চোখের দেখা , মনের কল্পনাঃ আমার লেখা ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখাটা একটা অতিসাধারণ ব্যাপার । কিন্তু রক্তিম আজকাল একঘুমে এতো স্বপ্ন দেখছে যে সে নিজেই অবাক হয় !
চেনা মানুষ , অর্ধচেনা মানুষ কাউকেই সে ফিরিয়ে দেয়না তার স্বপ্নের দরজা থেকে ।
বিকেলের সূর্যটা তখন আবছা মেঘেদের কাছ থেকে বিদায়ী সম্বর্ধনা নিচ্ছে । রক্তিম তখনো ঘুমাচ্ছে । বৈকালিক ঘুম ।
একটা চমৎকার স্বপ্ন চলছে ।
"একা একা কোথায় হাঁটছে জানেনা । কোত্থেকে আসা বাতাস যেন ওকে উড়িয়ে নিয়ে চলেছে প্রায় । একটা নদী পার হল । মাঝির মুখ দেখা গেলো না ।
নৌকা থেকে নেমে দেখে সামনে একটা সবুজ বন । ঘনসবুজ বনে ঢুকতে যাবে মাত্র । পা বাড়িয়েছে ......... । । "
আর তখনি যেন কে পেছন থেকে ডাক দিলো !
- ওঠ , ওঠ ।
আর কতো ঘুমাবি !
মায়ের উপর ভীষণ রাগ হয় ওর । প্রায় সময়ই মাঝপথে স্বপ্ন ভেঙে দেয় মা টা !!
কিন্তু মায়ের পরের কথাটা শুনেই সমস্ত রাগ চলে গেলো ।
-দেখ , দেখ ... মেঘ করসে ! বৃষ্টি আইতে পারে !
একলাফে বিছানা থেকে উঠলো রক্তিম। বারান্দায় গিয়েই দেখে অনেকখানি মেঘ জড়ো হয়েছে । সন্ধ্যার আর বেশি বাকি নেই ।
সন্ধ্যাবেলা মেঘ করে ঝরে পড়া বৃষ্টিকে কেন জানি বেশি আপন মনে হয় । সকালবেলার এতো কোলাহলে মেঘ বা বৃষ্টি কোনটাকেই আপন মনে হয়না । সন্ধ্যার একটা অদ্ভুত নির্জনতা আছে। সেই একাকীত্বে , নির্জনে বৃষ্টিকে মনের ঘরের সদস্য মনে হয় ।
আজ মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে ঝুপ করে অন্ধকার নামলো ।
কে কার আগে অন্ধকার করতে পারে সেই প্রতিযোগিতায় মেঘ আর সন্ধ্যার প্রথম আঁধারকে যুক্তভাবে বিজয়ী ঘোষণা করলো রক্তিম ।
আজকাল ২৪ ঘণ্টার ভেতর ১৮ ঘণ্টাই মন রক্তিমের মন খারাপ থাকে। কারো একটা খোঁচামারা কথায় মনটা অস্বাভাবিক খারাপ হয়ে যায় । আসলে রক্তিম কেমনজানি বোকা হয়ে গেছে । আগে এমন ছিল না।
এখন পড়াশোনায় মন বসাতে পারেনা । আগেও পারতো না তবে এতোটা অবনতি হয়নি । এখন অবনতি ছাড়া উন্নতি হচ্ছেনা । বাইরে বাইরে থাকতে পছন্দ করেনা । ক্লাসে গেলে যে হাসিটা ওর মুখে লেগে থাকে সেটা মন থেকে আসেনা ।
মেকি । লোক দেখানো হাসি ।
মন খারাপ করে থাকতে জানি কেন খুব বেশি ভাল লাগে ! ওর নিজেরই মনে হয় যে ও যেন পাগল হয়ে যাচ্ছে অথবা গেছে !
যাকে ২ দিনও চিনেনা তাকে বন্ধু ভেবে বসে থাকে । মনে করে বন্ধুটি পাশে থাকলেই জীবনটা আরও সুন্দর হয়ে উঠবে । সেই স্বল্পচেনা বন্ধুটি হঠাৎ এমন এক আঘাত করে বসে যে সেটা একদম মনে গিয়ে বাজে ।
ওর মনটা একটা নির্জন জায়গা । বেশি ভিড় নেই । তাই আঘাত বা আদর যেটাই পায় সেটাই মনে গিয়ে লাগে ।
এই লাগাতার মন খারাপের ভিড়ে বৃষ্টিটাকেই একমাত্র সমঝদার সঙ্গী মনে হয় । শীতের পর থেকেই এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করে ছিল ।
বৃষ্টি ওকে আক্ষরিক অর্থেই পাগল করে দেয় ।
আজ হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবেই মেঘ করলো । বৃষ্টি শুরু না হতেই মাকে না জানিয়ে চুপচাপ উঠে গেলো ছাদে ।
ওদের বাসা থেকে নদীটা দেখা যায়। নদীর ওপারে সামান্য কিছু ঘরবাড়ী আর অনেক অনেক সবুজের সমারোহ।
রক্তিম অবাক চোখে দেখতে লাগলো প্রকৃতির কাণ্ডকারখানা – পূবের আকাশটা একদম কালো হয়ে গিয়েছে । তার নিচে সবুজ গাছগুলো আরও উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন কালো ক্যানভাসে সবুজের তুলি বুলিয়ে গেছে । আর গাছগুলোর পায়ের কাছেই থমথমে নদী। উত্তাল হবার অপেক্ষায় আছে।
পশ্চিম দিকে তাকাল কেন জানি ! খেয়াল করলো পশ্চিমাকাশে সূর্যাস্তের লাল হলদে আভা এখনও লেগে আছে।
অর্ধেক আকাশ মেঘের দখলে আর অর্ধেক অস্তগামী সূর্যের !!
এত চমৎকার দৃশ্য কখনোই ভোলার নয় !
ইদানিং ওর মা বলে ও নাকি পাগল হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলেই ছাদে দৌড়ায় ; সেটা সকালেই হোক , সন্ধ্যায়ই হোক আর রাতেই হোক । ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। শেষমেশ কান ধরে নিয়ে আসতে হয়।
বাসায় আসার পর শুরু হয় মা ছেলের রাগারাগি পর্ব ।
কারো সাথে কথা বলতে ভাল লাগেনা। নিজের ঘর আর ছাদের মাঝেই আটকে থাকে রক্তিম ; আটকে রাখে আরকি। কারো সাথে কথা বলতে গেলে নিজের অপটুতায় পদে পদে লজ্জিত হয়। তাই আরও বেশি করে নিজেকে গুটিয়ে নেয়।
আর মনের যত ঝাল , যত রাগ অভিমান – সব ঝাড়ে মা বাবার ওপর । ওরাই তো একমাত্র আপন। সবার দেয়া আঘাতগুলো ওর এই রাগের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
তাই রক্তিমের দুই রূপ দেখতে পায় ওর মা বাবা। একেবারে শান্ত আর মাঝে মাঝে বিধ্বংসী ।
এতোখানি হতাশা কোত্থেকে আসলো সেটা ও নিজেই ভেবে পায়না। এখন মনে হয় এভাবে ধুঁকে ধুঁকে চলার চেয়ে একেবারে থেমে যেতে পারলেই ভালো হত !
মেঘগুলো প্রথম প্রথম ওর উপর অভিমান করে থাকে। ওর বাসার ছাদে ফোঁটা ফোঁটা করে বৃষ্টি নামে। ওর বিরক্ত লাগে। বাতাস বইছে জোরেশোরে ।
৫-১০ মিনিট পরে ঐ পশ্চিম থেকেই আস্তে আস্তে শব্দ করে ছুটে আসে বৃষ্টির ধারা। সব অভিমানের সমাপ্তি ঘটিয়ে রক্তিমের সাথে মিশে যায়। ও আকাশের দিকে মুখ তুলে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
কিছুক্ষণ পর ছাদের কোণায় লাগানো মায়ের হাতের কাঠমালতী , গন্ধরাজ আর জবা গাছের সামনে যায়। অসম্ভব সুন্দর লাগছে ওগুলোকে ।
গাছগুলো সূর্যতাপে হতাশাগ্রস্ত হয়ে মিইয়ে পড়ে , বৃষ্টির ছোঁয়ার আবার প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
রক্তিমও ওদের মত হতে চায়। কিন্তু হাসিখুশি জিনিসটা যেন হারিয়ে গেছে। আর ফিরে আসছেনা। এমন কেন হয় ? কাকে যেন প্রশ্ন করে।
উত্তর পায় না ।
অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। উল্টোপাল্টা নেচে নেচে ধেয়ে আসছে। বাতাসের তোড়ে কয়েক পা সামনে এগিয়ে গেল রক্তিম।
হঠাৎ কি জানি কেন ছাদে শুয়ে পড়লো হাতদুটো দুপাশে ছড়িয়ে।
আগের থেকে ভালো লাগছে এখন। আরও আপন মনে হচ্ছে বৃষ্টিকে । বৃষ্টির শব্দটা অদ্ভুত সুন্দর লাগে ! ওর ভেজা জামায় একটা ভারী শব্দ করে আছড়ে পড়ছে।
এভাবে অনেকক্ষণ শুয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালো।
আজ একটু বেশিই বাজ পড়ছে।
রক্তিমের যেন বুদ্ধিলোপ হয়েছে। দাঁড়িয়েই আছে ............
হঠাৎ চোখের সামনে দিয়ে একটা সুতীব্র আলোর ঝলকানি খেলে গেলো। আকাশটা চিরে গেলো যেন ।
তারপর আরেকটা বিশাল ...... বিশাল বাজ পড়লো। একটা বোমাও এত শব্দ করতে পারে না বোধহয় ।
═══════════════
বিদ্যুৎ নেই। রক্তিমের মা ভেবেছে হয়তো অন্ধকারে শুয়ে আছে ও । কিন্তু গিয়ে দেখে নিজের ঘরে নেই ও। সব জায়গা খুঁজে বুঝতে পারলো নিশ্চয়ই ছাদে গেছে । রাগ সামলাতে না পেরে ছাদে উঠে এলো ।
দেখে ঠিক মাঝখানটায় তখনো দাঁড়িয়ে আছে ফাজিল ছেলেটা ।
- ওই ছেঁড়া ! জলদি আয় ! ...... আয় !! আয় কইতাসি!!!
ডাকাডাকিতে কাজ হবেনা। তাই ছাতিটা মাথায় ধরে ওর পেছনে গিয়ে কানটা ধরলো ওর । ঝাঁকুনি খেয়ে রক্তিমের নিথর দেহটা সশব্দে লুটিয়ে পড়লো ভিজা ছাদে।
এইতো আধাঘণ্টা আগেও রক্তিম ভাবছিলো – কখনও তো বইয়ের শেষ চ্যাপ্টারটা ভালো করে শেষ করা হয়নি।
জীবনের শেষ চ্যাপ্টারটা না চাইলেও শেষ করতে হবে ।
শেষ অধ্যায় শেষ করার আনন্দে রক্তিমের মুখে তখনো একটুকরো হাসি লেগে আছে।
• • • • • • • •
*** সেফ হবার আগে লেখাটি ২ পর্বে দেয়া হয়েছিল । কিন্তু আসলে এক পর্বেই শেষ করা যায় । সেফ না হওয়াতে অনেকের চোখে পড়েনি তাই পুনরায় দেয়া হলো ।
এইজন্য মাফ চাইছি ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।