আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পশু ও তৈলাক্ত বাঁশ

বসে আছি পথ চেয়ে.... গ্রিক উপকথা অনুযায়ী, দেবতা জিউসের আদেশে প্রমিথিউস পৃথিবীতে পশু ও মানুষ দুইই সৃষ্টি করলেন; কিন্তু অসর্কতার কারণে পশুর সংখ্যা বেড়ে গেলো। দেবতা জিউস তখন প্রমিথিউসকে বললেন, পশুর সংখ্যা বড় বেশি হয়ে গেছে। এদের কিছু সংখ্যাকে তুমি মানুষে পরিণত করো। মহামতি জিউসের কথা মতো প্রমিথিউস কিছু পশুকে মানুষ করে দিলেন। ফলে কিছু পশু মানুষে পরিণত হলো।

তবে তাদের চেহারা মানুষের মতো হলেও প্রকৃতি ও আচার-আচরণ পশুর মতোই রয়ে গেলো। সেসব পশুস্বভাবের মানুষ পৃথিবীতে একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো। মানুষের স্বাভাব-চরিত্র দেখলে গ্রিক এই উপকথাটি সত্য বলেই মনে হয়। এখনো কিছু কিছু মানুষের মধ্যে পশু-প্রবৃত্তি প্রবলভাবেই বিদ্যমান। অনেক ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে মানবিক গুণাবলির চাইতে পশু-প্রবৃত্তিই প্রকাশিত হয় বেশি।

হিংস্রতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, লোভ, প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত হওয়া, বিবেক-বুদ্ধিহীন অপরিণামদর্শী আচরণ-সব মিলিয়ে পশুর সঙ্গে মানুষের পার্থক্য নিরূপণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। যে যতো বড় কথাই বলুক না কেনো, মানুষ হচ্ছে পশুত্ব এবং মানবিকতার মিশ্রণ। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই একটা করে পশু বাস করে। ভেতরের এই পশুটাকে বশ মানিয়ে লুকিয়ে রেখে, আড়াল করে মানবিক গুণগুলোকে যে সামনে আনতে পারে, সে-ই প্রকৃত মানুষ। মনুষ্যত্ব বা মানবিক গুণগুলোর চর্চা ও বিকাশের মাধ্যমে একজন মানুষ প্রকৃত মানুষে পরিণত হয়।

আর মানুষ যখন চেষ্টা ও অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে প্রকৃত মানুষে পরিণত হয় তখন তার ভেতরের পশুটা আপনাআপনিই মরে যায়। ন্যায়-নীতি, বিবেক, সত্য-এসবই হচ্ছে মানবিক গুণ। এগুলোকে বাদ দিয়ে কেউ মানুষ হতে পারে না। ন্যায়-নীতি-সত্যনিষ্ঠ, বিবেকবান মানুষই প্রকৃত মানুষ। যার মধ্যে এসবের অভাব রয়েছে, তাকে ঠিক মানুষ বলা যাবে না।

পশুর সঙ্গে তাকে তুলনা করাই ঠিক হবে। সেদিক থেকে বিচার করলে আমাদের সমাজে মানুষরূপী পশুর সংখ্যা এখনো কম নয়। আমরা কেবল ঘাতক, দালাল, রাজাকারদেরই পশুশক্তির সঙ্গে তুলনা করি; এর বাইরে যারা চাঁদাবাজ, ঘুষখোর, মুনাফাখোর, ব্যাংকের টাকা মেরে খায়, খাদ্যে ভেজাল মেশায়, শেয়ার বাজার থেকে টাকা লুট করে, যারা মানুষ পুড়িয়ে মেরে হরতাল সফল করে, যারা প্রতিনিয়ত মিথ্যাচার আর দায়িত্বহীন আচরণের মাধ্যমে জাতির সর্বনাশ করে-তাদের আমরা কীভাবে মানুষ বলি? তাদের পশুই বা বলি কোন যুক্তিতে? পশু আর যাই খাক, ঘুষ খায় না। খাদ্যে ভেজাল দেয় না। শেয়ার বাজার আর ব্যাংকের টাকা মেরে খাওয়ার ধান্দা করে না।

স্বজাতির ওপর ঝাপিয়ে পড়ে না। মিথ্যা আশ্বাস দেয় না। ক্ষমতায় গিয়ে ক্ষমতার দাপট দেখায় না, ক্ষমতার অপব্যবহারও করে না। সেই দিক বিবেচনায় মানুষ আসলে পশুরও অধম (তবে অবশ্যই তা সবাই নয়, কেউ কেউ)। মানুষের জীবনে পশুর প্রভাব অপরিসীম।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নয়নের এই যুগেও মানুষের পশুর ওপর নির্ভরতা সীমাহীন। পশুর মাংস, দুধ, চামড়া, হাড় মানুষের বেঁচে থাকার অনিবার্য উপাদান। পশ্চিমা দেশগুলোতে মানুষের সবচাইতে বিশ্বস্ত সঙ্গী ও অনুচর বিভিন্ন পশুপাখি। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের এ যুগে যৌথ পরিবার প্রথা ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছে। মায়া-মমতা-স্নেহের বন্ধন পরিবারকে টিকিয়ে রাখতে পারছে না।

স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন কেউই নয়; জীবন সায়াহ্নে পৌছে তাই পশুই হয়ে দাঁড়াচ্ছে ব্যক্তির সবচাইতে নির্ভরতার জায়গা বা শ্রেষ্ঠ বন্ধু। আমাদের দেশে অবশ্য যৌথ পরিবার প্রথা এখনো টিকে আছে। ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদ এখানে নাগরিক জীবনে বড় পরিবর্তন এনেছে বটে; কিন্তু তা এখনো সবকিছু ল-ভ- করে ফেলেনি। প্রচলিত মূল্যবোধ, পারিবারিক-সামাজিক বন্ধন শিথিল হয়ে আসছে। তাই বলে নিঃসঙ্গ মানুষ এখনো সঙ্গী হিসেবে পশুকে বেছে নেয়ার দলে নাম লেখায়নি।

তবে আমাদের সমাজে গালাগালের ক্ষেত্রে কেনো জানি এখনো প্রবল পশুনির্ভরতা দেখা যায়। ছাগল, গরু, ভেড়া, শুয়োর, কুকুর, গাধা, বানর প্রভৃতি পশু এবং এসব পশুর বাচ্চা বলে আমাদের দেশে হরহামেশাই গালি দেয়া হয়। জীবনে একবারের জন্যও এসব পশু অথবা তাদের বাচ্চা হিসেবে অভিভাবক, প্রতিবেশী, শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধব অথবা অন্য কোনো মহল থেকে অভিহিত হয়নিÑ এমন হতভাগা ব্যক্তি আমাদের সমাজে খুঁজে পাওয়া যাবে না। উদাহরণ বা দৃষ্টান্ত হিসেবেও বিভিন্ন পশুর কথা অত্যন্ত সাবলিলভাবে উল্লেখ করা হয়। সাহিত্যে, বক্তৃতায়, আলোচনায়, বইপুস্তকে পশুর উদাহরণ বার বার আসে।

তবে আমাদের সমাজে শিক্ষিত মহলে পাঠ্যপুস্তকের সেই বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উপরে ওঠার অংকটি অত্যন্ত বিখ্যাত হয়ে আছে। যেখানে বানরটি তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে তিন ফুট উপরে উঠার পর দুই ফুট আবার নিচে নেমে যায়। জাতি হিসেবে আমরা সেই বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উপরে ওঠার দুষ্ট চক্র থেকে বের হতে পারিনি। আমরা কোনো একটি ক্ষেত্রে তিন ফুট উপরে উঠলে অন্য আরেক ক্ষেত্রে দুই ফুট নিচে নেমে যাই। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বাঁশটিকে অকারণে তৈলাক্ত করে তার পর সেই তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উপরে উঠার এই বাহুল্য কসরত দেখানোর খেলার নেতৃত্ব দিচ্ছেন আমাদের মহামান্য নেতানেত্রীরা।

আমলা-ব্যবসায়ীসহ সমাজের নীতি নির্ধারকরা। পদ্মা সেতু নিয়ে এখন পর্যন্ত যা ঘটলো, কর্তাব্যক্তিরা যা বললো, নেপথ্য-নায়করা যা করলো তা কী সেই বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উপরে উঠার চেষ্টার উদাহরণ নয়? মানুষরূপী চতুর বানরের খপ্পর থেকে উদ্ধার পাওয়া আজ জরুরি হয়ে পড়েছে। পশুরা খেয়োখেয়ি করবে, আবার দলবাজরা পশুদের পক্ষ নেবে, ‘বানরের খেলা’ দেখে মুগ্ধ হবে, হোক। কিন্তু যারা এখনও পশু হয়ে যায়নি, যারা প্রকৃতই মানুষ, তাদের তো একটা দায়িত্ব আছে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।