১৫ আগস্ট তারিখটি উচ্চারিত হতেই সকলে ১৯৭৫-এর নিমর্ম হত্যাকাণ্ডের কথা বোঝেন, অনুরূপভাবে ২১ আগস্ট বলতে ২০০৪ সালে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা, ২৪ জনের মৃতু্য, ৩ শতাধিক নেতাকর্মীর হতাহত হওয়ার বীভৎস ঘটনার কথাই মনে পড়ে। উভয় হত্যাকান্ডের মধ্যে বেশ কিছু অমিল আছে, তবে লক্ষ্য ছিল অভিন্ন। অমিলগুলো হলো ১৫ আগস্টের হত্যাকা- ঘটেছিল রাতের অঁধারে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক এবং বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র তাতে ব্যবহৃত হয়েছিল, সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়া, তবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা কিছু কর্মকর্তা সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল, হত্যাকারীরা বঙ্গবন্ধুকেই শুধু নয়, তাঁর রক্তকে বহন করে এমন নারী-পুরুষ, শিশু_ যে কাউকেই হাতের কাছে পেয়েছিল তাঁদের প্রতি চরম পৈশাচিক মানসিকতা দেখিয়ে একে একে হত্যা করেছে। অন্য দিকে ২১ আগস্ট ঘটানো হয়েছে প্রকাশ্য দিবালোকে, একটি জনসভায় আড়ালে থেকে পরিকল্পিতভাবে কিছু সংখ্যক আরজেস গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়েছিল। তবে উভয় হত্যাকান্ডের মধ্যে যে মিলটি ছিল তা হচ্ছে ১৯৭১-সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সেটিকে পাকিসত্মানের ভাবাদর্শে ফিরিয়ে নেয়া, আধুনিক একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়তে না দেয়া।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডে ঘাতক ও ষড়যন্ত্রকারীদের তাৎক্ষণিক লক্ষ্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা সম্ভব হওয়ায় বাংলাদেশকে একটানা ২১ বছর পাকিসত্মান রাষ্ট্রের ভাবাদর্শে পরিচালিত করা সম্ভব হয়েছে, এই রাষ্ট্রের সংবিধান, প্রতিষ্ঠানসহ অনেক কিছুই সেভাবে পরিবর্তন করা সম্ভব হয়েছে। সেদিক থেকে পঁচাত্তরের ষড়যন্ত্রকারীদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনেকটাই 'সফল' হয়েছে, একাত্তরের শহীদদের স্বপ্নের বাংলাদেশ অনেকটাই প্রতিষ্ঠা করা যায়নি।
দ্বিতীয় হত্যাকান্ডটি ২০০৪-এর ২১ আগস্ট সংঘটিত করা হয়েছিল। ষড়যন্ত্রকারীরা এবারও বেছে নেয় আগস্ট মাসকে। উদ্দেশ্য তাদের একটিই ছিল, তা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যবস্থার সকল সম্ভাবনাকে ধূলিস্যাৎ করে দেয়া।
১৯৭৫ থেকে ২০০৪_সময়ের ব্যবধান ২৯ বছর প্রায় তিন দশক। ঘাতক ও ষড়যন্ত্রকারীদের পঁচাত্তরের মূর্তিতে আবার ফিরে আসার কারণ হলো একটানা ২১ বছর পাকিসত্মানের ভাবাদর্শে বাংলাদেশ শাসনের পর ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ৫ বছরের যে শাসন জাতিকে উপহার দিয়েছে তাতে মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শের পুর্নজাগরণ ঘটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে, তরম্নণ প্রজন্ম অনেক কিছুই মিলিয়ে দেখার সুযোগ পায়। ১৯৯৬-২০০১ সময়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যবস্থার অভ্যনত্মরে নতুনভাবে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, পঁচাত্তরের হত্যাকান্ডকে একাত্তরের চেতনায় গড়ে তোলা বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরম্নদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখার সুযোগ ঘটে। ফলে একাত্তর আবার বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ফিরে আসার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। সেই সম্ভাবনার মূল বাসত্মবতা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামী লীগযে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল নেতৃত্বদানকারী সংগঠন, সেই সংগঠনের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর পুনরাবির্ভাব ঘটেছে তাঁর কন্যার মাধ্যমে।
সুতরাং পঁচাত্তরের পরিকল্পনা ১৯৯৬-২০০১ সালে অনেকটাই ভেসত্মে যায়, ভবিষ্যতে আরও ভেসত্মে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। সেই প্রেক্ষিতেই ২০০৪ সালে রাষ্ট্রশক্তির প্রত্যক্ষ ইন্ধনে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্বকে আরও ভয়াবহভাবে শেষ করে দেয়ার পরিকল্পনা থেকেই ২১ আগস্টকে বেছে নেয়া হয়, গ্রেনেড বর্ষণের আয়োজন করা হয়। পঁচাত্তরের হত্যাকান্ডের আয়োজন থেকে এর বাস্তবায়নের ধরনটি শুধু ভিন্ন ছিল। প্রকাশ্য দিবালোকে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়েতে অনুষ্ঠিত জনসভার মূল বক্তৃতা মঞ্চ তথা খোলা ট্রাকযেখানে শেখ হাসিনাসহ অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতা ক্ষুদ্র পরিসরে জমায়েত ছিলেন, দাঁড়িয়ে ছিলেন। পঁচাত্তর থেকে ২০০৪-এর হত্যাকান্ডের পরিকল্পনাকারীদের অবস্থানগত পার্থক্য ও ছিল।
পঁচাত্তরে যারা হত্যাযজ্ঞে অংশগ্রহণকারী ছিল তারা ছিল সরাসরি একটি বাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, তাঁরা তখন সরকার প্রধানকেই হত্যা করতে আসে, সে কারণে রাতের আঁধারকেই তাদেরকে বাছাই করতে হয়। তবে তারা সবাই ছিল সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষিত ব্যক্তি। তারা নিজেরাও এই ষড়যন্ত্রের মূল পরিকল্পনাকারীদের বড়ো একটি অংশ ছিল, রাজনৈতিক অংশটি হয়তো নেপথ্যে ছিল। কিন্তু ২০০৪ সালের ষড়যন্ত্রের মূল পরিকল্পনাকারীরা ছিল পর্দার একেবারে আড়ালে, গ্রেনেড হামলায় মূল পরিকল্পনাকারীদের অংশ হয়ত হত্যাকান্ড সংঘটনে অংশগ্রহণ করেনি, তবে পরিকল্পনা বাসত্মবায়নের জন্য একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে ব্যবহার করা হয়েছিল। এর কারণ ছিল, তখন রাষ্ট্র এবং সরকার ব্যবস্থার কোন কোন গোষ্ঠী প্রত্যক্ষভাবে এর নেপথ্যে জড়িত ছিল, ঘাতকদের রক্ষা করার দায়দায়িত্ব নেয়ার ব্যবস্থা করা ছিল।
২০০৪ সালে হত্যার লক্ষ্যবস্তুতে যারা ছিলেন তারা কেউ তখন রাষ্ট্রপরিচালনায় যুক্ত ছিলেন না, সুতরাং, প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যাকা- সংঘটিত করার ক্ষেত্রে ঘাতকদের বিপদ বা ঝুঁকি কম ছিল, ট্যাঙ্ক, ভারি অস্ত্রশস্ত্রও তাদের প্রয়োজন ছিল না। হাতে বহন করার মতো আরজেস গ্রেনেড অস্ত্রই যথেষ্ট ছিল। তাদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য তো সরকারের কোন কোন গোষ্ঠী ছিলই। যারা গ্রেনেডের লক্ষ্যবস্তুতে ছিলেন তারা ছিলেন নিরস্ত্র, তাদের রক্ষা করার কোন রাষ্ট্রীয় বাহিনী ছিল না। ২৯ বছরের ব্যবধানে ষড়যন্ত্র বাসত্মবায়নে এ সব ভিন্নতা ও বাসত্মবতা মিলিয়ে দেখার বিষয়, বিবেচনায় নেয়ার বিষয়।
তবে পঁচাত্তরে ঘাতকরা অনেকটা 'সফল' হলেও ২০০৪ সালের পরিকল্পনা অনেকটাই 'সফল' হতে পারে নি। বিশেষত এই হামলার মূল টার্গেট তথা শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লাগের একঝাঁক মূল নেতৃবৃন্দ গ্রেনেডের লক্ষ্যবস্তু থেকে বেঁচে যাওয়ায় মূল পরিকল্পনাকারীদের আসল লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। তবে ছোট পরিসরে অপেক্ষাকৃত কম আয়োজনে প্রাণহানি, আহতের ক্ষয়-ক্ষতি কিন্তু ব্যাপকই ছিল। অতএব তাৎক্ষণিক ক্ষতি ২০০৪ সালে অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও শেখ হাসিনা এবং মূল নেতৃবৃন্দ বেঁচে যাওয়ায় সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক বিপর্যয় ঘটানো সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর গোটা পরিস্থিতি ঘাতকদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া ছিল শুধু সময়ের ব্যাপার।
সে কারণে এখন পঁচাত্তরকে সকল বিবেচনায় নিয়ে ২০০৪ সালের ২১-এর আগস্টকে দেখার চেষ্টা করলে সহজেই অনুমেয় যে যদি ২১ আগস্টের হত্যাকান্ডে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ মূল নেতৃবৃন্দ মারা যেতেন, তাহলে রাজনৈতিক শূন্যতার পরিণতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াত, বাংলাদেশকে পাকিসত্মানের ভাবাদর্শ রাষ্ট্রে পুরোপুরিভাবে পরিণত করার পরিকল্পনা বাসত্মবায়ন করা ষড়যন্ত্রকারীদের পক্ষে কতোখানি সহজ হতো_তা সহজেই অনুমেয়। একইভাবে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু যদি কোন প্রকারে বেঁচে যেতেন তাহলে পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এভাবে পাকিসত্মানের ভূত চেপে বসা মোটেই সম্ভব হতো না। সুতরাং এই দুই হত্যাযজ্ঞের পরবর্তী বাসত্মবতাকে মিলিয়ে দেখার মধ্যেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যবস্থার অনেক কিছু শেখা এবং বোঝার রয়েছে।
এখন আমরা অনেকেই হয়ত বুঝতে পারছি যে, ১৯৭৫ সালে দেশীয় এবং আনত্মর্জাতিক একটি গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতার বড় ধরনের পরিবর্তন চেয়েছিল, এটিই তাদের মূল লক্ষ্য ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তনের ফলে আমাদের জাতীয় জীবনে কী কী অর্জন পরিত্যাজ্য ও বিসর্জিত হতে যাচ্ছিল তা দীর্ঘদিন অনেকেই বুঝতে চায়নি।
অনেকেই পঁচাত্তরের রাজনৈতিক হত্যাকা-কে বাকশাল প্রতিষ্ঠার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই শুধু দেখেছেন। যারা ষড়যন্ত্রকারী ও ঘাতকগোষ্ঠী ছিল তারা সংখ্যায় অপেক্ষাকৃত কম হতে পারে, কিন্তু তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিচার-বিশেস্নষণ বেশ স্বচ্ছ ছিল, তারা বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর রাজনৈতিক সবলতা ও সীমাবদ্ধগুলো ভালভাবে বুঝতেন। তারা এটিও ভালভাবে বুঝতেন যে, টুঙ্গিপাড়ার ছেলে হলে কী হবে, শেখ মুজিব তাঁর পূর্বেকার বা সমসাময়িক সকল নেতাকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পেরেছেন। তারা শেখ মুজিবের রাজনৈতিক এমন সবল দিক সম্পর্কে অবগত ছিলেন। হতে পারে তাদের বুদ্ধিদাতাদের বেশির ভাগই বাইরের ছিলেন, রাজনৈতিক বিদ্যাবুদ্ধিতেও তারা হয়ত অনেক বেশি বিচক্ষণ ছিলেন।
সুতরাং পঁচাত্তরে ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে বা প্রকাশ্যে যারা ছিলেন তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কে তা ভাল করে জানতেন, এই রাজনীতির মানুষটি দেশ স্বাধীন করার পর রাষ্ট্র গঠনে কত দূর পর্যনত্ম যেতে পারেন তাও অনুমান করতে পেরেছিলেন। ১৯৭২ থেকে '৭৫ সময়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ভিশন-মিশন অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যায় দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারী, ঘাতক গোষ্ঠীর কাছে। তারা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল যে, বাংলাদেশ থেকে মুজিবের হাতে শোষিতের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ একদিন রাজনৈতিক বাসত্মবতারূপে দৃশ্যমান হবেই। ধাপে ধাপে শেখ মুজিব একটি অসামপ্রদায়িক আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তুলবেনই_যা তৎকালীন 'তৃতীয় বিশ্বের' উন্নয়ন মডেল হয়ে ধরা দিতে পারে। শেখ মুজিবের রাজনীতির মধ্যে প্রগতিশীলতার নানা মিশ্রণ এবং বিবর্তনবাদিতার নানা উপাদান এমনভাবে ক্রিয়াশীল ছিল যা তাকে পাকিসত্মান আন্দোলন থেকে সরিয়ে নিয়ে নির্ভেজাল জাতীয়তাবাদের ভাবাদর্শে পুষ্ট করেছে, সমাজতন্ত্রের কল্যাণবাদী আকাঙ্ক্ষা তাঁকে আন্দোলিত করেছে, বিপস্নববাদের প্রতি সহানুভূতিশীল করেছে, তবে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি অবিচল আস্থাশীল রেখেছে।
এ সব কিছুকে সঙ্গী করে শেখ মুজিব রাজনীতির প্রাণপুরম্নষ রূপে আবির্ভূত হলেন, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি বাংলাদেশ অর্জন করে ছাড়লেনই। শেখ মুজিব এত সব রাজনৈতিক ধাতুতে গড়া মানুষ না হলে সেই সময়কে এতটা ঐতিহাসিক করা সম্ভব হতো না। শেখ মুজিব নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুণে এসবই করতে সক্ষম হলেন। এহেন শেখ মুজিব আধুনিক একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সফল হবেন নাতা রাজনীতির কোন অঙ্কেই হিসাব মেলাতে চায়নি ঘাতক এবং ষড়যন্ত্রকারীরা। তারা দেখছিলেন মুজিব সংবিধান প্রদানসহ নানাভাবে একটি সংসদীয় গণতান্ত্রিক ধারায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে আধুনিক করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু যুদ্ধ, বিশ্ব বাসত্মবতা, পশ্চাৎপদতাসহ নানা জটিলতা তার সেই পথকে প্রতিনিয়ত কণ্টকাকীর্ণ করছিল। তিনি তাই নতুন পথের সন্ধানে বিশ্ববীক্ষার মোড় ঘোরালেন, ষাট-সত্তর দশকের বিশ্ববাসত্মবতা থেকে নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বিবর্তনের নতুন ধারা রচনা করতে চাইলেন। এর পেছনে তার মূল চিন্তা ছিল দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করা। এভাবেই তিনি রাষ্ট্র-রাজনীতির একটি মডেল নির্মাণ করতে চাইলেন। সেই নির্মাণ দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ শেখ মুজিবের কাছ থেকে মোটেও অপ্রত্যাশিত ছিল না।
তিনি এমন প্রত্যাশার প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে এমনিতেই ছিলেন। তবে তাঁর সীমাবদ্ধতা ছিল, তিনি এ ধরনের পরিবর্তনের বিরোধী শক্তির ষড়যন্ত্র কত ভয়াবহ হতে পারে তা বিশ্বাস করতে চাইতেন না, বুঝতে চাইতেন না, গান্ধীর অহিংস রাজনীতির প্রভাব তাঁর ওপর অনেকটাই কার্যকর ছিল। অথচ গান্ধী নিজেই সহিংসদের হাত থেকে প্রাণে বাঁচতে পারেননি। তা ছাড়া পিতার দৃষ্টি দিয়ে সকল সনত্মানকে সমানভাবে ভালবাসা যায় কিন্তু রাষ্ট্রপিতার আসনে বসে সব নাগরিককে এক ধরনের সন্তান হিসেবে পাওয়া যায় না_এই সত্যটুকু তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি। তাঁর পক্ষে না পারার অন্যতম কারণ ছিল একাত্তর সালের বিশাল মুক্তিযুদ্ধে জনগণের সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করতে না পারার বেদনা, জনগণের ভালবাসার ঋণ শোধ করার আবেগতাড়িত বাসনা, সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ক্ষতবিক্ষত দেশে মানুষের অভাব-অনটন মুজিবকে অনেক বেশি দুর্বল করে দিয়েছিল- ভালবাসায় ঋণ শোধ করার প্রতি তাই তিনি ছিলেন অনেক বেশি ব্যাকুল, এ ক্ষেত্রে তিনি নিজের অবস্থানের প্রতি উদাসীন হয়ে গেলেন, এমন অসতর্কতা তার নিজের, পরিবারের এবং গোটা জাতির জন্য কত বড়ো বিপর্যয় নেমে আসতে পারে তা তিনি বোঝার চেষ্টা করেননি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যা ঘটেছিল তা ছিল মুজিবের রাষ্ট্র গঠনে 'দ্বিতীয় বিপ্লব'কে এগিয়ে নেয়ার যাত্রায় প্রতিবিপ্লবীদের মরণকামড়, সেই মরণকামড়ে প্রতিবিপস্নবীরা ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নবেম্বর পর্যন্ত একের পর এক এগিয়ে গেছে, জোর জবরদস্তি, হত্যা, খুন, গ্রেফতারসহ যা কিছু প্রয়োজন ছিল, যতো রক্ত ও তাজাপ্রাণের তাদের প্রয়োজন ছিল তা তারা সংহার করেছে। অবশেষে ক্ষমতার আসনে বসে ঘাতকরা মুক্তিযুদ্ধের নামটার বেশি আর কিছু ব্যবহার করেনি, মানুষকে বোকা বানাতে তাদের জুড়ি ছিল না। হ্যামিলনের বংশীবাদক হিসেবে জিয়াউর রহমানকে তুলে আনা হলো, কিন্তু রাজনীতির ময়দান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিষাক্ত করা হলো, স্বাধীনতাবিরোধী সকল অপশক্তির জন্য উন্মুক্ত করা হলো, পাকিসত্মানী কায়দায় রাষ্ট্র ও ধর্মকে যথেচ্ছভাবে অপব্যবহার করা হলো। একটা ককটেল রাজনীতির জন্ম দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর শোষিতের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে দুরূহ এবং জটিল করে দেয়া হলো। ইতিহাস বিকৃতি, সুবিধাবাদের উত্থান, লুটপাটের সুযোগ অবারিত করা ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশ পঁচাত্তর-পরবর্তী ২১ বছর দ্বিতীয় পাকিসত্মানে পরিণত হয়।
বাংলাদেশকে এই সময়ে চেনার কোনো উপায় ছিল না যে ১৯৭১ সালে এই দেশটি মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন করা হয়েছিল।
১৯৭৫-এর ষড়যন্ত্রকারীদের মূল পরিকল্পনাকারীরা উপমহাদেশের রাজনৈতিক বাসত্মবতাকে বিবেচনায় নিয়েই ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবারের সবচাইতে ছোট শিশু রাসেলসহ সকল সদস্য, নিকট আত্মীয়দের নির্মমভাবে হত্যা করে, একই সঙ্গে তাঁর বিশ্বসত্ম রাজনৈতিক সহচরদেরও অচিরেই জেলখানায় হত্যা করে। মুজিবের রক্ত এবং আদর্শকে নির্মমভাবে নির্মূল করার কারণ হচ্ছে মুজিবের রাজনীতি ও আদর্শ যেন কোনোভাবে বাংলাদেশে পুনর্জন্ম লাভ করতে না পারে। সেই সময় শেখ হাসিনা এবং রেহানা বা শেখ হাসিনার সনত্মানরাও যদি দেশে থাকত তা হলে তাদেরও নিশ্চিত হত্যা করা হতো। ষড়যন্ত্রকারীরা অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়েই ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টকে সংঘটিত করেছিল।
সেই পরিকল্পনার বেশির ভাগই তারা ২১ বছরে বাসত্মবায়ন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতিকে বাংলাদেশে আদর্শবাদী রাজনীতিবিদদের জন্য জটিল এবং কঠিন করে দেয়া হলো।
একটা কথা আমরা জানি, চোর, ডাকাত, ঘাতক এবং ষড়যন্ত্রকারী যত পরিকল্পনা করেই তাদের অপকর্ম সম্পাদন করুক না কেন সব কিছুই তারা উপড়ে ফেলতে পারে না, নিয়ে যেতে পারে না, ধ্বংস করে দিতে পারে না। মহৎ যে কোন আদর্শ ও বাসত্মবতার অবশিষ্টাংশ যত ছোটই হোক একদিন না একদিন তা থেকে সমাজ প্রগতির ধারা শক্তি সঞ্চয় করে আপন অবস্থান নির্মাণ করেই-এটিই ইতিহাসের পরম শিক্ষা। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁর রক্ত এবং আদর্শের রাজনীতিকে নির্মূল করার জন্য যত বুলডোজারই চালানো হোক না কেন, এতবড় মুক্তিযুদ্ধ যে রাজনৈতিক শক্তির নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছিল, যে আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে, যে স্বপ্ন বুকে নিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ যুদ্ধ করেছিল সেই আদর্শকে একেবারে মাটি ও মানুষের হৃদয় থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা যায় না।
সেটি সম্ভব হয়নি। শত প্রতিকূলতার মধ্য থেকেই অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার রাজনৈতিক শক্তি ধীরে ধীরে আপন জায়গা করে নেয়, সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে আপন নিয়মেই শেখ হাসিনার উত্থান ঘটেছে। শেখ হাসিনাকে নতুন বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তাধারায় উজ্জীবিত হতে হয়েছে, তিনি সেভাবে অবস্থান তৈরি করেছেন যা দেশী-বিদেশী সকল বিবেকবোধসম্পন্ন মহলকেই নতুনভাবে আশাবাদী করেছে, আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার প্রতি আস্থাশীল করে তুলছে। মানুষ ২১ বছরের মিথ্যাচার, সুবিধাবাদ এবং ভোগবাদী রাজনীতির স্বরূপ অনেকটা চিনতে পেরেছে। অপরদিকে শত্রম্ন ভেবে যে আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার ষড়যন্ত্র প্রতিনিয়ত হচ্ছিল সে সম্পর্কে অনেকটাই সচেতন হতে পেরেছে দেশের মানুষ।
বিষয়টি পঁচাত্তরের ষড়যন্ত্রকারী এবং ঘাতকদের অজানা ছিল না। তবে প্রেক্ষাপট অনেকটাই বদলে গেছে। পঁচাত্তরে যে সব বিদেশী ষড়যন্ত্রকারী পরামর্শদাতা, অর্থদাতা ছিল, একুশ শতকে তাদের অবস্থানের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে, ঘাতকদের পেছনে তখন আনত্মর্জাতিক মৌলবাদী শক্তিসমূহই সংঘবদ্ধ হয়, তাদের বুদ্ধি পরামর্শ এবং এদেশীয় এজেন্ট, রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত কোন কোন শক্তিই নতুন বাসত্মবতায় শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দিতে পরিকল্পনা করে ছিল। রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে তখনকার ৪ দলীয় জোট সরকারের ভেতরের একটি অংশ পঁচাত্তরের হত্যাকান্ডের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটি কিছু টেকনিক্যাল কারণে ব্যর্থ হয়।
যদি ২১ আগস্টের মূল পরিকল্পনা 'সফল' হতো তা হলে বাংলাদেশ ১৯৭৫-পরবর্তী যেভাবে পাকিসত্মানী ধারায় ফিরে গিয়েছিল, একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ফিরে যাচ্ছিল, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ষড়যন্ত্র 'সফল' হলে বাংলাদেশকে একটি তালেবানী, জঙ্গীবাদী, মৌলবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ষড়যন্ত্রকারীদের আর কোনো শক্ত বাধা থাকত না, সে ক্ষেত্রে বেগম খালেদা জিয়া-তারেক রহমান, জামায়াতসহ অতি দক্ষিণপন্থী দলগুলো ২০০৬ সালে বিনা নির্বাচনেই রাষ্ট্রক্ষমতায় নতুনভাবে আবিভর্ূত হতে পারত। সেটিই হয়ত মূল পরিকল্পনাকারীদের বিবেচনায় ছিল, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় তখন থেকে আরও বেশ কিছু কাল ঐ সব ব্যক্তি ও শক্তিকে দেখা যেত, বাংলাদেশ রাষ্ট্র তাহলে নতুন করে অনেক দিনই আধুনিক প্রতিষ্ঠান, দৃষ্টিভঙ্গি, শিক্ষা-দীক্ষা ও পরিকল্পনার ছোঁয়া খুঁজে পেত না, বাংলাদেশ আবারও মিথ্যাকে পুঁজি করে চলতে শুরম্ন করতো, দেশ আবার দম্ভ, সামপ্রদায়িক শক্তির করলে পড়ত, প্রতীক্ষায় থাকতে হতো নতুনভাবে মুজিব আদর্শের আর একজন ধারকের। জানিনা তিনি কে হতেন, বঙ্গবন্ধু পরিবারের নবীন না অন্য কেউ, নাকি বেঁচে থাকা আওয়ামী লীগ নেতৃবন্দ। সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে ২১ আগস্টে ঘাতক চক্র 'সফল' হলে আবার গোটা জাতি আর একবার নতুন করে পেছনে নিক্ষিপ্ত হতো, বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্যে অর্থনৈতিক মুক্তি, রাজনৈতিক স্বাধীনতা সুদূরপরাহত হতো।
আমাদের ভাগ্য, ষড়ন্ত্রকারীরা সেদিন ব্যর্থ হয়েছিল, শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ প্রাণে বেঁচে গেছেন। শুধু কষ্ট হয় আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মীর জন্য, তিন শতাধিক আহদের জন্য। এই হতাহতের রক্তের ওপর বাংলাদেশ ২০০৪ সাল থেকে নতুনভাবে দাঁড়ানোর শিক্ষা পেয়েছে, ২০০৮ সালের ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমরা সেই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাই নতুন করে করতে দেখেছি। সুতরাং এখন ইতিহাসের এমন সব যন্ত্রণাদায়ক পথকে স্মরণ করে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া শোষিতের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে রাজনীতি সচেতন মহলকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে, দিন বদল করতে হবে। লেখক: মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী।
লেখাটির তথ্যসূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৭ আগস্ট ২০১০ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।