ব্যস্ত নগরী এখন একেবারে নিরব, নিস্তব্ধ। গভীর ঘুমে বিভোর নগরীর জনপদ। শুধু ঘুম নেই অলি মিয়ার চোখে। দু’ চোখজুড়ে বাঁধ ভাঙ্গা অশ্র“র বন্যা। কষ্টের সাগরে ভাসছে তার জীবন তরী তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতি আসবে, বিষাদের অনলে পুড়বে তার সুখের সংসার, ঘুৃর্ণাক্ষরেও কখনো ভাবেনি সে।
সময় গড়াতে থাকে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভাবতেই চোখজুড়া আরো ঝাপসা হয়ে উঠে। এয়ারপোর্টের একজন কর্মকর্তা ছিল অলি মিয়া। মাসে ১৫/১৬ হাজার টাকায়। বেশ ভালই চলছিল তার সুখি সংসার।
ছুটিতে বাড়ি যায় সে। দুর্ভাগ্যও অলি মিয়ার পিছুৃ পিছু পথ ধরে। অসুখ হয় তার। আসতে প্রায় এক সপ্তাহ কেটে যায়। এসেই দেখে সাধের সেই চাকরীটা আর নেই।
মুহূর্তেই ভেঙ্গে পড়ে সে। অনেক কাকুতি মিনতি করে টিকে থাকতে চায়। কিন্তু কোন মিনতিই কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করলনা। ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে সে দিন বাসায় ফিরে অলি মিয়া। পর দিন বড় এক অফিসারকে ধরে আবারো আবেদন করে।
কিস্তু চাকুরীটা আর জুটলনা বটে, তবে ভিতরেই সামান্য পান সিগারেটের দোকান নিয়ে বসার পারমিশন পায়। তবুও কোনমতে থাকার ঠাই হল। দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার সাজানো সংসার। বড় রবি, উদয়ন স্কুলে ক্লাস ফোরে ও শফিক কিন্ডার গার্টেনে পড়াশুনা করছে। মেয়ে খাদিজা এখানো অনেক ছোট।
কিন্তু বাসা ভাড়া ও তাদের পড়াশুনার খরচ চালাতে রীতিমত হিমসিম খাচ্ছে অলি মিয়া। একবুক কষ্ট নিয়েই দিনাতিপাত করছে সে। একদিন লাঞ্চের পর নিজের দোকানের ভাঙ্গা চেয়ারটায় বসে মাথা নিচু করে কাঁদছে। মনির এসে ডাকল। আগে উভয়ে একই চাকরীতে ছিল।
অলি মিয়া চোখ মুছতে মুছতে মনিরের দিকে তাকায়। একি তুমি কাঁদছ কেন ? কে নেয় অলি মিয়ার মনের খবর। চুপ করে ফ্যাল ফ্যাল নয়নে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনির বুঝতে পারল অলি মিয়ার দৈন্য দশার কথা। মেঘহীন এ ঝড়ে মনির খুবই মর্মাহত হল।
তার দিকে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিল। বলল: ঠিক আছে তুমি আমার বাসায় ভাড়া থাকবে। যা-ই পার দিও। এতে কোন আপত্তি নেই। হতাশ হৃদয়ে জ্বলে ওঠল আশার আলো।
মনিরের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে অলি মিয়ার অন্তর। পরের মাসে ঢাকার দক্ষিণখান অঞ্চলে মনিরের বাসায় ওঠে অলি মিয়া। এভাবে কষ্টের সিঁড়ি বেয়ে চলতে থাকে সে।
পর্ব-২
সময়ের হাত ধরে খাদিজাও বেড়ে ওঠে। মা মমিনার চোখের মনি।
হাজার বছরের কাংখিত ধন। স্বপ্ন দেখেছিলেন যেন তার কোলজুড়ে একটি মেয়ে আসে। আল্লাহ কবুল করলেন তার সেই মিনতি। ফুলের মতই সুন্দর। চাঁদের মতই উজ্জল খাদিজার চেহারা।
যেন একটি ফুটন্ত গোলাপ। একটি স্নিগ্ধ চাঁদ। অর্থের অভাবে তার পড়াশুনা থেমে যাবে, এ কথা ভাবতেই মমিনার বুুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। নাহ যে করেই হোক আমি তাকে শিক্ষিত করে তুলবই। শিক্ষার প্রদ্বীপ তার মাঝে জ্বালবই।
মমিনার দৃঢ় সংকল্প। আল্লাহর উপর ভরসা করে ভর্তি করে দিলেন আল মানার কিন্ডার গার্টেনে। খাদিজাও পড়াশুনায় বেশ উদ্যমী। অসাধারণ প্রতিভা খাদিজার। প্রথম সেমিষ্টার পরীক্ষায় ই সকলের দৃষ্টি কাড়ে।
সফলভাবেই ১ম আসনটি দখল করে নেয়।
এদিকে রবিও ক্লাস নাইনের সিঁড়িতে উপনীত। আগামীতে পরীক্ষার্থী। তিনজনের পড়াশুনার খরচ আর বাসাভাড়া দিতে রীতিমত হুচট খাচ্ছে অলি মিয়া। প্রথমে যে বেতন পেত তা দিয়ে দক্ষিণখানেই তিন কাটা জমি রেখেছিল এবং অগ্রিম দুই লক্ষ্য টাকা আদায়ও করে ফেলেছে।
কিন্তু দুভার্গ্য অলি মিয়ার পিছু ছাড়েনি। স্বপ্ন দেখেছিল আর ৪/৫ বছর পর নিজের জায়গায় বাড়ি করে সুখে দিন কাটাবে। কিন্তু অলি মিয়ার এখন মাসিক আয় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। এ দিয়ে সংসার ও ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার খরচ ও বাসা ভাড়া কিছুতেই বেড় আনাতে পারেনা। অলি মিয়ার এ দৈন্য দশা মনিরের চক্ষু এড়ায়নি।
একদিন বলল: অলি! তোমার ভাড়া দিতে হবেনা। অলি মিয়া কিছুটা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে। তবুও খুড়িয়ে খুড়িয়ে পথ চলতে থাকে সে। দুর্ভাগ্য যেন অলি মিয়ার নিত্য সঙ্গী। অলি মিয়ার এ সুখটুকুও বেশি দিন টিকলনা।
মনিরের স্ত্রী মনিরের এ উদারতাকে সহজে মেনে নিতে পারেনি। তাই একদিন মনির অলি মিয়াকে বাসা ছেড়ে দিতে বলল। অলি মিয়ার মাথায় যেন মস্ত বড় আকাশটা ভেঙ্গে পড়ল। কিংকর্তব্যেবিমূঢ়।
অজানা কষ্টের ঝড়ে মন ভেংগে যায়।
অলি মিয়ার জীবনজুড়ে নেমে আসে কঠিন অন্ধকার। কেন পৃথিবী এত কষ্টের। এত যন্ত্রনার। পৃথিবীর মানুষগুলো কেন এত নিষ্ঠুর ?
ভাঙ্গা মনে ভাবে সে। নির্জল আঁখি দুটি অশ্র“তে ভিজে যায়।
ঝাপসা হয়ে আসে চারপাশ।
কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে কয়েক ফোটা তপ্ত অশ্র“। ছেলেমেয়েদের অনাগত ভবিষ্যতের ভাবনায় আরো মোষড়ে পড়ে। এখন কোথায় ওঠব ? কে দেবে একটু ঠাই ? ক্লান্ত মনে ভাবতে থাকে অলি মিয়া।
এদিকে রবির স্কুলও কোচিংয়ের টাকা বাকি প্রায় দুই হাজার টাকা।
খাদিজার বাকি এক হাজার টাকা। স্কুল থেকে চাপ আসে বেতন পরিশোধ করার জন্য। কিন্তু অলি মিয়া যে নিরুপায়। মেহেদি পাতার বুকে যেমন লাল রং লুকিয়ে থাকে, কেউ দেখেনা,তেমনি অলি মিয়ার মনের পাতায় কষ্টের যে নীল আভা লুকিয়ে আছে তা কেউ দেখেনা। এখন কী করবে কিছুই ভেবে পায়না।
মাসের আর মাত্র ৭দিন বাকি। নতুন ভাড়াটে মিলে যাওয়ায় মনির বলল: এ মাস পরই বাসা ছেড়ে দিতে হবে। অলি মিয়ার হৃদয় যমুনায় উথলে ওঠে কষ্টের উত্তাল তরঙ্গ। সারওয়রের বড় ভাই আনোয়ারের কাছে নিজের অসহায়ত্ব পেশ করে অলি মিয়া। কিন্তু আনোয়ার কোন ভ্রক্ষেপই করেনি।
যা তা বলে তাড়িয়ে দেয়। ব্যর্থ মনোরথে ফিরে আসে সে। মাস শেষ। মনির বাসা ছেড়ে দেওয়ার জন্য ভীষণ চাপ দেয়। অলি মিয়া আবারো আনোয়ারের দোয়ারে এসে দাঁড়ায়।
ছলছল নয়নে নীড় হারা পথিকের ন্যায় আনোয়ারের কাছে একটু আশ্রয় চায়। কিন্তু আনোয়ারের মন গলেনি। এরপরও পাথরের মত শক্তই রয়ে গেল তার কঠিন অন্তর।
অলি মিয়া সব আশা ছেড়ে দিয়ে শেষ আশ্রয় আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকে। গহিন হৃদয় থেকে প্রার্থনা জানায় একটা সুষ্ঠ সমাধানের।
একজন অসহায় বান্দার এ করুন আর্তনাদ স্রষ্টার দৃষ্টি এড়ায়নি। এবার আল্লাহর রহমতের এক পসলা বৃষ্টি ঝরে পড়ে অলি মিয়ার উপর। সরোয়ারের বাবা রফিক চৌধুরী থাকার ঠাই দিলেন। অলি মিয়া যে জায়গাটা কিনেছিল, সেখানেই পুরাতন কুড়ে বেড়ার ছাউনি একটা ঘরে থাকতে দিলেন। থাকার উপযোগী না হলেও অলি মিয়ার এ ছাড়া যে আর কোন গতি নেই।
কোন রকমে উপযোগী করে নিল। তবুও তো মাথা গুজার ঠাই হল। স্রষ্টার কাছে শুকরিয়া জানাল। কিছুটা স্বস্থির নিশ্বাস ফেলল অলি মিয়া।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।