ভেবেছিলাম আর কখনো যুদ্ধ হবেনা, আমার আর কখনো যুদ্ধ দেখা হবেনা, কি বোকা আমি, কখন যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি, আমি এখন যোদ্ধা, এ যুদ্ধ সারা জীবনের যুদ্ধ, এ যুদ্ধ জীবন যুদ্ধ...... বিদেশে উচ্চ শিক্ষা শেষ করে দেশে ফিরে কোথাও কোনরকম চাকরির চেষ্টা না করে ব্যবসা শুরু করলাম। আইটি ব্যবসা, যেহেতু আমি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র ছিলাম, বিশ্বাস ছিল ভাল করতে পারব। এলাকার সবাই বলতে লাগল ব্যবসাই যদি করব তাহলে বিদেশে পড়ালেখা করার কি দরকার ছিল। অনেক আবার সরাসরি বলেই ফেলল যে চাকরি পাইনা বলে ব্যবসা শুরু করেছি। কথার তীব্রতা এত বেশি ছিল যে বাধ্য হয়েই চাকরি খুঁজতে লাগলাম।
এমন একটা চাকরি যেন ব্যবসাও চালিয়ে যেতে পারি। কিছুদিনের মধ্যে একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় লেকচারার হিসেবে নিয়োগ পেয়ে গেলাম। কিন্তু ব্যবসা আর চাকরি যে একসাথে হয়না সেটা টের পেলাম খুব তাড়াতাড়ি। ধীরে ধীরে ব্যবসায় মনোযোগ কমতে লাগল, শিক্ষকতার প্রেমে পড়ে গেলাম। মাঝে ডেনমার্ক এর গ্রীনকার্ড পেয়ে চলে গেলাম ডেনমার্ক, কিন্তু ডেনমার্ক ভাল লাগল না, চলে এসে আবার জয়েন করলাম শিক্ষকতায়।
ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক জার্নালে বেশ কিছু গবেষণা প্রকাশিত হল। লেকচারার থেকে সহকারী অধ্যাপক হয়ে গেলাম, অস্থায়ী ভাবে দায়িত্ব এসে পড়ল কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে। আজ ৫ম বারের মত একাডেমিক কাউন্সিল এর মিটিং-এ অংশগ্রহন করলাম সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে। অর্থনৈতিক সমস্যার কারনে নিজের গড়া কোম্পানি এখন আর নিজের নেই, তারপরেও ভাবতে ভাল লাগে যে একটি বিশেষ কাজে সেই কোম্পানি আজ দেশসেরা। এখন ও বিভিন্নভাবে যুক্ত রয়েছি সেই কোম্পানির সাথে, সেই সুবাধে বেশ কিছু জাতীয় আইটি প্রজেক্টে নিজের অবদান রাখার সৌভাগ্য হয়েছে
উপরের কথাগুলো নিজের ঢোল নিজে বাজানোর মত হলেও নিচের কথাগুলো বুঝার জন্য প্রয়োজন আছে।
আমি কেরানীগঞ্জ এর এক গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাবা তার উপার্জনের সমস্থ টাকা খরচ করে পড়ালেখা শিখিয়েছেন। আমার সমবয়সী অনেকেই দেশে বিদেশে থেকে এখন অনেক টাকার মালিক, তাদের তুলনায় আমি কিছুইনা, যদি ও কারও উল্লেখ করার মত শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। আমার উপার্জন নিয়ে আমার পরিবার যতটা না চিন্তিত, তার চেয়ে বেশী চিন্তিত আমার গ্রামবাসী। হাজার বার আমি এবং আমার পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞেস করেছে আমার ইনকাম কত।
এত পড়ালেখা করে আমি কি করলাম, অমুকের ছেলে তো এত টাকার মালিক, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এইত কিছুদিন আগের কথা, আমার এলাকায় এক কিন্ডার গার্টেন স্কুল আছে। ওই স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আমন্ত্রন পত্র পেলাম, সেই আমন্ত্রন পত্রে নিজেকে আবিষ্কার করলাম ভলান্টিয়ার হিসেবে কিছু ক্লাস থ্রি, ফোর এর ছাত্রের সাথে, যাদের কাজ হল ক্রিকেট খেলার বল কুড়িয়ে আনা। এলাকার সবার আলোচনার মধ্যে চলে আসল বিষয়টা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে এমন অপমান কিছুতেই সহ্য করতে পারলাম না, ভেবেছিলাম ভুল হয়েছে, খুব কষ্ট নিয়ে কিন্ডার গার্টেনের প্রধান শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির প্রধানের সাথে যোগাযোগ করলাম, আশ্চর্য হলাম, কেউ একটু দুঃখ ও প্রকাশ করল না, এবং বেপারটা তারা সজ্ঞ্যানেই করেছে।
বুঝতে দেরি হল না যে আমি ভিলেজ পলিটিস্ক এর শিকার। যে গ্রামে ৩০০০ লোকের মধ্যে ১০ জন ও গ্রাজুয়েট না, সেখানে আমার এমন উত্থান অনেকেই পছন্দ করত না জানতাম, তাই নিজে কখনও কোন রাজনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত হতাম না, কারও সাথে কোনদিন ঝগড়া ও করতাম না, চেষ্টা করতাম যতটা সম্ভব ভাল থাকা যায়। নানাভাবে এর আগেও বিব্রত হয়েছি, কিন্তু তাই বলে এমন ভাবে অপমানিত হতে হবে বুঝতে পারিনি। বাধ্য হলাম একবুক কষ্ট নিয়ে এলাকা ছেড়ে শহরে চলে আসতে। জানিনা আর কখন ও ফিরে যাওয়া হবে কিনা আমার সেই গ্রামে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।