মাথায় অনেক গল্প আসে; কিন্তু লেখার মত পর্যাপ্ত ধৈর্য-শ্রম-অধ্যবসায় নেই। গল্পগুলোকে তাই ছোট করে কবিতা বানাই....
***এর আগের চ্যাপ্টার
অনিমের ঘুম ভাঙল অনেক বেলা করে। সবুজ এর মাঝে দু'বার বমি করে এসে এখন উঠানের মাঝে বসে নিজের মাথায় পানি ঢালছে। শ্রাবণের দুপুর। আজও আকাশে তেমন মেঘ নেই।
সবুজের গা ঘেঁষে অতি অল্প ছায়া তার দক্ষিণ-পূর্বে পড়েছে। ছায়াটা এত অল্প - অনিম ধারণা করল সময় এখন দুপুর বারোটা-সাড়ে বারোটা'র মত হবে। উদাস স্থির হয়ে বসে আছে তার বারান্দায়। অনিমও একঠাঁয় তাকিয়ে কী এক গভীর চিন্তায় যেন মগ্ন।
সবুজ অনিমের দিকে মুখ তুলে হাসল, 'কী গুরু? কী অবস্থা তোর?'
অনিম আচমকা সবুজের দিকে তাকিয়ে বলল, 'Tell me, good Brutus, Can you see your face?'
সবুজ থতমত, 'কী?... এর মানে কি?'
অনিম হালকা হেসে বলল, 'শেকসপিয়ার।
জুলিয়াস সীজার। '
সবুজ একই সুরে বলল, 'তো? এখানে তোর সীজার আসলো কোত্থেকে?'
-'না দোস্ত, সীজার আসে নাই', অনিম হাসে, 'ডায়লগটা আসলো হঠাৎ। আচ্ছা, তুই কী উত্তর দিবি? Can you see your face?'
-'অনিম?', সবুজ কাছে এসে সোজা দাঁড়িয়ে বলল, 'দোস্ত শেষরাতে কি তুইও খানিকটা গলায় ঢালছস?'
উদাস এবার শব্দ করে হেসে ওঠে। না, সে জানে অনিম নেশা করেনি। তবে সে অনিমের কথাগুলো খুব খেয়াল করে শুনতে লাগল।
এই ছেলেটা অন্যরকম।
অনিমও হেসে সবুজের কথা উড়িয়ে দিয়ে বলল, 'ওসব বাদ দে না, বাপ ! শুধু এ্যান্সার-টা দে। Can you see your face? ইয়েস অর নো?
সবুজ সাথে সাথেই জবাব দিল, 'অফকোর্স ইয়েস! কেন পারব না? আয়নার সামনে দাঁড়ালেই তো...'
অনিম তালি দিয়ে ওঠে, 'ওখানেই তো ভুল'টা করলি ! আয়নাতে তো তুই তোর মুখ দেখতে পাস না। যেটা দেখস সেটা হল মুখের মিরর ইমেজ, মানে ওটাকে কি বলে, প্রতিবিম্ব'
উদাস কেমন চমকে উঠল !
অনিম বলে চলে, 'আমরা কেউ সারা জীবন চেষ্টা করেও নিজের মুখ দেখতে পাব না। দেখতে পারব মুখের ছায়া... ব্রুটাস-ও একই উত্তর দিয়েছিল...'
সবুজ এবার সত্যি বিরক্ত হয়, 'তা ঘুম থেকে উঠে এসব কী শুরু করলি? তোর সাথে আর যাব কিনা আমাকে ভাবতে হবে'
অনিম উঠে দাঁড়ায়, 'না দোস্ত।
ভাবছিলাম কাল রাতের কথা... হয় না? হঠাৎ সেল্ফ-রিকগনিশন? কাল রাতে হঠাৎ কেমন একটা বোধ আসলো - ঠিক বোঝাতে পারতেছি না। মনে হচ্ছে কেমন একটা আয়নায় নিজেকে দেখলাম...'
সবুজ ঠাস করে তালির শব্দে দুই হাত এক করে কপালে ঠেকায়, 'বাপ, মাফ করবি আমাকে? বেরোলে চল এখনই বেরোই, লেকচার বন্ধ কর'
উদাস বলে উঠল, 'ভরদুপুরে না খেয়ে কই যাবে বাবু? তারচে আয়োজন সামান্য আছে, তাই মুখে দিয়ে যাও?'
সবুজ ঘুরে তাকায়, 'বাউলচাচা, তোমাকে অনেক জ্বালালাম...'
অনিম হেসে ওঠে, 'এখন আবার বাউলচাচা? কাল সারারাত নেশায় উদাসদা বলে কান্নাকাটি করলি !'
উদাসও হাসতে থাকে। সবুজ জিভ কাটে।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া করেই ওরা উদাসের ঘর থেকে বিদায় নিল।
যাওয়ার আগে উদাস অনিমকে ধরল, 'বাবু? আরশী-বিনে মুখ দেখি না - আরও কি যেন বললে তখন? আরেকটু বুঝিয়ে বলে যাবে?'
অনিম হেসে বলে, 'তুমি তো ভালই বুঝেছো বাউল।
বাকিটা ভেবে নাও? আসল ভাব তো বলেই দিলাম। এরপর আরও বলতে গেলে শুধু 'আমি কী ভেবেছি' সেটাই বলা হবে...'
অনিমকে সরিয়ে সবুজ সামনে এসে দাঁড়ালো, 'বাউল শোনো? তোমার মাথা এমনি অনেক খারাপ আছে। এরচে বেশি খারাপ করো না। নিজে বাঁচো, আমাকেও রক্ষা দাও আরেক লেকচার থেকে'
উদাসকে প্রাণখুলে হাসতে দিয়ে বেরিয়ে আসলো দুজন।
বাউলের ঘর থেকে বেরিয়ে বিলের পথ ধরে হাঁটতে লাগল ওরা।
গতকাল এই পথ ধরেই এসেছে, মনে হচ্ছিল কতটা রাস্তা ! অথচ আজ খুব তাড়াতাড়িই যেন বিল পেরিয়ে এল। পথের বামপাশে মসজিদের সাথে লাগোয়া বিশাল দীঘি। ইমাম সাহেব ঘাটের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পাখির পালক দিয়ে কান খোঁচাচ্ছিলেন। ওদের দেখে খানিক বিরতি দিয়ে তাকিয়ে রইলেন। দূরে সবুজ ক্ষেতের মাঝখান থেকে হঠাৎ কোত্থেকে যেন একঝাঁক শাদা পাখি বেরিয়ে এসে উড়ে চলে গেল।
অনিম মুগ্ধ চোখে বিশাল কার্পেটের মত সবুজ ক্ষেতে বাতাসের দোলা দেখতে লাগল অপলক।
সবুজ খোঁচাল, 'কীরে? তোর মনে আবার কী ভাব জাগ্রত হল?'
অনিম বিড়বিড় করে বলে চলে,
'The waves beside them danced; but they
Out-did the sparkling waves in glee:
A poet could not but be gay,
In such a laughing company:'
তারপর একটু থেমে শ্বাস নিয়ে বলল,
'I gazed---and gazed---but little thought
What wealth the show to me had brought:'
সবুজ তাকায়, 'মানে কী?'
অনিম হাসল, 'ওয়র্ডসওয়র্থ'
সবুজ এবার ক্ষেপে ওঠে, 'ভাই তুই কিন্তু সত্যি পেইন দিচ্ছস ! কী লেকচার শুরু করলি অনবরত? ডিসগাস্টিং...'
অনিম হাসতে লাগল, 'তুই আসলে আজকে ক্ষেপে যাওয়ার মুডে আছোস। নাহলে বুঝতি, এই লাইন গুলায় কোনও লেকচার নাই, পিওর কাব্য। আর দোস্ত লাইফে কিছু ডিসগাস্টিং তো থাকবেই; লাইফ কি উপন্যাস নাকি যে খালি ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটতে থাকবে?' একটু ভেবে আবার বলল, 'উপন্যাস হলে অবশ্য দেখতি, আজ তোর ঘুম ভাঙাত গ্রামের কোনও চপল কিশোরী ! তুই ওই হরহর করে বমি করার পর তোর জন্যে লেবু-পানি নয়তো লেবু-চা করে আনতো, মায়া-মায়া চোখে বলত, "বাবু ভাল লাগছে?" আ-হা দরদ...'
সবুজকে এই প্রথমবার আলাপে খানিক উৎসাহী দেখালো, 'আসলেই দোস্ত ! সেই মেয়ে কেমন হত বল তো? না, আমি বলি... একদম ছিপছিপে একটা মেয়ে, বয়েস ধর ষোলো-সতের। আঁটো-সাটো শাড়ি পড়ে আসত, একদম সিম্পল - কানে দুল বা খোপায় ফুল কোনওটা দরকার নাই।
চুল খোলা হলেই বেটার। তাই না?'
অনিম মুখ টিপে হাসে আর মাথা নাড়ে।
সবুজের সে খেয়াল নেই, 'দোস্ত মেয়েটা কত বেশি ফর্সা হত বল তো?'
অনিম আর হাসি চাপতে পারে না। তারপর বলে, 'ভাল ঔপন্যাসিক হলে মেয়ের গায়ের রং নিয়ে এত চিন্তা করত না। বোধহয় একটু শ্যামলাই রাখত।
শ্যামলা মেয়েদের চেহারায় খুব গাঢ় মায়াবী ভাব থাকে...'
সবুজ হাত নাড়ল, 'ধুর, তুই বেশি বুঝস! ভালো ঔপন্যাসিক হলে অবশ্যই আমার জন্যে একটা নায়িকার মত নায়িকা নিয়ে আসত'
'আর খারাপ ঔপন্যাসিক হলে?, অনিম তাকায়।
'খারাপ ঔপন্যাসিক হলে তো শালা কোনও মেয়েই আনতো না ! তোর ওই ফিলোসফিক্যাল ডায়ালগ দিয়েই সকালটা বরবাদ করত !'
অনিম শব্দ করে হেসে ওঠে, 'তুই শালা আইটেম একটা'
-'হ, তোর উপন্যাসে আইটেম তো একলা আমিই একটা', গজগজ করতে থাকে সবুজ।
'আরে এত্ত মাথা-গরম কেন আজকে তোর? আমি ঐ নভেলের কথা তুলেই ভুল করছি। লাইফ হোক বা নভেল, তোর নায়িকা ঠিক সময়েই আসবে, দেখবি তুই'
ওরা হাইওয়ের কাছে পৌঁছে যায়।
পথের দিকে তাকিয়ে সবুজ প্রশ্ন করে, 'তো গুরু? এবার কোনদিকে?'
অনিম ডাইনে-বাঁয়ে দুদিকেই তাকায়।
বামে দূরে একটা বাঁক আছে, তা না হলে পথটা প্রায় সরলরেখা - দুপাশেই আদিগন্ত বিস্তৃত।
পথের কি শেষ আছে?
হঠাৎ তদের চোখে পড়ে ওপাশের মেঠোপথ ধরে একটা কিশোরী আনমনে গান গাইতে গাইতে দুলে দুলে আসছে, বিল থেকে শাপলা-শালুক কুড়িয়ে। বয়স ষোল-সতের হবে হয়ত, আঁটো-সাটো শাড়ি, খোলা চুল আর খুব মায়াবী মুখ।
মেয়ের গায়ের রং শ্যামলা।
*****************************************************************
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, ব্যস্ত নগরেও।
তবে শহরের সন্ধ্যাগুলো গ্রামের মত অমন ঝুপ করে নেমে আসে না। আকাশটাও বোধহয় শহরের মানুষগুলোকে ভয় পায় - চমকে দিতে চায় না। ঝুমু বারান্দায় বসে সন্ধ্যার নেমে আসা দেখছে। রাস্তায় মানুষ, গাড়ি, আলো বা শব্দ কেউ স্থির নয় - সবার সে কী তাড়াহুড়া !
ঝুমু আকাশের দিকে তাকায়। বেশ ক'দিন পর আজ সন্ধ্যার আকাশে মেঘ নেই।
একটা-দুটা করে তারা জেগে উঠছে। অনেকগুলো তারা আছে, খুব খেয়াল না করলে দেখা যায় না। ঝুমু'র মনে হচ্ছে খালিচোখে যত তারা দেখা যায়, আজ সব তারা সে দেখতে পাচ্ছে ! ঝুমু হঠাৎ খেয়াল করে, সে বিড়বিড় করে Yeats-এর কবিতা আবৃত্তি করছে ! 'An Indian Song' ! ঝুমু মোটেও Yeats পড়ে না। এটা অনিম ভাই'র প্রিয় কবিতা। অনিমের এত প্রিয় যে, তার মুখে এত অসংখ্যবার শুনে ঝুমু'র পর্যন্ত মুখস্ত হয়ে গিয়েছে ! সেটা অবাক ব্যাপার না।
অবাক ব্যাপার হল, ঝুমু চাইলেও এখন থামতে পারছে না - কবিতাটাই তাকে পেয়ে বসেছে !
এ যেন তার কবিতা, তার গান !
তন্বী মেয়েটার চোখে প্রবল বাষ্প জমে। তবু তার অবাধ্য ঠোঁটদু'টা বিড়বিড় করতেই থাকে,
"How we alone of mortals are
Hid in the earth’s most hidden part,
While grows our love an Indian star,
A meteor of the burning heart..."
অনিম কোথায় এখন? Hid in the earth’s most hidden part?
ঝুমু এত ভাবতে পারে না, এত ভাবতে চায়ও না আর।
সে শুধু আনমনে ফিসফিস করতে থাকে, 'a meteor of the burning heart...a meteor of the burning heart...'
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।