খুব জানতে ইচ্ছে করে...তুমি কি সেই আগের মতনই আছো নাকি অনেকখানি বদলে গেছো... এস এম সুলতান সহজপাঠ, র্দুভেদ্য জীবন
হাসান কামরুল
শুভ্র সাদা মানব কল্যাণে ব্রতী এ এক প্রকৃতির উপাদান। এস এম সুলতানের দর্শন মানবতা, কল্যাণের অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছে উঠাই ছিল তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কৃষকের ক্লান্ত দিন, কৃষানী স্বপ্নের বিভোরতা দেখেছেন ধ্যানে মগ্নে আপন মহিমায়। ছবি একেছেন, বোহেমিয়ান জীবন নিয়ে বেড়িয়েছেন কাদা মাটির সুধা গন্ধে। প্রকৃতির অপার উপাদানের নিমিত্তে ক্ষেতের আলধরে, সোনালী ধানের ওষোর ভেঙ্গে হেটে বেড়িয়েছেন গাও গ্রামের প্রান্তে।
শিশুদের প্রতি ভালোবাসায় বিমোহিত সুলতান। শিশুদেরকে ভবিষ্যতের যোগ্য উত্তরসুরি ভেবে শিশুদের গড়ে তোলার ইচ্ছে শক্তির ব্যাপ্তি ছিল রঙের তুলির আচড়ে। তাই শিশুদের সখ্য তাকে দিয়েছে অনন্য এক প্রেরণাশক্তি । শিশুদের মাঝে নিজেকে বিস্তৃত করাই ছিল আরাধ্য। আরাধনার তৃপ্তিতে আপ্লুত হয়েই শিশু স্বর্গের সূচনা।
নিজের পরিধি বিস্তারের মানসে শিশুসঙ্গ তাকে নিয়ে গেছে ভাবনার অসীম এক জায়গায়। সৌন্দর্য্য পিপাসু প্রকৃতির সৌন্দর্য্যে অবগাহনে গ্রহণ করেছেন যাযাবর জীবনকে । জীবনের মোহ ত্যাগ, সীমাহীন আর্থিক অনটন, চারপাশের মানুষের অনভিপ্রেত অসহযোগীতা ও সংসার ত্যাগ তাকে তিলে তিলে রুপান্তরিত করেছে অদ্ভুত অভিপ্রায় এক ব্যক্তিত্বে। যা নিয়মের বাহির থেকে প্রকৃতির রুপ রস সুধা পানে চারপাশকেই নিয়ামক হিসেবে কল্পনার জগতে তুলির সুবিশাল ক্যানভাসে ঠাই দিয়েছেন চিত্রচর্চায়। জীবনের অলিগলি পেরিয়ে রক্তমাংশের সুসজ্জিত কশেরুকা ভেদ করে এনেছেন হাড্ডিসার মানুষের নিত্যদিনের জীবন।
শৈল্পিক ভাবনা থেকেই তিনি তুলির নরম আচড়ে একেছেন গরীব মানুষগুলোকে, যাদের কশেরুকার মগজে ধনীক শ্রেনীর বসবাস। শোষনের সেই হাতিয়ারকে জাত ভেদ ভুলে প্রতিভু প্রজাতির গোয়ালের গোবাদি পশুর শৃঙ্গের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তার গভীর কৌতুহলদীপ্ত চোখ চিত্রা নদী দেখেছে, ডিঙ্গি নৌকায় শিশুদের দেশ ভ্রমনের প্রয়োজনীয়তা মানসপটে সযতেœ বয়ে নিয়ে দেশ বিদেশে তা উপ¯হাপন করেছেন আগামির কথা ভেবে। অন্তরাতœা আর লৌকিক বিবেচনায় দেশের মাটি বায়ু আকাশ ও মানুষই ছিল তার আরাধ্য। মানব সেবার ক্যাটাগরিতে প্রাধাণ্য পেয়েছে নির্বাক ছবি।
যার ভাষা নেই কিন্তু আছে প্রকাশের অভিপ্রায়। আর এ অভিব্যক্তিই তাকে দিয়েছে অনন্য সুন্দর ছদ্মাবরন জীবন । প্রকৃতির অপার মহিমায় জাতভেদের বাড়াবাড়িতে বিরক্ত হয়েছেন, কখনো কখনো নিরুদ্দেশ্যে পলাতক জীবনকে সঙ্গি করে মন দিয়েছেন স্বীয় কর্মে। প্রকৃতির অপ্রকৃতি¯হ আচরনে তার ভিতরটা হু হু করে কেদে উঠত। তাই প্রকৃতির অসদাচারন তার অন্তরদেশে প্রতিবাদের ভয়ানক খেয়াল সৃষ্টি করতো।
চারপাশের মানুষের বিষবাষ্পে তার চরিত্রে অদ্ভুত পরিবর্তনে অভিষ্ট হতো। বেখেয়ালী এ জীবন নিয়ে মানুষের কৌতুহলও ছিল অতুলনীয়। চুপিসারে দলবেধে পুরুষ মহিলা ঝি জায়া ভগিনী এক নজর সুলতান দর্শনে চিত্রারপাড়ে ভীড় জমাতো। সাধক পুরুষ ভেবে কেউ কেউ তার দর্শনকে মঙ্গলের শুভক্ষণ ভেবে সুলতান দর্শনে আড়ষ্ট ছিল কতোশতো জীবন। এ এক মানুষ যার বেখেয়ালী জীবনে খুব খেয়াল ছিল ছবি আকায়।
কতো ভাষার অভিব্যক্তি স্পষ্টত চিত্রকর্মে। যুগযুগ ধরে ভাষাহীন চিত্র কর্ম কতোটা বেপরোয়া হয়ে সমাজে রাষ্ট্রের অনাচারে প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। তাইতো সুলতান ভীতিতেও ভুগেছে বহু প্রতিষ্ঠিত চিত্রশিল্পী। যারা রাষ্ট্রের কাছাকাছি থেকে বোহেমিয়ান সুলতানের সৃষ্টিকর্মকে রাষ্ট্রিয় পক্ষপাতদুষ্টে আড়াল করেছে। কারণ অতীতের সব সৃষ্টিশীলতা যে সুলতানের সৃষ্টিকর্মে ঢাকা পড়ে যেত মহুর্তে।
তার ছবির ভাষার ভীতিতে সুলতানকে ঢাকা শহরেও আসতে অনেকের প্রত্যক্ষ বিরোধীতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাই নড়াইল থেকে ঢাকাকে অনেক দুর ভেবে ছুটে গেছেন কলকাতায়। কলকাতায় যখন সুলতানের জয়জয়কার তখনো অতি উচ্চমার্গিয় চিত্রকররা কলকাতায় সুলতান বিরোধীতার পোষ্টার ছেপেছেন। রাতের আধারে তা কলকাতা শহরের অলিগলিতে সুলতান কপাট মুর্খ বলে প্রচারসমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু তারপরও সুলতান লক্ষ্য থেকে এক চুল পরিমান লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি।
রাতের বেলায় সুলতান সান্নিধ্যে যারা আতœতৃপ্তিতে ভুগেছে। তারাই দিনের বেলায় সুলতান বিরোধীতায় কাপাতেন বক্তৃতার মঞ্চ। কিন্তু তারপরও সুলতান তাদেরকে সঙ্গ দেয়া থেকে বিরত থাকেনি।
সুলতান নিয়ে রাষ্ট্রের অবহেলা সুলতান প্রেমিকদের হতাশ করে। কেন আমাদের সরকার ব্যবস্হা আমাদের রাষ্ট্র এসএম সুলতান নিয়ে এতোটা উদাসিন তা বোধগম্য নয়।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান সহ প্রতিযশা শিল্পীদের নিয়ে পাঠ্যপুস্তুকে শিক্ষা দেয়া হয় কিন্তু সুলতান রয়ে গেছেন বরাবরই অনুপস্হিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায়তো সুলতান এক প্রকারে নিষিদ্ধই বটে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চারুকলা ইনস্টিউটগুলোতে এসএম সুলতান নিয়ে কোন শিক্ষা দেয়া হয়না। অতচ এস এম সুলতানের চিত্রকর্ম বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছেন। লন্ডন থেকে প্যারিস এসএম সুলতান দীপ্তমান।
প্যারিসের যাদুকরে এসএম সুলতানের আকা তিনটি চিত্রকর্ম স্হান পেয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও এসএম সুলতান পড়ানো হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে তার প্রিয় স্বদেশে মহৎ এ শিল্পী বরাবরের ন্যায় অনুপস্হিত ও অবহেলিত। এস এম সুলতানের জন্মবার্ষিকী ও মৃত্যুবার্ষিকী নিয়ে রাষ্ট্রিয় কোন আড়ম্বর চোখে পড়েনা। অতচ অনেকের বেলায় রাষ্ট্রিয় আয়োজন দেখে এসএম সুলতান নিয়ে যে বৈষিম্য চলছে তা স্পষ্ট হয়।
রাষ্ট্রযন্ত্র একপেশি পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারেনা, হওয়া উচিতও নয়। বিশেষ করে এসএম সুলতানের মতো এমন একজন গুনি মানুষকে যদি রাষ্ট্র স্বীকৃতি না দেয় তাহলে তা জাতি হিসেবে আমাদেরকে নীচু করবে তা নি:সন্ধেহে বলা যায়। হ্যা রাষ্ট্রব্যবস্হায় অনেক বিষয়ে মতদ্বৈততা থাকে। তাই বলে গুনি মানুষদের নিয়ে নয়। এসব মানুষেরা রাষ্ট্রিয় সম্পদ, তাদেরকে মুল্যায়ন করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
তাই সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করে বলবো সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা ইন্সটিউটের যাত্রা শুরু হয়েছে। অত্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হওয়া চারুকলায় এসএম সুলতানকে পাঠ্যসূচীর অর্ন্তভুক্ত করা হোক। এখানকার ছাত্রছাত্রীরা সুলতান পাঠে নিজেদের ঙ্ঞানের ভান্ডার পুর্ণ করুক। তাদের মাধ্যমে এসএম সুলতান ছড়িয়ে যাক মহাবিশ্বের মহাব্যাপ্তি। তাতে রাষ্ট্র কিছুটা হলেও ভারমুক্ত হবে।
এসএম সুলতান পাঠের আসর এই সবুজতায়নের পরিসীমা ছেদ করে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও পৌছে যাক এই প্রত্যাশা সুলতান প্রেমিকদের। আশা করি এক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ সকল সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। এক্ষেত্রে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের দায় অনেক বেশি। কেননা তাদেরই কাজ শিল্প সংস্কৃতির গুনিজনদেরকে রাষ্ট্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া। এস এম সুলতান নিয়ে কোন রাজনীতি নয়, কোন মহলের আক্রোশ নয়।
এস এম সুলতানকে সকল প্রকার বির্তকের উর্ধেব রেখে যথাযথ মূল্যায়নেই আমাদের ব্যক্তি সত্ত্বা নিহিত রয়েছে। তাই এস এম সুলতান ছড়িয়ে পড়–ক স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, শিল্প সংস্কৃতির সকল ডালপালায় এমন প্রত্যাশাই আমাদের সকলের। সরকার যথাযথ পদক্ষেপের ব্রতী হয়ে এসএম সুলতানকে রাষ্ট্রিয়ভাবে সম্মানীত করুক তাও সংস্কৃতিমনা মানুষদের কাম্য।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।