আমি তো পরবাসী চিরকাল স্বদেশে-বিদেশে
ফকির ইলিয়াস
======================================
কুয়েত এয়ারওয়েজের বিলাসবহুল এয়ারক্র্যাফটে বসে কবি শহীদ কাদরীর কথা বার বার মনে পড়লো। আমরা নিউইয়র্কের জে.এফ কেনেডি বিমানবন্দর ছেড়ে এসেছি। আপাততঃ গন্তব্য কুয়েত ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। কুয়েতে সাড়ে চার ঘন্টা যাত্রা বিরতির পর ঢাকা পৌঁছবো। শহীদ কাদরী তার কবিতায় বলেছিলেন ‘আমি তো পরবাসী চিরকাল স্বদেশে-বিদেশে’।
তাঁর কবিতার ঘ্রাণ আমাকে মগ্ন করে রাখে। পাশের আসনে বসা প্রিয়তমা স্ত্রী আর কন্যাদ্বয়ের কোলাহল আমাকে স্পর্শ করতে পারে না। দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশে আসছি। সে এক অন্য রকম অনুভূতি। প্রিয় জন্মভূমি।
প্রিয় মা। প্রিয় স্বজনেরা। গভীর আকাশে এয়ারক্র্যাফটটি ভেসে যাওয়ার পর আমরা সীট বেল্ট খুলে বসেছি। নিউইয়র্ক-কুয়েত ফ্লাইটে যাত্রীদের সিংহভাগ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়। এয়ার ইন্ডিয়া জেএফকে বিমানবন্দর থেকে আগে ফ্লাইট করতো।
এখন করে না। বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে সেই বাজার দখল করে নিয়েছে কুয়েত এয়ারওয়েজ কিংবা ইত্তেহাদ এয়ার লাইন্স। ভারতীয় যাত্রীদের আধিক্য মনে করিয়ে দিয়েছে যদি বাংলাদেশ বিমান নিউইয়র্ক পর্যন্ত তাদের রুট পুনঃস্থাপিত করতে পারতো তবে এই ভারতীয় যাত্রীরা অনেকেই বিমানে চড়ার আগ্রহ দেখাতেন। না, তা এখন পর্যন্ত হয়নি।
বার বার কথা দিয়েও বর্তমান সরকার কথা রাখতে পারেন নি। জানিনা, তাদের মেয়াদে আর তা সম্ভব হবে কী না। ফ্লাইটে আমার ডান দিকে যিনি বসেছিলেন তিনি ভারতের কেরালা অঙ্গরাজ্যের অধিবাসী একজন আই.টি প্রফেশনাল। তার সাথে কথা জমে উঠলো। জানালেন, পেশাগত কাজেই নিজ জেলা ট্রিচুর ডিস্ট্রিকটে যাচ্ছেন।
তারা ক’জন মিলে সেখানে একটি আই.টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলেছেন। জানালেন গ্রাম এখন আর গ্রাম নেই। সেই অজ পাড়াগাঁয়ের সড়কের পাশেই তাদের বিশাল প্রতিষ্ঠান। কয়েকজন যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসী প্রফেশনাল মিলেই গড়ে তুলেছেন। এখন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে তারা কাজ করতে প্রস্ত্ততি নিচ্ছেন।
অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের সেসব বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর হেল্প ডেস্ক ভারত থেকেই পরিচালিত হবে। বললাম চমৎকার উদ্যোগ। যেহেতু শ্রমমূল্য ভারতে কম, তাই যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রতিষ্ঠানই তাদের কাজগুলো সেখানে করিয়ে নিতে আগ্রহী হবে, তা এখন সকলেরই জানা বিষয়। আর এভাবেই ভারত ক্রমশঃ হয়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম আই.টি মিত্র। যে প্রশ্নটি বার বার আমার মনে জাগে, বাংলাদেশ কী বিষয়টি নিয়ে ভাবছে? আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি বাংলাদেশ এ বিষয়ে উদ্যোগী হয়, তবে বিদেশে অবস্থানরত আই.টি স্পেশালিস্টরা অবশ্যই তাদের অবারিত হাত বাড়িয়ে দেবেন।
কারণ একজন পরবাসী পেশাজীবী ধ্যানে-মননে কিভাবে বাংলাদেশকে ধারণ করেন, তা আমার অভিবাসী জীবনের তিন দশকেরও বেশি সময়ে আমি খুব ভালো করেই দেখেছি।
দুই.
পয়লা জুলাই রাতে নিউইয়র্ক ছেড়ে আসতে আমাদের কিছুটা সময় দেরি হয়েছিল। একজন যাত্রী অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন বোর্ডিং এর পর। তাই তাকে জরুরি চিকিৎসা বিভাগের হাতে সমর্পণ করে আসার দায়িত্ব ছিল ফ্লাইট কর্মকর্তাদের উপর। রাত ন’টায় কথা থাকলেও রাত দশটায় ফ্লাইট ছেড়ে আসে।
এগারো ঘন্টা দশ মিনিটের যাত্রার পর কুয়েত সময় সোমবার (দুই জুলাই) বিকেল সোয়া চারটার পর আমরা কুয়েতে পৌঁছি। এখানেও বাইরে তখন বেশ গরম। নিউইয়র্ক যখন ছেড়ে আসি তখন সেখানের তাপমাত্রা ছিল ৯২ ডিগ্রী ফারেনহাইট। তীব্র গরমে নিউইয়র্কবাসীর নাভিশ্বাস চলছিল। কুয়েতের লু হাওয়া মনে করিয়ে দিল, বাংলাদেশেও এখন দাবদাহ চলছে।
কুয়েত বিমানবন্দরে প্রচুর বাঙালি কাজ করেন। তাদের কর্মঠ জীবনযাপন সম্পর্কে নানা বিষয়ে জানা হলো। ঢাকার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে আমাদের অবস্থান জানিয়ে দিলাম। কুয়েত এয়ারপোর্টে জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া। তারপরও সন্তানাদি সাথে থাকলে খরচে কার্পণ্য করা যায় না।
কুয়েত সময় সোমবার রাত আটটা পনেরো মিনিটে বিমান ছাড়ার কথা থাকলেও, ছাড়লো রাত ন’টায়। পাঁচ ঘন্টা পঁচিশ মিনিটের ফ্লাইট কুয়েত থেকে ঢাকা। কুয়েত থেকে এয়ারক্র্যাফট ছাড়ার পরপরই চেহারা পাল্টে গেল বিমানের ভেতরের। চারজন তরুণকে কুয়েত পুলিশ বিমানে তুলে দিল কড়া পাহারায়। জানলাম এরা বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত থাকায় কুয়েত জেলে ছিল।
তাদের প্রত্যেকের বয়স ২৫/২৮ হবে বলেই আমার ধারণা হলো। এরা কেন বিদেশে অপরাধে জড়িয়ে পড়লো? প্রশ্নটি বার বার জাগলো আমার মনে। এই ষোল কোটি মানুষের দেশে ফিরে কি করবে তারা? বিদেশই তো তাদের জন্য উত্তম ছিল। কুয়েতে বাঙালি শ্রমশক্তির বাজার বন্ধ হয়ে গেছে গেল ক’বছর যাবৎ। অর্থাৎ কুয়েত বাংলাদেশ থেকে শ্রমশক্তি নিচ্ছে না।
এর প্রধান কারণ কুয়েতে বাংলাদেশীরা বিভিন্ন জঘন্য অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। পুলিশ রেইড করে ধরছে অপরাধীদেরকে। তারপরও অপরাধ প্রবণতা কমছে না, জানালেন একজন ফ্লাইট যাত্রী আব্দুল হাকিম। তিনি কুয়েতের একটি ক্যাটারিং সেন্টারে পাচকের কাজ করেন। কয়েকজন কুয়েত প্রবাসীর সাথে কথা হলো।
তারা প্রতেক্যেই জানালেন, কুয়েতের বাংলাদেশ দুতাবাস প্রবাসী শ্রমিকদেরকে পর্যাপ্ত পরিমাণ সাহায্য সহযোগিতা করছেন না। বিশেষ করে কুয়েতে এখন শ্রমবাজারের ব্যাপক চাহিদা থাকার পরও কুয়েতস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস কুয়েত সরকারের সাথে কোনো সমঝোতা করছে না, কিংবা করতে উদ্যোগী হচ্ছে না। এই বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভাববেন বলে আমি আশাবাদী। কারণ বিদেশে শ্রমশক্তি রফতানির প্রাধান্য দিতে না পারলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার অর্জন ক্রমশঃ সংকুচিত হবে।
তিন.
তিন জুলাই মঙ্গলবার ভোর পাঁচটায় আমরা ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছলাম।
ইমিগ্রেশন পর্ব সেরে লাগেজের জন্য অপেক্ষার পালা। লাগেজগুলো এলো যথাসময়েই। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি জানান দিয়ে গেল, বাংলাদেশে এখন বর্ষাকাল। আমার অগ্রজপ্রতীম খালেদ আহমেদ সপরিবারে অপেক্ষা করছিলেন বাইরে। নিইউয়র্ক থেকে নিয়ে আসা গ্রামীণ ফোনের মোবাইল সীমটি মুহূর্তেই চালু হয়ে গেল।
‘ওয়েলকাম টু বাংলাদেশ’ এই স্বাগত মেসেজ দেখে বুঝা গেল ডিজিটাল বাংলাদেশের আমি এখন কানেকটেড গেস্ট! হ্যাঁ, এটাই নিয়তি, নিজ দেশে নো ভিসা রিকোয়ার্ড, সীল নিয়ে আসতে হয়েছে আমাকে। জয়তু কবি শহীদ কাদরী। আসার আগেই আপনি আমাকে ফোন করে বলেছিলেন ‘নো ভিসা সীলটা ঠিক মতো নিয়েছো তো, ইলিয়াস’! আমার মতো লাখো প্রবাসী এর মর্মযাতনা ভালো করেই বুঝেন। ‘ইমিগ্র্যান্ট পাথ ইজ অলওয়েজ ওয়ানওয়ে’। না আর ফিরে আসা যায় না।
আমাদের জন্য হোটেল বুকিং ছিল। বিমানবন্দরের এক নম্বর গেট থেকে তিন নম্বর গেটে আমাদের গাড়ী আসতে সময় নিল প্রায় চল্লিশ মিনিট। বাম্পার টু বাম্পার ট্রাফিক। তা পেরিয়ে আমরা হোটেলে পৌঁছলাম। প্রচন্ড ট্রাফিক জ্যাম জানিয়ে দিল এটা ঢাকা শহর।
ঢাকা থেকে সিলেটে আমাদের ফ্লাইট দুপুর বারোটা পঞ্চাশ মিনিটে। বাহন রিজেন্ট এয়ারলাইন্স। হোটেলে বিশ্রাম নিয়ে বারোটার দিকেই আমরা আবার লোকাল ফ্লাইট ধরার জন্য বিমানবন্দরে এলাম। নিউইয়র্ক থেকে উচ্চমূল্যে যখন রিজেন্ট এয়ারলাইনসের টিকিট কিনি, তখন আমাদেরকে জানানো হয়েছিল জনপ্রতি পঞ্চাশ পাউন্ড ওজনের দুটো ব্যাগেজ বিনামূল্যে বহন করবে রিজেন্ট এয়ারলাইনস। কিন্তু তা মানলেন না ঢাকা বিমানবন্দরের রিজেন্টের কাউন্টার পারসনরা।
তারা বললেন অতিরিক্ত ওজন চার্জ দিতে হবে? কেন দিতে হবে? আপনারা কথা রাখবেন না কেন? শেষ পর্যন্ত ৭০ টাকা কেজি প্রতি ওজন চার্জ দিয়ে ফ্লাইট করতে হলো। এটা তো প্রবাসীদের সাথে কথার বরখেলাপ। এ বিষয়ে পরে বিস্তারিত লেখার প্রত্যাশা রইলো। পৌনে দুটার দিকে সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে পৌঁছলাম। যারা আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছে এরা সবাই আমার অনুজ কিংবা সন্তানসম।
খলিল ইতোমধ্যে চলে গেছে এয়ারক্রাফটের খুব কাছাকাছি। জানালো,সবাই এসেছে। বাইরে। প্রচন্ড গরমে ভিজে আমি ও খলিল লাগেজগুলো বুঝে নিলাম।
বাইরে অপেক্ষা করছে মুন্না, আকতার, ফয়সল, ওলী, ইকরাম, জামাল সবাই তুর্কী-তরুণ।
আমার সাথে দেখা হয়েছে ফেসবুকে। দীর্ঘদিন পর দেখা। বাড়িতে যখন পৌঁছলাম তখন মায়ের দুহাত আমাকে নিয়ে গেল অন্য জগতে। এই তো স্বদেশ, এই তো মা।
------------------------------------------------------------
দৈনিক সিলেটের ডাক।
১৩ জুলাই ২০১২ শুক্রবার
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।