বিষ্ণু স্যারের বাসায় ক্লাস নাইন থেকে পড়ি। ক্লাস টেনে দুই বোন ভর্তি হইল আমাদের সাথে, একজন ডানহাতি আরেকজন বাঁহাতি। তখন জানতাম দুইজন যমজ। দুইজন পাশাপাশি বইসা যখন নোট লিখত তখন একজনকে আরেকজনের মিরর-এফেক্ট ছাড়া আর কিছু মনে হইত না। আমি গভর্নমেন্ট হাইয়ের ছেলে, আর ওরা খাস্তগীরের।
বিষ্ণু স্যারের বাসায় সব ভাল রেজাল্ট করা আঁতেল-টাইপ ছেলেমেয়েরাই পড়ত। এর মধ্যে আমি আর আমার এক বন্ধু “মোটামুটি ছাত্র কিন্তু ছেলে ভদ্র -টাইটের উপর রাখলে ভাল রেজাল্ট করবে” টাইপ ভেক ধইরা কেমনে কেমনে জানি ঢুইকা গেছিলাম একগাঁদা ক্যারিয়ার-ওরিয়েন্টেড রেজাল্টমুখী পোলাপানের মধ্যে। তাই কোচিং এ পড়ার সময় স্কুলের ইগো ধরে রাখার ঠাঁটে-বাটে কখনো কথা না হলেও ইনডাইরেক্টলি বাতাসে কমেন্ট পাস করে মেয়েদের সাথে খোঁচাখুঁচি চলতো প্রায়ই।
এসএসসি পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগে নেওয়া মডেল টেস্টগুলোতে চরম শোচনীয় রেজাল্ট (বেশিরভাগ মডেল টেস্টগুলোতেই আমার মার্কস ৭৫-এ ১৫-১৮ এর বেশি হতো না) করার পরও কিভাবে কিভাবে যেন ফাইনালে অবিশ্বাস্য রকমের ভাল রেজাল্ট হয়ে গেল, একেবারে গোল্ডেন!!! যার ফলশ্রুতিতে আমার জন্মের আগে থেকেই আমার জন্মদাত্রীর লালিত স্বপ্ন “ছেলেকে নটরডেমে পড়াবো” বাস্তবায়নের পথ একেবারে মসৃণ হয়ে গেল। ছোটবেলার সব বন্ধু-বান্ধবের সাথে একসাথে চট্টগ্রাম কলেজে পড়ার আর দিনরাত টাংকি মাইরা বেড়ানোর রঙ্গিন মনোবাসনার গুষ্টি কিলাইয়া মা-বাবা-নানা-নানু-খালা-খালু-মামা সবাই মিলে আমারে প্যাকেট কইরা ঢাকায় নিয়ে আসলো।
শুরু হইল নানার বাসায় থেকে কলেজের অস্বাভাবিক চাপের মধ্যে ভয়ংকর নিঃসঙ্গ দিন কাটানো। আগে যেইখানে ফ্রেন্ডরা দিনে ১০-১২টা কল দিত, সে জায়গায় ঢাকা আসার পর প্রথম ৩দিনে একটা কলও আসে নাই ফোনে। সবাই নতুন কলেজে নতুন ফ্রেন্ড সার্কেল নিয়া বিজি, আমিই খালি পুরান পোলাপাইনরে মিস কইরা ঝিম মাইরা আছি। নতুন কেনা ফোনটা সারাদিন হাতে নিয়ে বসে থাকতাম আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম। মাঝে খোঁজ পাইলাম প্রাইমারী লেভেলে আমার সাথে পড়া আমার ছোটবেলার ক্রাশ নাকি আমার হাইস্কুলের ফ্রেন্ডদের সাথেই চিটাগং কলেজে পড়তেছে।
ফ্রেন্ডের কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে শুরু হইলো আজাইরা গেজানো। এইভাবে চলতে চলতে কলেজে ক্লাস শুরু হওয়ার ২মাসের মাথায় পুজার ছুটি। ট্রেনের এক বগিতে নটরডেমের চিটাইঙ্গা পোলাপানগুলা সব এক হয়ে উরাধুরা মাস্তিতে বগি পিটায় ছাতু বানায় প্রথমবারের মত ঘরের ছেলেরা সব ঘরের দিকে রওনা হলাম। উত্তেজনা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি ছিল কারণ তার একদিন পরেই ছিল ফয়’স লেকে প্রথম আলোর সংবর্ধনা। সংবর্ধনা কে গোনায় ধরে? ২মাস পর সব ফ্রেন্ডের সাথে দেখা হবে চিন্তা কইরাই পোলাপানের খুশিতে মাথা খারাপ অবস্থা।
অতঃপর আসলো সেই ঈদের দিন। সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য ফ্রেন্ডদের প্রায় কাউকেই জানাই নাই চিটাগং যাচ্ছি। ফয়’স লেকে সবার সাথে দেখা হওয়ার পর মনে হইলো দুইমাস পর প্রথম বুক ভইরা দম নিলাম। স্কুল লাইফে আমার দুই ছায়াসঙ্গী রিয়াজ আর তাহসিনের সুবাদে চিটাগং কলেজের আর সব সুন্দরী ষোড়শীদের সাথে সাথে দেখা হয়ে গেল আমার বাচ্চাকালের ক্রাশের সাথেও। রিয়াজদের গ্রুপটার সাথে প্রায় ২-৩ঘন্টা ঘুরার পর কেমন জানি নিজেকে খাপছাড়া লাগছিল।
ওরা সব পরিচিত। আর আমি সেখানে ৫-৬জনের বেশি কাউকে চিনি না। তাই একটু পর আলাদা হয়ে উদাস মনে এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করতেছিলাম আর মাইয়া দেইখা মন ভাল করতেছিলাম। সেই ফিলিংসময় মুডের ১৩টা বাজায় দিয়া হঠাৎ সাইড থেইকা ক্যানক্যানা গলায় কে জানি চিক্কুর পাইরা উঠলো “আরে... ফাইজুস না-আ-আ-আ-আ?!?!?!?” মেজাজ-মুজাজ খারাপ কইরা সাইডে তাকায় যখন দেখি বিষ্ণু স্যারের বাসায় সেই লেভেলের মুড নিয়া চলা টুইনের মধ্যে একটা, রাগার বদলে উল্টা টাশকি খায়া গেলাম। টাশকিত ভাব সরায়া যেই একটু পার্ট নিয়া (নটরডেমের পোলা বইলা কথা, পার্ট না লইলে কেম্নে কি???) কথা কইতে যামু, আমারে সেকেন্ড দফা তব্দা খাওয়াইয়া কোন কথা কওয়ার আগেই “দাঁড়াও রাশমীনকে ডেকে নিয়ে আসি” বইলা ধুম কইরা কই জানি দৌড় দিল।
আমি নগদে দুইবার ঝাক্কি খাইয়া যখন হিসাব মিলানোর চেষ্টা করতেছি দেড় বছর একলগে পইড়া যেই মাইয়ার লগে আই-কনটাক্টও হয় নাই, সেই মাইয়া তো আমার সাথে নিজে থেকে কথা বলার কথা না, তখনই দুই বোন সামনে আইসা হাজির। টুকটাক কথাবার্তার পর আমার ফোন নাম্বার নিয়ে ওদের অন্য ফ্রেন্ডের ডাকাডাকিতে চলে গেল। ওদের নাম্বার পাইলাম না কারণ ওদের মোবাইল ইউজ নিষিদ্ধ ছিল বাসায়। পরে পুজার বন্ধ কাটায় ঢাকা আসার পর হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় আননোন একটেল নাম্বারের কল। আমি ব্যপক পার্টিংস নিয়া কল রিসিভ করলাম কোন ভিকি/হলিক্রসের মাইয়ার কল মনে কইরা, দেখি টুইনসের ফোন।
আজাইরা বকবক করলাম। হুদাই ফাপর নিলাম ভিকি/হলিক্রসের মাইয়া দেখতে দেখতে পেইন খাইয়া গেছি, মাইয়াগুলা সারাদিন কল দিয়া পড়াশোনার ডিস্টার্ব করে, আর ভাল্লাগে না ব্লা-ব্লা। ওইপাশ থেকে দুই বোন মিল্লা হালকা চিপ দিয়া দিল। বিষ্ণু স্যারের বাসায়ও এরকম খুব ভাল ছেলের ভাব ধরতাম আর স্যার গেলে পোংটামি করতাম- মনে করায় দিয়া। নগদে ধরা খাইয়াও খারাপ না লাইগা বরং ভালই লাগল এই ভাইবা যে দুই বোনরে যতটা আঁতেল আর কাঠখোট্টা টাইপ মনে করছিলাম- ওরকম না।
বরং ভালই ফ্রেন্ডলি।
এরপর আসলো সে-এ-এ-এ-ই বিখ্যাত/কুখ্যাত ডিজুস জমানা। সারারাত ধইরা আজাইরা পকর-পকরের মচ্ছব। আমার আর তাহসিনের তো আগে থেকেই ডিজুস ছিল। রিয়াজও ওর বাংলালিংক “লেডীস ফার্স্ট” সিম পালটায় ডিজুস নিল, রাশমীন-রুম্মানও দেখি বাসায় লুকায় মোবাইল নিল।
বাই দা ওয়ে, রাশমীনরা রিয়াজের কিভাবে কিভাবে জানি খালা হয়, ছোটবেলায় মডেল কেজিতেও ক্লাসমেট ছিল তিনজন। নাম্বার পাওয়ার পর প্রথম দিনই দুইজনের সাথে হালকা মজা নিলাম। রুম্মানরা রিয়াজের বাংলালিংক নাম্বার জানলেও নতুন ডিজুস নাম্বারটা জানতো না। তো আমি একদিন রুম্মানের কল পেয়ে ইচ্ছা করে একটু পর লাইন কেটে সাথে সাথে রিয়াজের ফোনে ডাইভার্ট করে দিলাম। রিয়াজকেও জানায় দিলাম।
এরপর রুম্মান ফোন দেওয়ার সাথে সাথেই রিয়াজের ঝারি শুরু- “এই মেয়ে তুমি কে? সারাদিন এই নাম্বারে কল দাও কেন? তোমার মত ফাজিল মাইয়ার পাল্লায় পড়ে আমার সোজা-সরল-ভাল ছেলে নাতিটার পড়াশোনা চান্দে উঠছে”। ঝাড়ির ব্যপকতায় রুম্মান কিছু না বইলাই ভয়ে ফোন কাইটা দিল। এরপর আমি আর রিয়াজ যতই কল দেই না কেন, আর কল রিসিভ করে না। পরে এসএমএস দিয়া কাহিনী বুঝাইয়া কল রিসিভ করাইতে হইছে। এরপর থেকে তো প্রতিদিনই সারারাত ফোনে কনফারেন্স করে কথা চলত ৪জনের।
ফোনের চার্জ শেষ হয়ে যাইতো, তাও কথা শেষ হইতো না। রাশমীনের সাথেই বেশি কথা হইতো, রুম্মান সারারাত পড়তো, আর মাঝে মাঝে ফোনে কথা কইতো (এই মাইয়া আসলেই ব্যপক আঁতেল আছিলো এন্ড এখনো আছে)। রাশমীনের সাথে কথা হইতো সব পিন মারামারি টাইপ, হুদাই পচানি-পাল্টা পচানি। আর রুম্মানের সাথে কথা বলা মানেই নির্মল বিনোদন। সে নরমাল একেকটা কথা বলত আর আমি-রিয়াজ ওইগুলার ডার্টি মিনিং বাইর কইরা হাইসা গড়াগড়ি খাইতাম।
এমনকি একদিন এমনই হাসাইছে এই মাইয়া যে রাত তিনটায় আমার হাসি শুইনা আমার নানা ঘুম ভাইঙ্গা উইঠা আসছে। উনি আমারে এত রাতে পড়া বাদ দিয়ে মোবাইলে গেজানোর জন্য ঝাড়ে আর তার মধ্যেও আমি রুম্মাইন্নার কথা ভাইবা ফিকফিক কইরা হাসি। সারারাত রুম্মানদের সাথে কথা বলতাম আর কলেজের টাইম ছাড়া সারাদিন কথা বলতাম আমার ক্রাশের সাথে। ওই মেয়ের সাথে কথা বলি দেইখা রাশমীন পেইন দিত। তাই ওরে পাল্টা পেইন দেওয়ার জন্য বৌ ডাকা শুরু করলাম আর রুম্মানরে শালী।
রাশ বেচারী তো চেইতা এক্কেবারে ফায়ার! কনফারেন্সে পচানিতে ওর ফর্ম ভাল থাকলেই শেষ এবং অব্যার্থ অস্ত্র হিসাবে “বৌ” ওয়ার্ডটা ইউজ করতাম। ব্যাস, পাশার দান উল্টায় যাইতো। রাশ রাইগা গাইল দিত, আমি আর রিয়াজ খ্যা-খ্যা কইরা হাসতাম।
ডিজুস জমানা শেষ হওয়ার পর কথাবার্তা অনেক কমে গেল। আমি তখন আমার ক্রাশের পিছনে মোবাইলের সব টাকা শেষ করি।
তিনদিন কলেজের টাকা থেকে বাঁচাইলে ৫০টাকার একটা কার্ড কিনা যাইতো। ১০-২০টাকা ফ্লেক্সির সুবিধাও তখন ছিল না, দিনের বেলা এফএনএফ নাম্বারে মিনিমাম কলরেটও ছিল সম্ভবত মিনিটে এক টাকার কাছাকাছি। এত টানাটানির মধ্যে ক্রাশের সাথে কথা কইয়াই পোষায় না, ফ্রেন্ডদের সাথে কেমনে কথা কমু? তাই আমার ফোন থেকে টুইনসের দিকে কল যাওয়া প্রায় বন্ধই হয়ে গেল। এর মধ্যে আমার স্কুলের আর কলেজের কয়েকটা ফ্রেন্ড রাশ-রুমকে পেইন দেওয়ার পর ওই নিয়া ঝামেলায় রাশের সাথে কথা বলাও অনেক কমে গেল। রিয়াজ কলেজের ফ্রেন্ডদের নিয়ে ব্যস্ত।
মাঝে দিয়ে আঁতেল রুম্মাইন্নাই পড়তে পড়তে পেইন খায়া গেলে রাত একটা-দেড়টার দিকে কফি বানাইতে উইঠা কল দিত। আমারও ওই টাইমে কফি খাওয়ার বাতিক ছিল। তাই দেখা যাইতো ১০মিনিটের কফি বানানো-খাওয়ার জায়গায় কথা কইতে কইতে ৪০-৪৫মিনিট লাইগা গেছে।
আস্তে আস্তে এইচএসসি ফাইনালের টাইম আইসা পড়লো। আমি আর রিয়াজ তো পুরা কলেজ লাইফ কাটাইছি টাংকিবাজি কইরা আর মাইয়াগো পিছে ঘুইরা।
রিয়াজের আবার গেমিং এর নেশা ব্যাপক। তার উপর মোবাইলের পিছে টাইম দিয়া সারাবছরে কারোই কিছু পড়া হয়নাই। দুইজনেরই পাশ-ফেল নিয়া টানাটানি অবস্থা একেবারে। টেস্টের পর থেকে আবার শুরু হইলো রাতে রুম্মানের সাথে কথা বলা, এবার প্রয়োজনে। একচুয়ালি আমি বা রিয়াজ কমই কল দিতাম, রুম্মানই কল করতো বেশি আমাদেরকে পড়তে বসানোর জন্য।
আমি ঢাকা বোর্ডে ছিলাম দেখে আমাকে সাজেশন দিতে পারতো না, মাগার রিয়াজকে একেবারে চ্যাপ্টার-বাই-চ্যাপ্টার দাগায় দিত ফোনে। আমিও ওখান থেকে হালকা-পাতলা আইডীয়া নিয়ে আমার মত সাজেশন বানাইতাম। এর মধ্যে আমার ক্রাশ তার এক ফ্রেন্ডের সাথে পিরিতি শুরু করল, আমি তো একেবারে ছ্যাকা খাইয়া ব্যাকা হইয়া গেলাম। পড়াশোনা জাহান্নামে গেল। রুম্মাইন্নারে ফোন দিয়া দুঃখবিলাস করি, ও আমারে সাজেশন দেওয়ার বদলে কাউন্সেলিং শুরু করল।
কেমনে কেমনে ওর সাপোর্ট পাইয়া এইচএসসিতেও এ+ মাইরা দিলাম, এইবার গোল্ডেন ছাড়া। এরপর আর পায় কে? দুনিয়া অনেক সস্তা মনে হইতে থাকল। মনে হইলো ভার্সিটি এডমিশন ছেলের হাতের মোয়া। ওমেকার মডেল টেস্ট দিতে গিয়া মনে হয় এত কঠিন প্রশ্ন বুয়েটে আসবে না। তাই ওমেকার গুষ্টি কিলাইতে ২সপ্তাহের বেশি লাগল না।
এডমিশন কোচিং করতে রিয়াজ আর তাহসিনও তখন ঢাকায় আমার বাসায়। সারাদিন তিনজন পুল খেলি- দিনে শান্তিনগর ফ্যান্টাসি’তে আর রাতে ঘুমাইতে যাওয়ার আগে মোবাইলে। বুয়েট পরীক্ষার দুই সপ্তাহ আগে মেডিকেল এডমিশনের রেজাল্ট পাইলাম। যদিও মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা ছিল না, তারপরও লাইফে ফার্স্ট এরকম ধাক্কা খাইলাম। রুম্মানের মেডিকেলে চলে আসছিল, কিন্তু ওর ইচ্ছা ছিল বুয়েটে পড়ার।
সে-ও ধুমায় পড়তেছে বুয়েটের জন্য। তাই বাধ্য হয়ে আবার দুই সপ্তাহের ক্র্যাশ কোর্সে ভর্তি হইলাম রুম্মান আম্মাজানের কাছে। কিন্তু আর যা-ই হোক, দুই সপ্তাহের প্রিপারেশনে আমার মত ডামিশের পক্ষে বুয়েট ধরা সম্ভব না। আমি ডাব্বা খাইলাম আর রুম্মান বুয়েটেও টিকল।
শেষমেষ ভর্তিপরীক্ষার সব যুদ্ধ শেষে দুই বোন মেডিকেলে ভর্তি হল, আমি আর রিয়াজ ভাঙ্গাচুরা ইঞ্জিনিয়ারিং এ।
ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েও সিলেট শাহজালালে গেলাম ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়বো বলে। জানুয়ারি’র ১০তারিখ আমাদের ব্যাচের মেডিকেলে ক্লাস শুরু হল। স্কুল আর কলেজে আমার সাথে থাকা বিল্লু (মীর সাদাদ বিল্লাহ) আর রুম্মান দুইজনই সিলেট ওসমানী মেডিকেলে। রুম্মানরে কল দিলে সে তখন কল রিসিভ করার টাইম পায় না। হলে তার সাথের মেয়েগুলা নাকি মারাত্মক ফ্রেন্ডলি, সারাদিন ওইগুলার সাথে লাফালাফি কইরা তার দিন কাটে।
বন্ধু মানুষ নতুন বন্ধু পাইয়া আমারে ভুইলা গেছে ভাইবা একটু দুঃখ পাওয়ার কথা থাকলেও উল্টা খুশি হইলাম। মাত্র কয়মাস আগেই ছ্যাকা খাইছি, কুলিং পিরিয়ডও শেষের দিকে। এখন রুম্মাইন্নারে সেটিং দিয়া ওর মেডিকেলের একটা বান্ধবীরে পটায় ফেলতে পারলে তো ছক্কা!!! মনে ফুর্তি-ফুর্তি ভাব নিয়ে ২৬তারিখ সিলেটের বাসে উঠলাম। মাঝখানে যাত্রাবিরতিতে প্রথমে বিল্লু’র ফোন, এরপর রুম্মানের। দু’জনেরই নাকি চিটাগং মেডিকেলে মাইগ্রেশন হয়ে গেছে।
এরপর বাকি রাস্তা নিজের কপালরে গালি দিতে দিতে সিলেট আসলাম। আব্বার পোস্টিং তখন সিলেটেই ছিল। ওসমানী মেডিকেলের সামনেই আব্বার কোয়ার্টারে আমার বাসা। সন্ধ্যায়ই কল দিলাম বিল্লু আর রুম্মানকে ওদের কলেজের সামনে আসার জন্য। বিল্লু নাকি কার বাসায় বেড়াতে গেছে, তাই আসেনাই আর রুম্মান বললো আসতেছে।
আমি কায়দা কইরা কইলাম সন্ধ্যায় একলা বাইর হইস না, হলের সামনে নামলেও কাউরে নিয়া নামিস। জানতাম রুম্মান ওর সবচেয়ে ভাল ফ্রেন্ডটারেই নিয়ে নামবে, ও যাওয়ার আগে যদি আমার একটা গতি হয়ে যায় খারাপ কি? মাগার হালায় এমুনি খারাপের খারাপ, একলা নামছে। কোন ফ্রেন্ডরেই আনেনাই। উল্টা ফাপর নিতেছে সিলেটে সে একলাই চলতে পারবে, মেডিকেলের ভিতর অনেক সিকিউরড জায়গা ব্লা ব্লা ব্লা... আর আমার আম-ছালা সব যাওয়ার দুঃখে তখন কানতে ইচ্ছা করতাছে। যা হোক, ২-১দিনের মাথায় বিল্লু আর রুম্মান সিলেট থেকে চলে গেল।
চিটাগং এ দুই বোন আবার একসাথে, খুশিতে মইরা যাইতেছে। আর আমি-রিয়াজ-তাহসিন আবারো আলাদা।
সিলেটে এসে ক্যাম্পাসে এতই ব্যস্ত হয়ে গেলাম সিলেটের বাইরের কারো সাথেই আর কথা হতো না। সকাল ৯টায় বাসা থেকে বের হতাম, রাত ১০-সাড়ে ১০টায় এসে ভাত খেয়ে আবার রাত সাড়ে এগারটা থেকে একটা পর্যন্ত গলির মুখে আড্ডা। রিয়াজ কল করলে দেখা যেত আমি ব্যান্ডের প্র্যাকটিসে, সাউন্ডে কথা বলা যাচ্ছে না।
আর রাশ/রুম কল করত কোন না কোন প্রোগ্রামের ঠিক মাঝখানে- হয় কনসার্ট নাইলে ডিপার্টমেন্টের নবীনবরণ নাইলে ভার্সিটি ডে’র মিছিলের মাঝে। সিলেটের বাইরের সবাই পেইন খাওয়া শুরু করল “তুই তো ব্যপক বিজি মানুষ, ফোন দিলে ধরস না, ধরলেও কথা কইতে পারস না”। এমনকি ঢাকা আসলেও দেখা যাইতো আমি ঢাকার ফ্রেন্ডদের সাথে দেখা না করে শাহজালালের বড়ভাই/পোলাপানের সাথে টিএসসি’তে আড্ডা দিচ্ছি। আমার এই টাইপ ক্যাম্পাস-প্রীতির কারণে আমার অনেক ডায়নোসর-বন্ধুত্ব বিলুপ্ত হইলেও তেলাপোকার মত টিকে থাকল রিয়াজ-রুম্মান আর আমার সবচেয়ে পুরানো লেংটাকালের দোস্ত উচ্ছ্বাস। উচ্ছ্বাস এমন একটা পোলা যে ওর সাথে জীবনেও কারো ঝামেলা হওয়া সম্ভব না।
তবে আমি-রিয়াজ-রুম্মানের মধ্যে যে ঝামেলা হয়নাই- তা না। রিয়াজের সাথে তো ভুল বুঝাবুঝি হইছেই। ব্যাপক গুরুতর ঝামেলা হইলেও প্রত্যেকবারই একই কারণে ঝামেলা হইছে দেখে ওইগুলায় তেমন নতুনত্ব নাই। কিন্তু রুম্মানের সাথে মনেহয় তিনবার মারদাঙ্গা কেচাল লাগছিল। এর মধ্যে একবার না বুঝে ওরে পচাইতে গিয়া যে ভুলটা করছিলাম, সেইটা ভাবলে এখনো নিজেরে থাবরাইতে ইচ্ছা করে।
রিয়াজ না থাকলে এরপর হয়তো লজ্জায় আর কথা-ই কইতে পারতাম না ওর লগে। মাঝে রুম্মান ফোন রিসিভ করতো না বলে আমি-রিয়াজ দুইজনই ওর লগে কথা কওয়া অফ কইরা দিছিলাম। কথা হইলেও টেরা-টেরা কথা বলতাম। আর শেষবার তো আমি মারাত্মক সিরিয়াস- এরকম একটা টপিকে আমারে চেতাইতে গিয়া এমনই ঝাড়ি খাইছে যে নগদে আমারে ব্লক মারছে (একমাস পরে অবশ্য নিজেই আনব্লক মাইরা ফ্রেন্ড রিকু পাঠাইছে, জুসের থেইকা বেশিদিন কেউ দূরে থাকতে পারে না)।
এতকিছুর মধ্যেও ২০০৫ এর ৯অক্টোবর থেকে ২০১৩ এর ১৯জুলাই পর্যন্ত পৌনে আট বছরে যেই জিনিসটা এখনো পাল্টায় নাই সেইটা হল আমার প্রত্যেকটা জন্মদিনে রিয়াজ, রুম্মান প্রথমজন তিনজন কলারের দুইজন হিসাবে জায়গা পারমানেন্ট করে ফেললেও আমি একবারও আমি রিয়াজ/রাশমীন/রুম্মানকে ওদের বার্থডে’তে টাইমমত উইশ করতে পারিনাই।
হয় পরে করছি, নাহলে রিয়াজের কাছে শুনে রাশমীনকে উইশ করছি। এমনকি গতবছর রুম্মান ওর বার্থডে’তে আর না পাইরা রাত ৪টার দিকে ঠোঁট বেকানো স্মাইলি দিয়ে এসএমএস করার পর আমি রিপ্লাই দিছি “বয়ফ্রেন্ডের এসএমএস আমারে দিছোস নাকি ভুলে?”। এরপর ওর “হারামজাদা তুই মইরা যা। এইবারও ভুইলা গেছোস” রিপ্লাই পাওয়ার একঘন্টা পর আমার মনে পড়ছে কি ভুইলা গেছি
কালকে তোর এসএমএস পইড়া রাশমীনকে উইশ করলেও তোরে তো এই বছরও উইশ করলাম না দোস্ত। তাই বইসা বইসা এই আজাইরা লেখাটাই লিখলাম, গিফট হিসাবে নিতে পারস।
এর আগে আমার আর কোন ফ্রেন্ডরে নিয়া লিখতে বসিনাই। তোরেই সেই ‘অনার’টা দিলাম। কেন দিলাম? মানুষ হিসাবে আমি খুবই বোরিং, প্রেডিক্টেবল, সেলফিশ টাইপের। নিজের সমস্যাগুলো অনেক বড় কইরা দেখি, অন্যদের সমস্যাগুলা আমার গায়েই লাগেনা। আমার মত মানুষের সাথে বন্ধুত্ব ধইরা রাখাটা বস্তা পিঠে নিয়ে পাহাড়ে উঠার মত একটা কাজ।
সাধারণত ‘বুদ্ধিমান’ মানুষ এই কাজটা করেনা। বুদ্ধিমান মানুষ গাধার পিঠে বোঝা চাপিয়ে দিয়ে পাহাড়ে উঠায়। আমার সত্যিকারের বন্ধুগুলাও একেকটা প্রমাণ সাইজের গাধা- তুই, আশিক, রিয়াজ এন্ড লাস্ট বাট নট দা লিস্ট উচ্ছ্বাইস্যা। আমি অনেকের জন্য অনেককিছু করছি, এদের অলমোস্ট সবাই আমার সাথে এমন বিহেভ করছে যা আমি ওদের কাছে আশা করিনাই। আর তোরা কয়েকজন এমনই গাধা যে তোদের জন্য আমি কখনো কিছু না করার পরও তোরা এখনো আমার সাথে লটকায় আছোস কোনরকম স্বার্থ ছাড়াই।
কি জন্য আছোস সেটা এখনো আমার কাছে অনেক বড় একটা রহস্য। আর এই গাধাগুলার মধ্যে তুই-ই একমাত্র ‘মহিলা গাধা’ দেইখা তোরে বাকিদের উপর কিঞ্চিৎ এডভান্টেজ দিলাম। আরো একটা কারণ অবশ্য আছে। তুই আমার “বাংলা টেক্সটে বিশাল বড় লেখা” পড়তে পেইন খাস। বাট এইটা তুই কোনভাবেই শেষ পর্যন্ত না পইড়া উঠতে পারবি না যতই পেরা খাস না কেন।
ভাল থাক, অনেক বড় ডাক্তার হ, রোগী মারিস না, আঁতলামী বাদ দিয়া একটা প্রেম কর। প্রত্যেক সপ্তাহে নতুন-নতুন বড়ভাই দেইখা মাথা ঘুরায় না পইড়া বিয়া-শাদীর চিন্তাভাবনা কর। তুই ‘ম্যাচিউরড’ পাবলিক, সবাইরে লেকচার দিয়া বেড়াস, তোর সাথে এইসব টেম্পোরারী ক্রাশ খাওয়া মানায় না...
** হ্যাপী বার্থডে **
>> যেকোন ধরণের আউল-ফাউল কমেন্ট নগদে রিমুভ এবং ইউজার ব্যান করা হবে ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।