রাব্বিআল্লাহ্--আল্লাহ্ই আমার একমাত্র রব্ব-সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও নিরংকুশ কর্তৃত্বের একমাত্র মালিক। এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার দাওয়াত
-ঈমানদারদের দায়িত্ব ও কর্তব্য
সকল প্রশংসা দয়াময়, অসীম দাতা ও দয়ালু সুমহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীনের জন্যই যিনি জগতসমূহের একমাত্র রব্ব। আল্লাহর রহমত ও বরকত নাযিল হোক তাঁর সর্বশেষ নাবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তাঁর পবিত্র বংশধর ও সম্মানিত সহচরগণের প্রতি। আমরা শোকর আদায় করছি মহান আল্লাহ তা’আলার দরবারে যিনি আমাদেরকে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত হিসেবে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন এবং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে যে দ্বীনকে তিনি পূর্ণতা দান করেছেন সে দ্বীন-ইসলামের অনুসারী হওয়ার তাওফিক দান করেছেন।
কালামে পাকে আল্লাহ্ ফরমান-
“আল্লাহর পথে জিহাদ (জান ও মাল দিয়ে চূড়ান্ত চেষ্টা) করো যেমন জিহাদ করলে তার হক আদায় হয়।
তিনি নিজের কাজের জন্য তোমাদেরকে বাছাই করে নিয়েছেন এবং দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কোনো কঠোরতা আরোপ করেননি। তোমাদের পিতা ইবরাহীমের মিল্লাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও। তিনিই (আল্লাহ) তোমাদের নাম রেখেছেন “মুসলিম” পূর্বেও এবং (এই কুরআন) এর মধ্যেও; যাতে রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষ্যদাতা হন এবং তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানব জাতির জন্য। সুতরাং তোমরা সালাত কায়েম করো, যাকাত দাও এবং আল্লাহ’কে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর। তিনিই তোমাদের অভিভাবক, কত উত্তম অভিভাবক তিনি, কত উত্তম সাহায্যকারী তিনি!” (সূরা হাজ্জ ২২:৭৮)
অর্থাৎ মুসলিম এক উচ্চ মর্যাদাশীল জাতির নাম, যাদেরকে স্বয়ং আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীন নামকরণ করেছেন এবং তাঁর নিজের কাজের জন্য বাছাই করে নিয়েছেন।
আল্লাহ্ তা’আলা অন্য সকল জাতির উপর মুসলিমদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সংবিধান আল কুরআন নাযিল করেছেন। আল্লাহ্ তা’আলা মুসলিমদেরকে আরও দান করেছেন ইসলাম নামক একমাত্র পরিপূর্ণ দ্বীন-জীবন ব্যবস্থা যাতে অন্য কোন দ্বীন হতে মুসলিমদের আদৌ কোন কিছু গ্রহণ করার প্রয়োজন না হয়। আল্লাহ্ তা’আলা মুসলিমদেরকে ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য ক্বিবলা হিসেবে নির্ধারণ করেছেন তাঁর প্রিয় ঘর কা’বা কে। আর আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর উম্মত কে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য আযানের ন্যায় একটি উত্তম যিকির নির্বাচন করেছেন, যার মাধ্যমে মুসলিমগণ দিনে কমপক্ষে পাঁচ বার আল্লাহর বড়ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব ও সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করে। সুতরাং যারা নিজেদেরকে ঈমানদার মুসলিম দাবী করেন তারা অবশ্যই আল্লাহর কাজ করবেন।
আর আল্লাহ তাঁর যে সকল কাজের জন্য ঈমানদারদেরকে মনোনীত করেছেন সে সম্পর্কে ফরমান-
“আর যেন তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের প্রতি আহবান করবে, ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম। ” (সূরা আলে ইমরান ৩:১০৪)
মহান আল্লাহ অন্যত্র আরও ফরমান-
“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হয়ে যাও, যেমন ঈসা ইবনে-মরিয়ম তার শিষ্যবর্গকে বলেছিল, আল্লাহর পথে কে আমার সাহায্যকারী হবে? হাওয়ারীগণ (শিষ্যবর্গ) বলেছিল: আমরা আল্লাহর পথে সাহায্যকারী। অতঃপর বনী-ইসরাঈলের একদল বিশ্বাস স্থাপন করল এবং একদল কাফের হয়ে গেল। যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছিল, আমি তাদেরকে তাদের শত্রুদের মোকাবেলায় শক্তি যোগালাম, ফলে তারা বিজয়ী হল।
” (সূরা আস সাফ্ফ ৬১:১৪)
“তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, মানবজাতির (কল্যাণের) জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে। তোমরা ন্যায় কাজে আদেশ এবং অন্যায় কাজে নিষেধ কর এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনো। ” (সূরা আলে ইমরান ৩:১১০)
“তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের সেই সব নিয়ম-কানুন নির্ধারিত করেছেন যার নির্দেশ তিনি নূহকে দিয়েছিলেন এবং (হে মুহাম্মাদ) আর যা আমি আপনার কাছে ওহীর মাধ্যমে পাঠিয়েছি এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা এবং ঈসাকে, এ বলে যে, তোমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠা কর এবং এ ব্যাপারে পরস্পর দলাদলি-বিচ্ছিন্নতা করো না। (হে মুহাম্মাদ) এই কথাটিই এসব মুশরিকের কাছে অত্যন্ত অপছন্দনীয় যার দিকে আপনি তাদেরকে আহবান জানাচ্ছেন। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা আপন করে নেন এবং তিনি তাদেরকেই নিজের কাছে আসার পথ দেখান যারা তাঁর প্রতি রুজু করে।
” (সূরা শুরা ৪২:১৩)
আয়াতে কারীমাসমূহে আমরা দেখতে পাচ্ছি, আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার দাওয়াত, আল্লাহর পথে সাহায্য, মানুষকে কল্যাণের পথে ডাকা, সৎ কাজের আদেশ দেয়া, অসৎ কাজের নিষেধ করা, নসিহত করা প্রভৃতি কাজই আল্লাহর নির্দেশিত কাজ এবং এই কাজ সমূহ সম্পাদন করার জন্যই আল্লাহ উম্মতে মুহাম্মদীকে নির্বাচিত করেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
“সেই ব্যক্তির কথা অপেক্ষা উত্তম কথা আর কার হতে পারে, যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং ঘোষণা করে- আমি একজন মুসলিম। ” (সূরা হা-মীম আস সাজদাহ ৪১:৩৩)
সুতরাং, এ কথাও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, দুনিয়াতে এক আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীনে ফিওে আসার দাওয়াত দেওয়াই হল একজন মুসলিমের জন্য সবচেয়ে উত্তম কাজ এবং তার জীবনের সর্বোত্তম মিশন।
আল্লাহ পথভ্রষ্ট মানব জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্যে যুগে যুগে নাবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন-
“তিনিই সেই সত্তা যিনি তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন সত্য পথ ও সত্য দ্বীন সহকারে যাতে তিনি একে সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী করতে পারেন, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।
” (সূরা আত-তাওবাহ ৯:৩৩, আস সাফ্ফ ৬১:৯)
অর্থাৎ আল্লাহ যুগে যুগে নাবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন তাঁর দ্বীনকে সকল বাতিল দ্বীনের বিপরীতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কিন্তু বাতিলপন্থীরা, শিরককারীরা তা পছন্দ করেনি। অনুরূপভাবে নাবী ও রাসূলগণের অনুপস্থিতিতে তাঁদের দাওয়াতের ধারাবাহিকতায় আজকে যখন আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন ইসলামকে একটি রাজনৈতিক তথা সমাজ ও রাস্ট্র পরিচালনার ব্যবস্থা হিসেবে উম্মাহর সম্মুখে উপস্থাপন করা হয় এবং একমাত্র আল্লাহর সার্বভৌমত্ত্ব প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয় তখনও একটি বিশেষ শ্রেণী-গোষ্ঠী দাওয়াতদাতাদের বিরোধীতা সহ তাদের উপর দমন-নিপীড়ন-নির্যাতন শুরু করে দেয়। এই বিশেষ শ্রেণী-গোষ্ঠীর লোক কারা এবং কেন, কিভাবে তারা এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ত্ব প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তা কুরআন স্পষ্টভাবে আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছে। যেমন মূসা (আলাইহিস সালাম)কে যখন আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন আল্লাহদ্রোহী শাসক ফিরাউনের নিকট এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ত্বের দাওয়াত দিতে পাঠিয়ে ছিলেন তা কুরআন বর্ণনা করছে এভাবে-
(আল্লাহ নির্দেশ দিলেন, হে মূসা! তুমি) “ফিরাউনের কাছে যাও, সে তাগুত (আল্লাহর সীমা লংঘনকারী) হয়ে গেছে। তাকে জিজ্ঞেস করো, তুমি কি পবিত্রতা অবলম্বন করতে ইচ্ছুক? এবং আমি কি তোমাকে তোমার রব্ব-এর দিকে পথ দেখাবো, যেন (এর ফলে) তুমি তাঁকে ভয় করতে থাকো ?” (সূরা নাযিয়াত ৭৯:১৭-১৯)
অপর এক আয়াতে মূসা (আলাইহিস সালাম) তার জাতির উদ্দেশ্যে বললেন-
“এরপর মূসা বললো- আমি কি আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমাদের জন্য অন্য কোন ইলাহ খুঁজবো? অথচ তিনি আল্লাহই, যিনি তোমাদেরকে সারা দুনিয়ার সমস্ত জাতি গোষ্ঠির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।
” (সূরা আরাফ ৭:১৪০)
সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহর ফলে, দাসত্ব, আইনের আনুগত্য ও উপাসনাও শুধুমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের জন্য নির্দিষ্ট, অন্য কারো জন্য নয়! প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌমত্ব আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো হতেই পারে না কারণ আল্লাহ ব্যতীত চিরন্তন ও চিরস্থায়ী সত্ত্বা আর কেউ নেই। আর তাই মূসা (আলাইহিস সালাম) ফিরাউন সহ জাতির সকল মানুষকে আল্লাহকেই একমাত্র রব্ব ও ইলাহ মেনে নেয়ার দাওয়াত দিয়েছিলেন। কারণ তাঁর জাতির শাসক ফিরাউন আল্লাহর পাশাপাশি নিজেকেও জাতির রব্ব ও ইলাহ দাবী করেছিল আর জাতির মানুষ সে দাবী মেনেও নিয়েছিলো। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ফিরাউনের কাহিনী আমাদের কাছে বর্ণনা করেন এভাবে-
“এবং দেশবাসীকে জমায়েত করে সে (ফিরাউন) ভাষণ দিলো, অতঃপর সে বললো, আমিই তোমাদের সবচেয়ে বড় রব্ব। ” (সূরা নাযিয়াত ৭৯: ২৩-২৪)
কুরআনের অপর এক স্থানে বর্ণিত হয়েছে-
“ফিরাউন বলল, হে পরিষদবর্গ! আমি ছাড়া তোমাদের অন্য কোন ইলাহ আছে বলে আমার জানা নাই।
” (সূরা কাসাস ২৮:৩৮)
সূরা নাযিয়াত-এর আয়াতটিতে ফিরাউন নিজেকে সবচেয়ে রব্ব দাবী করলেও সূরা কাসাস-এর আয়াতে নিজেকে ইলাহ হিসেবে দাবী করেছে। আয়াতে কারীমাসমূহের বিশ্লেষণে যাওয়ার পূর্বে রব্ব ও ইলাহ শব্দদ্বয়ের অর্থসমূহ উল্লেখ করে নিতে চাই। রব্ব শব্দের যে সকল অর্থ পাওয়া যায় তা হলোÑ সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রক্ষাকর্তা, শৃংখলা বিধানকারী, পূর্ণতাদানকারী, হাশরের ময়দানে একত্রে জমাকারী, সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক, সার্বভৌম আইনদাতা-বিধানদাতা, নিরংকুশ কর্তা। (দেখুন: তাফসীরে ইবনে কাছীর ১ম খন্ড, সূরা ফাতিহা বাংলা অনুবাদ, আল্লামা আশরাফ আলী থানবী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) কৃত মুনাজাতে মকবুল, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত আল কুরআনুল করীম সূরা আল ফাতিহার টীকা, লিসানুল আরব ৩য় খন্ড, ৫৪৫ পৃষ্ঠা, মিছবাহুল লুগাত ২৭২ পৃষ্ঠা, সূরা মু’মিন ৪০:৬২-৬৮, সূরা আরাফ ৭:৪, সূরা যুমার ৩৯:৫-৬, সূরা ফাতির ৩৬:১১-১৪, সূরা শুয়ারা ২৬:৭৭-৮২ ইত্যাদি)
আর ইলাহ শব্দের যে সকল অর্থ পাওয়া যায় তা হলোÑ দাসত্ব পাওয়ার অধিকারী সত্ত্বা, নিজ আইনের আনুগত্য পাওয়ার অধিকারী সত্ত্বা ও উপাসনা পাওয়ার অধিকারী সত্ত্বা।
সূরা নাযিয়াত-এর আয়াতটিতে ফিরাউন নিজেকে সবচেয়ে বড় রব্ব দাবী করেছে এর মানে এই নয় যে, সে নিজেকে সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রক্ষাকর্তা, শৃঙ্খলা বিধানকারী, পূর্ণতাদানকারী, হাশরের ময়দানে একত্রে জমাকারী হিসেবে দাবী করেছে অথবা সে আল্লাহর অস্তিত্ত্বে বিশ্বাস করতো না অথবা সে লোকদেরকে আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে নিষেধ করেছে।
তার দাবী যদি এমন হতো তবে তার অনুগতরাই সর্বপ্রথম তাকে মস্তিস্ক বিকৃত বলে বিদ্রোহ করতো। সরাসরি আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীনের কালাম কুরআনই আমাদেরকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছে যে, ফিরাউনের দাবী ছিল সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সার্বভৌমত্বের দাবী। সারা পৃথিবীতে নয় তার দাবী ছিল কেবল মিশরের শাসন ক্ষমতার উপর নিরংকুশ আধিপত্যের দাবী। তার দাবী ছিলো মিশরের সাধারণ জনগণের জন্য তার ইচ্ছানুযায়ী যেমন খুশী তেমন আইন-কানুন ও মূল্যবোধ নির্ধারনের ক্ষমতার দাবী। দেখুন কুরআন কী বলেছে-
“একদিন ফিরাউন তার জাতির উদ্দেশ্যে (এক) ভাষণ দিলো।
সে বললো, হে জনগণ! মিশরের সার্বভৌমত্ব (বাদশাহী) কি আমার জন্য নির্দিষ্ট নয়? আর এই নদ-নদীগুলো কি আমার (রাজত্বের) অধীনেই প্রবাহিত হচ্ছে না? তোমরা কি তা দেখতে পাও না?” (সূরা যুখরুফ ৪৩:৫১)
অতএব ফিরাউনের সবচেয়ে বড় রব্ব দাবীর অর্থ হচ্ছে, সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রক্ষাকর্তা, রিযিকদাতা, শৃঙ্খলা বিধানকারী, পূর্ণতাদানকারী, হাশরের ময়দানে একত্রে জমাকারী হিসেবে নয়, শুধুমাত্র তার মিশর রাজ্যের সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও কর্তৃত্বের মালিক হিসেবে সে রব্ব। আর সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও কর্তৃত্বের মালিক হিসেবে রব্ব দাবী করার কারণে কোনটি হালাল, কোনটি হারাম এটি নির্ধারণ করার অধিকারও একমাত্র তার।
সূরা কাসাস-এর আয়াতে ফিরাউন নিজেকে ইলাহ হিসেবে দাবী করেছে। এ দাবীর মাধ্যমে সে কি তাকে পূঁজা-উপাসনা করার জন্য লোকদেরকে আহ্বান করেছে? না কক্ষনো নয়! বরং সে নিজেও জাহান্নামের ভয়াবহ আযাব থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাত লাভের আশায় বিভিন্ন দেব-দেবীর পূঁজা-পার্বনে অংশ নিতো। কুরআন থেকেই এর প্রমাণ দেখে নিনÑ
“ফিরাউনের জাতির নেতারা (ফিরাউনকে) বললো, আপনি কি মূসা ও তার লোকজনকে রাজ্যে অশান্তি সৃষ্টির জন্য এমনভাবে খোলা ছেড়ে দিবেন? আর তারা আপনাকে ও আপনার ইলাহ্দের এভাবে বর্জন করে চলবে?” (সূরা আরাফ ৭: ১২৭)।
আয়াতটি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করছে যে, ফিরাউনেরও অনেক ধরনের ইলাহ্, মা’বুদ বা উপাস্য ছিলো। তাহলে ইলাহ দাবী বলতে আসলে কী বুঝায় কিংবা ইলাহ বলে সে কী দাবী করেছিলো ? মূলতঃ ফিরাউন যেহেতু ইতিপূর্বে রব্ব দাবীর মাধ্যমে নিজেকে সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও নিরংকুশ কর্তৃত্বের মালিক দাবী করেছিল সেহেতু সে দাবীর বাস্তবায়নে তারই দাসত্ব ও আইনের আনুগত্য করার মাধ্যমে তাকে ইলাহ (দাসত্ব, আইনের আনুগত্য ও উপাসনা পাওয়ার অধিকারী সত্ত্বা) মানার আহ্বানও সে জাতিকে জানিয়েছিলো। অর্থাৎ সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও নিরংকুশ কর্তৃত্ব যার মেনে নেয়া হয় দাসত্ব, আইনের আনুগত্য এবং উপাসনাও তারই হয়। তাহলে বুঝা গেলো যিনি রব্ব (সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও নিরংকুশ কর্তৃত্বের মালিক) তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ইলাহ (দাসত্ব, আইনের আনুগত্য ও উপাসনা পাওয়ার অধিকারী সত্ত্বা)। সুতরাং যিনি রব্ব নন কিংবা রব্ব হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না তিনি ইলাহও হতে পারবেন না।
কারণ যিনি হুকুম-বিধান দেয়ার সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নন তার হুকুম-বিধান হতেই পারে না, আর আইন-বিধানই যেক্ষেত্রে অনুপস্থিত সেখানে তা মানা কিংবা না মানার প্রশ্নতো অবান্তর। সরল ভাষায় যিনি আইন-বিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে, হুকুম প্রদানের ক্ষেত্রে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী-মালিক তিনিই রব্ব। আর যার সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়া হয়, আইন-বিধানের আনুগত্য ও দাসত্ব করা হয় তিনিই ইলাহ। ‘যিনি রব্ব তিনিই ইলাহ, যিনি রব্ব ইবাদাত-উপাসনাও তারই’ এ প্রসঙ্গে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন ফরমান-
“তিনিই আল্লাহ, তোমাদের রব্ব, সার্বভৌমত্ব তাঁরই, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। ” (সূরা যুমার ৩৯:৬)
“তিনি আল্লাহ, তোমাদের রব্ব, সকল কিছুর স্রষ্টা, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।
সুতরাং তোমরা কোন দিকে বিভ্রান্ত হচ্ছো ?” (সূরা মু’মিন ৪০:৬২)
“প্রকৃত সত্য এই যে, আল্লাহই আমার ও তোমাদের রব্ব। তারই ইবাদাত করো। এটাই সরল-সোজা পথ। ” (সূরা যুখরুফ ৪৩:৬৪)
“নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার রব্ব এবং তোমাদেরও রব্ব। কাজেই তোমরা তাঁর ইবাদাত কর, এটাই হলো সরল পথ।
” (সূরা আলে ইমরান ৩:৫১)
আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালার ইরশাদকৃত উল্লিখিত আয়াত সমূহের মাধ্যমে এ কথা প্রমাণিত হয়ে গেল যে, যিনি রব্ব তিনিই ইলাহ; সকল ইবাদাত তাঁরই জন্য নির্দিষ্ট। অর্থাৎ যিনি রব্ব নন, তিনি ইলাহও নন; কোন ধরনের ইবাদাতও তার প্রাপ্য নয়।
শুধু ইতিহাস নয়, এ কথা কুরআনের বহু স্থানে বলা হয়েছে যে, নাবী ও রাসূলগণের দাওয়াতকে সবার আগে রুখে দাঁড়িয়েছিলো সমাজের সচ্ছল শ্রেণী, অত্যধিক সহায় স¤পদের মালিক, যারা ক্ষমতা ও কর্তৃত্ত্বের অধিকারী ছিল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ ফরমান-
“কখনো এমন ঘটেনি যে, কোনো জনপদে আমরা একজন সতর্ককারী পাঠিয়েছি আর সেই জনপদের সমৃদ্ধশালী লোকেরা একথা বলেনি যে, তোমরা যে পয়গাম নিয়ে এসেছো আমরা তা মানি না। ” (সূরা সাবা ৩৪:৩৪)
(বিস্তারিত জানতে সূরা আরাফ ৭:৬০,৬৬,৭৫,৮৮,৯০, সূরা বনি-ইসরাইল ১৭:১৬, সূরা আল-মু’মিনুন ২৩:২৪,৩৩-৩৮,৪৬,৪৭, সূরা যুখরুফ ৪৩:২৩, সূরা হুদ ১১:২৫-৩৪ ইত্যাদি)
আল্লাহর নাবী হযরত নূহ (আলাইহিস সালাম) এর দাওয়াত সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে-
“আমরা নূহকে তার সময়কার লোকদের প্রতি প্রেরণ করেছি।
সে বললো- হে আমার স¤প্রদায়ের লোকেরা! তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই, আমি তোমাদের জন্য একটি ভয়াবহ দিনের আজাবের আশংকা করছি। জবাবে তার স¤প্রদায়ের সরদাররা বললো- আমরা তো দেখছি যে, তুমি সু¯পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত রয়েছ। ” (সুরা আরাফ ৭:৫৯-৬০)
নূহ (আলাইহিস সালাম) তার জাতিকে আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ হিসেবে মেনে নেয়ার দাওয়াত দিলে তার জাতির প্রধানেরা তার বিরোধীতা করে এবং তাকে পথভ্রষ্ট বলে দাবী করে। অথচ কুরআনুল কারীমের এ স্থানে ও অন্যান্য স্থানে হযরত নূহ ও তাঁর স¤প্রদায়ের যে অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে তা থেকে একথা সু®পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এ স¤প্রদায়টি আল্লাহর অস্তিত্ব (ঊীরংঃবহপব ড়ভ অখখঅঐ) অস্বীকার করতো না, তাঁর স¤পর্কে নিরেট অজ্ঞও ছিল না এবং তাঁর ইবাদাত করতেও তারা অস্বীকার করতো না। তাহলে প্রশ্ন দেখা দেয়, ইলাহ বলতে তারা কী বুঝেছিলো এবং কেন তারা এর বিরোধিতা করেছিল? আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ হিসেবে মেনে নিলে তাদের সমস্যাটা কোথায় ছিলো ? নূহ (আলাইহিস সালাম)-এর স¤প্রদায় কর্তৃক তাঁর দাওয়াতের বিরোধীতার মূল কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে যা পাওয়া যায় তা হলোÑ তার সম্প্রদায় জানতো ইলাহ হচ্ছে সেই স্বত্ত্বার নাম যার দাসত্ব, আইনের আনুগত্য ও উপাসনা করা হয়।
সুতরাং নূহ (আলাইহিস সালাম)-এর কথামতো আল্লাহকেই যদি একমাত্র ইলাহ হিসেবে মেনে নিতে হয় তবে তো দাসত্ব, আইনের আনুগত্য আর উপাসনাও একমাত্র আল্লাহর মেনে নিতে হবে, ফলশ্র“তিতে স¤প্রদায়ের ক্ষমতাবান সরদার-শাসকগোষ্ঠীর নিজস্ব মনগড়া হুকুম, আইন-বিধান বাস্তবায়নের কোন সুযোগই থাকবে না। তাহলে বুঝা যাচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে নূহ (আলাইহিস সালাম)-এর স¤প্রদায় যে গোমরাহীতে লিপ্ত ছিল তা হলো শিরক। অর্থাৎ তারা আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্ব সহ তাঁর সত্ত্বা ও গুণাবলীতেও শরীক করতো এবং উপাসনা লাভের অধিকারে গায়রুল্লাহকেও হিস্যাদার মনে করতো। আর এ মৌলিক গোমরাহী থেকেই জাতির মানুষেরা নিজস্ব মনগড়া মা’বুদকে আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের অংশীদার গণ্য করতো এবং তাদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য জাতির মধ্যে একটি বিশেষ শ্রেণীর জন্ম হয়। এ শ্রেণীটি সমস্ত ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্তৃত্বের একচ্ছত্র মালিক হয়ে বসে।
জাতির মাঝে শ্রেণী বৈশম্য সৃষ্টি করে তাদেরকে উচ্চ শ্রেণী ও নিু শ্রণীতে বিভক্ত করে। সমাজ জীবন জুলুম ও বিপর্যয়ে ভরপুর করে তোলে। নৈতিক উচ্ছৃংখলতা, চারিত্রিক নৈরাজ্য ও পাপাচারের মাধ্যমে মানবতার মূলে কুঠারাঘাত করে। এ অবস্থার পরিবর্তন করার জন্যই হযরত নূহ আলাইহিস সালাম জাতির মানুষকে আল্লাহকেই একমাত্র ইলাহÑদাসত্ব, আইনের আনুগত্য ও উপাসনা পাওয়ার সত্ত্বা হিসেবে গ্রহণ করে নেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্ব সহ তাঁর সত্ত্বা, গুনাবলী ও উপাসনায় শিরক মুক্ত হওয়ার জন্য অত্যন্ত সবর, সহিষ্ণুতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে দীর্ঘকাল দাওয়াতী প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালান।
আল্লাহর আরেক নাবী হযরত শোয়াইব (আলাইহিস সালাম) এর দাওয়াত সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে-
“আর মাদাইয়ানবাসীর প্রতি আমরা তাদের ভাই শোয়াইবকে পাঠিয়েছি।
সে বলল: হে আমার জাতির লোকেরা! তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। তোমাদের নিকট তোমাদের রব্বের সুস্পষ্ট দলিল এসে পৌঁছেছে। কাজেই ওজন ও পরিমাপ পূর্ণ মাত্রায় করো, লোকদেরকে তাদের পণ্যদ্রব্যে ক্ষতিগ্রস্ত করে দিওনা এবং জমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করো না, যখন এর সংশোধন ও সংস্কার সম্পূর্ণ হয়েছে। এরই মধ্যে রয়েছে তোমাদের কল্যান, যদি তোমরা বাস্তবিকই মু’মিন হয়ে থাকো। ” (সূরা আরাফ ৭:৮৫)
আয়াতে কারীমার শেষাংশ দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায় যে মাদাইয়ানবাসী নিজেদেরকে ঈমানদার বলে দাবি করতো।
তারা আসলে ছিল গোমরাহ ও বিকৃত বিশ্বাসের মুসলিম। বিশ্বাসগত ও চারিত্রিক বিপর্যয়ে লিপ্ত থাকলেও তারা কেবল ঈমানের দাবীই করতো না বরং এ জন্য তাদের গর্বও ছিল। তাই হযরত শোআইব (আলাইহিস সালাম) বলেন, যদি তোমরা বাস্তবিকই মুমিন হও, তাহলে তোমাদের এ বিশ্বাসও থাকা উচিত যে, সততা ও বিশ্বস্ততার মধ্যেই কল্যাণ নিহিত এবং যেসব দুনিয়া পূজারী লোক আল্লাহ ও আখিরাতকে স্বীকার করে না তোমাদের ভাল-মন্দের মানদণ্ড তাদের থেকে আলাদা হওয়া উচিত। অর্থাৎ তোমাদেরকে এক আল্লাহ’কেই ইলাহ-দাসত্ব, আইনের আনুগত্য ও উপাসনা পাওয়ার সত্ত্বা হিসেবে হিসাবে গ্রহণ করতে হবে, তাঁর উলুহিয়্যাতে কারও অংশ স্থাপন করা যাবে না। এবং আল্লাহকে ইলাহ-দাসত্ব, আইনের আনুগত্য ও উপাসনা পাওয়ার সত্ত্বা হিসেবে মেনে নেয়ার পর তোমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এ বিশ্বাসের আলোকে তার প্রদত্ত শরীয়াহ মোতাবেক হতে হবে, তোমাদের নিজস্ব মনগড়া কোন ব্যবস্থা দ্বারা নয়।
অনুরুপভাবে হযরত হূদ (আলাইহিস সালাম) ও হযরত সালিহ (আলাইহিস সালাম)-কেও বিশ্বজগতের রব্ব-সার্বভৌম আইনদাতা-বিধানদাতা ও নিরংকুশ কর্তৃা আল্লাহ’কে একমাত্র ইলাহ্-দাসত্ব, আইনের আনুগত্য ও উপাসনা পাওয়ার সত্ত্বা হিসেবে মেনে নেওয়ার দাওয়াত দেওয়ার জন্য আল্লাহ্ তাদেও নিজ কওমের মধ্যে পাঠিয়েছিলেন। আল্লাহ ফরমান-
“আর আ’দ (সম্প্রদায়)-এর নিকট আমি তাদের ভাই হূদ’কে পাঠালাম। সে বললো: হে আমার স্বজাতীয় ভাইয়েরা! আল্লাহর ইবাদাত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ-দাসত্ব, আইনের আনুগত্য ও উপাসনা পাওয়ার সত্ত্বা নাই। তোমরা নিছক মিথ্যা উদ্ভাবনকারী। ” (সূরা হুদ ১১:৫০)
“আর সামুদ জাতির প্রতি তাদের ভাই সালিহ’কে প্রেরণ করলাম; তিনি বললেন: হে আমার জাতি।
আল্লাহর ইবাদাত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহÑদাসত্ব, আইনের আনুগত্য ও উপাসনা পাওয়ার সত্ত্বা নাই। তিনিই তোমাদেরকে যমীন হতে সৃষ্টি করেছেন, তন্মধ্যে তোমাদেরকে বসতি দান করেছেন। অতএব; তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর অতঃপর তাঁরই দিকে ফিরে এসো। নিশ্চয়ই আমার রব্ব একান্ত নিকটবর্তী, ডাকে সাড়া দানকারী। ” (সূরা হুদ ১১:৬১)
এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার দাওয়াতের ধারাবাহিকতায় মানব জাতির মাঝে সর্বশেষ নাবী ও রাসূল হিসেবে আল্লাহ প্রেরণ করলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে।
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের মূর্ত প্রতীক। ক্ষমা, উদারতা, বদান্যতাসহ যাবতীয় মহৎ গুণের অধিকারী ছিলেন তিনি। রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ পাকের নির্দেশে যে সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার দাওয়াত নিয়ে এসেছেন, তা মানুষের মধ্যে পৌঁছানোর জন্য তিনি যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, দুনিয়াতে এ পরিশ্রমের চেয়ে অধিক মূল্যবান পরিশ্রম আর কিছুই হতে পারে না। এ রাহে তিনি যে ত্যাগ ও কুরবানি পেশ করেছেন এর চেয়ে মূল্যবান ত্যাগ ও কুরবানি আর কোন কিছুই হতে পারে না। আল্লাহ তা’আলা এ দাওয়াতী মিশনে কৃত পরিশ্রম, ত্যাগ ও কুরবানির যে মূল্য ও পুরস্কার নির্ধারণ করেছেন, আর কোন কিছুতেই তিনি এত বেশি মূল্য ও পুরস্কার নির্ধারণ করেননি।
মহান আল্লাহ্ পাক তাঁর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’কে সু®পষ্ট সত্য পথ নির্দেশনাসহ প্রেরণ করেছিলেন এমন একটি যুগ সন্ধিক্ষণে, যখন বিশ্ববাসী তাদের বিশ্বাস ও আচরণসহ জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে একমাত্র প্রকৃত রব্ব ‘আল্লাহ্’কে ভুলে জাহিলিয়্যাতের গভীর অজ্ঞতা ও পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে পৃথিবীবাসীগণ এর চেয়ে খারাপ ও অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় কখনোই অতিক্রম করেনি। তা সত্ত্বেও তিনি তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, অক্লান্ত পরিশ্রম ও একমাত্র আল্লাহমুখী আপোষহীন সংগ্রামের মাধ্যমে জাহিলিয়্যাতের এ অন্ধকারকে এক সোনালী আলোয় উদ্ভাসিত করেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সমাজে আল্লাহর নাবী ও রাসূল হিসেবে প্রেরীত হয়েছিলেন সে সমাজের লোকজন অতি প্রাকৃতিক ক্ষেত্রে আল্লাহ্কে রব্ব মানতো এবং এটা সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাসও করতো যে, সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রিযিকদাতা, আসমান-জমিনের অধিপতি, জন্ম-মৃত্যুর মালিক, দৃষ্টিশক্তি-শ্রবণশক্তির মালিক হিসেবে আল্লাহই একমাত্র রব্ব। যেমন আল কুরআনে আল্লাহ বলেছেন-
“জিজ্ঞাসা কর, এই পৃথিবী এবং এর মধ্যে যারা আছে তারা কার? তারা নিশ্চয়ই বলবে আল্লাহ্র।
বলো, তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না? জিজ্ঞাসা কর, কে সপ্ত আকাশ এবং মহা আরশের অধিপতি? তারা বলবে আল্লাহ্। বলো, তবুও কি তোমরা ভয় করবে না? জিজ্ঞাসা কর, যদি তোমরা জেনে থাকো সকল কিছুর কর্তৃত্ব কার হাতে? আর কে তিনি যিনি আশ্রয় দান করেন এবং যার উপরে আশ্রয়দাতা নেই? তারা নিশ্চয়ই বলবে এ বিষয়টিতো আল্লাহর জন্যই নির্ধারিত। বলো, তবুও তোমরা বিভ্রান্ত হচ্ছো কোথা থেকে?” (সূরা মু’মিনুন ২৩:৮৪-৮৯)
‘‘তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, কে তোমাদের আকাশ ও পৃথিবী থেকে রিযিক দেয়? কে তাদের দৃষ্টি শক্তি এবং শ্রবণ শক্তির মালিক? কে জীবিতকে মৃত আর মৃতকে জীবিত করেন? কে চালাচ্ছে এই বিশ্ব ব্যবস্থাপনা? তারা নিশ্চয়ই বলবে, আল্লাহ্। অতঃপর বলো, তবুও কি তোমরা (সত্যের বিরোধী পথে চলার ব্যাপারে) সতর্ক হচ্ছো না? সেই আল্লাহ্ই তো তোমাদের প্রকৃত রব্ব। কাজেই সত্যের পরে গোমরাহী ও বিভ্রান্তি ছাড়া আর কী বাকি আছে? সুতরাং তোমরা কোনদিকে চালিত হচ্ছো? (সূরা ইউনূছ: ১০:৩১-৩২)
অর্থাৎ কুরআনে আল্লাহ পাক বলছেন, মক্কার কাফির-মুশরিকরা সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রিযিকদাতা, আসমান-জমিনের অধিপতি, জন্ম-মৃত্যুর মালিক, দৃষ্টিশক্তি-শ্রবণশক্তির মালিক হিসেবে আল্লাহই যে একমাত্র রব্ব একথা মানতো।
অথচ এই জাতির মাঝেই সমগ্র মাখলুকের জন্য আল্লাহ তাঁর রাসূল হিসেবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রেরণ করলেন এবং তাঁকে নির্দেশ দিলেন- “হে চাদর গায়ে শয়নকারী! ওঠো! অতঃপর (জাতির মানুষকে) সাবধান-সতর্ক করো এবং তোমার রব্বের শ্রেষ্ঠত্ব (সার্বভৌমত্ব) ঘোষণা কর। ” (সূরা আল মুদ্দাস্সির ৭৪:১-৩)।
অর্থাৎ হে আমার প্রিয় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তুমি চাদর জড়িয়ে শুয়ে আছো কেন! তোমার উপরে তো একটি মহত কাজের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। এ দায়িত্ব পালন করার জন্য তোমাকে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে উঠে দাঁড়াতে হবে। অজ্ঞ ও মূর্খ লোকেরা এ পৃথিবীতে যাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রতাপ মেনে চলেছে তাদের সবাইকে অস্বীকার করবে এবং গোটা পৃথিবীর সামনে উচ্চ কণ্ঠ একথা ঘোষণা করবে যে, এ বিশ্ব জাহানে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কোন শ্রেষ্ঠত্ব ও সার্বভৌমত্ব নেই।
সুতরাং তুমি আল্লাহর বড়ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব ও সার্বভৌমত্ব ঘোষণার মাধ্যমেই কাজ শুরু করো। হযরত নূহ আলাইহিস সালামকে নবুওয়াতের পদমর্যাদায় অভিষিক্ত করার সময় আল্লাহ্র পক্ষ থেকে যে ধরনের আদেশ দেয়া হয়েছিল এটাও মূলতঃ সেই ধরনেরই আদেশ। হযরত নূহ আলাইহিস সালামকে আল্লাহ্ বলেছিলেন:"তোমার নিজের কওমের লোকদের ওপর এক ভীষণ কষ্টদায়ক আযাব আসার পূর্বেই তাদের সাবধান করে দাও। " (সূরা নূহ ৭১:১)
এখানে আরো একটি সূক্ষ্ম বিষয় আছে যা ভালভাবে বুঝে নেয়া দরকার। এ আয়াতসমূহের মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রিসালাতের বিরাট গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য তৎপর হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
একথা তো স্পষ্ট যে, যে সমাজ ও পরিবেশে তাঁকে এ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে কাজ করার জন্য তৎপর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হচ্ছিল তা ছিল র্শিক ও কুফরের কেন্দ্রভূমি বা লীলাক্ষেত্র। সাধারণ আরবদের ন্যায় সেখানকার অধিবাসীরা যে কেবল মুশরিক ছিল, তা নয়; বরং মক্কা সে সময় গোটা আরবের মুশরিকদের সবচেয়ে বড় তীর্থক্ষেত্রের মর্যাদা লাভ করেছিল। আর কুরাইশরা ছিল তার ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী, সেবায়ত ও পুরোহিত। এমন একটি জায়গায় কোন ব্যক্তির পক্ষে শিরকের বিরুদ্ধে এককভাবে তাওহীদের পতাকা উত্তোলন করা জীবনের ঝুঁকি গ্রহণ করার শামিল। তাই “ওঠো এবং সাবধান-সতর্ক করো” বলার পরপরই “তোমার রব্বের শ্রেষ্ঠত্ব-সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করো” বলার অর্থই হলো যেসব বড় বড় তাগুত তোমার এ দাওয়াতের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে হয়, তাদের মোটেই পরোয়া করো না।
বরং ¯পষ্ট ভাষায় বলে দাও, যারা আমার এ দাওয়াত ও আন্দোলনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে আমার রব্ব তাদের সবার চেয়ে অনেক বড়। মূলতঃ আল্লাহর বড়ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব ও সার্বভৌমত্বের নকশা যে ব্যক্তির হৃদয়-মনে খোদিত সে আল্লাহর জন্য একাই গোটা দুনিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে সামন্যতম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও সংকীর্ণতা অনুভব করবে না।
আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ পাওয়ার পর আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে দাওয়াত দিলেন- “...তোমরা তোমাদের রব্বের প্রতি ঈমান আনো। ” (সূরা আলে ইমরান : ১৯৩ এর অংশ)
অর্থাৎ হে লোক সকল! যে আল্লাহকে তোমরা সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, আসমান-জমিনের অধিপতি, জন্ম-মৃত্যুর মালিক, দৃষ্টিশক্তি-শ্রবণশক্তির মালিক হিসেবে রব্ব মানছো সেই আল্লাহকেই একমাত্র রব্ব-সার্বভৌম আইনদাতা-বিধানদাতা ও নিরংকুশ কর্তা হিসেবে মেনে ঈমান আনো। কারণ একদিকে আল্লাহর অস্তিত্ত্বে বিশ্বাস করা, সৃষ্টিকর্তা, জীবন-মৃত্যুর মালিক, রিযিকদাতা, প্রতিপালক হিসেবে আল্লাহকে রব্ব বিশ্বাস করা অপর দিকে আল্লাহর পরিবর্তে কিংবা আল্লাহর পাশাপাশি নিজকে সার্বভৌম আইনদাতা-বিধানদাতা ও নিরংকুশ কর্তা হিসেবে দাবী করা কিংবা অন্য দাবীদারকে সমর্থন করা হচ্ছে মহান আল্লাহ পাকের রুবুবিয়্যাতে সুস্পষ্ট শিরক।
অর্থাৎ বিশ্ব-জাহানের সমস্ত জিনিসের রব্ব-সার্বভৌম আইনদাতা-বিধানদাতা ও নিরংকুশ কর্তা হচ্ছেন আল্লাহ, কাজেই অন্য কেউ কেমন করে সার্বভৌমত্বের মালিক হতে পারে, আইনদাতা-বিধানদাতা হতে পারে? হলে সেও তো রব্ব হয়ে গেল! সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, আসমান-জমিনের অধিপতি, জন্ম-মৃত্যুর মালিক, দৃষ্টিশক্তি-শ্রবণশক্তির মালিক প্রভৃতি অতি প্রাকৃতিক ক্ষেত্রে আল্লাহকে রব্ব মানলে আর স্বাধীন জীবনে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও কর্তৃত্বের মালিক হিসেবে মানুষকে রব্ব গ্রহণ করলে আল্লাহর রুবুবিয়্যাতে তাওহীদ তো থাকছেই না উপরন্তু রুবুবিয়্যাতে শিরক প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এ সাধারণ কথাটা কি তোমাদের বুঝে আসছে না? সমস্ত-বিশ্ব-জাহান আল্লাহর সার্বভৌম ব্যবস্থার অধীনে চলছে এবং বিশ্ব-জাহানের একটি অংশ হিসেবে আমাদের নিজের অস্তিত্বও সে ব্যবস্থার অনুসারী। কিন্তু নিজের চেতনাসঞ্জাত ও নিজস্ব ক্ষমতা ইখতিয়ারের আওতাধীন জীবনের জন্য আমরা ভিন্ন রব্বের সন্ধান করবো, এটা কেমন করে যুক্তিসংগত হতে পারে! সুতরাং সমগ্র সৃষ্টি জগতের প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক অবস্থার বিরুদ্ধাচরণ করে তোমরা কতদিন আর বিভ্রান্ত হয়ে ধ্বংসের পথে চলতে থাকবে?
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওহী প্রাপ্তির প্রাক্কালে সমাজের যে সকল লোকজন কখনোই তাঁর কোন কাজের বিরোধিতা করেনি, এক আল্লাহর সার্বভৌমত্বের দাওয়াত পাবার পর তারাই সর্বপ্রথম তাঁর বিরুদ্ধাচরনে লেগে গেল। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দাওয়াত ছিল, তাদের পুরনো অভ্যাস, অন্ধানুকরণ ও জাহিলিয়্যাতের রীতিনীতির স¤পূর্ণ পরিপন্থী। ফলে তারা এ দাওয়াতকে অংকুরে গুটিয়ে দেয়ার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি স¤পন্ন করে।
কিন্তু রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বিরোধিতা, গর্জন ও হুংকারে কোন প্রকার কর্ণপাত করেননি, বিচলিত কিংবা দুর্বল হননি। তিনি তার উপর অর্পিত রিসালাতের গুরু দায়িত্ব অত্যন্ত সাহসিকতা ও প্রত্যয়ের সাথে চালিয়ে যেতে থাকেন। কারণ, তিনি-তো আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত একজন রাসূল; যদি সারা পৃথিবীও তার বিরোধিতা করে এবং তাকে প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়, তাহলেও আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তা পালন করাই হল তাঁর একমাত্র কাজ। সারা দুনিয়ার সমগ্র মানুষও যদি একত্র হয়ে তার বিরোধিতা করে, তারপরও কোন ক্রম।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।