আজ ভোর হয়নি। হয়তো কাল-ও হবেনা। চারিদিকে ভীষণ কাল। ভোর হবার প্রতিক্ষায়.... অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পায়ের তলাটা কেমন যেন ধরে এসেছে। যা রোদ পড়েছে...পায়ের জোড়াতালি দেয়া চপ্পল-টাও মনে হয় দেবে যাচ্ছে শহুরে ব্যাস্ত রাস্তার গলা পিচে।
ঘাড়ে ঝুলে থাকা ব্যাগ টাও ক্ষণে ক্ষণে জানান দিচ্ছে "আর পারি না...আর পারি না"...
সকালে না খেয়েই ঘর থেকে বেরিয়েছে মুবিন। এখন সূর্য প্রায় খাড়া মাথার উপর।
এর আগের কয়েকটা বাসে রীতিমত যুদ্ধ করেও উঠতে পারে নি। এর পরেরটায় না উঠলেই নয়...
এক ঝটকায় উঠে গেল সে মৃদুমন্দনে থাকা ৬নম্বর বাসটাতে।
এর পরই শুরু-
হায়রে মজার খাউজানি!
হেরপর বাইর হয় লালপানি!
রাইতে যায়না ঘুমানি!
এই যে যাত্রী ভাইরা!
চুলকানি একখান মারাত্নক সামাজিক রোগ!
চুল্কাইতে চুল্কাইতে কালশিরা ফালাইয়া দিসেন!
প্যান্টের পকেটে কলম রাখতে পারেন না চুল্কাইতে চুল্কাইতে ফুটা কইরা ফালাইসেন বইলা!
এই চুলকানি থেইকা বাঁচতে হইলে আপনের লাগবো টাইগার কোম্পানির গরম মলম!
কোম্পানি রেট ২০টাকা ২০টাকা ২০টাকা!
তয় আমার কাছ থেইকা লইলে এই মহা কার্যকারী গরম মলমের দাম মাত্র ১০টাকা ১০টাকা ১০টাকা!
কি ভাই!আছেন কেউ?
হকারের চটকদার কথা শুনে হাসতে হাসতে অনেকের পেট ব্যথা...সুশীল সমাজের কয়েক জন আবার ফ্রড বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন...এরই মাঝেই কেউবা সন্তর্পণে কিনে রাখছেন মহাশক্তিধর গরম মলম!
বাসের হেল্পারের ঝারি খেয়ে তাত্তাড়ি নেমে যায় মুবিন জ্যাম শেষ হবার আগেই।
সকাল থেকে না খাওয়া। সাত সকালে ট্রাফিক পুলিশ-কে ২০টাকা না দিতে হলে হয়তো নাস্তা টা হয়েও যেত।
সারাদিনে খুব একটা বিক্রি হয়নি। ওভারব্রীজের নিজে বসে যখন তার সারাদিনের উপার্জনের হালখাতা চলছে তখন আয়ের হিসেব ঠেকেছে ৮৭টাকায়।
আজকাল দুই টাকার পান খেলেও সমস্যা!
দশ টাকার নোট দিলে ৭টাকা ফিরিয়ে দিয়ে বলে খুচ্ররা নাই চকলেট লন একখান।
খরচের খাতায় এই পান নামক জিনিসটি না থাকলে হয়ত জমার হিসেব গিয়ে ঠেকত ৯০টাকায়।
মনের অজান্তেই ৫টাকার কয়েন সমেত হাতটি চলে যায় উরুর কিছু উপরে...হ্যাঁ আরও উপরে...এই বস্তুটি চুল্কানির জন্য খারাপ না......
মুবিনের কাছে বেঁচে থাকার স্বপ্ন গুলো তার গরম মলমের মতই বোধহয়.........
মুবিনের ছোট সংসার। আছে শুধু মা আর আদরের ছোট একটা বোন।
থাকে গুলশান বস্তিতে।
বাবা নামের কোনো একটা অস্তিত্ব নাকি কোনো কালে ছিল।
তবে তার মা'র কাছে তার বাবার পালিয়ে যাবার অভিসম্পাত ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাওয়া যায় না...
মা কাজ ঝুটা কাজ করে বাসায় বাসায় তবে ছোট বোনকে সে এসবের মধ্যে যেতে দেয়নি।
তাকে নিয়ে মুবিনের অনেক স্বপ্ন। বস্তির একটু দূরে একটা স্কুলে পড়ে সে। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছিল বলে বেতন-ও দিতে হয় না।
তবুও ওর খাতা কলমের হিসেব জোগাতেই হিমশিম খেতে হয় মুবিনের.....
বস্তির শুরুতে ঢুকতেই চায়ের কাপে চামচের টুংটাং শব্দ।
মৌসুমি'দের এই চায়ের দোকান-টা সেই শুরু থেকেই দেখে আসছে।
আর মৌসুমি?
ওর সাথেই তো মুবিনের সুতা কাটা ঘুড়ি ওড়ানোর স্বপ্ন দেখে!
হয়ত ঘটা করে বলা হয়নি তবে ছোট বেলা থেকে চেনা মানুষ-টা এতটুকু বুঝে না এটা মানতে নারাজ মুবিন।
মৌসুমির চোখে চোখ পড়তেই মুখ ঘুরিয়ে বাড়ির দিকে হাটা শুরু করল সে...
মাস খানেক আগে তারা দুইজন ঘুরতে গিয়েছিল কোথায় যেন।
আহা...মুবিনের স্মৃতিতে একখণ্ড সুখবিলাস চিকচিক করে ওঠে...
রাস্তায় মৌসুমির হঠাত চোখ আটকে গেল রকমারির দোকানের কাঁচের অবয়বে প্রকাশমান এক সেট ইমিটেশনের গয়নায়।
দাম মাত্র ১০০০টাকা...
মৌসুমি মুবিনের অবস্থা জানতো।
তাই সে আর কথা না বাড়িয়ে হাটা ধরল। তবে সেদিন জিনিসটা কিনে না দিতে পারাটা মুবিন-কে প্রতিদিন প্রশ্ন যুগিয়েছে"সে কি তবে এতটাই নিরুপায়!''
এর পর সে মনে মুনে শপথ করেছিল যে ওই গয়নাটা না কিনে সে মৌসুমির সামনে দাঁড়াবে না...
তার শপথের সাথে সায় দিল তার সংযম...
আজ প্রায় এক মাস...
এখন তার পকেটে বলা যায় ১০০০টাকা আছে।
আজ-ই হয়ত গভর্নরের সই করা এই কয়েকটা ময়লা নোটের বিনিময়ে তার প্রাপ্য হয়ে যাবে প্রেয়সীর ভুবন ভোলানো হাসি...
বাড়িতে ঢুকে পাওয়া গেল না ছোট বোন টিকে। মায়ের মুখটাও মলিন।
মা!ফাতেমা কই?
-আমি কি জানি!মরতে গ্যাসে না কই গ্যাসে!
আরে!এমনে কতা কও ক্যান!ভালা কতা কইলে কানে যায় না?
-হ!কতা তো কানে ঢুকবো না!......ওই!গরিবের আবার পড়াশুনা কিয়ের রে!তার উপরে আবার মাইয়া!কত কই যে আমার লগে কামে যাউক!না...হ্যারে পড়াইয়া উনি জজ ব্যারিস্টার বানাইবো!
তাতে তুমার কি?আমার ট্যাকা দিয়া আমার বইনেরে পড়াই!চুরি কইরা পড়াই না কইয়া দিলাম!
-অহন পড়াইয়ো দেহি!আইজ স্কুলে গেসিলাম!মাস্টার কইসে হ্যার কাছে প্রাইভেট না পড়াইলে পাস করতে দিবোনা!মাসে মাসে ১০০০টাহা কি তোরে মুরগী পাইড়া দিব?
(প্রচন্ড রাগে কপাল কুচকে গেল মুবিনের)
কি কইলা!আমার বইন না বৃত্তি পাওয়া!অয় তো এমনেই সব পারে!তাইলে আবার প্রাইভেট পড়ামু ক্যা?
-হেইডা আমারে কস ক্যা?মাস্টারে সাফ কইয়া দিসে প্রাইভেট না পড়াইলে ফেল!
দরজাটা এক ঝটকায় সরিয়ে বের হয়ে আসে মুবিন।
হুম...এই জড় পদার্থ গুলোর সাথে এহেন দুর্ব্যবহারের হক তার আছে। গোটা দুনিয়া যখন তাকে পেছন থেকে না পাওয়ার ছুরি বসিয়ে যাচ্ছে তখন এই জড় পদার্থ গুলো ছাড়া আর কার সাথে পেরে উঠবে সে?
ব্যস্ত রাস্তার পাশে দোকান-টা। কাঁচের ঠিক ওপাশেই সে শোভা পাচ্ছে একখণ্ড স্বপ্ন।
১০০০ ডিজিট টি এই যুবকের কাছে এখন জীবনের সমীকরণের কিছু চেনা চলকের মান।
সে কি কিনবে তার প্রেয়সীর জন্য তার এত দিনের জমানো স্বপ্ন?নাকি প্রতি মাসেই তার এরকম সংযম চলবে কিছু শিক্ষা ব্যাবসায়ীদের লালসা মেটাতে?
পাঁচ টাকার কয়েন'টা এখন মুবিনের হাতে......
কয়েনটা দিয়ে সুখকাব্য রচনা করতে গিয়ে ভাবে ইদানিং পুরিয়া ব্যাবসা খুব রমরমা............তার যে টাকার অনেক দরকার... ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।