আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লাল মাটির দেশে কালো মাটির মানুষ - লুসাকা ও বাড়ি ফেরা

সপ্তা শুরু হলো আর আমারও শুরু হলো খাঁচার পাখির জীবন। মাঝে মাঝে মাইন এরিয়ার ভেতর কাছে পিঠের দোকান গুলোতে হেটে আসি তবে বাড়ি ফেরার পর নিজে লাল ধুলোয় হাপুশ হুপুশ লাল হয়ে আসি, গা শিন শিন করে ধুলায় তাই বাইরেও যেতে ইচ্ছে করে না তেমন। ক্লিফ বলল সে দুদিন পরেই যাবে জাম্বিয়ার রাজধানি লুসাকায়, অফিসের ফ্যাকট্রি ওপেনিং এ, আমাকও সাথে নেবে বলেছে। আমি এই খাঁচা থেকে মুক্তির আলো দেখি এই খবরে। খুব ভোরে আমাদের রওনা দিতে হলো সেদিন।

লুম্মুয়ানা থেকে সোলওয়াজি যেতে হবে সেখান থেকে ফ্লাইট ধরে এনডোলা। এনডোলা থেকে প্লেন বদলিয়ে লুসাকা। সকাল ৭.৩০শে ফ্লাইট সোলওয়াজি থেকে। এয়ার পোর্টে গিয়ে যখন পৌছালাম তখন ঠান্ডা বাতাসে আমার হাত মুখ সব জমে বরফ হয়ে গেছে আর তার সাথে লাল ধুলো। এয়ারপোর্টের ব্যলাকনি তে আমি শীতে কাপছি এয়ারপোর্টের বার ও রেস্ট্যুরেন্ট এয়ার পোর্টের সাইজ দেখে আমি কি আর বলব ।

আগের প্লেনটার চাইতে অনেক ছোট। প্লেনের ভেতর পাইলট আর আমরা ঠাসা ঠাসি কাছাকাছি বসে গল্প করতে করতে আকাশে উড়াল দিলাম। সকালের নরম রোদে আফ্রিকা দেখি নিচে। নদি থেকে ধোয়া ওঠে ঘন কুয়াশার মতন করে আর ছারা ছারা বুশ। আমরা এক সময় মেঘের উপর উঠে গিয়ে দিগন্ত কে দেখি, নিচে সাদা সাদা তুলো তুলো মেঘ ফেপে ফুলে যেন সাদা সাদা হাওয়াই মিঠাই হয়ে ভেসে আছে।

রোদর আলো মেঘে পড়ে অসাধারন এক ব্যপার। আমাদের গ্রুপটা ছিল ছয় জনের। আমি, ক্লিফ আর বাকিরা ক্লিফের কলিগ। প্লেনে তো নয় যেন বাসে চেপে আড্ডা মেরে মেরে আকাশ পাড়ি দিচ্ছি। এনডোলা'র পৌছাতে ৪৫ মিনিট এর কিছু কম লাগল।

প্লেনের পেছনে বিশাল এক বক্স-এ রাখা চিপস আর ফ্রুট জুস আমরা নিজ দায়িত্বে নিয়ে গপাগপ সাবার করে দিলাম (এয়ার হোস্টেস এর কোন বালাই ছিলা না সেখানে )। এনডোলা পৌছানর আগে প্লেন থেকে আরো কিছু ছবি তুললাম আকাশ থেকে কয়েকটা মাইনও চোখে পরল। এনডোলায় নেমে আরেকটু বড় প্লেনে চেপে বসলাম আমরা। এটাতে অবশ্য এয়ার হোস্টেস ছিলেন। ৪৫মিনিট পর আমরা পৌছালাম জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকা'য়।

ছোট্ট একটা এয়ারপোর্ট। খুব মেঘ আর ঠান্ডা ছিল সেদিন। বাতাসে ঠান্ডা আরো বেশি মনে হলো। তবে এখানে লাল ধুলো নেই। হটেলে পৌছে হটেলের ইন্টেরিয়র দেখে ভাল লাগলো।

কাঠের মুখোশ গুলো দেখে এত দিনে মনে হলো উমম আমি আফ্রিকায় !!!! সেদিনটা হটেলের আশে পাশে ঘুরে কাটিয়ে দিলাম আমরা। সন্ধ্যায় ক্লিফের কলিগদের সাথে নিচে আড্ডা আর ডিনার ছিল। পরদিন সকালে আমি আমার মত ঘুরে ঘুরে আশপাশটা দেখলাম...ক্লিফ ওদের প্রগ্রাম শেষে ফিরে এলে আমরা শহর দেখতে বের হলাম। আমরা একটা হস্তশিল্পের ট্রাইবাল ভিলেজে গেলাম লোকাল হাতে বানানো জিনিশ দেখতে। অসাধারন সব জিনিস সেখানে।

চমৎকার সব হাতে আঁকা ছবি, কাঠের বানানো চমৎকার সব স্ট্যাচু। কপারের তৈরি গহনা, হাড়ের গহনা, পাথড়ের চমৎকার সব জিনিস। আর মজার ব্যাপার হলো কপার প্রসেস করার আগে যে অবস্থায় থাকে তাকে Malachite বলে। Malachite এটা দিয়ে ওরা শুধু গহন নয় নানান রকম স্ট্যাচু আর চমৎকার সব শোপিস বানিয়েছে। কোনটা রেখে কোনটা নেব অবস্থা আমার তখন হা হা হা ।

কিন্তু চাইলেই সব নেয়া যাচ্ছে না কারন অস্ট্রেলিয়া ইমিগ্রেশন অনেক কিছুই অস্ট্রেলিয়ার ভেতর আনতে দেয় না। বিশেষ করে কাঠের জিনিস আর এনিমেল পার্ট দিয়ে যা বানান হয় সেসব। অনেক ঝামেলা হয় ইমিগ্রেশনে। বন্ধুদের জন্য ক'একটা উপহার আর নিজের জন্য একজোড়া Malachite এর বালা কিনলাম। অদ্ভুত একটা ব্যাপার কপার কিন্তু কপার নয় দেখতে !! সন্ধ্যায় ক্লিফের এক কলিগের বাড়িতে বার্বিকিউ এর আয়োজন ছিল।

চমৎকার একটা সন্ধ্যা কাটল আমার সেদিন। চমৎকার একটা মেয়ে যার নাম ধরুন "স্টিফেনি" তার সাথে পরিচয় হলো। নিজের প্রতিবিম্ব যেন দেখলাম। আমরা দেখতে এক নই তবে আমদের চিন্তা ভাবনা, জীবনধারন, ভাল লাগা, চাওয়া পাওয়া হুবহু এক রকম। একটা ধাক্কা সত্যি খেলাম নিজেকে আরেকজনের মাঝে দেখে।

পরের দিন ফিরে আসার পালা। ফেরত পথে আমরা এনডোলা এসে ড্রাইভ করে সোলওয়াজি যাবো বলে ঠিক করলাম। পথে একরাত কাটাবো "কিটউই" নামে একটা ছোট্ট শহরে। হটেলটা ছিল চমৎকার পুরোনো ধাচে বানানো। হটেলের গেটে একটা আফ্রিকান স্কাল্পচার।

রুমের টয়লেটে পাথরের বেসিন। ঘরেআর ব্যালকনিতে পুরোনো কাঠের পুরোনো ডিজাইনের ফার্নিচার, মনে সেই ব্রিটিশ আমলের আমেজ আর গন্ধ এনে দেয়। রাতে চমৎকার ইন্ডিয়ান ডিনার করলাম। হোটেলটার ওনার ইন্ডিয়ান তাই সব কিছুতে পুরোনো দিনের আফ্রিকান-ইন্ডিয়ান ছোয়া আছে। আমার ভাল লাগলো সেই গন্ধ আর পরিবেশ, নিজেকে অতিতের কোন চরিত্র বলে মনে হতে থাকল।

বর্তমানের পাতা থেকে আমি চলে গেছি তখন অতিতের লালচে পুরনো পাতায়। পরদিন ৬ঘন্টা ড্রাইভ করে ফেরা পথ কিটউই থেকে লুম্মুয়ানা। পথে আমরা Chimpanzee sanctuary তে থামলাম। পরিবার পরিজন আর দলনেতা নিয়ে বিশাল এক Chimpanzee বসতি সেখানে। দলনেতা পায়ের উপর পা দিয়ে মহা আনন্দে পা নাচিয়ে বিশ্রামে ব্যস্ত।

বাচ্চা টা এর ওর সাথে দুস্টুমি করে খেলে বেরাচ্ছ। শিম্পান্জি ফেরার পথে জঙ্গলের মাটি পথে ক্লিফ আমাকে ওর মানুয়াল গিয়ারের জিপ'টা ড্রাইভ করতে দিল। অনেক বছর পরে ম্যনুয়াল গিয়ারের গাড়ি চালাতে গিয়ে খুব মজা পেলাম। প্রথমে অনেক দিনের অনভ্যাসে একটু নাজেহাল অবস্থা হলেও ৪/৫ মিনিটেই গাড়িটাকে বাগে এনে ফেললাম। খুবই মজা লাগলো চালাতে!! বাড়ি ফিরতে সেদিন সন্ধ্যা হয়ে গেল।

বাড়ি ফিরেই মনে হলো আর মাত্র চারদিন তারপরই বাড়ি ফিরে আসবো। কথাটা মনে হতেই আনন্দে মন ধেই ধেই করে নাচতে চায়। Couldn't wait to pack my bag and fly off. এর পরের ক'টা দিন কনোমতে চলে গেল। ফিরতি পথটা খুব সহজ লাগল। জোহানেসবার্গের সেই ফুড শপের মেয়েটা আমাকে দেখে চেচিয়ে উঠল "You You You.... You came back !!!" আমি অবাক হয়ে গেলাম এই মহিলা প্রতিদিন এতো হাজার হাজার মানুষ দেখে....আমাকে সে তিন সপ্তা আগে একবার দেখেছে মাত্র, সে কি করে আমাকে মনে রাখল! আমার আরো অবাক হওয়া বাকি ছিল তখনও....যে লোকটা ইমিগ্রেশনে ছিল সেও আমাকে দেখা মাত্র বলে উঠল " I know you i know this passport!!" ক্লিফ পর্যন্ত অবাক।

এই মানুষ গুলো Made me feel so special!! আমার খুব ভাল লাগলো। মনটা সত্যিই খুব ভালোলাগায় ভরে গেল....এই অজানা অচেনা মানুষ গুলো আমাকে মনে রেখেছে অল্প এক ঝলকের দেখা থেকে এ তো সত্যিই পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত !!! আমি অভিভুত!!! আমি যেন সত্যিকারের রাজকন্য হয়ে গেলাম তখন.......। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।