মাঝে মাঝে বৃষ্টি দেখে হাত বাড়ানোর ইচ্ছে জাগে... ভেতর ভেতর যাই পুড়ে যাই, কেউ জানেনা আমার আগে... আমাদের ছেলেবেলায় পাঠ্য বইয়ের ছবিগুলো ছিল অসাধারণ! ছবিগুলো ছবির মতই। কি যে অসম্ভব সুন্দর! বুকের ভেতর কোথায় যেন তিরতির করে ছুঁয়ে দিত নরম বাতাস। আজকাল কারা বাচ্চাদের বইয়ের ছবি আঁকেন জানিনা, তবে এসকল ছবিতে প্রাণ নেই, অনুভূতি নেই, সেই তিরতির ছুঁয়ে যাওয়া নরম বাতাসও নেই! সেদিন ছোটবোনের বই ওলটাতে গিয়ে দেখি ভেতরের ছবিগুলোয় কারো হাতের চেয়ে মাথা বড়, গাছের চেয়ে পাতা বড়, ডালের চেয়ে পাখি বড়! একটা বেখাপ্পা কার্টুন কার্টুন ভাব!
অবশ্য আজকাল কার্টুনেরই যুগ।
আমরা গাওগ্রামে বেড়ে উঠেছি বলেই কিনা কার্টুন সংক্রান্ত বিষয়ে ছিলাম পুরোপুরি অন্ধকারে। ইউনিভার্সিটি ফার্স্ট ইয়ারে কিনশিপ ক্লাশে একদিন ফারজানা ম্যাম বলছিলেন, তিনি এখনও টম এন্ড জেরী দেখেন।
শুনে ক্লাস সুদ্ধ আমার সহপাঠীরাও যেন আবেগাপ্লুত হয়ে পরলেন,-‘জানেন ম্যাম, এখনও টিভিতে টম এন্ড জেরি শুরু হলে, রিমোট নিয়ে আব্বু আম্মুর সাথে মারামারি লাগিয়ে ফেলি, কতদিন রাগ করে যে ভাতও খাইনি’। আমি তখন ভ্যাভ্যাভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে ছিলাম। কারণ, টম এন্ড জেরী বলতে আমি ভেবেছিলাম, আমাদের এইচএসসি ইংরেজি পাঠ্য বইয়ে ‘মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পের জেরী। তখন পর্যন্ত আমার পৃথিবীতে জেরী নামক প্রানী ওই একজনই, সেই গল্পের মা হারা পিচ্চি জেরী। কিন্তু সেখানে টম কোথায়? অনেক খুঁজে টুজে অবশ্য টম একজন পেয়েছিলাম, তিনি হচ্ছেন ‘আঙ্কল টম’স কেবিন’ গল্পের আংকল ‘টম’! এদের তাহলে টিভিতেও দেখা যায়!! পরে অবশ্য বুঝেছিলাম, এই টম-জেরী সেই টম এন্ড জেরী নহে!
বাচ্চাদের ন্যাশনাল কারিকুলাম বোর্ডের টেক্সট বইয়ের গল্প কবিতার ছবিগুলো দেখে ভেতরে ভেতরে চূড়ান্ত রকম অস্বস্তিকর ফিলিংস হতে থাকে।
কিছুতেই দূর করতে পারিনা। গ্রাম থেকে শহর অবধি ছেলে মেয়েরা এখন টম এন্ড জেরী চেনে। শুধু চেনেইনা, এইসকল কিছু খায়, ঘুমায়, স্বপ্ন দেখে। ডোরেমন কার্টুনের ছবিওয়ালা ব্যাগ না হলে তারা স্কুলে যাবেনা। বাচ্চাদের কি দোষ? আমরা না হয় ঠাকুর মা'র ঝুলি পড়েছি, কিন্তু প্রযুক্তি যেখানে সময়ের প্রয়োজনে আগাচ্ছে, আমরা সেখানে কই? থাকুরমার ঝুলির কিছু কার্টুন এনিমেশন দেখলাম, ভালো উদ্যোগ ভেবে বাহবাও দিলাম, কিন্তু যারা দেখবে, তারা এ যুগের বাচ্চা।
চাইলেই এদের 'ছেলেভুলানি' গান শুনিয়ে ঘুম পারিয়ে রাখা যাবেনা। অমন আনাড়ি গ্রাফিক্স আর এনিমেশন তারা কেন দেখবে! টিভির রিমোট ঘুরালেই তারা দুর্দান্ত এনিমেশন দেখে, গ্রাফিক্স দেখে, মুভমেন্ট দেখে- টম এন্ড জেরী, বেনটেন, স্পাইডার ম্যান আরও কি কি যেন!! আর আমরা গ্রাফিক্স এনিমেশন দূরে থাক, অসাধারণ সব ছবিগুলোর বদলে টেক্সট বইখানাও এ কি দিয়ে ভরিয়ে ফেলছি! নদীর দেশ, মাঠের দেশ, গ্রামের দেশ বাংলাদেশকে এই শেকরহীন নতুন প্রজন্ম কি করে চিনবে? কোথায় চিনবে?
আমাদের ছেলেবেলায় টেক্সট বইয়ের ছবিগুলো সম্ভবত হাশেম খান কিংবা কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা। বইয়ের বেশিরভাগ গল্প কবিতাই ছিল গ্রামের। ছবিগুলোও। হয়তো সেকারনেই আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখতাম।
কমলাফুলির ছবি, সফদার ডাক্তার, মামাবাড়ির পুকুর ভর্তি মৃগেল মাছ, আসমানিদের রসুলপুরের ছোট্ট বাড়ি, খেয়াঘাটের বিশাল বট, পরিশ্রান্ত পথিক আর শান্ত নদীতে ঘুমের মতন নিঃশব্দে বয়ে চলা পাল তোলা নৌকোর সারী... চোখের সামনের রোজকার পৃথিবীটা কেমন করে এমন ছবি হয়ে চলে এলো বইয়ের পাতায়, কি যে অবাক হতাম ভেবে! ক্লাস থ্রী কিংবা ফোরে চমৎকার এক ছড়া ছিল-, ‘‘বিষ্টি এলো কাশবনে, লাগলো সারা ঘাসবনে, বকের সারি কোথায়রে...” গোটা গোটা হরফে লেখা ছোট্ট ছড়াটার পটভূমিকায় পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে থাকতো বৃষ্টির ছবি। বাতাসে হেলে পড়া কাশবনে চরাচর ভেসে যাওয়া বৃষ্টি। সাদাকালো ছবিতে যেন বুকের ভেতর জুড়েও নামতো বৃষ্টির ঢল, যেন মেঘ কালো মেঘে আঁধার নেমে আসে বইয়ের পাতায়। বাতাসে তেরছা হয়ে পড়া সেই বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচতে কলশি কাঁখে ছুটে যায় পল্লীবধূ, অবাধ্য গরুর পালের পেছনে ছোটে কৃষক। বৃষ্টির ফোটায় যেন টুপ টুপ খই ফোটে বর্ষার ভরা গাঙে, সে গাঙে ভেসে যায় পাল তোলা নাও... হাঁসেদের দল।
আহা আমার দেশ! ছবিগুলো কেমন করে যেন আমাদের ভিজিয়ে দিত বৃষ্টিতে! আসলে ছবিগুলো যারা একেছিলেন, সেখানে কল্পনার সব রঙ নয়, ছিল জীবনের সব রঙ। আমাদের জীবন, আমাদের গাও, আমাদের নদী, আমাদের বৃষ্টি, আমাদের কাশবন, আমাদের জলে ভরা গাঙে পাল তোলা নৌকার সারী।
সেদিন ছোট বোনের বই দেখে রীতিমত আঁতকে ওঠার দশা। বইয়ের পাতায় পাতায় কি হাস্যকর সব ছবি, সে ছবিতে প্রান নেই, চিন্তা নেই, জীবন নেই। নৌকার মাঝির সাইজ যেন নৌকার সমান, কখনো কখনো নদীও খানিকটা ছোট লাগে পাল তোলা নৌকোর কাছে।
গরু ছোট করে বাছুর আঁকার চেষ্টা। কিন্তু গরু ছোট করে আকলেই কি বাছুর হয়?
বিলম্বে হলেও আমি যেমন বুঝেছিলাম, এই টম-জেরী সেই টম এন্ড জেরী নহে!
তেমনি সর্বক্ষেত্রে যাহা লাউ, তাহাই কদু নহে... ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।