বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদে পেশ ইমাম নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদপত্র দিয়ে আবেদন করা দুই ব্যক্তিকে পেশ ইমাম পদে নিয়োগ দেয়ায় তোলপাড় চলছে জাতীয় মসজিদে। এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞাকেও তোয়াক্কা করা হয়নি। নিয়োগ পাওয়া ইমামদের একজন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বর্তমান মহাপরিচালক সামীম মো. আফজালের ভাগ্নে। অপরজন ঢাকার একজন এমপি’র নিকট আত্মীয় এবং তার মালিকানাধীন বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সাবেক কর্মী।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিয়োগপ্রাপ্ত দুই ইমামই আবেদনপত্রের সঙ্গে ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তা পদে ৮ বছরের চাকরির ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদপত্র দাখিল করেছেন। প্রাথমিক বাছাইয়ে তাদের প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তাদের অনুকূলে ইন্টারভিউ কার্ড ইস্যু হয় এবং চূডান্তভাবে তারাই নিয়োগ লাভ করেন। অত্যন্ত মর্যাদাশীল এ পদটিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একটি চাতুর্যপূর্ণ বিজ্ঞপ্তির কারণে খুব কম সংখ্যক আবেদনপত্র জমা পড়ে। বিজ্ঞপ্তিতে পেশ ইমাম পদটিকে বলা হয় ২য় শ্রেণীর পদ।
আবার অভিজ্ঞতা হিসেবে চাওয়া হয় ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তা পদে ৮ বছর চাকরির অভিজ্ঞতা। বিজ্ঞপ্তিতে পদটিকে দ্বিতীয় শ্রেণীর পদ বলা হলেও দুই ব্যক্তির নিয়োগপত্রে তাদের শুধু প্রথম শ্রেণী নয় বরং সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার স্কেল দেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, নিয়োগ পরীক্ষার সময় বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে বায়তুল মুকাররম মসজিদের খতিব প্রফেসর মাওলানা মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক ড. আবদুল্লাহ আল মারুফ এবং মূল সদস্য ফাউন্ডেশনের সচিব রেজাউল করিমসহ সংস্থার ১নং সিলেকশান কমিটির ১৪ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। সদস্যবৃন্দ সর্বসম্মতিক্রমে আবেদনকারীদের মধ্যে কোন উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া গেল না এবং প্রার্থীরা কেউই বায়তুল মোকাররমের ইমাম হওয়ার উপযুক্ত নয় বলে পুনরায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচারের জন্য সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এরপরও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মো. আফজাল ১নং সিলেকশান কমিটির সিদ্ধান্তের বিপরীতে নিজের মতো করে কর্মপত্র তৈরি করেন।
তারপর ১নং সিলেকশান কমিটি অর্থাৎ নিয়োগ কমিটির মূল সদস্যদের বাদ দিয়ে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ৫ জন বোর্ড সদস্যের স্বাক্ষর নিয়ে নিয়োগপত্র ইস্যু করেন। এ ৫ বোর্ড সদস্যের একজন এমপি, দু’জন দু’টি ইসলামী রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং দু’জন ক্ষমতাসীন রাজনীতির সঙ্গে জডিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। এরা সংস্থার পরিচালনা পর্ষদ বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য- সে সঙ্গে তারা নিয়োগ কমিটিরও সদস্য হয়েছেন নিজেরা মিলে অনুমোদন করে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন অ্যাক্ট অনুসারে বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্যবৃন্দ জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে কেবল অনুমোদনকারী, কোন ক্রমেই নিয়োগ সুপারিশকারী কর্তৃপক্ষ নন। আলোচ্য নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫ জন বোর্ড সদস্য একাধারে সুপারিশকারী কর্তৃপক্ষ।
আবার অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করেছেন।
তবে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির অভিযোগে মহাপরিচালক সামীম মো. আফজালের প্রস্তুত করা কর্মপত্রে নিয়োগ কমিটির সদস্যসচিব তথা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সচিবসহ ধর্ম, অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সরকারি প্রতিনিধি সদস্যদের কেউই স্বাক্ষর করেননি। বিশেষজ্ঞ সদস্য বায়তুল মুকাররম মসজিদের খতিব প্রফেসর মাওলানা মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক ড. আবদুল্লাহ আল মারুফও স্বাক্ষর করেননি। সমপ্রতি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মো. আফজাল সচিবকে বাদ দিয়ে অতি গোপনে উক্ত দুই ব্যক্তির অনুকূলে নিয়োগপত্র ইস্যু করেন এবং তাদের ডেকে যোগদানপত্রে স্বাক্ষর করান। ইসলামিক ফাউন্ডেশন অ্যাক্ট ১৯৭৫-এর অনুচ্ছেদ ১০(১) অনুসারে নিয়োগ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ সচিবের সম্পাদন করার কথা থাকলেও আলোচ্য নিয়োগের ক্ষেত্রে মহাপরিচালক তাকে বাদ দিয়েই এ নিয়োগ সম্পন্ন করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত এক ইমামকে ঢাকার বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ, অন্যজনকে চট্টগ্রাম আন্দরকিলা শাহী জামে মসজিদে ইতিমধ্যে পোস্টিং দেয়া হয়েছে। বায়তুল মুকাররম মসজিদে যোগদানকারীর নাম মাওলানা এহসানুল হক। তিনি ২০০৫ সালে ঢাকার মালিবাগ জামেয়া শরীয়া মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস এবং ২০০৬ সালে ইফতা সম্পন্ন করেছেন। এর মাত্র ৫ বছর পার হতেই তিনি ৮ বছরের ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তার ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদ দিয়ে চাকরির আবেদন করেন। তবে তিনি কখনওই ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তা পদে চাকরি করেননি।
তাছাড়া দাওরায়ে হাদিস পাস করে কোন দিন ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তা পদে চাকরি পাওয়া যায় না। তার আবেদনপত্রটি প্রাথমিক বাছাই কমিটি বাতিল করে দিয়েছিল। পরে ইফা’র মহাপরিচালক সামীম মো. আফজালের নির্দেশে তার ইন্টারভিউ কার্ড ইস্যু করা হয়। মাওলানা এহসানুল হক ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বর্তমান মহাপরিচালক সামীম মো. আফজালের বড় বোনের ছেলে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম আন্দরকিলা শাহী জামে মসজিদে পেশ ইমাম হিসাবে যোগদানকারী মাওলানা আনোয়ারুল হক ২০০১ সালে চট্টগ্রামের পটিয়া মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন।
তিনি ২০০৬ সালে মিশর থেকে ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। তার ইমামতির অভিজ্ঞতা থাকলেও ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তা পদে চাকরির অভিজ্ঞতা নেই। তিনি ঢাকার একজন এমপির নিকট আত্মীয় এবং তার মালিকানাধীন বেসরকারি টিভি চ্যানেলে কাজ করছিলেন। এই দুই ব্যক্তিকে নিয়োগের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রচার করা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতেও কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়। ধর্ম ও অর্থ মন্ত্রণালয় ২০০৬ সালে ইফা বোর্ড অব গভর্নরসের সুপারিশের প্রেক্ষিতে পেশ ইমাম পদটিকে সরকারের সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদায় উন্নীত করেন এবং নিয়োগের জন্য বয়সসীমা করা হয় ৪০ বছর।
কিন্তু ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পেশ ইমাম পদটিকে বলা হয় ২য় শ্রেণীর পদ। আবার পদটির জন্য অভিজ্ঞতা হিসেবে চাওয়া হয় ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তা পদে ৮ বছর চাকরির অভিজ্ঞতা। বিজ্ঞপ্তিতে পদটির জন্য বয়স সর্বোচ্চ ৪০ না লিখে লেখা হয় ৩০ বছর। এতে বহু মাদরাসার প্রিন্সিপ্যাল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অত্যন্ত মর্যাদাশীল এ পদটিতে আবেদন করতে পারেননি। তাছাড়া ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তা পদে ৮ বছর চাকরি করার পর কেউ ২ শ্রেণীর কর্মকর্তা পদে চাকরি করতে আসবেন না।
ফলে অত্যন্ত কম আবেদন জমা পড়ে। আর এ সুযোগে আলোচ্য ২ ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া হয়। ওদিকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পেশ ইমাম পদটিকে ২য় শ্রেণীর কর্মকর্তা কেন লেখা হয়েছে আবার নিয়োগপত্রে সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার অর্থাৎ ১৮,৫০০-২৯,৭০০ টাকা বেতন স্কেল দেয়া হয় তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদে পেশ ইমাম নিয়োগের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে একটি মামলা বিচারাধীন। আর এ ধরনের বিচারাধীন বিষয় সমাধান হওয়া পর্যন্ত নিয়োগ বন্ধ রাখার সরকারি বিধান থাকলেও এ ক্ষেত্রে মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল ওই বিধান অমান্য করে তার বোনের ছেলেসহ দু’জনকে নিয়োগ দেন।
বিগত ৩ বছর ধরে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজালের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। বিচার বিভাগীয় এ কর্মকর্তার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ধর্ম মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত টিম গঠন করলেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক শ্রেণীর কর্মকর্তার চাপে তা বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে ইফা প্রেসে ১৮ মাসে সাড়ে ৩ কোটি টাকা আত্মসাতের একটি অভিযোগ তদন্ত করছে। কিছুদিন আগে তার ভাইয়ের ছেলে শাহ আলমকে ভুয়া শিক্ষাগত সার্টিফিকেট এবং ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদপত্র দিয়ে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা পদে নিয়োগের অভিযোগ ওঠে। প্রতিষ্ঠানটিতে ৪৭ জন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা নিয়োগের সময় মহাপরিচালক তার বোনের মেয়ে-ভাইয়ের ছেলে সহ বহু আত্মীয়কে নিয়মবহির্ভূতভাবে চাকরি দেন বলেও অভিযোগ আছে।
সূত্র: মানবজমিন ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।