আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

***এক বৃদ্ধা মায়ের আত্মত্যাগের ইতিহাস***

ভোলাহাটের নাম শুনেছেন কেউ? উল্লেখযোগ্য কোনো স্থান নয়, তাই আমাদের শোনবার কথাও নয়। কিন্তু এই ভোলাহাটের আছে এক অনন্য বিশেষত্ব, যেখানে আজ থেকে একচল্লিশ বছর আগে বাস করতেন এক মহীয়সি বৃদ্ধা। এদেশের সর্ব পশ্চিমের যে চারটি ইউনিয়ন তা নিয়েই গঠিত উপজেলা এই 'ভোলাহাট'। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার অন্তর্গত হলেও ভৌগলিক দিক দিয়ে ভারতের মালদহ জেলারই যেন নিকটে এই উপজেলাটি। আর এই প্রান্তবর্তীত স্থানটি ছিল একাত্তরে সেক্টর-৭ এর অন্তর্গত।

এই স্থানে যুদ্ধ তৎপরতা কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ায় কমান্ডার লে. কর্নেল কাজী নূর-উজ্জামান (পরবর্তীতে কর্নেল) নিজে একদিন পরিদর্শনে আসেন ভোলহাটস্থ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প। সারা রাত গাড়ী চালিয়ে প্রত্যুষে ভোলাহাট উপস্থিত হবার পর এই সেক্টরে ঘটে যায় তার জীবনের অন্যতম একটি স্মরণীয় ঘটনা। ভোলাহাট ক্যাম্পে পৌঁছার পরেই তিনি দেখতে পান এক বৃদ্ধা মাথায় ঝুড়ি নিয়ে এগিয়ে আসছে মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পের দিকে। জীর্ণ দেহ, রুক্ষ ত্বক, চোখে পথ চলার ক্লান্তি। কাছে আসবার পরই কমাণ্ডার নূর-উজ্জামান যোদ্ধাদের নির্দেশ দেন বৃদ্ধাটির ঝুড়ির ভেতর কী আছে তা খোঁজ নিতে।

নিজেও এগিয়ে যান বৃদ্ধার কাছে। ঝুঁড়ির ভেতরে উঁকি দিয়েই লাফিয়ে দূরে সরে পড়েন কমাণ্ডার কাজী নূর-উজ্জামান। নির্দেশ দেন এই ঝুঁড়ি যেন সরিয়ে নিয়ে রাখা হয় বহুদূর। কারণ সেই ঝুঁড়ি ভর্তি ছিল এন্টি-পার্সোনাল মাইন, যার বিষ্ফোরণে মৃত্যু নেমে আসতে পারতো উপস্থিত সবার। বুড়িটির কাছ থেকে জানা যায় মুক্তিযোদ্ধারা যে পথ দিয়ে দলদলিয়া নামক একটি ছোট্ট গ্রামের পাশ দিয়ে বোয়ালিয়া যাবার চেষ্টা করতো ঠিক সেই পথেই এক রাতে বুড়ির মনে হলো শত্রুরা কিছু যেন পুঁতে রাখছে।

গ্রামের বয়স্ক এই বৃদ্ধা তার স্বল্প বুদ্ধিতে ভেবেছিল এই জিনিসগুলো লোহা, পেরেক বা কাঁটা জাতীয় কিছু হবে, যা মুক্তিযোদ্ধাদের পায়ে ফুটলে ব্যাথা হতে পারে। এই কারণেই এই নির্বংশা পৌড়া নিজের টুকড়ি নিয়ে একে একে সব মাইনগুলো তুলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আনে তা জমা দিতে। সমরবিদ্যায় বলা হয়ে থাকে, "Bombs & Explosives can't differentiate friends and foes." অর্থাৎ যুদ্ধক্ষেত্রে বোমা এবং বারুদ চিনেনা শত্রু-মিত্র । তাই মাইন উত্তোলনকে বিবেচনা করা হয় যুদ্ধক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হিসেবে। কিন্তু নিজের ঝুঁপড়িতে বসেই এই বৃদ্ধা চিনেছিলেন দেশের শত্রুদের এবং নিজের অজান্তেই বড় একটি ঝুঁকি নিয়ে হলেও বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন দেশের সূর্যসন্তানদের প্রাণ।

দেশ অর্থ কি? দেশ সেই বৃদ্ধাকে কী দিয়েছে জানিনা? কিন্তু সেই বৃদ্ধা নিজের অজান্তেই দেশের যোদ্ধাদের প্রাণ বাঁচাতে যে ঝুঁকিটি নিয়েছেন তা বিশ্বের অন্য কোথাও হলে লেখা থাকতো স্বর্ণাক্ষরে। ভোলানাথ গ্রামটিও আমাদের কাছে অপরিচিত থাকতো না মোটেও। বৃটেনে যেকোনো বেসামরিক ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় অবদান রাখলে তাকে দেওয়া হয় জর্জ ক্রস। কিন্তু আমরা আমাদের সাত কোটি জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতায় একনিষ্ঠভাবে সহানুভূতি প্রকাশকে সম্মান জানাতে পারিনি কোন ভাবেই। এখনো ফুরিয়ে যায় নি সময়।

কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের ইতিহাসবিমুখতা এবং অতীত থেকে শিক্ষা না নেওয়া যে এই দীর্ঘশ্বাসকে প্রলম্বিত করবে তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে? সূত্রঃ এক সেক্টর কমাণ্ডারের স্মৃতিকথা ( কর্নেল কাজী নূর-উজ্জামান) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।