আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিদেশে দলীয় রাজনীতি কি কারনে, কি উদ্দেশ্যে?

আমার এক প্রবসী বন্ধু তার ফেসবুকের পলিটিকাল ভিউতে লিখেছে “two men three parties” সাধারণ অর্থে এ কথার কোনও তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া না গেলেও একটু চিন্তা করলে এরূপ কথার ভয়ংকর সত্যতা উপলব্ধি করা যায়। দেশমাতৃকার কথা চিন্তা করে মানুষজন দল করছে, পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, মানুষের চেয়ে দলের সংখ্যা বেশী অথচ সাধারনের ভাগ্য সে একই রকম আছে। প্রধান দলগুলির পাশাপাশি ভুঁইফোড় দলের সংখ্যা এতো বেড়ে গেছে যে জনগণ কার কথা শুনবে তার তাল খুঁজে পাচ্ছেনা। রাজনৈতিক দলগুলির দৌরাত্ব এখন দেশে পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। দলীয় স্বার্থে অন্ধ লোকজন বিদেশে গিয়েও মারামারি, হানাহানিতে লিপ্ত রয়েছেন।

দেশের এত দলের এতো বিদেশী শাখা কার জন্য, কি তাদের উদ্দেশ্য? যুবদল কাতার শাখা আর শ্রমিক লীগ যুক্তরাষ্ট্র শাখা দেশ বা দেশের মানুষের কল্যাণে কি ভূমিকা রাখছে, ভবিশ্যতেই বা কি রাখবে তা ভাবনার বিষয়। যুক্তরাজ্য প্রবাসী আমার এক বন্ধু আর এক অগ্রজ প্রায়ই তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ছবি ফেসবুকে দেন। তাদের একজন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতা গোছের লোক আর বন্ধুবর মূলধারার রাজনীতি তথা লেবার পার্টির রাজনীতির সাথে জড়িত, সংগত কারনে আমি সবসময়ই তাদের বড় শুভাকাঙ্ক্ষী। অব্দুস সামাদ আজাদ, হুমায়ুন রশিদ চৌঃ আর ক্যারিসমেটিক নেতা মমিনুল মউজদিন মারা যাওয়ার পর আমরা অভিবাবক শূন্য আর যিনি আছেন তিনি ইতিমধ্যে কালো বিড়াল খুঁজতে গিয়ে নিজেই হাত কালো করে ফেলেছেন। এমতাবস্থায়, তরুন নেতা কর্মীর আগমনের প্রক্রিয়া তরান্নিত্ব হলে আমাদের প্রতিনিধিত্ব করার মত কাউকে নিশ্চয়ই নিকট অতীতে পাওয়া যাবে।

কিন্তু তা বিদেশে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসুক তা আমি চাই না। বিভিন্ন কারনে বিশেষ করে জীবিকার সন্ধানে অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন যার ধারা আজও বিদ্যমান। সাম্প্রতিক এক হিসাবে দেখা গেছে যে প্রায় ৭২ লাখ বাংলাদেশী বিদেশে অবস্থান করছেন (priyo.com) এবং তারা গত অর্থবছরে প্রায় $১৩ বিলিয়ন ডলার মত বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠিয়েছেন (Bangladesh Bank) । আয় রোজগারের পাশাপাশি রাজনীতি সচেতন ভাই বেরাদার বিদেশে গিয়েও দলীয় রাজনীতির সংশ্লিষ্টতা বজায় রেখেছেন। কিন্তু বিদেশে মূলধারার রাজনীতির সাথে বাংলাদেশিদের অংশগ্রহন তুলনামুলকভাবে অনেকটা কম।

তবে তারা চুটিয়ে বিদেশে দেশীয় পলিটিক্স চালিয়ে যাচ্ছেন। দেশের বাইরে এমন স্থান নেই বললেই চলে, যেখানেই কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছে অথচ দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের শাখা নেই। সেই সাথে তারা দেশীয় কোন্দলের সংস্কৃতিও বজায় রেখেছেন শতভাগ, তার উপরে রয়েছে উপদলীয় কোন্দল! এ কথা বলাবাহুল্য, তাদের এহেন রাজনৈতিক অভিলাশ বা কর্মকাণ্ড দেশে বা দেশের বাইরে বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের জন্য বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা ছাড়া ভালো কিছু উপহার দিতে পারেনি। দলীয় রাজনীতির বাইরে দেশকে নিয়ে যারা সামান্য ভাবেন তারা নির্দ্বিধায় বলতে পারেন যে, বিদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শাখাগুলোর কোন্দলে দেশের ভাবমূর্তি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশের ভাবমূর্তি নিয়ে যখন দেশের ভিতরেই কোনও ইতিবাচক পদক্ষেপ বা কারও মাথা ব্যাথা নেই সেখানে বিদেশে দিনে আনে দিনে খায় এমন নাগরিকদের কাছে বেশী কিছু আশা করা বৃথা।

১/১১‘র পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দলগুলি কোনও অঙ্গসংগঠন না রেখে নিবন্ধন নিয়েছিল কিন্তু ম্যাডাম বিশেষ করে শেখ হাসিনা ঐ সময়ে বিদেশের মাটিতে যেখানেই গেছেন সেখানেই দলীয় (বিদেশে অবস্থিত অঙ্গসংগঠন) ফোরামের লোকজনের ব্যাপক লোক সমাগমকে বিদেশে তার জনপ্রিয়তার মাপকাঠি হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন! এই প্রসঙ্গে আমি আমার এক সহকর্মীর অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে ভাগ করব, সে তখন লন্ডনের ফিন্সব্যারি পার্কের “বুটস” এ কাজ করত, একদিন সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ সাহেব সেখানে গেলেন কিছু কেনাকাটা করতে সাথে মহাসচিব রুহুল আমিন, তাকে দেখে আমার সেই সহকর্মী এগিয়ে গিয়ে হাত মেলাল, প্রেসিডেন্ট মহোদয় তার সঙ্গীকে উদ্দেশ্য করে বললেন “দেখেছ দেখেছ বাংলাদেশের মানুষ আমাকে চিনে আমাকে এখনও চায়”! পাঠক কি বুঝলেন? আমাদের দেশের নেতা নেত্রিরা তাদের জনপ্রিয়তা (??) বিদেশের মাটিতেও কায়েম রাখতে চান তাইত বিদেশের মাটিতে নিত্য নুতন দলীয় সংগঠন গজিয়ে উঠছে! আম জনতার লাভ হোক আর নাই হোক তাদেরত লাভ হচ্ছে তাই বিদেশের মাটিতে একটু কোন্দল আর রেষারেষি জিইয়ে রাখলে মন্দ কি, কি বলেন পাঠক? কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগ এম.পি গোলাম মাউলা রনির একটি লেখা পড়েছিলাম প্রিয় ব্লগে (priyo.blog.com), তার ভাষ্যমতে, শেখ হাসিনা সংস্কারপন্থী নেতা তোফায়েল আহমেদকে মন্ত্রী হিসাবে না রাখার আগাম সিদ্ধান্ত নেন তাও সেটা লন্ডনে অন্যান্য স্থানীয় নেতার সাথে বৈঠকের পর, তার তথ্যমতে সেখানে শ্রদ্ধেয় আব্দুল গাফফার সাহেব ও নাকি উপস্থিত ছিলেন। সত্য মিথ্যা জানি না, কিন্তু একটা বিষয় আমাকে খুব ভাবায় সেটা হল জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিদেশে বাস করা নেতাদের সাথে শলা পরামর্শ! এহেন কর্মকাণ্ড জাতীয় নিরাপত্তার জন্য যতটা হুমকি তার চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ হল ভুইফুড় নেতাদের সম্প্রিক্তকরন। এতে জাতীয় পর্যায়ের নেতারা একদিকে যেমন তথাকথিত বিদেশী পাতি নেতাদের কর্মকাণ্ডের বৈধতা দেন অন্যদিকে বিদেশে বসবাস করা লোকজনকে/কমিউনিটিকে দলীয় স্বার্থে বিভক্ত রাখেন। এই বিভিক্তির রেশ শেষ পর্যন্ত ঐসব দেশের মূলধারায় জড়িত রাজনিতিকদের কর্মকাণ্ডেও পড়ে। ১৯ শতকের শেষ দিকে বিলেতে অভিবাসন শুরু হলেও আজ পর্যন্ত ইউকেতে আমাদের তেমন কোনও রাজনৈতিক প্রতিনিধি নেই।

হাল আমলের লেবার এম.পি রোশনারা আলী আর টাওয়ার হ্যামলেট বারার (বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকা) মেয়র ছাড়া বাকিরাত লন্ডনে বসে আওয়ামী লীগ আর বিএনপির হয়ে মাঠ গরম আর কাদা ছুড়াছুড়ি করতে ব্যাস্ত। অভিবাসীরা প্রথম দিকে রাজনীতিতে জড়াতে পারেনি তাদের অশিক্ষার কারনে আর আজ ২০১২‘তে শিক্ষিত দ্বিতীয় আর তৃতীয় প্রজন্মের বংশধরেরা পারছেন না অহেতুক দলাদলির কারনে তাও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারনে, ভাবুনত একবার! অভিবাসী শ্রমিকদের বড় একটি অংশ মধ্যপ্রাচ্য আর দূরপ্রাচ্যের দেশগুলিতে কাজ করেন। ভিটামাটি বিক্রি করে বিদেশ যাওয়া শ্রমিকরা বাংলাদেশ মিশন থেকে বিশেষ কোনও সহযোগিতা পান না। পরিস্থিতি এমন যে, দূতাবাসগুলির কর্মকাণ্ড কেবল পাসপোর্ট ইস্যু আর নবায়ন, শ্রমিক মৃত্যুর পর নাম ঠিকানা যাচাই আর পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে তারবার্তা পাঠানোর মধ্যেই সিমাবদ্ধ। শ্রমিকের মজুরি, পাওনা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে তারা অপারগ (ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত)।

এই ক্ষেত্রে প্রবাসীদের সংগঠনগুলি শ্রমিকদের ভালো সহযোগিতা করতে পারত। তারা নতুন আসা শ্রমিকদের বাসস্থান, চিকিৎসা, বেতন-ভাতা, যাতায়াত, ভাষা এই সমস্ত কাজে প্রাথমিক ধারনা দিয়ে তাদেরকে প্রস্তুত করতে পারত। কিন্তু হায়, তারাত দলীয় লেজুড়বৃত্তিতেই ব্যাস্ত সহকর্মীদের নিয়ে ভাবার সময় কোথায়! সবাই মনে করে আমরা কষ্ট করে থিতু হয়েছে তোমরাও একই পথে হেঁটে নিজেদের টিকিয়ে রাখার চেষ্টা কর। নুন্যতম সহযোগিতা কেউ কাউকে করে না। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এবং ঢাকা বিমানবন্দরের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৩ থেকে ২০১২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত নয় বছরে ১৫ হাজার ৭৫২ জন প্রবাসীর লাশ এসেছে।

২০০৯’র এপ্রিল থেকে ২০১২’র এপ্রিল পর্যন্ত অর্থাৎ গত তিন বছরে এর সংখ্যা ৮ হাজার ১৩২ জন, প্রতিদিন গড়ে সাত থেকে আটজনের লাশ আসছে। আর কত লাশ যে বেওয়ারিশ হিসাবে বিদেশের মাটিতে আর মর্গের হিমঘরে পড়ে রয়েছে তার ইয়ত্তা নেই! কত মানুষ যে কাজের খোঁজে রাস্তায় রাস্তায় না খেয়ে ঘুরছে, কত শ্রমিক অন্যায্য বেতন আর মালিকের অত্যাচারের শিকার হচ্ছে এই ব্যাপারে দলের লেজুড়বৃত্তি করা প্রবাসী সংগঠনগুলি কি করছে? পাশের ঘরের শ্রমিক ভাইকে অভুক্ত আর নির্যাতিত হতে দেখেও যারা বিভিন্ন দলীয় ফোরামে গলা ফাটিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা কতটুকু মানবিক গুণসম্পন্ন? টিপাইমুখ বাধ আর সীমান্তে হত্যা বন্ধে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ছাত্র-শিক্ষক আর তরুন অভিবাসীরা মেলবোর্ন আর সিডনির মাঠে যে অভিনব প্রতিবাদ কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল সেই মহৎ উদ্যোগটি পর্যন্ত দেশী দলভিত্তিক কুরাজনীতির শিকার হয়েছিল। তরুন ঐ প্রতিবাদকারীদের হিজবুত তাহরিরের সদস্য বলে কটাক্ষ করা হয়েছিল। দেশের বাইরে থাকাকালীন সময়ে প্রত্যেক নাগরিক দেশের প্রতিনিধি কিন্তু তাদের কাজ কর্ম যদি দেশের পরিবর্তে দলীয় স্বার্থে পরিচালিত হয় তখন দেশের কতটা লাভ হয় তা খতিয়ে দেখা দরকার। দলগুলির রাজনৈতিক ও আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় বিদেশে চালু থাকা অঙ্গ সংগঠন সমূহ দেশের স্বার্থে কি কাজ করছে বা তাদের দ্বারা দেশের কি উপকার হচ্ছে তা ভেবে দেখার সময় হয়েছে।

তারা যেহেতু দেশের বাইরে থাকেন দেশের কথা না হয় বাদই দিলাম কিন্তু প্রবাসীদের কল্যাণে তারা কি করছেন? গনতন্ত্রে দল মানেই ভিন্নমতের মিলন কেন্দ্র আর উদ্দেশ্য বিহীন অঙ্গ সংগঠন সমূহ বচসা, কোন্দল আর উপকোন্দলের বিষবাষ্প নির্গত করা ছাড়া আর বিশেষ কিছু কি করছে তা ভাববার সময় এসেছে বলে মনে করি। বিদেশী রাজনীতিতে আমাদের প্রতিনিধিত্ব বেশী না হলেও আস্তে আস্তে তা বাড়ছে এর ধারা আরও বাড়াতে হলে দেশীয় রাজনীতির শাখা প্রশাখা বন্ধ করা ছাড়া আর কোনও বিকল্প নাই। এই সমস্ত রাজনৈতিক শাখা বন্ধ হলে বিদেশের মাটিতে প্রবাসীদের অহেতুক বিবাদ বন্ধ হবে কমিউনিটিতে ঐক্য তৈরি হবে এতে তারাই শুধু উপকৃত হবেন না দেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হবে। বাংলাদেশী হিসাবে আমরা চাই আমাদের রাষ্ট্রপতি আর প্রধানমন্ত্রী দেশ বিদেশে থাকা সকল বাংলাদেশীর রাষ্ট্রপতি আর প্রধানমন্ত্রী হবেন কোনও দল বা গোত্রের নন। এইটুকু আশা কি আমরা করতে পারি না? (লেখাটি মাদিবার ৯৪ বর্ষে পা দেয়া আর সদ্য প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদেকে উৎসর্গ করলাম) সুনামগঞ্জ, জুলাই ২০, ২০১২ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।