পাশ্চাত্যে ক্রমেই পরিবার প্রথার বিলোপ ঘটছে। এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে নানা সংকট। পুঁজিবাদ তথা বস্তুতান্ত্রিক চিন্তা, পরিবার ব্যবস্থা বিলুপ্তির ক্ষেত্রে উস্কানি হিসেবে কাজ করছে। পাশাপাশি ধর্ম থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণেও এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।
সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পরিবার হচ্ছে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাচীন প্রতিষ্ঠান।
সভ্যতা নির্মাণে পরিবারের অবদানই সবচেয়ে বেশি। মাতৃগর্ভে জন্ম নিলেই একটি শিশু মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠে না। মানুষ হিসেবে গড়ে উঠার জন্য তাকে মূল প্রশিক্ষণ দেয় তার পরিবার। কাজেই একটি সভ্যতা নির্মাণের জন্য পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, পাশ্চাত্যে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন এ প্রতিষ্ঠানটি আজ বিপর্যয়ের মুখে।
পরিবারই যে মানবজাতির শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়,সে কথাটি যেন পাশ্চাত্যের সরকার ও নীতিনির্ধারকরা ভুলতেই বসেছেন। পরিবার যে উচ্চতর এক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গড়ে ওঠে,তারা পরোক্ষভাবে তা অস্বীকার করছেন। মনে রাখতে হবে, স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে যৌনতাই পরিবারের সবকিছু নয়। পরিবার প্রথা ব্যক্তির পাশাপাশি সমাজ এবং রাষ্ট্রে শান্তি নিশ্চিত করে। কিন্তু পাশ্চাত্যে যৌনতাকে সব কিছুর উর্ধ্বে স্থান দেয়া হচ্ছে।
সব কিছুর ওপর যৌনতা প্রাধান্য পেলে মানুষ আর পশুর চেয়ে শ্রেষ্ঠতর জীব হিসেবে মর্যাদা পাওয়ার অধিকার রাখে না। আসলে সুস্থ ও সমৃদ্ধ পরিবার একটি সুস্থ ও সমৃদ্ধ সমাজ ও সভ্যতার জন্ম দেয়। অপরদিকে, পারিবারিক বিপর্যয় সভ্যতা ধ্বংসের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখতে পারে।
হজরত আদম (আ ও হজরত হাওয়া (আ যে পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবী,তা সব ঐশী ধর্মের অনুসারীরাই স্বীকার করেন। তারা এটাও স্বীকার করেন যে,ওই দুই আদি মানুষ দিয়ে মানব জাতি শুরু হয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত বংশবৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
নারী ও পুরুষের মধ্যে সম্পর্কের মাধ্যমেই যে পরিবারের ভিত্তি গড়ে ওঠে,তা সবাই মানেন। দাম্পত্য তথা পারিবারিক জীবনকে ধর্মীয় বিশ্বাসের অন্যতম চাবিকাঠি হিসেবে দেখা হয়। পারিবারিক জীবনে অনাবিল শান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে পরিবার হয়ে ওঠে সব উদ্যম,প্রেরণা ও প্রশান্তির ক্ষেত্র। তেমন একটি পরিবারই সমাজকে ইতিবাচক অর্থে সার্থকভাবে কিছু দিতে পারে,যা সুস্থ সামাজিক জীবনের নিশ্চয়তা দেয়। পরিবার প্রথার বন্ধনকে আকড়ে ধরে রাখা না হলে পাশ্চাত্যের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাও ব্যর্থ হয়ে যাবে।
পরিবার প্রথায় বিপর্যয় নেমে এলে সভ্যতার বিলুপ্তি ঘটবে।
জার্মানির বিখ্যাত লেখক ও রাজনীতিবিদ কার্ল শ্নাইডার পাশ্চাত্যে পরিবার বিষয়ক আইনের সমালোচনা করে বলেছেন, প্রচলিত আইন পরিবারের নৈতিক ভিত্তিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তার মতে, পরিবার হচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন। ব্যক্তিত্ব গঠন ও নারীর সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে পরিবারের বিকল্প নেই। কিন্তু তারপরও পাশ্চাত্যে পরিবার প্রথাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না।
পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, মানুষের শরীর ও মনকে সুস্থ রাখতে পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু সব কিছু জেনেও পাশ্চাত্যের মানুষ নিজেই নিজের অপূরণীয় ক্ষতি করছে। পরিবারের সদস্যরা তাদের ভূমিকা ও দায়িত্বকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এ কারণে পাশ্চাত্যে নারীরা মা ও স্ত্রী হিসেবে তাদের সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। একজন পুরুষও পরিবারের প্রধান হিসেবে তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না।
বাবা-মায়েরা নিজেদের বিনোদন ও স্বার্থকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। সন্তান লালন-পালন তথা পরিবার ব্যবস্থাপনা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় নয়। পাশ্চাত্যের পরিবারগুলোর এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গীই ওই সমাজের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় বয়ে আনছে।
পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী নীতিও পরিবার ব্যবস্থাকে পতনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পাশ্চাত্য সমাজের বাবা-মায়েরা ডে-কেয়ার সেন্টারে সন্তানদেরকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রেখে দেন।
সেখান থেকে ভালো-মন্দ যা শেখে, তাকেই তারা যথেষ্ট বলে মনে করে। কিন্তু ডে-কেয়ার সেন্টার যে কখনোই বাবা-মায়ের মতো মায়া-মমতা ও উষ্ণতা দিতে পারবে না, তা তারা বুঝেন না। পরিবার হচ্ছে শান্তি-সুখের নীড়। তা ছাড়া, আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে পরস্পরের জন্য বিনোদনের বিষয়ও ভেবেছে। শিশুদের ভেবেছে, মন ও দৃষ্টি জুড়ানো আদরের ধন হিসেবে।
ধর্মীয় জীবন ধারায় ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ভাবনাকে মর্যাদা দেয়া হয়েছে,কিন্তু পরিবার-স্বজন,রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তা ছিন্ন করে ব্যক্তিকে আলাদা করে ভাবার কোনো অবকাশ রাখেনি।
পাশ্চাত্যে পরিবার বিপর্যস্ত হওয়ায় সবচেয়ে বেশি অসহায় ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নারী। পাশ্চাত্য সমাজে নারীদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে বিজ্ঞাপন,পর্ণচিত্র ও নাচ-গানের মত বিনোদন শিল্পে। পাশ্চাত্যে বর্তমানে পারিবারিক ব্যবস্থার যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তা ঐতিহ্যবাহী ও প্রচলিত ব্যবস্থা থেকে ভিন্ন । আগে পরিবার ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করতেন একজন পুরুষ ।
যেমন, ইসলাম ধর্মে দায়িত্বের দিক থেকে পুরুষকে অধিকতর কর্তব্যপরায়ণ ভাবা হয়। তবে কর্তৃত্বপরায়ণ হিসেবে নয়। ধর্মীয় ও সাধারণ বিবেচনায়, স্বামী ও স্ত্রী পরস্পরের পোশাকের মতো। এ ক্ষেত্রে একজনের ওপর অন্যজনের কর্তৃত্ব নেই,আছে দায়িত্ববোধ। ইরানের সমাজ বিজ্ঞানী ড.শাহলা বাকেরি বলেছেন, পাশ্চাত্যে পরিবার ব্যবস্থায় এই যে পরিবর্তন, তা সমসাময়িক ইতিহাসে নজিরবিহীন এবং এ পরিবর্তন সব শিল্পোন্নত দেশে প্রভাব ফেলেছে।
পাশ্চাত্যে যে রাষ্ট্র ও সমাজে 'বস্তুবাদ' যত বেশি প্রভাব ফেলতে পেরেছে, সেই সমাজ ও রাষ্ট্রে লিভটুগেদার ও সমকামিতা তত বেশি বেড়েছে। সেখানে বিবাহ বিচ্ছেদ সাধারণ বিষয় হয়ে গেছে। পরিবারগুলো অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ছে। শিশু কিশোররা নীতি ও নৈতিকতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। বৃদ্ধ মা ও বাবার ঠাঁই হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে।
পিতৃ পরিচয়হীন সন্তানের সংখ্যা বাড়ছে। সমকামিতার মতো প্রকৃতিবিরোধী প্রবণতাও সমাজকে গ্রাস করছে। এরইমধ্যে পাশ্চাত্যের অনেক দেশে প্রকৃতি ও ধর্ম বিরোধী এমন প্রবণতাকে আইনি স্বীকৃতিও দেয়া হচ্ছে। এর ফলে 'পরিবার' সম্পর্কে চিরাচরিত সংজ্ঞা বদলে যাচ্ছে।
পাশ্চাত্যে পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার কারণে সৃষ্ট সংকট নিয়ে আলোচনা এখানেই শেষ করার অবকাশ নেই ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।