব হয় , হয় হাজার কাটাকুটি । বিশ্রি হয়ে গিয়েছে খাতাটা । মাঝে মাঝে মনে হয় খাতাটা ছিড়ে ফেলি । নাহ আজ খুব বেশিই চায়ের নেশা চেপেছে । হেটেই না হয় বাসায় যাব ।
বেশি চিন্তাভাবনা করে চায়ের অর্ডার দিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম । চা আসার পর চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নিজের পরিস্থিতি বিশ্লেষনে বসলাম । আসলে প্রতিবার বিশ্লেষনেই ব্যার্থতার ফর্দটাই লম্বা হয় বেশি । এখন আমি আমার ভাগ্যকে ইচ্ছামত গালি দিব । মানুষ বড়ই অদ্ভুত ।
আমি খেয়াল করেছি যখন মানুষ কোন কিছুর উপর খুব বিরক্ত হয় অথচ কিছুই করার থাকে না তখন সে ইচ্ছামত যদি গালি দিতে পারে সে জিনিসটাকে তখন অদ্ভুত একটা প্রশান্তি লাভ করে । যখন এসব উল্টাপাল্টা চিন্তা করছি , কখন যে হাসান ফারিহা এসে দাড়িয়েছে আমার টেবিলের সামনে খেয়ালই করিনি । আমি তখনই টের পেয়েছি যখন হাসান আমার বাম কাধের উপর তার হাত রেখেছে । চমকে উঠলাম । হাতের কাপ থেকে ছলকে উঠে চা পড়লো পান্জাবিটার উপর ।
মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো হটাত্ । হাসানকে কড়া গলায় কিছু বলতে যাব ঠিক তখনই ফারিহার দিকে চোখ পড়লো ।
মেয়েটার চোখের তারায় আবারও করুনার দৃষ্টি দেখতে পেলাম । সেই সাথে কৌতুকের আভাসও স্পষ্ট । বিব্রত বোধ করলাম খুব ।
আমার ইতস্তত ভাবটা হাসান ধরতে পারলো । পরিস্থিতি হাল্কা করার জন্য বলল "দোস্ত ফারিহা তোর লেখা 'শেষ দেখা' গল্পটা পড়ে তোর সাথে দেখা করতে চেয়েছিল । তাই নিয়ে এলাম । " ফারিহা একটু হাসলো । তারপর রিন রিনে কন্ঠে বলল "ভাইয়া আপনি খুব ভাল লিখেন ।
বই বের করে ফেলেন । " আবার তার চোখের দিকে তাকালাম কিন্তু এবার তার চোখ আমাকে বলল না যে সে কি সত্য বলছে নাকি মিথ্যা । আমি দায়সারা ভাবে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বের হয়ে এলাম সেখান থেকে । ক্লাস শেষ করে রাস্তায় হাটছি । হটাত্ আমার কাধে টোকা পড়লো ।
পাশ ফিরে দেখি হাসান হাসতেছে । হাসতে হাসতেই বলল "চল রে গাঁধা । আজকে দুই গাঁধা এক সাথে হাটবো । " হাসান কিভাবে যেন সব বুঝে ফেলে । অদ্ভুত একটা ভাল লাগা কাল করলো আমার মাঝে ।
মুচকি হেসে মাথা দোলালাম শুধু ।
(৪)
"কি ব্যাপার ? কথা বলছো না কেনো ? রাগত গলায় বললেন চাচি । আমি বরাবরের মতই চুপচাপ । মুখে কোন রা নেই । আমার চোখজোড়া তখন মেঝের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ।
"আমি জানতে চাইছি টাকাগুলো কোথায় গেল ?" গলার স্বর আরো এক কাঠি বাড়ালেন চাচি । আমি ঘামছি খুব । না অপমানের কারনে নয় , আজকে গরম পরেছে বেশ । নিন্ম মধ্যবিত্তদের আর কিছু থাকুক না থাকুক তবে মান ইজ্জতের প্রশ্ন তাদের কাছে অনেক গুরুত্ব বহন করে । আমি সম্ভবত নিন্ম মধ্যবিত্তদের এই সূত্র থেকে বের হতে পেরেছি ।
আড়চোখে চাচার দিকে তাকালাম । চাচা গম্ভীর মুখে বসে আছেন শোফার এক কোনায় । এদিকে চাচির গলার ভলিউম ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে । আমার অবস্থান তখন বাসার দরজার ঠিক বরাবর সামনে । দরজাটা হা হয়ে খুলে আছে ।
সেখান দিয়ে অতি উত্সাহী প্রতিবেলির মুখ উকি দিচ্ছে । আমি খুব আস্তে পিছনে ফিরতেই সেই ইন্টার পড়ুয়া মেয়েটাকে দেখতে পেলাম । এবার লজ্জা লাগা বোধটা সক্রিয় হলো । চাচির দিকে ফিরে মিন মিন কন্ঠে বললাম "চাচি আমি নেইনি" । চাচি আবার খেকিয়ে উঠলেন ।
কেনো যেনো তার গলায় এক ধরনের বিচিত উল্লাস লক্ষ্য করলাম । হয়তো আমার এই উত্তরের অপেক্ষায় ছিলেন । তারপর যাচ্ছে তাই ভাষায় গালাগাল করলেন কিছুক্ষন ।
আমি তখনও চুপচাপ দাড়িয়েই আছি । বুঝে গিয়েছি আসলে এখানে আমার কোন মতামত টিকবে না ।
"তোর মতো চোরকে পুলিশে দেওয়া উচিত" খেকিয়ে উঠলেন চাচি । অনেক্ষন পর চাচা এবার বললেন "কি বলো নাহার ! স্ট্যাটাস কোথায় নামবে ভাবতে পারো ?" । "নামার আর বাকি আছে কি ?" বললেন চাচি । চাচা চুপ হয়ে গেলেন । আমার শেষ ভরষা ছিলেন চাচা ।
চোখের সামনে আশার প্রদিপটা নিভে গেল । জীবনে অনেকবার হতাশ হয়েছি । হতাশার আরেকটা মাত্রা যোগ হলো সেগুলোর সাথে । সুতরাং একটু পর চাচার বাসার সামনে পুলিশের একটা জিপ এসে থামলো । আমাকে প্রায় চোরের মতই গাড়িতে উঠালো ভিকটিম হিসেবে ।
আজকে বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো এমনটা হতো না । বাবা না থাকায় কতটা অসহায় হয়ে গেছি টের পাচ্ছি এখন ! বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো । আমার দেখা হয়নি যে আমারই চাচাতো ভাই তখন বাড়ির পিছনে দাড়িয়ে তার বন্ধুদের সাথে মিলে এতোক্ষন ঘটে যাওয়া পূর্নদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি চুটিয়ে উপভোগ করছিল । মুখে ক্রুর হাসি লেগে ছিল তার । তার জ্যাকেটের বুক পকেট ফোলা ।
সেখান থেকে সামান্য উকি মেরে আছে টাকার বান্ডেলটা । হয়তো সেও মজা পাচ্ছে ।
(৫)
হাসানদের বাসার ছোফার এক কোন গুটিসুটি মেরে বসে আছি আমি । মিনিট বিশেক আগে থানা থেকে হাসান আর তার বাবা আশফাক সাহেব আমাকে বের করে এনেছেন । আশফাক সাহেব বেশ প্রভাবশালী লোক ।
তাই সমস্যা হয়নি । এর আগে হাসানের বাসায় কয়েকবার আসা হয়েছে । তবে তার বাবার সাথে এবারই দেখা হয়েছে প্রথম । "কি ব্যাপার আহনাফ ? তারা তোমাকে ধরে নিয়ে গেলো কেন ?" গম গম করে উঠলো আশফাক সাহেবের গলাটা । "আহ বাবা , সে কিভাবে জানবে ? ওকে কি তোমার তেমন ছেলে মনে হয় ?" বলল হাসান ।
"তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি । "বজ্র কন্ঠে বললেন আশফাক সাহেব । "জ্বি খালু আ. . .আমি ঠিক জানি না । " আস্তে করে জবাব দিলাম । "হমম , তা কোথায় থাকবে ঠিক করেছো ? ও বাড়ির দরজা তো বন্ধ এখন তোমার জন্য ।
" বললেন তিনি । নিরবে এপাশ ওপাশ মাথা নাড়লাম । আশফাক সাহেবের মুখে তাচ্ছিল্যের একটা হাসি ফুটে উঠলো । হাসান দ্রুত বলে উঠলো "কেন বাবা ? আমাদের বাসা তো খালিই । " আশফাক সাহেব রাগী দৃষ্টিতে তাকালেন ছেলের দিকে ।
হাসান আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলো । তার আগেই বলে উঠলাম "আসলে খালু হলে সিট পেয়ে গিয়েছি । হলে থাকতে কষ্ট হবে ভেবে যাইনি । ওখানেই উঠবো । " বলেই সালাম দিয়ে উঠে দাড়ালাম ।
দরজার দিকে হাটা ধরলাম ।
বাহিরে তখন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে । আকাশের গুরুগম্ভীর আয়োয়াজে চারপাশ কেঁপে উঠছে । কোন দ্বিধা ছাড়াই সেই ঝুম বৃষ্টির মাঝে রাস্তায় বের হয়ে এলাম । আমি তখন কিছু ভাবতে পারছিলাম না ।
আজকাল অনুভুতিগুলো সব ভোতা হয়ে গিয়েছে । তাই বৃষ্টির স্পর্শে খুঁজে চলেছি অনুভূতিগুলোকে । যদি কোন অনুভূতির খোঁজ পেয়েই যাই তাহলে মন্দ কি ? অপ্রকৃতস্থ ভাবটা আবার জেগে উঠেছে নিজের মধ্যে । ইচ্ছা করলেই হয়তো এই অস্বাভাবিক ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যেতে পারি । তবে আমি চাই না এড়িয়ে যেতে ।
কারন যাদের পৃথিবীর প্রত্যেকটা ব্যাপারই অস্বাভাবিক , তাদের সাথে অস্বাভাবিক জিনিসগুলোই স্বাভাবিকের খাতায় নাম লেখায় । অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই ভিজে চুপচুপে হয়ে গেলাম । হটাত্ বাম কাধে আলতো করে হাত রাখলো কেউ । পাশ ফিরতেই হাসানকে দেখতে পেলাম । ছেলেটার চোখে মুখে অদ্ভুত বিষন্নতার ছাপ ।
হাসানের মতো হাসিখুশি ছেলেটার মুখে যেটা একেবারেই বেমানান ।
কিছু বোঝার আগেই হাসান আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল "দোস্ত আমাকে ভুল বুঝিস না । আমি তোর পাশে ঠিক এভাবেই থাকবো সবসময় । " জবাবে মৃদু হেসে সায় দিলাম তার কথায় । হাসানের মুখে হাসি ফুটে উঠলো ।
তারপর আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তা পাড় হতে গেলো দৌড়ে । কিন্তু হাসান কিংবা আমি কেউ লক্ষ্য করিনি বিপরিত পাশ থেকে আসা টেম্পোটাকে । টেম্পো চালক শেষ মুহূর্তে ব্রেক চাপলো । রাস্তায় চাকা ঘষা খাওয়ার বিশ্রি শব্দ হলো । কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না ।
হাসানের শরীরটাকে চোখের পলকে আগের অবস্থান থেকে কয়েক ফুট দূরে পরে থাকতে দেখলাম । রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ । আমার পৃথিবী তখন দুটো রূপে সেজেছে । একটা রূপ প্রাকৃতিক বৃষ্টি ভেজা । আরেকটা রূপ মানব সৃষ্ট হাসানের রক্তস্নাত ।
দৌড়ে হাসানের কাছে গিয়ে বসলাম । নিজের অজান্তেই চিত্কার করে কেঁদে উঠলাম । পৃথিবীর হাজার কোলাহল আর বৃষ্টির আয়োয়াজের মাঝে হারিয়ে গেলো আমার চিত্কার ।
(৬)
হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকা হাসানের শেষ দিনগুলোর সঙ্গি ছিলাম আমি । দিন রাত চব্বিশ ঘন্টাই ছিলাম হাসানের সাথে ।
হাসানের মা বাবার আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠতো হসপিটালের পরিবেশ । ফারিহা মেয়েটাও গত কয়েকদিন হসপিটালে ছিল । আজকে সকালে জোড় করে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি । হাসানের জ্ঞান ফেরেনি । ডাক্তাররা কোন আশার বাণীই শোনাতে পারছেন না ।
সবই আল্লাহর উপর নির্ভর করছে । মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে অসম্ভব কিছু নেই । নামাজ পড়ার হারটা ইদানিং বেড়েছে ।
চারদিন পর হাসানের জ্ঞান ফিরলো । আমি তখন তার খুব কাছেই ছিলাম ।
হাসান আমাকে দেখে মুচকি হেসেছিল । তারপর দুর্বল ভঙ্গিতে চোখ বন্ধ করলো । হটাত্ হটাত্ অদ্ভুত কিছু খেয়াল মনে উকি দেয় । এই তো কিছুদিন আগেও হাসানের বাবার ব্যাবহার এক রকম ছিল আর এখন অন্যরকম । আমাদের অনুভূতি এখন একই ।
একই দুঃখে আমরা কাঁদি । আচ্ছা মানুষকে এক কাতারে ফেলতে কি শুধু দুঃখের উপাদানই প্রয়োজন ? হাসানের শেষ মুহূর্তটা তার হাত ধরে বসে ছিলাম আমি । তার হাতের উপর আলতো করে আমার হাত দিয়ে চাপ দিচ্ছিলাম । হাসানের খুব কষ্ট হচ্ছিলো কথা বলতে । তার মা বাবা পাশেই বসে ছিলেন ।
ফারিহা বসে ছিল তার বেডের সাইডে । সবাই কাঁদছিল । কেন যেন আমি কাঁদতে পারিনি । হাসান প্রায় অস্পষ্ট কন্ঠে বলল "দোস্ত । আমাকে ভুল বুঝিস না ।
আমি তোর পাশেই থাকবো । " হাসান চুপ হয়ে গেলো । একেবারে চুপ । পৃথিবীর নিঃস্তব্ধতার জগতের মাঝে আরেকটি নিঃস্তব্ধতার উত্স যোগ হলো ।
হাসানের কবরটা নিজ হাতে খুড়েছিলাম ।
পরম যত্নে তাকে শুয়িয়ে দিয়েছিলাম সেখানে । আমার বন্ধুকে । আমার প্রিয় একটা মানুষকে । না আমি কিন্তু কাঁদিনি । হাসি খুশি একটা মুখ বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল ।
মনের দৃশ্যপটে হাজারো স্মৃতি ঘুড়ছিল ।
মহাসড়কের উপর হাটতে হাটতে হাসানের কথা ভাবছিলাম । আকাশ কেঁদে চলেছে আকুল হয়ে । আকাশটা ঠিক আমার মতো কাঁদলে তার চোখ মুছে দেওয়ার কেউ থাকে না । এক সময় কান্না শুকিয়ে যায় ।
আমার এতোদিন একটা মানুষ ছিল কান্না মুছে দেওয়ার । আমার বন্ধু হাসান । সে হারিয়ে গেছে । আমি জানি না কেনো যেনো মনে হচ্ছে আমি Terry Jacks এর সেই বিখ্যাত Seasons in the sun গানটা শুনতে পাচ্ছি । আমি সম্ভবত আবার অপ্রকৃতস্থ হয়ে যাচ্ছি ।
আমার আজ অপ্রকৃতস্থ হতে কোন বাধা নেই । কারন যে এতোদিন বাঁধা দিত সে হারিয়ে গেছে । আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি গানটা . .
Goodbye to you, my trusted friend.
We've known each other since we're nine or ten.
Together we climbed hills or trees.
Learned of love and ABC's,
skinned our hearts and skinned our knees.
Goodbye my friend, it's hard to die,
when all the birds are singing in the sky,
Now that the spring is in the air.
Pretty girls are everywhere.
When you see them I'll be there.
We had joy, we had fun, we had seasons in the sun.
But the hills that we climbed
were just seasons out of time.
আমার এখনো মনে হচ্ছে হাসান সেই পরিচিত ভঙ্গিতে আমার কাধ জড়িয়ে ধরবে । আলতো করে টোকা দিবে কাধে । আর আমি পাশ ফিরে তার মায়াময় মুখটাতে সেই পরিচিত হাসি দেখতে পাবো ।
বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেলো আরো । আমার তখন সত্যিই মনে হচ্ছে আমার বাম কাধ কেউ জড়িয়ে ধরেছে । আমি জানি এটা অবাস্তব কিন্তু তবুও বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে । ভয়ে পাশ ফিরছি না । যদি হাসানকে দেখতে না পাই আর ? থাকুক না অবাস্তব চিন্তা ।
বাস্তবতার মাঝে কিছুটা সময় না হয় নাই বা কাটালাম । অপ্রকৃতস্থ হয়ে গেছি আজ পুরোপুরি । আমার তাতে কোন আক্ষেপ নেই । তবুও অপ্রকৃতস্থ হওয়ার মাঝে আজকে একটা অদ্ভুত চাপা কষ্ট লুকিয়ে আছে । আজকে আমার অবাস্তবতার মাঝেই থাকতে ইচ্ছা করছে ।
খুব বেশি ইচ্ছা করছে । নিঃশব্দে আমার চোখ থেকে টপ করে এক ফোটা অশ্রু বের হয়ে মিশে গেলো বৃষ্টির পানির মতো । যার খোঁজ কখনো আর পাওয়া হবে না ।
উত্সর্গঃ
প্রিয় বন্ধু নাঈম হাসান সুস্ময়কে । নাঈমের সাথে পরিচয় সেই হাফপ্যান্ট কাল থেকে ।
এই যখন ক্লাস থ্রি তে পড়ি তখন থেকে । তারপর পেরিয়ে গেছে এক যুগ । বন্ধুত্ব অটুট থেকে গেছে । ক্যাডেট কলেজে পড়া দোস্তকে নিয়ে গর্বের অন্ত নেই । দোস্ত আমি তোর পাশে এভাবেই থাকতে চাই ।
থাকতে দিবি তো ? ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।