দুরন্ত বিপ্লবের সামাজিক যোগাযোগ উপায়
মরিচ অর্থকরী ফসলের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফসল। এটি মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কাঁচা, পাকা ও শুকনা উভয় অবস্থায়ই এর ব্যবহার হয়। মরিচ সব ঋতুতে চাষ করা যায়। তবে মোট ফলনের ৮৫% শুকনা মরিচ শীতকালে ফলানো হয়।
বাংলাদেশে মসলা জাতীয় ফসলের মধ্যে মরিচের আবাদ এলাকায় শীর্ষে।
মরিচ চাষে ভালো ফলন পেতে বা লাভবান হতে হলে কতগুলো নিয়মের ওপর অবশ্যই নির্ভর করতে হবে। যেমন- বীজতলা থেকে শুরু করে সংরক্ষণ পর্যন্ত সঠিক নিয়ম পালন করলে ভালো ফলন অবশ্যম্ভাবী।
মাটি ও আবহাওয়া
পানি নিষ্কাশন, সুবিধাযুক্ত বেলে দোঁ-আঁশ মাটিতে মরিচ চাষ করা হয়। তবে জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দো-আঁশ মাটি চাষাবাদের জন্য উত্তম।
অম্লীয় মাটিতে মরিচের চাষ করা গেলেও ক্ষারীয় মাটিতে ভালো হয় না। বন্যা বিধৌত পলি এলাকায় মাঝারি উঁচু ভিটা যেখানে বর্ষার পর ভাদ্র (আগস্ট-সেপ্টেম্বর) মাসে জো আসে এমন জমিতে মরিচ ভালো হয়।
বীজতলা তৈরি
বীজতলায় বীজ বপনের আগে মাটি শোধন বা সোলারাইজেশন করে মাটিতে জসবান বা রিডোমিল সেপ্র করতে হবে। বীজ ভিজিয়ে রেখে ছিটিয়ে বা সারি করে বপন করতে হবে। চারা একটু বড় হলে উঠিয়ে ২য় বীজতলায় ১.৫ী১.৫ ইঞ্চি দূরে দূরে রোপণ করতে হবে।
চারা উৎপাদন পদ্ধতি : ভালো চারা উৎপাদন করার জন্য প্রথম বীজতলায় চারা গজিয়ে দ্বিতীয় বীজতলায় স্থানান্তর করতে হবে। দু’বার চারা রোপণ করলে গাছের শিকড় শক্তিশালী হয় এবং মূল মাঠে চারা কম মারা যায়।
নীরোগ চারা উৎপাদনের জন্য বপনের ৬ ঘণ্টা পূর্বে ভিটাভেঙ বা ক্যাপটান দ্বারা বীজ শোধন করতে হবে। বীজ বপনের পর অতিবৃষ্টি বা প্রখর রোদ থেকে রড়্গা পেতে বাঁশের চাটাই বা পলিথিন দিয়ে বীজতলা ঢেকে দিতে হবে। সাধারণত বীজ বপনের ৭-১০ দিনের মধ্যে বীজ গজায়।
বীজ গজানোর পর ১০-১২ দিন বয়সের চারা উঠাতে হয় এবং সাথে সাথে দ্বিতীয় বীজতলায় ২.৫ মিটার দূরত্বে চারা লাগাতে হয়। ছোট এবং নরম চারা উঠানোর জন্য বীজতলায় হালকা সেচ দিতে হয়। চারার বয়স ৩০-৩৫ দিন হলে জমিতে লাগানোর উপযোগী হয়। সাধারণত এক বিঘা জমিতে চারা লাগানোর জন্য প্রায় ১৩০ গ্রাম মরিচ বীজ প্রয়োজন।
জমি চাষ
জমিতে সাধারণত ৪-৫টি চাষ ও মই দিতে হয়।
প্রথম চাষ গভীরভাবে হওয়া দরকার। শেষের চাষের সময় পূর্ণমাত্রায় গোবর, টিএসপি, জিপসাম এবং ১/৩ অংশ ইউরিয়া ও এমপি সার মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
ভিটি তৈরি
মরিচের চারা লাগানোর জন্য ১ মিটার প্রশসত্ম ও লম্বায় জমির অবস্থা বুঝে ভিটি তৈরি করতে হবে।
রোপণ
রবি মৌসুমের জন্য ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর এবং খরিফের জন্য ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ মার্চ এর মধ্যে চারা?তৈরির জন্য বীজ বপন করতে হবে। হরমোন প্রয়োগ : মরিচের ফুল ঝরে পড়লে পস্নানোফিঙ নামক হরমোন প্রয়োগ করলে ফুল কম ঝরে এবং ফলন বাড়ে।
পস্নানোফিঙ ৪-৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছের উপরে ছিটিয়ে দিতে হয়।
পরবর্তী পরিচর্যা
নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার ও মাটি ঝুরঝুরে করতে হয়। জমিতে ১৫ দিন অন্তর সেচ দিতে হয়। সেচের কয়েক দিন পর মাটিতে চটা দেখা দিলে তা ভেঙে দিতে হবে, আলগা করে দিলে আলো বাতাস পাবে।
ফসল তোলা
মরিচ কাঁচা বা পাকা অবস্থায় তোলা হয়।
ভালো ফলনের জন্য মরিচ যত বেশি তোলা যায় তত ফলন বেশি পাওয়া যায়। মরিচ শুকিয়ে রাখার জন্য পরিপূর্ণ পেকে গেছে এমন মরিচ তুললে গুণগতমান ঠিক থাকবে।
সংরক্ষণ
মরিচের পরিপক্ব ফল তুলে তা শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হয়। সূর্যালোকের সাহায্যে ফল শুকানো আমাদের প্রচলিত পদ্ধতি। কিন্তু সতর্ক না হলে অতিরিক্ত সূর্যতাপে ফল সাদাটে রঙ ধারণ করে।
মরিচ শুকানোর সময় মরিচের বোঁটা যেন খুলে না যায়। সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। মরিচ শুকানোর পর মাচার উপরে টিনে ডোল, গোলা, পলিথিন বা ড্রামে করে রাখতে হবে।
বীজ উৎপাদন
মরিচ স্বপরাগায়িত জাত। মানসম্মত বীজ উৎপাদন করতে হলে বীজ ফসলের জমির চারা পাশে অন্তত ৪০০ মিটারের মধ্যে মরিচ, বেগুন, টমেটো এর চাষ যে জমিতে করা হয়েছে সে জমিতে মরিচের চাষ করা যাবে না।
বীজ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কলাকৌশল অনুসরণ করলে প্রতি বিঘায় ১০ কেজি বীজ উৎপাদন করা সম্ভব।
রোগ
মরিচের এনথ্রাকনাজ ডাইব্যাক ও ব্যাকটেরিয়া রোগ হয়। রোগ হলে মরিচ হলুদ বর্ণ ধারণ করে ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে কীটনাশক হিসেবে ডায়াজিনন প্রয়োগ করা যেতে পারে।
জাত
মরিচের ভালো ফলন পেতে হলে উপযুক্ত হাইব্রিড জাত যেমন প্রিমিয়াম, মনিক, মেজর, ভিগর এগুলো নির্বাচন করতে হবে।
মরিচের অনেক জাতের মধ্যে এখানে ‘প্রিমিয়াম হাইব্রিড’ নিয়ে আলোচনা করা হলো-
জাতের বৈশিষ্ট্য
প্রিমিয়াম উচ্চফলনশীল হাইব্রিড জাত। এটি মধ্যম আকৃতির ঝোপালো গাছ। অনেক ঝালযুক্ত। শীতকালে আবাদ করা যায়। এ ছাড়া কাঁচা পাকা দুভাবেই ব্যবহার হয়।
বীজ
বপনের সময়
ভাদ্র-আশ্বিন মাস বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।
বীজের পরিমাণ
প্রতি শতকে ১.৫ গ্রাম ও একরে ১৫০ গ্রাম। বীজতলায় চারা উৎপাদন ৩ী১ মিটার মাপের ও ১৫ সেমি. উঁচু বেড?তৈরি করতে হবে। বীজতলার উপরের সত্মরে পচা গোবর, আবর্জনা সার এবং দো-আঁশ মাটির মিশ্রণ ছড়িয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া ৩/৪ সপ্তাহ মোটা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখে মাটি শোধনের পর ৫ সেমি. পর পর লাইন করে ১ সেমি. গভীরতায় ২.৫ সেমি. দূরে দূরে বীজ বপন করতে হবে।
প্রতিটি বীজতলার জন্য ১০ গ্রাম বীজ ব্যবহার করা যাবে। বীজ বপনের পর বীজের ওপর কিছু ঝুরঝুরে মাটি ছড়িয়ে দিতে হবে। অতি বৃষ্টি বা রোদের ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য মাটি থেকে কমপক্ষে ৩০ সেমি. ওপরে পলিথিন বা চাটাই দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। চারা গজানোর ১২ দিন পর একবার এবং ২০ দিন পর আর একবার ৫০ গ্রাম ডাইথেন এম -৪৫ ও ২০ মিলি, ডাসবান ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে বীজতলায় সেপ্র করতে হবে।
চারা রোপণ : ২৫-৩০ দিন বয়সের ৫/৬টি পাতা বিশিষ্ট স্বাস্থ্যবান চারা ১ মিটার প্রশস্ত বেড তৈরি করে সারি থেকে সারি ৭৫ সেমি. এবং চারা থেকে চারা ৭৫ সেমি. দুরত্ব বজায় রেখে রোপণ করতে হবে।
দুই বেডের মাঝে ৪০ সেমি. প্রশ্থ ও ১৫ সেমি. নালা করতে হবে।
সার প্রয়োগ
জমি তৈরির সময় এবং পরবর্তীতে ফসলের অবস্থা বুঝে কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শঅনুযায়ী উপরি সার প্রয়োগ করতে হবে।
ফসল সংগ্রহ ও ফলন
চারা রোপণের ৭০-৭৫ দিনের মধ্যে মরিচ সংগ্রহ শুরু করা যায়। কাঁচা অবস্থায় প্রতি শতাংশে ১০০-১২০ কেজি এবং একর প্রতি ১০-১২ টন ফলন পাওয়া যায়।
অন্যান্য কার্যাবলী
১।
প্রথমত ৩/৪টি শাখাপ্রশাখা ছাঁটাই করতে হবে।
* আগাছা দমন ও সেচ নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
* রোগবালাই দমনে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
* খুঁটি ব্যবহার করে গাছকে মাটিতে হেলে পড়া থেকে রক্ষা করতে হবে।
২।
উপরোক্ত পদ্ধতিতে উন্নতমানের হাইব্রিড জাতের মরিচ চাষ করলে ভালো ফলন অবশ্যম্ভাবী। নিয়ম অনুযায়ী চাষ করলে একজন কৃষক নির্বিঘ্নে অধিক লাভবান হতে পারবেন।
তাছাড়া মরিচ এমন একটি মসলা যা তরকারি, আচার কিংবা মুখরোচক অন্য কোনো খাবার তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়। চাষি ভাইয়েরা সঠিক ভাবে মরিচের চাষ করলে বাজারে যেমন চড়া দামে বিক্রি করতে পারবেন তেমনি ঘরের প্রয়োজন মিটিয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারবেন।
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ।
তাই আমাদের উচিত সুন্দরভাবে ফসল ফলিয়ে বিদেশ থেকে আমদানি না করে দেশের ফসল দিয়ে দেশের মানুষের প্রয়োজন মিটিয়ে দেশকে উন্নতির দিকে ধাবিত করা।
***
তথ্যসূত্র: অনামিকা সরকার, ডিপ্লোমা কৃষিবিদ, লালতীর সীড লিমিটেড। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।