সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ... হিজড়াদের জীবন নিয়ে বাংলাদেশে পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র নির্মাণের মতো ঘটনাটি ঘটিয়ে ফেলেছেন নোমান রবিন। চলচ্চিত্রের নাম কমন জেন্ডার: দ্য ফিল্ম। অবশ্য এটি এর আগে নির্মিত একটি টেলিভিশন নাটকেরই চলচ্চিত্ররূপ। হিজড়াদের নিয়ে এর আগে ‘ইচ্ছে বসন্ত’ শিরোনামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন শবনম ফেরদৌসী। আর হিজড়াদের মতো প্রান্তিক ও বঞ্চিত মানুষের জীবন যাপন নিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রায় বৈপ্লবিক একটি ঘটনা।
জনপ্রিয় করে তোলার বেশ কিছু উপাদান সংযোজনের সচেতন প্রয়াস চলচ্চিত্রটিতে লক্ষ করা গেলেও কেবল বিষয়বস্তুর কারণেই এটি একটি বিকল্প চলচ্চিত্রের উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
আমাদের দেশে লৈঙ্গিক রাজনীতি নিয়ে সমীক্ষার দৌড় কেবল পুরুষের বিপরীতে নারীর লৈঙ্গিক পরিচয় বা অধিকার কী দাঁড়াচ্ছে তার হিসাব-নিকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। সমলিঙ্গ এবং উভলিঙ্গ বা হিজড়াদের লৈঙ্গিক পরিচয় নিয়ে এ দেশের শিল্পমাধ্যমে তেমন কাজ হয়নি বললেই চলে। অথচ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কুইয়ার চলচ্চিত্র অহরহ নির্মিত হচ্ছে—সমকাম, উভলিঙ্গ, লিঙ্গান্তর, ট্রান্সভেসটাইট ইত্যাদিকে চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু করে তুলেছেন রেইনার ওয়ারনার ফাসবিন্ডার বা পেদ্রো আলমাদোভারের মতো বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকাররা। এই পরিচালকেরা তাঁদের সংবেদনশীল চিত্রায়ণের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন সমাজের এসব প্রান্তিক মানুষের হাসি-কান্না-বঞ্চনা, নিষ্পেষণ জীবন যাপন ও টিকে থাকার সংগ্রামের কথা।
হিজড়াদের লৈঙ্গিক পরিচয় বা রূপান্তরের নানা ধরন থাকলেও এই চলচ্চিত্রের হিজড়ারা ছেলে হিসেবে জন্ম নেওয়ার পর অভ্যন্তরীণ হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে নারীদের মতো পোশাক পরে, নারীদের মতো আচরণ করে; পরিবারে-সমাজে এদের স্থান হয় না। কৌমের মতো করে যৌথভাবে কোনো এক ‘মাসি’র অধীনে এরা একত্রে বড় হতে থাকে। নাম পাল্টে সুস্ময় হয়ে যায় সুস্মিতা, বাবু হয়ে যায় বুবলি। এই দুই চরিত্র কাহিনিতে কিছুটা বেশি গুরুত্ব পেলেও তাদের সঙ্গী-সাথি মিলে পুরো হিজড়া সমাজ একক চরিত্র হিসেবে চলচ্চিত্রে হাজির থেকেছে। এক বিয়ের অনুষ্ঠানে সুস্মিতাকে বন্ধুত্বের প্রস্তাব দেয় যুবক সঞ্জয়।
মুঠোফানে তাদের আলাপ চলতে থাকে। সঞ্জয় মাঝেমধ্যেই তাকে বলে যে সে যদি মেয়ে হতো, তবে খুব ভালো হতো। সঞ্জয়ের এই প্রত্যাশা সুস্মিতার মধ্যে নারীভাবের সঞ্চার করে, নিজের মধ্যে সে নারীত্বের উপস্থিতি টের পায়। সুস্মিতা সঞ্জয়ের প্রেমে পড়ে। সঞ্জয় সুস্মিতাকে তার মা-বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে গেলে মা-বাবা ছেলেকে একজন হিজড়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্য তিরস্কার করেন।
অপমানে সুস্মিতা আত্মহত্যা করে। মৃত্যুর পরদিন সুস্মিতার (সুস্ময়) মা তাকে দেখতে আসেন। সুস্মিতার মাকে দেখে বুবলির মধ্যেও মাকে দেখার প্রবল বাসনা জাগে। সে গভীর রাতে নিজ বাড়িতে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তার ভাই তাকে পিটিয়ে বের করে দেয়, লাঞ্ছনা করে। এই অপমান বুবলিকেও আত্মহননে প্ররোচিত করে।
বুবলির মৃত্যু সরাসরি দেখা না গেলেও শেষদৃশ্যে দেখা যায় তারা দুজন স্বর্গে, মেঘের রাজ্যে সাক্ষাৎ করেছে।
ছবির কাহিনিবিস্তার এটুকুই। কিন্তু পরিচালক তো কেবল ফেনিয়ে তোলা একটি গল্প শোনাতে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেননি, আধিপত্যশীল লৈঙ্গিক রাজনীতি কীভাবে হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রান্তিক করে ফেলেছে এবং তার ফলে তাদের জীবন যাপন কতটা বিভীষিকাময় হয়ে উঠতে পারে, তার দিকেই পরিচালকের দৃষ্টি নিবদ্ধ থেকেছে। ফলে হিজড়ারা কীভাবে বাজারে-বাড়িতে টাকা তুলে জীবননির্বাহ করে, কী স্ল্যাঙ আলাপচারিতায় ব্যবহার করে, কোন ভঙ্গিতে চলাফেরা করে—লোকালয়ে দৃষ্ট এসব মামুলি তথ্যগত বিষয় যেমন চলচ্চিত্রে চিত্রায়িত হয়েছে, তেমনি লৈঙ্গিক রাজনীতিতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী-পুরুষের দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায় যে হিজড়া-জীবন, সেদিকটিও উঠে এসেছে। চলচ্চিত্রটি দেখে জানা যাবে যে শৈশব থেকে রূপান্তরের একপর্যায়ে হিজড়া-মানুষদের আর পরিবারে ঠাঁই হয় না।
পরিবারই তাদের বের করে হিজড়া সমাজে নির্বাসন দেয়। ভদ্রস্থ সচ্ছল পরিবারে জন্ম নেওয়ার পরও তাদের জীবন কাটতে পারে বস্তি-ঝুপড়িতে, মাসির অধীনে, হিজড়া-বন্ধুদের সঙ্গে। আর জীবন যাপনের পদে পদে সে ঠেকে, পাবলিক টয়লেটে পুরুষ ও নারী উভয় কর্নার থেকে তাদের বের করে দেওয়া হয়। মৃত্যুর পর তাদের সৎকারের জন্য গোরস্থানে ঠাঁই নেই, সমাহিত করতে হলে লৈঙ্গিক পরিচয় গোপন রাখতে হবে। এসব কারণেই হয়তো তারা বেপরোয়া, তাদের কায়দা-কেতা দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে বিব্রত করে, টাকার জন্য জোরাজুরি করে।
তবে আমরা জানি, যেকোনো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন একেবারে বর্ণহীন নয়। ফলে তাদের নৃত্যগীতময় এক মধুর জীবনও আছে। আছে পরস্পরকে সাহায্য করার এক সৎ অঙ্গীকার, সারাক্ষণ পরস্পরকে গালিগালাজ করার পরও আছে বন্ধুত্ব-ভালোবাসার এক নিবিড় বন্ধন।
একদিকে মানবীয় সম্পর্কের বুনন, অন্যদিকে প্রাধান্যশীল সমাজের দিক থেকে পাওয়া লাঞ্ছনা—বৃহত্তর এই দুই দিকের রসায়নে যে ন্যারেটিভ দাঁড়িয়েছে, তা সংবেদনশীল মানুষকে স্পর্শ করবেই, হূদয় ও চোখকে আর্দ্র করবেই। সঞ্জয়ের প্রতি সুস্মিতার প্রেম এবং মায়ের প্রতি বুবলির যে ভালোবাসা, তা লৈঙ্গিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে এক নিরেট মানবিক আখ্যানের জন্ম দেয়।
আর এই দুই পরম মানবিক অনুভূতি তীব্র টানে চরিত্রদ্বয়ের মতো দর্শকও ভেসে ওঠেন, অথচ পরে তার করুণ ফলাফল দর্শকদের মনে এই উপলব্ধির জন্ম দেয় যে, কেবল হিজড়া হওয়ার কারণেই তাদের এই অপ্রাপ্তি ও বঞ্চনা—যার পরিণতি আত্মহনন ডেকে আনে। ফলে হিজড়া সমাজের প্রতি দর্শকের আগের উপলব্ধিতে একটা পরিবর্তন আসবে। সে হিসেবে পরিচালক সফল তাঁর বার্তা পরিবেশনে। তবে প্রেক্ষাগৃহবিমুখ দর্শককে প্রেক্ষাগৃহে টেনে আনতে পরিচালক বাণিজ্যিক ও জনপ্রিয় হওয়ার মতো বেশ কিছু উপাদান সংযোজন করেছেন। যাত্রাপালার সিকোয়েন্সে যাত্রার কোনো কিছু না দেখিয়ে কেবল প্রিন্সেসের নৃত্যগীত পরিবেশনকে অধুনা আইটেম গান ছাড়া আর কীই বা বলা যাবে? আছে বেশ কয়েকটি গান, যার মধ্যে একটি নারী-পুরুষের প্রেমসংক্রান্ত, একটি মাকে নিয়ে, আরেকটি হিজড়া সমাজের বন্ধুত্ব-সম্পর্কিত।
জনপ্রিয় ফর্মুলা হিসেবে গানকে অবলম্বন করতে গিয়ে একটা বিপত্তিও ঘটেছে—হিন্দু বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখানো হয়েছে কাওয়ালি গান। নির্মম জীবনযাপন করেও হিজড়াদের ধর্মবিশ্বাস অটুট থাকে, কথায় কথায় তারা আল্লাহকে সাক্ষী মানে। মোল্লাশ্রেণী কর্তৃক হিজড়াদের খেদানোর রেফারেন্স ছবিতে থাকলেও যে হুজুরদের আমরা চলচ্চিত্রে দেখি, তাদের হিজড়াদের প্রতি খুব সহানুভূতিশীলই দেখি। এই চলচ্চিত্রে বড় কোনো স্টার নেই, তবুও এর দর্শক টানার যোগ্যতা রয়েছে। সুস্মিতার চরিত্রে সাজু খাদেম এবং বুবলির চরিত্রে মঞ্চের নামী অভিনেতা দিলীপ চক্রবর্ত্তী অসাধারণ অভিনয় করেছেন।
হিজড়া চরিত্রের ম্যানারিজম ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে এই দুজনসহ প্রায় সবাই সফল হয়েছেন। রাহুল আনন্দের শব্দধারণ ও আবহসংগীতের কাজ দুটিও মনে ধরার মতো। গানগুলোতে অবশ্য এই সময়ের স্টার শিল্পী ন্যান্সি, বালাম, আরেফিন রুমীরা কণ্ঠ দিয়েছেন। গানগুলো শ্রুতিমধুরও। ডিজিটাল ফরমেটে নির্মিত চলচ্চিত্রটি আমাদের পুনর্বার মনে করিয়ে দেয় যে ফরমেটটি ব্যয়সাশ্রয়ী ও নন্দনতাত্ত্বিক নানা সুবিধা দেয় বলেই বিচিত্র সব বিষয়ের ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্র নির্মাণ করা এখন সম্ভব, যদিও টাইটেল কার্ডের অ্যানিমেশনটি ব্যর্থ হয়েছে; শেষ দৃশ্যের স্পেশাল ইফেক্ট অবশ্য উৎরে গেছে।
প্রথম প্রকাশ: আনন্দ, প্রথম আলো, ০৫ জুন, ২০১২।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।