৬ বছর আগের কথা। তখন ফুটবল বিশ্বকাপের সময়। ফুটবল উপলক্ষ্যে যথারীতি ক্যাম্পাসে একটা হট্টগোল, অতঃপর পরীক্ষা স্হগিত। সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হয়েছিলাম আমরা, যাদের ঐ একটা পরীক্ষার জন্য সার্টিফিকেট আটকে গেল।
হলে ছিলাম, ২-১টা টিউশনি করাতাম, তাই লম্বা বন্ধের মাঝেও বাড়ি যাওয়া হয় নাই ছাত্রের পরীক্ষার কারণে।
কিন্তু একদিন বাড়ী থেকে ফোন আসল, আব্বার শরীর ভালো নয়, পরীক্ষার আগে এসে একবার ঘুরে যাও। বাড়ীতে গেলাম, ২ দিন ছিলাম। ফুটবল খেলা দেখা, ভাই বোনদের সাথে গল্প করা এই সবে ২ দিন কিভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। ঢাকায় চলে আসলাম রাতের বাসে। সারারাত ঘুম হলো না ঠিক মতো।
সকালে এসে ঘুম দিলাম, বিকালে টিউশনিতে গেলাম। রাত ৯ টার দিকে হলে ফেরত আসলাম। একটু পরে আবার বড় আপার ফোন, '' আব্বার শরীর খারাপ, তুমি চলে এসো। '' রাতে খেয়ে ১০টার দিকে ফকিরাপুলে চলে গেলাম তাড়াতাড়ি, বাসের টিকেট পেলাম রাত ১১.৩০ এর দিকে। কাউন্টারে বসে আসি।
আবার আপার ফোন এল, '' তুমি কি টিকেট করেছো? তুমি কি বাড়ি আসছো? আব্বার শরীর অনেক খারাপ, এখন হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে, তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো চলে এসো। ''
এরপর আমি আবার আপাকে ফোন দিচ্ছি, ফোন রিসিভ করছে না। বড় ভাইকে ফোন দিলাম, ফোন রিসিভ করছে না। আমার চিন্তা বাড়তে লাগলো। আবার ফোন করলাম, একবার ভাইয়ার কাছে, আর একবার আপার কাছে, কেউ রিসিভ করে না।
আবার মনে হলো, হাসপাতালে হয়ত মোবাইলে কথা বলতে সমস্যা, তাই কেউ ফোন রিসিভ করছে না। ইতিমধ্যে বাসে উঠে পড়েছি, বাসও চলতে শুরু করেছে। একটু পর আপা ফোন করলো।
'' আব্বা আর নেই, তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো। '' আর কিছু বললো না।
আমি এখনো ভাবতে পারছি ঐ রাতের কথা। আমার বুক ফেটে কান্না আসছিলো। বড় হওয়ার পর কখনো কাঁদি নাই। কিন্তু এইবার আমার দম বন্ধ একটা অবস্হা, তারপর গুমড়ে কান্না। বাসের অর্ধেক মানুষে ভর্তি, পিছনে অনেকগুলো সিট ফাঁকা।
একদম পিছনে চলে গেলাম, তারপর হাউ মাউ করে কান্না। কখনো গুমড়ে কান্না, কখনো চিৎকার করে কান্না, মাঝে মাঝে বিভিন্ন আত্মীয় স্বজন ফোন করা শুরু করলো। অনেকেই সান্তনা দিচ্ছিলো, কিন্তু যার যায় সেই বুঝে। প্রায় ৩ ঘন্টা কান্না করেছিলাম। আমার বুকে এতো কান্না জমা ছিলো, সেটা আগে কখনো বুঝতে পারি নাই।
এর আগে অনেককে মারা যেতে দেখেছি, দেখেছি তাদের আত্মীয় স্বজনদের কান্না। তারা এতো কিভাবে কান্না করতো, সেটা বুঝতাম না। যখন আব্বা মারা গেল, তখন বুঝলাম, আমি কি হারিয়ে ফেলেছি। আব্বা সবসময় মাথার উপর একটা ছায়া হয়েছিলো। মনে হলো, একধাক্কায় সেই ছায়াটা সরে গেল।
খুব অসহায় মনে হচ্ছিলো।
আব্বা মারা গিয়েছিলো ৭৩ বছর বয়সে, কিডনীর সমস্যা ছিলো, ডায়াবেটিসও ছিলো। কিডনীর সমস্যাটা যখন ধরা পড়লো, তখন লাস্ট স্টেজে, ৮০% ড্যামেজ। ডাক্তার বললো, ডায়ালায়সিস করলে কিছুদিন হয়ত সারভাইব করতে পারবে। তবে রক্ত পরিবর্তন করে উনার শরীর এলাউ করবে না।
আর এই বয়সে কিডনী প্রতিস্হাপনও সহ্য করবে না।
কতদিন, সেটা আমরা জানতাম না। [ডাক্তার সাহেব ভাইকে বলেছিলো, ৬ মাস বড়জোড়, ভাই আমাদের কাউকে সেটা জানায় নাই]। তবে সেটা সাধারণ ডায়ালাইসিস নয়, পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিল ।
পেটে অপারেশন করে কিডনির সাথে একটা নল লাগিয়ে দেওয়া হবে।
ঐ নল দিয়ে ২ লিটার করে বিশেষ ধরণের ফ্লুইড প্রতিদিন ৩ বার করে ঢুকাতে হবে, আবার বের করতে হবে। এবং সারদিনও পেটে ২ লিটার ফ্লুইড নিয়ে থাকতে হবে। একবার ডায়ালাইসিস করার সময় আগের দুই লিটার ফ্লুইড বের করে পুনরায় নতুন ২ লিটার পেটে ঢুকিয়ে দিতে হতো। পুরো কাজে সময় লাগতো প্রায় দেড় থেকে ২ ঘন্টা করে। এইভাবে দিনে ৩বার।
ডায়ালাইসিস করার সময় রোগী এবং সাহায্যকারী ২জনকেই সার্জিক্যাল মাস্ক পড়তে হতো, ফ্যান চালানো যেতো না, রুমের দরজা জানালা বন্ধ রাখতে হতো। কারণ পেটের সাথে সংযুক্ত ঐ নলে খুব সহজেই জীবানু আক্রমণ করতে পারে।
ডায়ালাইসিস করার জন্য বারডেমে অপারেশন করা হয়েছিলো। আমার এখনো মনে আছে, অপারেশন থিয়েটার থেকে যখন আব্বাকে বের করে আনা হয়েছিলো, আব্বার চোখে পানি, মনে হচ্ছিলো, অনেক কষ্ট পেয়েছেন। আমি একটা হাত দিয়ে আব্বার হাতটা ধরলাম, আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখলো আব্বা।
বললো, এনেস্হেসিয়া ঠিক মতো কাজ করে নাই, খুব ব্যাথা পাচ্ছেন। তখন আমার মনে হলো, আমার হাতটা শক্ত করে ধরে আব্বা বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন খুজছেন।
পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস খুবই দামি প্রক্রিয়া। যে ফ্লুইড একবার শরীরে দেওয়া হয়, সেটা বের করে আবার নতুন ফ্লুইড দিতে হয়, প্রতিবার ২ লিটার, নতুন করে। একব্যাগ ফ্লুইডের দাম ছিলো ২৫০ টাকা।
দিনে ৩ ব্যাগ, এইভাবে প্রতিদিন।
এর সাথে নানা শারিরীক সমস্যাও দেখা দিতো। শরীরে ২ লিটার ফ্লুইড ঢুকানোর পর দেখা গেলো, বের হচ্ছে দেড় লিটার। বাকীটা শরীরে রয়ে যাচ্ছে, শরীর ফুলে যাচ্ছে। তখন আবার অন্য ঔষুধ খেতে হতো, সাথে দিনে ৩বার ইনসুলিন নিতে হতো।
হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার কারণে মাঝে মাঝে ইনজেকশনও দিতে হতো। দৈনিক ঔষুধ বাবদই খরচ হতো প্রায় এক হাজার টাকা। কিন্তু এটা অনেক টাকা মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য। পরে কখনো কখনো দিনে ২বার করা হলো, কখনো কখনো ১ বার। টাকার অভাবে ঠিক মতো ডায়ালইসিস করানো যাচ্ছিলো না, সেটা সবাই বুঝতে পারছি, কিন্তু কেউ মুখ ফুটে বলতে পারছি না, মনে হচ্ছিলো, এটাই স্বাভাবিক।
ডায়ালইসিসের জন্য অপারেশন করার পর আব্বা বেঁচে ছিলেন ২ বছর। বারডেমের যে ডাক্তার অপারেশন করিয়েছিলেন, তিনি বললেন, এই ধরণের ডায়ালাইসিসে অনেক ঝামেলাও হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পেটের সাথে লাগানো ঐ নলে ইনফেকশন হয়, পরে জটিলতা আরে বেড়ে যায়, শেষে ওটা খুলে ফেলা লাগে। কিন্তু আব্বার ক্ষেত্রে এমন কিছু হয় নাই, আমার বোন নিজে এক হাতে সবকিছু করেছে, আন্তরিকতার সাথে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সারাদিন আব্বার সাথেই থাকতো। একজন নার্সের পক্ষেও অতটুকু সময় দেওয়া সম্ভব নয়।
এখন যদি কোনো কিডনী রোগী দেখি, মনটা কেমন বিষিয়ে যায়। খুব মায়া হয়।
আব্বা মারা গেলেন আজ ৬ প্রায় বছর হতে চললো, আব্বা অনেক কিছু দেখে যেতে পারেন নাই, ২ ভাই এর ২টা ছেলে সন্তান হলো, আমার পড়ালেখা শেষ করে চাকুরীতে ঢুকা এবং বিয়ে, বড় বোনের বিয়ে, বড় ভাইএর ভালো একটা চাকুরী.. কিছুই দেখে যেতে পারলো না। আজ আব্বা থাকলে হয়ত অনেক খুশি হতো। আবার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি ছিলো না, তাই আব্বা সবসময় আমাদের ভাইবোনদের পড়ালেখার উপর খুব জোড় দিতো।
আব্বা বলতো, '' আমার ছেলেমেয়েরাই আমার সম্পদ, আমার জায়গা জমি দরকার নাই''। জাগতিক বিষয় সম্পত্তি নিয়ে আব্বার তেমন আগ্রহ ছিলো না, সব খরচ করেছেন আমাদের জন্যই। গ্রাম থেকে শহরে আসলেন, আমাদের শহরের স্কুলে ভর্তি করালেন, ভাইবোন সবাইকে গ্রাজুয়েট করিয়েছেন। এটাই আব্বার আনন্দ।
জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে আব্বার ৬ষ্ঠ মৃত্যু বার্ষিকী।
আমার আব্বার জন্য সবাই দোয়া করবেন, যেন আল্লাহ তাঁকে বেহেশতবাসী করেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।