আমি সাইফুল্লাহ সাইফ । পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে "ইনফরমেইশন এন্ড কমুনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং" বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে পরছি । অনেক কিছুই ভালো লাগে; বই পড়া, ভ্রমন করা, গান শুনা আরও আনেক । একজন সৎ আদর্শবান মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখি । নিজে লেখালেখি করি, এ
‘মাষ্টার গত তিন মাসের ভাড়া দ্যাও নাই ।
বাড়ি ভাড়া দেওয়ার সময় ভাবছিলাম মাষ্টার মানুষ, ভদ্র স্বভাবের হইব, কথার দাম থাকব । কিন্তু এতো দেখি মহা ধুরন্দর! প্রথম মাসে কইছিলা হাত খালি, পরের মাসে দিবা । আমি মানলাম । তার পরের মাসে এইটা সেইটা ওজুহাতে কাটাইলা । গত মাসে কইলা, এই মাসের শুরুতে সব টাকা পরিশোধ করবা ।
কয়দিন ধইরা ক্যাবল আওয়া আর যাওয়া । তোমার খোঁজ খবর নাই । আমি আসার খবর পাইলেই তুমি যে ঘরের পিছনের দরজা দিয়া চইল্যা যাও, এইটাও আমি বুঝি । কওতো মিয়া, তোমারে বাড়িডা ভাড়া দিয়া আমি কি মুসিবতে আছি! আমি আর কিছু সহ্য করমু না কইলাম । কাইল একবার আমু ।
ভাড়া দিলে বাড়িতে থাকবা, নাইলে কাইলই চইল্যা যাইবা । তোমার যেমন প্যাট চলে মাষ্টারি কইরা, আমার তেমন রুজি-রোজগার চলে এই বাড়ির ভাড়া দিয়া । সংসারডা চলে এই দিয়া । আমি আর কথা বাড়ামু না । যাই ।
’
আবুল হোসেন চলে যায় । তিনি এই বাড়ির মালিক । বুলুরা ভাড়া থাকে । বুলুর বাবা রুপনগর রেজিস্টার্ড প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক । বুলু এবং বকুল দুই ভাই বোন ।
বকুল বয়সে বুলুর চেয়ে পাঁচ বছরের বড় । কিছুদিন হল তার বিয়ে হয়েছে । বুলু ক্লাস সিক্সে পড়ে ।
বুলুর বাবা আতিক মাষ্টার । তাঁর পৈত্রিক নিবাস একটি আজপারাগাঁয়ে ।
আতিক মাষ্টার সেকালে ম্যাট্রিক পাশ করে গ্রাঁমের সবচেয়ে শিক্ষিত বলে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন । বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষ কৃষিকাজ করেছে । তাঁরা ছিলেন অশিক্ষিত । আতিক মাষ্টার শিক্ষিত মানুষ, তাদের পথে চলতে তাঁর বিবেকে বাঁধে । তিনি চাকরির সন্ধান করতে থাকেন ।
অনেকদিন ঘুরে ফিরে তাঁর এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের মাধ্যমে তিনি এই স্কুলের চাকরীটি যোগাড় করেন ।
স্কুলটি জেলা সদরের কাছাকাছি একটি গ্রাম্য এলাকায় । গ্রাম এলাকা বলে স্কুলের আশেপাশে কোন বাড়ি ভাড়া পাওয়া গেল না । তাই নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে এক নতুন দিনের আশায় তিনি জেলা শহরেই পত্তন করেন ।
তাছাড়া জেলা শহরের প্রতি তাঁর একটি বিশেষ দুর্বলতা ছিল ।
তিনি তাঁর ছেলেমেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন । কিন্তু গ্রামের অন্ধকার পরিবেশে আলোর কোন সুযোগ নেই ।
শহরে এসে তাঁর একটাই লক্ষ্য ছিল । একটি জমি কিনে সেখানে তিনি নিজের বাড়ি বানাবেন । একটি ছোট সংসার, তাতে কয়েকজন প্রানি ।
ব্যাস, এটুকুইতো স্বপ্ন তার মত একজন স্কুল শিক্ষকের!
সরকারী স্কুল হলেও কথা ছিল । একজন রেজিস্টার্ড স্কুল শিক্ষকের জন্য এটা অনেক বড় স্বপ্ন! কত আর বেতন! এই একমুঠো বান্ডেল টাকা থেকে এদিকওদিক নোট ফসকে বেড়িয়ে যাওয়া ক্ষেত্রের যেন আর অভাব নেই ।
সংসার, ছেলেমেয়ের পড়ার খরচ, বাড়ি ভাড়া, এই তিনটি আবশ্যক বিষয়কে এক করলে সেই একমুঠো খালি হয়ে শূন্যস্থান পুরনের জন্য অন্যের কাছে হাত পাততে হয় । পরের মাসে অন্যের টাকা পরিশোধ করতে গেলে বাড়ি ভাড়া দেয়া হয় না । বিচিত্র এক জীবন বৃত্ত!
আতিক মাষ্টারকে এই বৃত্তে ঘুড়তে ঘুড়তে নিজের সংসারটাকেও ঘুড়াতে হয় ।
তাকে চলতে হয়, কাক-শালিকের ঘর বাঁধার নিয়মে । যেন একটি কাক নতুন বাসা বানিয়ে অপেক্ষা করছে তার বাচ্চা ফুটার জন্যে । তারপরই ফুড়ুৎ করে একদিন এত কষ্টে গড়া বাড়িটি ছেড়ে উড়াল দেবে শূন্য আকাশের বুকে । পেছনে জমে থাকা স্মৃতিগুলোকে বাতাসে উড়িয়ে দেবে উড়ে যাওয়া পাখিটির পালকের মত । কিন্তু পাখির পালকের উড়ে যাওয়ার যে ক্ষমতা আছে, সেই ক্ষমতাটুকু আতিক মাষ্টারের স্মৃতিগুলোর নেই ।
কেননা মানুষের স্মৃতি স্ফটিকের মত কঠিন পদার্থ । ইচ্ছে হলেই তাকে বায়বীয় পদার্থের মত করে উড়িয়ে দেয়া যায় না । নতুন করে আরেকটি ঘরের জায়গা খুজলেও আতিক মাষ্টার কিন্তু স্মৃতির দংশনে আত্মবিদগ্ধ হন । আজ এখানে, কাল ওখানে এই জীবনটি তিনি সহজ চোখে দেখতে পারেননা । ক্ষণস্থায়ী জীবনব্যবস্থাটি তাকে কাঁদায়, তার অন্তর্যামীতে এসে ঘা দেয় ! এটাই কী জীবন!
অবশ্য পৃথিবীটাই এক হিসেবে সম্ভবনা ও অনিশ্চয়তার সমষ্টি ।
সেখানে মানুষের জীবন, জীবিকা, অর্থ, খ্যতি, সবইতো গৌন । তবু পৃথিবী তার গৌন বিষয়কেই আপন বলে জানে । এই যেমন আতিক মাষ্টারের জীবন ও জীবিকা, একটুকু বেঁচে থাকার স্বপ্ন, সবইতো গৌণ । পৃথিবী যেন এই গৌণতাকে মহোৎসব করে চালিয়ে নেয় তার আপন সব আয়োজন নিজের মত করে ।
এখন পর্যন্ত তাঁরা সর্বোচ্চ যে বাড়িতে স্থায়ী হয়েছেন, তার মেয়াদ এক বছর ।
তারপর থেকে ছয় মাস, পাঁচ মাস, তিন মাসের মাথায় তাঁদের বাড়ি পরিবর্তন করতে হচ্ছে ।
আতিক মাষ্টার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন ছেলে তার মেয়ের পড়াশুনার উপর । মেয়েকে পড়ালেখা শিখিয়ে বিয়ে দিয়েছেন । মেয়ের বিয়ে তাকে সবচেয়ে বেশি এলোমেলো করে দিয়েছে । তা নাহলে গত তিন মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি থাকত না ।
তাছাড়া মেয়ের শ্বশুর বাড়ি কত আনুসঙ্গিক খরচপাতি দিতে হচ্ছে!
বুলুর বয়স কম হলেও সে বুঝতে পারে, তার বাবা অন্য সবার বাবার মত ছেলের সব ইচ্ছা পূরণ করতে পারবেন না । এতে তার কোন ক্ষোভ নেই । তাদের যে এতো বড় পৃথিবীতে সামান্য এক খণ্ড জমি পর্যন্ত নেই, একথাও বুলু জানে । সম্ভবত এ জন্যই বাবার প্রতি তার এত মায়া! বুলু পড়ালেখা শিখে একদিন বড় হয়ে বাবার ইচ্ছা ঠিকই পূরণ করবে । মাত্র বড় হওয়ার অপেক্ষা!
সন্ধ্যে হলেই বুলু তার বাবার কাছে পড়তে বসে ।
বাবা তার হাতের লেখার খাতায় প্রতিদিন একটি করে প্রবাদবাক্য লেখায় ।
আজ বুলু লিখছিল, পড়ালেখা করে যে, গাড়িঘোড়ায় চড়ে সে ।
বুলু লিখে আর ভাবে, ‘তার গাড়িঘোড়ায় চড়ার দরকার নেই, শুধুমাত্র একখণ্ড জমিতে নিজের একটি বাড়ি হলেই হবে । যেখানে কেউ ভাড়া চাইতে আসবে না আবুল হোসেনের মত । তার বাবাকেও এমন অপমান সহ্য করতে হবে না ।
’
আজ আবুল হোসেন চাচা যখন বুলুর বাবাকে কথাগুলো বলছিলেন, তখন বুলুর খুব কান্না পাচ্ছিল । বুলু বাবার মুখের দিকে তাকাতে পারছিল না । তার কাছে কি যে অসহায় লাগছিল বাবাকে! বাবা যেন বুলুর চোখের জল দেখে ফেলতে না পারে তাই বুলু অন্য দিকে মুখ করে রেখেছিল । কারন বাবা বুলুর চোখের জল দেখলে তিনি নিজেই লজ্জা পাবেন ।
বুলু নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে, ‘ আচ্ছা আমরা এত গরিব কেন?’ এর কোন উত্তর বুলু জানে না ।
বুলু আবার প্রশ্ন করে, ‘বাবাওতো পড়ালেখা করেছে, তাহলে আমাদের একটি বাড়ি নেই কেন?’ এ প্রশ্নও বুলুকে আড়ি দেয় ।
রাতে ঘুমোতে যাবার সময় বুলু লক্ষ্য করল, বাইরে দিনের আলোর মত ঝকঝকে জোছনা । চাঁদের বুড়ি আজ পুরোপুরি দেখা দিল নিজের অস্তিত্ব নিয়ে । পূর্ণচন্দ্রের শোভা নিয়ে আলোকিত করেছে পৃথিবীকে!
বুলুর ঘরের জানালা দিয়ে একটি উঁচু পানির ট্যাঙ্ক দেখা যায় । তার মনে হয় পানির ট্যাঙ্কটির উপরে উঠলেই বুঝি ঐ দূর আকাশের চাঁদটাকে ছোঁয়া যাবে ।
চাঁদের বুড়িকে কাছে পাওয়া যাবে । চাঁদের বুড়ির অলৌকিক ক্ষমতা আছে । বুলু তার কাছে যা চাইবে, তাই পাবে । এই পানির ট্যাঙ্কটিই বুলুর এটুকু জীবনের দেখা সবচেয়ে উঁচু স্থান ।
তার খুব ইচ্ছে হয়, একদিন পানির ট্যাঙ্কের উপরে উঠে ঐ আকাশটাকে ছুঁয়ে দিতে ।
আবার ভয়ও হয় । সে শুনেছে, এই পানির ট্যাঙ্কটির উপরে উঠতে গিয়ে অনেকেই নাকি মারা গেছে । কেউ এখানে উঠার সাহস করে না ।
বুলু তবু মনে সাহস এনে সিদ্ধান্ত নিল, সে পানির ট্যাঙ্কটির চূড়ায় উঠবেই উঠবে । কালই উঠবে!
পরদিন বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার পথে বুলু পানির ট্যাঙ্কটির নিচে এসে বই খাতা পাশে নিরাপদ স্থানে রেখে, ট্যাঙ্কটির উপরে উঠা শুরু করে দেয় ।
এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, সর্বমোট পাঁচটি মইয়ের সাহায্যে উপরে উঠতে হবে । একেকটা মইয়ের উচ্চতা বুলুদের ঘরের পাশের বড় কদমগাছটির মততো হবেই । নিচে থেকে দেখে ট্যাঙ্কটি অনেক উঁচু উঁচু মনে হয় । কিন্তু বুলুকে ভয় পেলে চলবে না । বুলু প্রথম মইয়ে উঠা শুরু করে দিলো ।
লোহার মই, তবু বেশ নড়াচড়া করছিল । অনেক পুরনো হয়ে গেছে মইটি ।
বুলু মনেমনে ভাবে, সবকিছুইতো একদিন শেষ হয়ে যায় । এই যে মইটিতে বুলু উঠছে, তাওতো আজ হোক কাল হোক একদিন ঠিকই ভেঙ্গে যাবে । যদি আজই ভেঙ্গে যায়! বুলু ইতিমধ্যে প্রথম মইয়ের অনেকটা অংশ উঠে এসেছে ।
যতই উপরে উঠছে, মইটি যেন আরো বেশি নড়াচড়া করছে ।
বুলু একবার নিচের দিকে তাকিয়ে ভাবল, না, আর নিচের দিকে তাকানো যাবে না, তাতে মনে ভয় ঠুকে যেতে পারে । বুলু মাত্র প্রথম মইটি শেষ করেছে । একটি মই শেষ হওয়ার পর আরেকটি মইয়ের সংযোগস্থলে একটু দাঁড়ানোর মত জায়গা আছে । বুলু সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে দ্বিতীয় মইয়ে উঠা শুরু করে দিল ।
বর্ষাকাল, একটু আগেই বৃষ্টিতে ভিজে মইটি পিচ্ছিল হয়ে আছে । প্রথম মইটি ট্যাঙ্কটির ভিতরের দিকে বলে শুকনো ছিল । বুলু সবকিছু উপেক্ষা করে বেশ সময় নিয়ে মইয়ের প্রতিটি ধাপে উঠছে ।
তার মনে বিভিন্ন রকম চিন্তা এসে ঘুরপাক খাচ্ছে । সে যে কোন সময় মইটি থেকে পড়ে যেতে পারে ।
এই মুহূর্তে মায়ের কথা তার খুব মনে পড়ছে ।
বুলু ভাবে, সে এখন যে চিন্তাগুলো করছে, একজন মানুষের মৃত্যুর আগেও বুঝি ঠিক এইরকম চিন্তাগুলই মাথায় আসে । কারণ সে তো এখন মৃত্যুর মুখে!
তার মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে । বুলু মরে গেলে মা কিভাবে কাঁদবেন, বুলু যেন চোখের সামনে সব দেখতে পাচ্ছে । টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা জল এসে বুলুর হাতের উপর পড়ল ।
বুলুর মনে পড়ল তার অসহায় বাবাকে । আজ সকালে বুলু তার বাবাকে দেখে আসে নি । বাবা হয়ত সকাল সকাল টাকার জন্য বেড়িয়ে পড়েছেন । আজ আবুল হোসেন চাচাকে বাড়ি ভাড়া দেয়ার কথা । আজ টাকা না দিতে পারলে কালই তিনি বাড়ি থেকে বের করে দেবেন ।
বুলু অনেকক্ষণ ধরেই মইয়ের একটি ধাপে বসে রইল । তার খুব ক্লান্তি লাগছে । আর উপরে উঠতে ইচ্ছে করছে তার ।
ভয় বুলুকে থামিয়ে দেয়, মায়া বুলুকে পেছন থেকে আঁকড়ে ধরে । বুলু তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফেলে ।
বুলু খুব সাবধানে মই থেকে নেমে বাড়ি চলে এলো । বাড়িতে এসে মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল ।
মা কাঁদছেন । বুলু একটু আগেও মায়ের কান্না কল্পনা করেছিল । সেটা ছিল কল্পনায় বুলুর মৃত্যুর কান্না ।
কিন্তু মা কাঁদছেন, কাল এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে বলে । মা কত কষ্ট করে বাড়ির আঙিনার ঐ ছোট্ট জায়গাটিতে একটি লাউ গাছ, একটি সিম গাছ, একটি ঝিঙে গাছ লাগিয়ে মাচা বানিয়ে দিয়েছেন । প্রতিদিন সকাল বিকাল গাছে পানি ঢালেন । লাউ গাছটি পরিচর্যা পেয়ে কেমন তরতরিয়ে বেড়ে উঠেছে । গাছে ফুল এসেছে, ফলের অপেক্ষা ।
পাশে ঝিঙে ও সিম গাছ দুটিও যেন ঐ লাউ গাছটির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠছে । মা’য়ের নিজ হাতে একটু একটু করে গড়ে তোলা এতদিনে
র চারপাশ থেকে হঠাৎ করেই নিজেকে অব্যহতি দেয়ার কষ্টে তিনি কাঁদছেন ।
রাতে বাবা বুলুকে ডেকে, বুলুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘বুলু তুমি তোমার দাদা বাড়ি যেতে চেয়েছিলে না? আমি কালই তোমাকে নিয়ে যাব । ‘
বুলু জিজ্ঞেস করল, ‘মা যাবে না?’
‘হ্যাঁ, তোমার মাও যাবে । ’
‘বাবা আমরা কতদিন থাকব সেখানে?’
‘তা বলা যায় না ।
আমরা অনেকদিন বেড়াতে যাই না-তো? এবার যখন সুযোগ এসেছে, বেশ কিছুদিন থাকব । ’
‘বাবা সেখানে কোন স্কুল আছে?’
‘অনেকদিন বাড়ি যাওয়া হয় নাতো, ঠিক বলতে পারব না । থাকবে নিশ্চই । ’
‘বাবা, কাল আমরা কখন যাব?’
‘বিকেলে রওনা দেব । ’
‘কাল আমি স্কুলে যাব না?’
‘না, কাল তোমাকে স্কুলে যেতে হবে না ।
সকালে তোমার সব কিছু গুছিয়ে নেবে । ঠিক আছে?’
বুলু মাথা নেড়ে হ্যাঁ জবাব দিল ।
বুলু বাবার সামনে থেকে চলে যায় । বুলু জানে, তাদের আর কখনোই এখানে আসা হবে না ।
আজ বাবা বুলুকে পড়ার কথা বলছেন না ।
অথচ বুলু কত দিন বাবার কাছে বায়না ধরেছিল, ‘বাবা আজ পড়ব না । ’ কিন্তু বাবা বুলুকে একদিনও ছুটি দেন নি । বাবার আজকের এই পরিবর্তনটি বুলুর কাছে অপরিচিত লাগে ।
বুলু তার শোবার ঘরের জানালা খুলে দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে । আজকেও গত কালের মত আকাশের জোছনায় পৃথিবীর বুক মাখামাখি ।
বুলু দূরের ঐ পানির ট্যাঙ্কটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে । বিকেলের স্মৃতিগুলো তার মনের আকাশে উঁকি দিয়ে উঠে ।
কাল তারা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে । এই যে তার চার পাশের বর্তমান একটি জগৎ, সেখানে এর কিছুই থাকবে না । সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি জায়গা ।
বুলু বাবার কাছে শুনেছে, সেখানে সবাই নাকি কৃষিকাজ করে । বুলু ভাবে, তার বাবাও সেখানে গিয়ে হয়ত কৃষিকাজই করবেন । হয়ত বুলুকে নিয়ে তার বাবা আর কখনোই পড়াতে বসবেন না । আর কখনো বুলুকে শেখাবেন না, পড়ালেখা করে যে, গাড়িঘোড়ায় চড়ে সে ।
আজকের জোছনা বুলু আর কখনো দেখতে পাবে না ।
ঐ যে দূরের পানির ট্যাঙ্ক, সেখানেও বুলু কখনো উঠার চেষ্টা করবে না । বুলু জানালা বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে । তার ঘুম আসছে না । কেবলই বিকেলের কথা মানে পড়ছে । চোখের সামনে ভাসছে, সে পানির ট্যাঙ্কটির চূড়ায় উঠছে ।
বুলু সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে, মা সব কিছু গুছিয়ে নিচ্ছেন । বাবাও ব্যস্ত । বুলু কাউকে কিছু না বলে, একদৌড়ে চলে আসে পানির ট্যাঙ্কের কাছে । রোঁদ এখনো তেতিয়ে উঠে নি ।
বুলু উপরে উঠা শুরু করে দিল ।
আজ বুলুর মনে অনেক সাহস । সিঁড়িগুলো শুকনো । বুলু এক এক করে সবগুলো মই শেষ করে পানির ট্যাঙ্কটির চূড়ায় পা রাখল ।
তার এত আনন্দ লাগছে যা সে কখনো কল্পনাও করে নি । সে আজ এক দুঃসাধ্যকে সাধন করেছে ।
বুলু এখন পানির ট্যাঙ্কটির সবচেয়ে উঁচুতে দাড়িয়ে আছে । এখান থেকে পুরো শহরটাকে দেখা যায় ।
ঐ যে দূরে আবুল হোসেন চাচার বাড়িটিকে অতি ক্ষুদ্র লাগছে! তার চারপাশের সব কিছুই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র । শুধু বুলুই যেন একমাত্র বড় কিছু!
বুলু হাত দুটোকে শূন্যে তুলে ধরে চীৎকার করে বলে, ‘এই পৃথিবী আমার!!’
তিনটি শব্দের মধ্যে শেষের শব্দটি প্রতিধ্বনি হয়ে বুলুর কানে বার বার ফিরে আসছে, ‘আমার, আমার, আমার......!!!
সাইফুল্লাহ সাইফ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।