আজ অফিসে এসে পত্রিকা পড়ছিলাম,অনেক লেখা দেখে জানতে পারলাম আজ বিশ্ব বাবা দিবস, অনেকে তাদের বাবাকে নিয়ে লিখেছেন, আমি পড়লাম তাদের লেখা আমার বাবা কে নিয়ে লিখতে ইচ্ছে হলো, ছোট সময় গ্রামরে বাড়ি থেকে বাবার হাত ধরে হেটে শহরের বাসায় আসতাম কতো কথা হতো আমাদের মাঝে বড় হলে কি হবো রাস্তার পাশে কিছু দেখে এটা কি ওটা কি হাজারো প্রশ্নে তাকে বিরক্ত করা ছিল আমার নিয়মিত অভ্যাস, তিনিও জবাব দিয়ে যেতেন ক্রমাগত।
হা হা হা বাবার পকেট কতোবার যে,কেটেছি,তার হিসেব নেই, স্কুল ফেরত বাবা দুপুর বেলা ঘুমুতেন, মাথার কাছে থাকতো তার জামা, নিরব দুপুরে আমি আস্তে আস্তে বিড়াল পায়ে মাথার কাছ থেকে জামার পকেট থেকে টাকা মেরে দে দৌড়, মাঝে মাঝে ধরাও পরেছি,একেবারে পকেট হাত দিয়েছি আর চোখটা খুললেন, কিছ’ক্ষন তাকিয়ে থেকে আবার চোখ বুজে ফেলেন, ওহ সে কি বিব্রতকর অবস্থা কোন রকম রুম থেকে বের হয়ে দু তিন দিন একটু চোখের আড়ালে থাকতাম, একই বাসা আড়ালে কি থাকা যায়?
একবার বায়না ধরলাম বড় খালার বাসায় বেড়াতে যাবো, বাবার কথা এবার যাওয়া যাবে না, আমি কান্নাকাটি শুরু করলাম, কিন্তু বাবার সিদ্ধান্তের কোন পরিবর্তন হলো না , আমি কাদতে কাদতে ঘুমিয়ে পড়লাম, বিকেল বেলা ঘুম ভাঙ্গে, দুপুরের কথা মনে পড়ে মনটা আরো খারাপ হয়ে পড়ে, মন খারাপ নিয়ে রাতে পড়তে বসলাম, রাতে বাবা আসলেন হাতে করে নিয়ে আসলেন আমার ক্লাসের একটা বই, ওহ সেদিন আমি কি খুশি হয়েছি, অনেক দিন থেকে বইটা কিনতে গিয়েও দোকানে পাইনি, নতুন বইয়ের মাতাল করা ঘ্রান নেই, নেড়েচেড়ে দেখি, দুপুরের সব কষ্ট ভুলে যাই নতুন বইয়ের প্রাপ্তিতে। আজ বাবার এই ভালোবাসা মনে হলে, আমাকে বাচতে শিখায়,বাবা ছেলের সম্পর্ক বেড়ে যায়।
আমার বাবা আমাদের কোন দিন খারাপ ধরনের পরামর্শ দেন নি, সব সময় সদুপদেশ দিয়েছেন, একবার আমার বড় চাচার সাথে বাবার কথা কাটাকাটি হয়, হঠাত করেই সেদিন বাবা বিকেল বেলা আছরের নামাজের শেষে আমাদের দু ভাই কে ঢেকে উপজেলার ঘাটে বসে বললেন, আমাদের দুই ভাইয়ের মাঝে কথাকাটাকাটি হয়েছে এট যেনো তোমাদের চাচাতো ভাইদের মাঝে তোমাদের সর্ম্পক খারাপ না করে অবশ্যই তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখবে। আমিতো হতবাক বলে কি এই লোক, সত্যিই মহৎ এই আমার বাবা,
আরেক দিন আমার বড় চাচা বাবাকে কি কারনে যেনো বাবাকে বকা দিয়েছেন সাথে আমার মাকেও।
এ কথা শুনে আমার মাথা গরম হয়ে যায়, বাবাকে ফোন দেই জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে, কেনো এই রকম ঘটলো, আমি ভেবেছিলাম আমাকে সাপোর্ট দিবে, উল্টা আমাকে বললো সে আমার বড় ভাই আমাকে বকা দিতে পারে তোমরা এর মাঝে আসবে না, আমি হতাশ হয়ে পড়ি।
আমার দাদা একটু মেজাজ গরম ধরনের মানুষ ছিলেন, প্রায়ই সামান্য বিষয় নিয়ে ক্ষেপে যেতেন, ছোট সময়ে দেখতাম বাবা এটাকে কিছুই মনে করতেন, বরং সব কিছু মেনে নিতেন, দাদা যা বলতো সেটাই ১০০% করে যেতেন, বয়সের শেষের দিকে দাদা রোজা রাখতে পারতেন না, আমার বাবাকে দেখতাম, আড়াল করা দোকান থেকে নাস্তা কিনে নিয়ে আসতেন নির্বিকারভাবে, যদিও লোকজন দেখলে হয়তো তাকে নিয়ে খারাপ ধারনা করতে পারে, কিন্তু বাবাকে দেখলাম এটা নিয়ে তার ভাবনা নেই তার একমাত্র চিন্তা দাদাকে নাস্তা করাতে হবে। বুড়ো মানুষদের যা হয় এটা এরকম কেনো .......এই নিয়ে ঘরের মধ্যে তোলপাড় কিন্তু বাবাকে দেখলাম না একবারও বিরক্ত হতে, কোনদিনই অসম্মান করেনি দাদাকে, সাধ্যমতো সেবা করে যাচ্ছেন। একবার তার ডায়েরি পড়ছিলাম এক জায়গায় লেখা দেখলাম হে আল্লাহ তুমি আমাকে তওফীক দাও আমি যেনো আমার বোনদের অধিকার যথাযথ দিতে পারি, আমি বুঝতে পারি না এতো ভালো চিন্তা আসে কোথা থেকে?
মাঝে মাঝে আমি বাবার প্রতি ক্ষেপে যেতাম, আমার বয়সী কতো ছেলে গাড়িতে ঘুড়ে বেড়ায়, বিশাল বিশাল বাড়ির মালিক, সব তাদের বাবার অর্জন তাদের বাবা তাদের জন্য রেখে যাচ্ছেন, আমার বাবা আমার জন্য কি রেখে যাচ্ছেন, বাড়ি গাড়ি কিছুই না, এ অভিযোগ থাকলেও এখন আর নেই, শ্রদ্ধায় আমার মাথা নতো হয়ে যায় কারন এখন আমি টাকা অর্জন করি, হিসেব করে চলেও মাস শেষে টানাটানি। আমি অবাক হয়ে যাই একজন স্কুল মাস্টার কিভাবে সংসার চালাতেন আমাদের পড়াশুনা করিয়েছেন, বিশ্ব বিদ্যালয়ে জীবনে কোন দিন টাকার কষ্ট পায়নি যখন যা চেয়েছি তাই পেয়েছি।
কিভাবে দিতেন এতো টাকা? আমি সব জানি বুঝি...........কিন্তু আমি কি এতো কষ্টের মুল্যায়ন করতে পারবো ?
আমার বাবা নাজিরপুর স্কুলের একজন শিক্ষক, হয়তো সে জন্যই অনেক নিয়ম কানুন আমাদের মেনে চলতে হতো, নিয়ম করে মাগরিব নামাজের পর পড়তে বসতে হবে, এশার নামাজের পর পরিবারের সবাই একসাথে খেতে হবে, রাত ১০টার আগে ঘুমানো যাবে না, মনে মনে পড়া যাবে না উচ্চ শব্দে পড়তে হবে। রাতে কোন বন্ধুদের বাসায় থাকা যাবে না, সকাল বেলা উঠে নামাজ পড়তে হবে, নামাজে শেষে কোরান তেলওয়াত তারপর পড়াশুনা করতে হবে। দুপুর বেলা খেলা যাবে না , যেখানেই থাকি না কেনো সন্ধার মধ্যে বাসায় থাকতেই হবে। এটা ছিলো আমাদের নিয়মিত রুটিন। সেদিন গুলিতে বেশ অখুশি থাকতাম এই নিয়মের অত্যাচারে ।
জীবনের এই পর্যায়ে এসে বুঝতে পারি কি উপকারটাই না করেছেন, সত্যি স্যালুট করতে হবে আমার বাবা কে, স্যালুট মাই ফাদার ।
আমি খুব কমই দেখেছি মা বাবার ঝগড়া, তাদের মাঝে আসলে কোন ঝগড়াই হতো না একটু কথা কাটাকাটি ছাড়া, আমি কতো দেখেছি আমাদের আত্মীয় স্বামী স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া ওহ সে কি বেহাল অবস্থা । আর আমাদের পরিবার উল্টো আমি কখনও দেখিনি আমার বাবা মায়ের গায়ে হাত তুলেছেন, বা খুব উচ্চবাক্যে দুজনের মাঝে ঝগড়া হয়েছে। আমার মা যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন বাবাকে দেখতাম সেবা করে যাচ্ছেন স্বার্থহীন ভালোবাসা নিয়ে, একবার দেখলাম আমার মা খুব অসুস্থ। বাবাকে দেকলাম আম্মুকে কাধে ভর করে টয়লেটে নিয়ে যাচ্ছেন, বাবা টয়লেটের সামনে দাড়িয়ে থাকলেন,আবার বাবা আম্মুকে নিয়ে আসলেন।
সত্যি তাদের এই সম্পর্ক আমাকে অনেক কিছু শিক্ষা দিয়েছে।
আমার লেখালেখির হাতে খড়ি মুলত বাবার লেখালেখির নকল করে, ছোট সময় হটাৎ করে আমি আবিষ্কার করি আমার বাবার ছাত্রজীবনের কবিতার খাতা। মন আর শরীরের ভাবের ঐকতানে ছন্দ মিলের সমাহারে সুখপাঠ্য কবিতা, আমার কবিতার হাতেখড়ি এখানেই। দু চারটে শব্দের অদল বদল সংযোজনে নতুন লেখ্যরূপ পেলো আমার হাতে। নিজেকে কবি ভেবে এক ধরনের সুখও নিয়েছি।
এমনকি সার্টিফিকেট প্রদান স্বর্বস্ব পাঠ্যক্রমের বাইরে আমার প্রথম সাহিত্য পাঠ আমার বাবার লাইব্রেরী থেকেই। বইয়ের সংখ্যা কম হলেও কিছু বই পড়ার কারনে পরবর্তীতে আমার বই পড়ার নেশা জন্মে।
এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে আসলে সব কথা লিখে শেষ করা যাবে না, লেখা শেষ করার আগে বাবা কে ফোন দিলাম কেমন আছেন, অনেক বিষয় নিয়ে কথাও হলো,ফোনের ফাকে ফাকে নিরবে আমি তাকে স্যালুট দিয়ে যাই অনবরত হয়তো কোনদিনই সে কথা তিনি জানতে পারবেন না ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।