ফারিয়াজ দেশে উত্পাদিত রড ও স্টিলের প্রায় পুরোটাই নিম্নমানের। দাম কম হওয়ায় বাজারে নিম্নমানের রডের চাহিদাই বেশি। এতে ইমারত অবকাঠামোর স্থায়িত্ব যেমন কমছে, তেমনি ভূমিকম্পে ক্ষতির
ঝুঁকিও বাড়ছে।
ভার সহ্য করার ক্ষমতার পাশাপাশি ওজন কতটা কম, তার ওপর নির্ভর করে রডের গুণগত মান। এ গুণগত মান নির্ণয়ের একক হলো মেগা প্যাসকেল (এমপিএ)।
পশ্চিমা দেশগুলোয় সাধারণত ১৩০ থেকে ১৮০ এমপিএ ক্ষমতাসম্পন্ন রড ব্যবহার করা হয়। উন্নয়নশীল দেশে ১০০ এমপিএর রড ব্যবহার করা হলেও বাংলাদেশে উত্পাদিত অধিকাংশ রডই ৫০ এমপিএর বেশি নয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ধাতব ও ধাতব প্রকৌশল বিভাগের (এমএমই) এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে রড ও স্টিল উত্পাদন প্রক্রিয়ায় অনুসরণ করা হয় না যথাযথ পদ্ধতি ও প্রযুক্তি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তির অভাবের পাশাপাশি অতি মুনাফার লোভে কাঁচামাল মেল্ট না করেই রড ও স্টিল তৈরি করা হয়। অবশ্য দু-একটি প্রতিষ্ঠান উত্পাদন প্রক্রিয়া কিছুটা উন্নীত করলেও তা আন্তর্জাতিক মানের নয়।
গবেষণা থেকে জানা যায়, উন্নত মানের স্টিল ও রড তৈরিতে প্রয়োজন— কন্টিনিউয়াস কাস্টিং মেশিন, ইন হাউস অপটিমাম ইমিশন স্পেক্ট্রামিটার (ওইএস), ইন্ডাকশন ফার্নেস ও উন্নত মানের স্ক্র্যাপ ইয়ার্ড। পাশাপাশি উত্পাদন প্রক্রিয়ায় রিফাইনিং, ডিঅক্সিডাইজেশন, ডিগ্যাসিং ও অ্যালয় এডিশন— এ চারটি ধাপ নিয়মানুযায়ী যথাযথভাবে অনুসরণ করলে কেবল দেশে উত্পাদিত স্টিলের মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছবে।
দেশে প্রায় ৩৫০টি রি-রোলিং ও ১০০টিরও বেশি স্টিল মিল রয়েছে। এর মধ্যে বিএসআরএম, কেএসআরএম, বসুন্ধরা, বায়েজিদ, জিপিএইচ, রহিম স্টিল মিলসহ সর্বোচ্চ ১০টি প্রতিষ্ঠান উত্পাদনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানের ৫০-৭০ শতাংশ অর্জন করতে পারছে। এর দু-একটি প্রতিষ্ঠানের পণ্যের মান ৭০ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে বুয়েটের অধ্যাপক ড. মো. আমিনুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, উন্নত বিশ্বে ৫০ বছর মেয়াদি বাড়ি তৈরি করলে তা টেকে ১০০ বছরের বেশি। অথচ দেশে যদি একই মেয়াদের বাড়ি নির্মাণ করা হয়, তাহলে তা অর্ধেক মেয়াদেই ধ্বংস হতে শুরু করে। এর পেছনে অন্যসব কারণের মধ্যে নিম্নমানের রডের ভূমিকাই বেশি।
রড ও স্টিল উত্পাদনে কাঁচামাল হিসেবে জাহাজ ভাঙা ও দেশীয় বিভিন্ন শিল্পের স্ক্র্যাপ ব্যবহার হয়। অনেক ক্ষেত্রে স্ক্র্যাপ আমদানিও করা হয়।
উত্পাদন প্রক্রিয়ায় রয়েছে তিনটি পদ্ধতি। প্রথমত. মেল্টিং পদ্ধতিতে স্ক্র্যাপগুলো মেল্ট করার পর কাস্টিং বিলেট তৈরির মাধ্যমে সবচেয়ে উন্নত মানের রড তৈরি। এ পদ্ধতি অনুসরণ করে দেশের গুটিকয় প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয়ত. ইনগটস পদ্ধতিতে স্ক্র্যাপ রিফাইনিং ছাড়াই মাঝারি মানের রড ও বার তৈরি। এ পদ্ধতি অনুসরণ করে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
তৃতীয়ত. আমদানি করা বিলেট বা স্ক্র্যাপ সরাসরি হট রোলিং করে নিম্নমানের রড তৈরি। দেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই এ পদ্ধতির অনুসারী। ইনগটস ও স্ক্র্যাপ থেকে সরাসরি প্রস্তুত করা রড নির্মাণকাজে ব্যবহার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।
উত্পাদন প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে বিএসআরএমের নির্বাহী পরিচালক তপন সেনগুপ্ত জানান, একটা সময় পর্যন্ত দেশে স্ক্র্যাপ থেকে সরাসরি রড উত্পাদন হতো। তা পরিবর্তনে এগিয়ে আসে বিএসআরএম।
দেশের উন্নত অবকাঠামোয় ব্যবহারোপযোগী ও রফতানিযোগ্য রড উত্পাদন করছে প্রতিষ্ঠানটি। উন্নত মানের রড উত্পাদনের পুরোধা হিসেবে এর মানোন্নয়নে কাজ করবে বিএসআরএম।
বাংলাদেশ অটো রি-রোলিং অ্যান্ড স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, মেল্টিং প্রক্রিয়ায় বিলেট তৈরি করে এক টন রড উত্পাদনে খরচ হয় প্রায় ১৫ হাজার, ইনগটস প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ ১০ হাজার এবং হট রোলিং পদ্ধতিতে ৭-৮ হাজার টাকা।
দেশে মাত্র ১০টি প্রতিষ্ঠান অটোমেটেড বিলেট ও ২০টি সেমি-অটোমেটেড প্রতিষ্ঠান ইনগটস পদ্ধতি অনুসরণ করে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো হট রোলিং পদ্ধতিতে রড উত্পাদন করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খরচ কমাতেই প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নত মানের রড তৈরি করছে না।
এ বিষয়ে শাহরিয়ার স্টিল মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাংলাদেশ অটো রি-রোলিং অ্যান্ড স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান এসকে মাসাদুল আলম মাসুদ বলেন, দাম কম হওয়ায় নিম্নমানের রডের চাহিদা বেশি। বাড়তি চাহিদার সুযোগটিই নিচ্ছে দেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। ফলে যারা উন্নত মানের রড উত্পাদন করতে চায়, তারা দামের কারণে পেরে ওঠে না। এ জন্য উত্পাদনকারীর পাশাপাশি ব্যবহারকারীদেরও সচেতন হতে হবে।
দেশে বছরে উন্নত ও স্বল্পোন্নত রডের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৪০ লাখ টন। ৪০ লাখ টনই এখন দেশে তৈরি হলেও উন্নত মানের রডের পরিমাণ খুবই কম। এসব পণ্যের গুণগত মান তদারক করে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই)।
বিএসটিআইয়ের মহাপরিচালক এ কে ফজলুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশের শিল্পোন্নয়নসহ অবকাঠামগত উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে স্টিল ও রি-রোলিং মিলের উত্পাদিত পণ্যের গুণগত মানোন্নয়ন জরুরি। আর তা নিশ্চিত করা সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের নৈতিক দায়িত্ব।
কারখানা তদারকি, ল্যাব সুবিধা বাড়াতে সহযোগিতা, মানোন্নয়নে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ ছাড়াও রফতানি বাড়াতে বিভিন্ন দেশ থেকে সনদ পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক আয়রন অ্যান্ড স্টিল ইনস্টিটিউট (আইআইএসটি) সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাপী স্টিল উত্পাদন বাড়ছে। উত্পাদনে নেতৃত্বে দিচ্ছে এশিয়ার দুটি দেশ চীন ও জাপান। ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাপী স্টিল উত্পাদনের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩৪৪ মিলিয়ন টন, ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৫২৭ মিলিয়ন টন। ওই বছর চীন ৬৯৪ মিলিয়ন টন উত্পাদন করে শীর্ষে অবস্থান করে।
জাপান ১০৮ মিলিয়ন টন উত্পাদন করে দ্বিতীয় অবস্থান অর্জন করে। এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে ভারত ৭২, দক্ষিণ কোরিয়া ৬৯ ও তুরস্ক ৩৪ মিলিয়ন টন উত্পাদন করে। বাংলাদেশে পাঁচ বছর আগে উত্পাদন ৩০ লাখ টন হলেও গত বছর তা ৪০ লাখ টনে পৌঁছে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।