বানান করে করে পড়তে শিখেছি মাত্র। আমার কষ্ট হতো এভাবে পড়তে। বাক্যটা কোনমতে শেষ করতে পারলেও বুঝতে পারতাম না আসলে কী পড়লাম। এরকমই একটা বয়সে আমার হাতে এসে পড়েছিল পুরোনো একটা পত্রিকা। পুরোনো পত্রিকাগুলো রাখা হতো একটা টেবিলের নিচে।
ওগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতেই পেয়েছিলাম ওটা। নানা রকম কার্টুন তাতে। ওখানে ছবি দেখে আমি একটা লেখা পড়ার জন্য বেছে নিলাম। টেবিলের নিচে বসে বসেই আমি বানান করে করে, দাঁত ভেংগে চুরে ঐ লেখাটা পড়ে ফেলেছিলাম। তেমন কিছুই বুঝতে পারি নি।
খালি এটুকুই মাথায় ঢুকলো, একটা মেয়ে তার মাথার সব চুল কামিয়ে টাক্কু হয়ে গেছে। ঐ পৃষ্ঠায় টাক্কু মেয়েটার একটা ছবিও ছিল, হাতে একটা রেজর। আমি তখনো জানতাম না, ঐ পত্রিকার নাম, লেখকের নাম।
টিভিতে এক সময় মজার একটা নাটক দেখানো হতো, বহুব্রীহি। তবে ওটা যে কার লেখা নাটক তা অবশ্য আমি জানতাম না।
এরপরে আরেকটি জনপ্রিয় নাটক ‘’অয়োময়ো’’ দেখানো হত বিটিভিতে। তখন ক্লাস থ্রিতে পড়তাম। আর ক্লাস ফোরে উঠার পর ওই নাটক শেষ হয়েছিল। সে নাটকের ‘আউলা চুলে নাচো গো বাউলা গলায় গাও’’ অথবা ‘’আগে চলে দাসী বান্দী পিছে সখিনা’’ গানগুলো সে সময় লোকের মুখে মুখে ফিরত। আর আমরা বান্ধবীরা দল বেঁধে চলতে নিলে কেউ সামনে চলে গেলে ‘’আগে চলে দাসী বান্দী’’ গেয়ে টিটকারী করতাম।
আমরা তখন সবাই সখিনা হতে চাইতাম, কেউ আগে হাঁটতে চাইতাম না। এখনো কোন দলের মধ্য থেকে কেউ আগে হেঁটে সামনে চলে গেলে এই গান গেয়ে তাকে অপদস্ত করার রেওয়াজ আছে। সম্ভবত আমি ক্লাস ফোরে পড়ার সময় নাটকটির শেষ পর্ব দেখানো হয়েছিল। সে পর্বটা এত বড় ছিল যে আমার পক্ষে রাত দশটার ইংরেজী সংবাদের পর বাকি অংশ দেখা সম্ভব হয়নি। পরদিন স্কুলে গিয়ে বান্ধবীদের সাথে যথারীতি হা পিত্যেস করেছিলাম।
ক্লাস ফাইভে উঠে বই মেলা থেকে ভাইয়ার পছন্দে হুমায়ুন আহমেদ নামের একজন লেখকের ‘’এলেবেলে’’র দুটো পর্ব কেনা হলো। ততদিনে আমি গল্পের বই ভালভাবেই পড়তে শিখে গেছি। বই দুটো এত মজার! পড়তে পড়তে খেয়াল করলাম, অনেক ছোটবেলায় একটা পত্রিকায় একটি মেয়ের টাক্কু হয়ে যাবার গল্পটাও এখানে আছে। এভাবেই হুমায়ুন আহমেদের সাথে আমার পরিচয়। এরপরে যা হলো, আমি এই লেখকের লেখা ছাড়া আর কারো বই পড়তামই না বলা চলে।
কে কয়টা হুমায়ুন আহমেদের বই পড়েছে, এটা নিয়ে বান্ধবীদের মধ্যে রীতিমত প্রতিযোগিতা হতো। আমরা লিস্ট করতাম হুমায়ুন আহমেদের পড়া বইগুলোর। স্কুলের গণ্ডি পেরুনোর আগেই আমি তাঁর প্রায় ১৫০ বই পড়ে ফেলি। ‘’নন্দিত নরকে’’, ‘’তোমাকে’’, ‘’আকাশ জোড়া মেঘ’’, ‘’তারা তিনজন’’, ‘’সূর্যের দিন’’, ‘’অমানুষ’’, ‘’নিশিথিনী’’, আত্নজৈবনিক প্রায় সবগুলোবই আমার বারবার পড়া প্রিয় বই (আসলে তালিকাটা আরেকটু বড়)। শুধু এই বইগুলোই নয় আরো অনেক বই আমি বারবার পড়েছি।
বই পড়তে পড়তে পেনসিল দিয়ে লাইন দাগিয়েছি। ‘’যে ভালবাসা যত বেশি গোপন সে ভালবাসা তত বেশি গভীর’’, এই সব ফিলোসফি তো তাঁর বই পড়েই পাওয়া।
আমার ক্লাস সিক্সে পড়াকালীন সময়ে ‘’কোথাও কেউ নেই’’ নাটকটি বিটিভিতে প্রচারিত হয়েছিল। নাটকটা যে কত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সেটা এখনকার ছেলেমেয়েরা কল্পণাও করতে পারবে না। ‘’মাইরের মইদ্যে ভাইটামিন আছে’’, ‘’কুত্তাওয়ালী’’, ‘’গায়ে হলুদ-বডি টারমারিক’’, এইসব প্রবাদের তো এই নাটকের মাধ্যমেই জন্ম! আমার ভাইয়া ঘরের মধ্যে বাকের ভাই, বদি আর মজনুর পোস্টার লাগিয়েছিল, যাতে লেখা ছিল ‘’মাইরের মইধ্যে ভাইটামিন আছে’’ প্রবাদতুল্য সংলাপটি।
আর সেই গান ‘’হাওয়া মে উড়তা যায়ে’’ এর কথা নতুন করে আর বলবো না। আমাদের পাড়ার মাস্তান ছেলেটাও বাকের ভাইয়ের মত হাতে চেইন ঘুরানোর স্টাইল ধরে ফেলল, এই নাটক দেখে দেখে। এই নাটকের শেষ পর্বের দিন, আমার এক মামা তার পুরো পরিবার শুদ্ধ চলে এলো আমাদের বাসায় নাটক দেখবে বলে। তাঁদের পাড়ায় কারেন্ট চলে গিয়েছিল। তাঁদের পাড়ায় কারেন্ট চলে গেলে আমাদের পাড়ায় কারেন্ট থাকতো।
হুমায়ুন আহমেদের ঈদের নাটকগুলোর কথাও বড়দের কাছে শুনি। কিন্তু আমি এতই ছোট ছিলাম যে, ওগুলো দেখা হয় নি আমার। আর দেখলেও পুনপ্রচার করা হলে তখন দেখেছি।
ততদিনে আমার ধ্যানজ্ঞান হুমায়ুন আহমেদ হয়ে গেছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে ১৯৯৮ এর সেই দিনটির কথা, যেদিন পথে নুহাশ চলচ্চিত্রের মাইক্রো দেখে, আমার চোখ চঞ্চল হয়ে গিয়েছিল।
দেখি, সামনের সিটেই তিনি বসা, আমার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে আছেন। আর এদিকে আমি তো মহাখুশি! নাহ, বইমেলায় তাঁর সাথে আমার কখনো দেখা হয় নি। এই তাঁর সাথে আমার প্রথম ও শেষ মুখোমুখি হওয়া।
হুমায়ুন আহমেদের বই পড়তে পড়তে এক সময় তাঁর চরিত্রগুলোর মত পাগলামি আচরণও করে বসতাম হয়ত। আসলে ঐ বইগুলো পড়তে পড়তে একটা ঘোরের মধ্যে বসবাস করতাম।
শুধু আমি কেন? হিমুর ঘোর তো এখন এ দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে একটা রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে আমার মনে হয়। আমার বন্ধু বাপ্পী (ওয়াহিদ রেজা) কে আপনারা অনেকেই এখন একজন প্রতিষ্ঠিত হিমু হিসেবে চেনেন। মনে আছে, বাপ্পী তখন হলুদ পাঞ্জাবী পড়ত, এমন কি মাঝে মাঝে খালি পায়েও ক্যাম্পাসে আসতো। তবে হিমুর চেয়ে ঠাণ্ডা মাথার যুক্তিশীল মিসির আলী চরিত্রটা আমার বেশি ভাল লাগে। মনোবিজ্ঞান বিষয়টার প্রতি আমার যে একটা বাড়তি আগ্রহ, এর পেছনে মিসির আলীর অনেক বড় একটা অবদান আছে।
এই যে এখন আমি মাঝে মাঝে মনস্তাত্বিক বিষয় নিয়ে টুকটাক লেখার চেষ্টা করি, মিসির আলী না থাকলে তা মনে হয় না সম্ভব হতো। অনেকে আমার লেখার সহজ সরল সাবলীলতার প্রশংসা করেন, এটাও হুমায়ুন আহমেদের প্রভাব বলেই আমার মনে হয়।
হুমায়ুন আহমেদ বেশি পড়তে পড়তে এক সময় অন্য লেখকদের লেখা পড়ার রুচি আমার নষ্ট হয়ে গেল। কোন গভীর লেখা আমার পড়তে ভালো লাগতো না। কিন্তু ওদিকে আবার প্রায় একই ধরনের সংলাপ, চরিত্র, কাহিনী বিন্যাস আমাকে একঘেঁয়েমিতে ফেলে দিলো।
কোন বৈচিত্র নেই, সেই একই গতানুগতিক সংলাপ। আমার ভেতরকার পাঠকের মৃত্যু ঘটে গেল। একটা সময় আমি বলতে গেলে তেমন কিছুই পড়তে পারতাম না, এমন কি নিজের পাঠ্য বইও না। এজন্য হয়ত অন্য কোন ফ্যাক্টরও দায়ী হতে পারে, শুধু হুমায়ুন আহমেদকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সময়টা নিঃসন্দেহে আমার জন্য একটা খারাপ সময়।
দীর্ঘদিন পরে আমি আবারও ঘটনাচক্রে বই পড়তে শুরু করি, এবং হুমায়ুন আহমেদের বলয় থেকে বেরিয়ে এসে। আমি নানা ধরনের বই পড়তে শুরু করি, এবং হিমু চরিত্রটা আমার কাছে বিরক্তিকর লাগতে শুরু করে। আমি হুমায়ুন আহমেদের বই, নাটক, সিনেমা দেখা একদম বন্ধ করে দিই, আমার কাছে এগুলো স্রেফ সময় নষ্ট মনে হতে লাগলো। যদিও ‘’বাদশাহ নামদার’’ বইটার প্রশংসা শুনে আমি বইটি পড়ি। দীর্ঘ সময়ের পর এটিই আমার পড়া হুমায়ুন আহমেদের শেষ বই।
এই বইটি পড়ে মুগ্ধ হয়ে ভেবেছি, এমন বই তিনি কীভাবে লিখলেন। যদিও এর মধ্যেই কিছু কিছু ব্যাপার নিয়ে আমি কঠোর সমালোচনা করি এবং করবো।
যত সমালোচনাই করি না কেন, হুমায়ুন আহমেদের প্রতি আমার এক ধরনের কৃতজ্ঞতাও আছে। এই যে আমার জোছনা চেনা, রবীন্দ্রনাথকে জানা, এই যে বই পড়ার একটা অভ্যাস তৈরি করে দেওয়া, এই যে আমার মধ্যে একটা স্বপ্নালু মানুষের জন্ম দেওয়া, এসব তো হুমায়ুন আহমেদই করেছেন। তিনি জানলেনও না তিনি আমার কী করেছেন।
চলে গেলেন ‘’চাঁদনী পসর রাইতে মরণে’’র তীব্র ইচ্ছা নিয়ে। কিন্তু আজ তো চাঁদনী পসর রাত ছিল না!
২০ জুলাই, ২০১২
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।