সন্তান কে সমাজের উচুস্তরে দেখতে কে না চায় ? তাই মধ্যবিত্ত ঘরের মা-বাবা ছোটকাল থেকেই তার সন্তান কে বড় ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন দেখেন ! এমন ভাবে সন্তানের সামনে "ডাক্তার" ব্যাপার টি কে উপস্থাপন করেন যেন ডাক্তার না হলে জীবন বৃথা ! আর, একবার কোনরকমে ডাক্তার হতে পারলেই মিলবে জাদুর কাঠি,সুখের চাবি !"বাবা, আমি ডিজনিল্যান্ড যাব ", "বাবা আমি বড় হয়ে লাল গাড়ি কিনব" - সন্তানের এই সব আবদার তাই শেষ হয় বাবার উত্তরে- "ডাক্তার হলে তুমি সব কিনতে পারবে বাবা" !
ব্যপারটা এমন নয় যে সব মা-বাবাই এমন বলেন । এমনও অনেকেই আছেন যারা এই পেশার প্রতি নিজের ভাললাগার কারনেই ডাক্তার হতে চান । তারা সাধারনত ছোটবেলায় জীবনের লক্ষ্য লিখতে গিয়ে এমনটা লিখে থাকেন- "বড় হয়ে আমি মানুষের সেবা করতে চাই" ! শিক্ষক তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন- " দোয়া করি, বড় ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা কর" !
পাঠক, তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়ালো কি ? বড় হয়ে ডাক্তার হতে পারি আর না পারি, ছোটকালেই দুটি জিনিস কিন্তু আমাদের মাথায় ঢুকে গেল-
১) ডাক্তার হলে অনেক টাকা হবে, জীবনের সকল চাওয়া পুরন হবে ! আর-
২) মানুষের সেবা শুধু ডাক্তাররাই করে থাকেন !
যাই হোক, ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর এমনি একজন হলেন মাখনলাল ! ছোটকাল থেকেই শুরু হয় তার স্বপ্ন পূরণের লড়াই ! বন্ধুরা যখন মাঠে ক্রিকেট খেলত অথবা সন্ধ্যার পর সিনেমা হলে গিয়ে দেখত রঙ্গিন সুজন-সখি, মাখনলালের তখন একটাই কাজ- পড়া পড়া আর পড়া ! পড়তে পড়তে কেটে যায় শৈশবকাল ! বাল্যকাল ! তারুন্যে এসে মাখনলাল সুযোগ পায় মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার ! সেখানে দেখা হয় আরও অনেক মাখনলালের সাথে ! সবার চোখ ভরা একটাই স্বপ্ন- বড় ডাক্তার হব !!
এর পর শুরু হয় আসল খেলা ! কি সেই খেলা ?? আইটেম , কার্ড , টার্ম , ওয়ার্ড ফাইনাল, ব্লক ফাইনাল, ইয়ার ফাইনাল নামক নানারকম পরীক্ষা নানাকারনে একাধিকবার দিয়ে, সকাল ৭ টা থেকে দুপুর আড়াইটা , সন্ধায় আরও দুই ঘণ্টা - মোট ৯ ঘণ্টা করে সপ্তাহে ৬ দিন ক্লাস করে মাখনলালদের যোগাড় করতে হয় প্রফেশনাল পরীক্ষায় বসার যোগ্যতা, যার নাম ক্লিয়ারেন্স ! এ প্রসঙ্গে বলে রাখি- যে দেশে জব্বার , মিজান নামের বস্তুরা থাকেন , সেই দেশে ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার দিনটি ঈদ হিসেবে পালিত হয়ে থাকে !
যাই হোক, এরপর মাখনলালরা প্রফ পরীক্ষা দিতে বসেন । এমসিকিউ, রিটেন , ভাইভা, শর্ট কেস, লং কেস, অসপি - এই ধরনের নানা অঙ্গ বিশিষ্ট ৩টি প্রফ পরীক্ষা দিয়ে তারা ডাক্তার হওয়ার চেষ্টা করেন । দিনরাত কাচ্চি না খাওয়ার অপরাধে এইসব পরীক্ষায় ভেজিটারিয়ান মাখনলালরা হরহামেশাই শহীদ হয়ে যান , যদিও তাদের ভাগ্যে জোটে না কোন শহীদমিনার ।
যে পরিবেশে কেউ ৫ মিনিট দাড়িয়ে থাকলে অস্থির হয়ে পড়েন , সেই পরিবেশ অর্থাৎ হাসপাতালের ওয়ার্ড এ টানা তিন বছর প্রতিদিন ২ ঘণ্টা করে দাড়িয়ে থেকে , ৫-৬ ঘণ্টা ধরে চলা ভীতিকর প্রফ পরীক্ষাগুলি কখনো কখনো একাধিকবার দিয়ে পাশ করেন মাখনলাল ! ৫ বছরের সাধনা রূপ লাভ করে বাস্তবে ! ৫ বছর পড়াশুনা শেষে এইবার শুরু হয় তার ইন্টার্ন জীবন ! এই জীবন একবছর চলবে । এই সময়ে মাখনলাল প্রতিদিন ৮-১০ ঘণ্টা, কোন কোন দিন ১৬ ঘণ্টা, একেকদিন ২৪ ঘণ্টা হাসাপাতালে কাটাবেন , হাতে কলমে ডাক্তারি শিখবেন ও করবেন। বেতন পাবেন ১০০০০ টাকা !
প্রশ্ন ১ - পাঠক , আপনার বাসার ড্রাইভার এর বেতন কত ?
যাইহোক, ইন্টার্ন শেষে মাখনলাল লাভ করেন ডাক্তারি রেজিস্ট্রেশন । কিন্তু এইবার মাখনলাল প্রবেশ করেন এক ভিন্ন বাস্তবতায় , যেখানে তাকে একই সাথে বড় ডাক্তার হতে হবে , সরকারি চাকরি নিতে হবে , পরিবার এর কিছু দায়িত্ব নিতে হবে এবং নিজের পেট বাঁচাতে হবে ! তাই তার বাংলা এবং সাধারন জ্ঞান পড়া শুরু করতে হয় বিসিএস এর জন্যে , মোটা মোটা বইগুলি আবার পড়তে হয় এফসিপিএস, এম ডি তে সুযোগ করে নেবার জন্যে এবং ছোট চাকরি করা শুরু করতে হয় পেট বাঁচানোর জন্যে । এই ছোট চাকরি কে বলে "খ্যাপ", যেখানে মাখনলাল বেতন পাবেন ৮ ঘণ্টায় ৬০০ টাকা, অর্থাৎ ঘণ্টায় ৭৫ টাকা ! সুতরাং, মাখনলালের মাখন এবার গলতে শুরু করে।
তবু মাখনলাল সেবা কিন্তু দিয়ে যাচ্ছেন, কারন এই সেবায় তার পেট চলে ! সেই সেবার দাম ঘণ্টায় ৭৫ টাকা !
উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন- " তরুন ডাক্তার ও বৃদ্ধ নাপিত থেকে দূরে থাকুন" !
সুতরাং মাখনলালকে অবশ্যই বড় ডাক্তার হতে হবে। ডিগ্রী নিতে হবে এফসিপিএস, এম ডি এইসব । কিন্তু ডিগ্রি তো আর শুধু পড়া দিয়ে হয় না, সাথে লাগবে ৪ বছরের ট্রেনিং! এই ট্রেনিং এর সময় তাকে একজন ফুল টাইম চিকিৎসক হিসেবে ডিউটি করতে হবে কোন একটি মেডিকেল কলেজে, বিনা বেতনে ! সেই সাথে পেট বাঁচানোর জন্যে খ্যাপ তো চলবেই ! তাই টানা ৪ বছর ধরে বিনা বেতনে কাজ করবেন মাখনলাল , আর ডিউটির ফাঁকে পেট বাঁচানোর জন্যে মারবেন খ্যাপ -আয় ঘণ্টায় ৭৫ টাকা। এবার অনারারি (অনাহারি) মেডিকেল অফিসার মাখনলাল ! দিন রাত কেটে যায় তার হাসপাতালেই !
প্রশ্ন ২ - পাঠক, মাখনলাল ৪ টি বছর বিনা টাকায় হাসপাতালে আপনাকে চিকিৎসা দিয়েছেন, নিজেও শিখেছেন চিকিৎসাবিদ্যা!! আপনি হলে কয় বছর পারতেন?? আপনাদের অবগতির জন্যে বলে দেই- বড় সরকারি হাসাপাতালে এই ধরনের বিনাবেতনে কাজ করা ডাক্তারের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি থাকে। এদের বলে- HMO !
মা বলেন- মাখন রে, একটা বিয়ে কর ।
কিন্তু মাখনলাল ভয় পায়। নিজে খেতে পায় না, বউ কি খাবে ? এইভাবে কেটে যায় মাখনলালদের যৌবন ! বয়স ৩০ ছুই ছুই ! কোনোরকমে ট্রেনিং শেষ ! এই বেলা মাখনলাল ভাবেন, বিসিএস টা দিয়ে নেই, তারপরই সুখের সংসার পেতে বসব ! শুরু হয় আরেক খেলা । পড়ো বাংলা, পড়ো সাধারন জ্ঞান, সেই voice change, narration আর সুদকষার অংক !! এইসব পড়তে আর ভালো লাগে না মাখনলালের, স্কুলের অন্য বন্ধুরা ততদিনে বিয়ে শাদি করে পুরদস্তুর জাকিয়ে বসেছে, আর মাখন?? মাখন পড়ছে ! পড়ছে ইথিওপিয়ার রাজধানীর কথা, জানছে এভারেস্ট এর উচ্চতা ! সরকারি ডাক্তার হতে হবে যে !!
এইভাবে ২/৩বারের চেষ্টায় মাখনলাল হয়ে গেলেন সরকারি ডাক্তার ! পোস্টিং হল থানা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে, বেতন ১৭০০০ টাকা , থাকার জন্যে পেলেন কোয়ার্টার। পলেস্তারা খসা, ডাম্প পড়া, জানালার কাঁচ ভাঙ্গা সরকারি কোয়ার্টারে থাকে মাখনলাল, এক সময়ের দেশ কাঁপানো মেধা মাখনলাল। নিজেই রাধে, নিজেই খায় !কিন্তু এভাবে কতদিন? তাই মাখন বিয়ে করল।
এবার শুরু হল ভানুমতির খেল ! ১৭০০০ টাকায় মা-বউ-সংসার কীভাবে চালান সম্ভব ?? দেশের সবচেয়ে মেধাবি, বোর্ড প্লেস করা মাখন এই টাকায় কি দিয়ে কি করবেন ?? মাখনের অন্য বন্ধুরা এতদিনে ২ সন্তানের বাপ ! কেউ কিনেছেন গাড়ি ! কারো সন্তান পড়ে ঢাকার বড় স্কুল এ ! থানা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মাখনের শখ হয় তার ছেলেটিকে ও ভালো ইস্কুলে পড়ানোর , ভালো পরিবেশে রাখার ! কিন্তু পারে না মাখন, সে ডাক্তার, তাই তার শখ বলে, স্বপ্ন বলে কিছু থাকতে নেই। তার আছে শুধু মানবসেবার দায়িত্ব! কারন শুধুমাত্র ডাক্তাররাই সরকারি টাকায় পড়েছেন , আর বাকি যত শিক্ষালয়,সেগুলো হয় বেসরকারি অথবা সেখানে পড়াশুনা বলে কিছু নাই ! হতাশ ডাঃ মাখনলাল পরে থাকেন থানা সাস্থ্য কেন্দ্রেই । পাঠক বলতে পারেন,মাখনদের ডিজনিল্যান্ড আর কত দূর ?
এইভাবে হতাশার, পাওয়া না পাওয়ার হিসাব মিলাতে মিলাতে কয়েক বারের চেষ্টায় fcps, md ও পাশ করে মাখন! বয়স তখন ৩৮ ! জীবনের ৩৮ টি বসন্ত পার করে মাখনলাল হয় Dr. Makhonlal, MBBS, FCPS, MD ! অনেক চেষ্টা-তদবির করে অবশেষে মাখনলাল ট্রান্সফার হয়ে আসেন একটি মেডিকেল কলেজে !
তারপর পাড় হয় আরও কত দিন ! মধ্যবয়স পেরিয়ে গেছে কিছুদিন আগেই। এমন সময় মাখন হয় প্রফেসর !! বয়স কমপক্ষে ৪৫ ! এই ৪৫ টি বছর সাধনা করে মাখন শিখেছে অনেক কঠিন চিকিৎসাব্যবস্থা, অভিজ্ঞতাবলে অর্জন করেছে অনেক মরনাপন্ন রোগীকেও বাঁচিয়ে তোলার জ্ঞান !! আজ তার ভিসিট এখন ৫০০ টাকা ! মাখনলালের সন্তানদের কাছে ডিজনিল্যান্ড এখন শাহবাগের শিশুপার্কের চেয়েও কাছে ! লাল গাড়ি চড়ে তারা ডেটিং এ যায় !
আর পাঠক,শীগগির আপনারা কোমর বাঁধুন ! এইবার এসেছে সেই দিন ! এতদিনে এসেছে আপনাদের দিন! এখন আপনারা তাকে কসাই বলে গালি দিতে পারবেন, তার বিরুদ্ধে রোগী হত্যার অভিযোগ আনতে পারবেন, আর সেই অভিযোগ তদন্তের আগেই মাখনলাল কে হাতকরা পড়াতে আছেন আপনাদের সেপাইরা। আর আপনাদের টিভি? মিডিয়া ?? মাখনলালের হাতকরা পরা ছবি বাড়িয়ে দেবে তাদের পত্রিকার, চ্যানেলের কাটতি !! পারসোনার গোপন কামেরার খবর কিন্তু ঠাইও পাবেনা তাদের পাতায় !!
প্রশ্ন ৩ - kfc তে ১০০ গ্রাম আলুর দাম ৭০ টাকা হলে, ৪৫ বছর ধরে চলা এই সাধনার সম্মানী হিসেবে ৫০০টাকা কি খুব বেশি ?
তারপরও ডাক্তাররা হতাশ হননা,আটক সহকর্মী কে মুক্তির দাবীতে রোগী দেখা বন্ধ করেন না।
বেতন বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করেছেন ডাক্তাররা, এমনটা শুনেছেন কোনোদিন ?? যতবার ডাক্তাররা আন্দোলন করেন, খেয়াল করে দেখবেন, সেই আন্দোলন ওইসব কারনে নয়, সেই আন্দোলন হয় শুধুমাত্র আপনারা ডাক্তারদের গায়ে হাত তোলেন বলে ! আপনারাই বলুন- কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা পাবার অধিকার কি ডাক্তারদের নেই??
একজন সাধারন ছাত্র কীভাবে একজন বড় ডাক্তার হয়ে ওঠেন, ডাঃ মাখনলাল এর মাধ্যমে সেটাই আমি আপনাদের জানাতে চেয়েছি । আমি খুব ভালো করেই জানি- এতশত ডাক্তারদের ভিড়ে কেউ কেউ আছেন যারা অসৎ ! তারা কমিশন খান, প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী ভাগান, রোগীর সাথে খারাপ ব্যবহার করেন, অবহেলার অভিযোগ ও কিছু ক্ষেত্রে সত্য ! তাদের কঠোর শাস্তি দেয়া উচিৎ। কিন্তু সবাই কি এমন? বাস্তবতা ভেবে দেখুন- আজ আমাদের সমাজের প্রতিটা অঙ্গেই পচন ধরেছে । বাকি সকল পেশার আপনারা দুর্নীতি করে বাড়ি গাড়ি করবেন আর চাইবেন, ডাক্তাররা ১০০ভাগ সৎ থাকবে, আর সেই চাওয়ায় একটু কমতি হলেই যখন তখন গায়ে হাত তুলে বসবেন, গালি দেবেন এটা কি ঠিক?
দয়া করে অভিযোগ তদন্ত না করেই বিচার আর শাস্তিপ্রদান শুরু করে দেবেন না। বড় ডাক্তার হওয়া অনেক কষ্টের কাজ, অনেক অনেক অনেক কষ্টের ফল এটা! এত কষ্ট, এত শ্রম কে আবেগের বশে অপমান করবেন না ! আমরা খুব কষ্ট পাই, ভালো কিছু করার উৎসাহ হারাই ! একটা কথা ভুলে যাবেন না - বাঁচতে হবে সবাই মিলে, সামাজিক নিয়ম মেনে !!
(সংগৃহিত) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।