ভালো মানুষ হতে চাই"-উত্তরটা এমনি ছিল। ছোট্ট একটা মুখ থেকে এমন উত্তর পেয়ে নিজেকে কাঠগোড়ায় দাঁড় করালাম,কীসের পেছনে ছুটছি এতো!! মানসশৈত্যজবিভবলব্ধতাড়নাপ্রসূতজান্তবপ্রবৃত্তিহেতু এক নিঃস্বপ্ননিদ্রাভিলাষী প্রচন্ড রোদ। রোদে জ্বলজ্বল করছে এমন এক সময়ে একলা দাঁড়িয়ে আছি। রোদে পুড়ে যাওয়া আকাশ,পুড়ে যাওয়া বাতাসের গন্ধ যেনো আমি টের পাই। একে একে পুড়িয়ে দিচ্ছে সবকিছু।
ধিক ধিক করে জ্বলছে। এই অসহ্য পুড়ে যাওয়া শহরের কোনো এক রাস্তার পাশে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আমি বাড়ি কিভাবে ফিরবো তা ভাবতে থাকি। বাড়িতেও আবার পুড়তে হবে। অসুস্থ মা বাবা, ছোট ভাই এদের দগ্ধ চেহারা আমাকে পোড়ায়। বাড়ির শেওলা ধরা দেয়াল যেনো আমার চোখে খোঁচা দেয়।
আমার আর বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে না। তার বদলে ইচ্ছে করে এই রোদে পুড়ে যাওয়া রাস্তায় থাকি আরো কিছুক্ষন। কোথাও এক ফোটা ছায়া নেই। ছায়া সে তো আমার মত মানুষের জন্য থাকবে না। আমি হয়তো অদৃশ্য।
আমাকে দেখা যায় না। ভুল বললাম...ছায়া এর মত বিচিত্র জিনিস গুলো হয়তো আমাকে দেখে না। আমার জন্য তাদের দয়া নেই। দয়া সে তো আরো বিচিত্র। এক দল মেয়ে দল বেঁধে এসে আইস ক্রিম খাচ্ছে।
ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেলো। স্কুলে থাকার সময়ের দুই টাকার পাইপ আইসক্রিম। পকেট টা দেখলাম । বড়জোর পঞ্চাশ টা টাকা আছে। এই মাসের টিউশনি এর বেতন পাইনি।
তাও গেলাম। আইসক্রিমের গাড়ির কাছে গিয়ে বললাম, “মামা,পাইপ আইসক্রিম আছে?দুই টাকার টা?” মামা অবাক হয়ে তাঁকিয়ে থাকে!! ঐপাশের মেয়ে গুলো খিল খিল করে হেসে উঠে। কেউ হয়তো কিছু বললো,বলে আবার হাসাহাসি। বলুক !! এসব আমার কানে আসে না। আমার কান হয়তো তাদের হাসি কে ঘৃণা করে হয়তো।
তাদের কথা,তাদের হাসি।
আবার আগের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। এক ফোটা বাতাস ও নেই কোনোদিকে। নাকি আমি এসেছি বলে সব বাতাস মাথা তুলে অন্য জায়গায় চলে গেলো ? পোড়া বাতাস ও আমাকে ছেড়ে চলে যায়।
একটা বাস এলো।
প্রচন্ড ভীড়। বাসের সিট নিয়ে কাড়াকাড়ি,মহিলা সিটে পুরুষ বসেছে তা নিয়ে মারামারি,ঘামের তীব্র গন্ধ,ভীড়ে ভীড়ে রেষারেষি , পকেটমার,ক্যানভাসার,দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদের উপর ভুলে অন্যদের হাত ফসকে পড়া,হরকে পড়ে যাওয়া এই সবকিছুকে একসাথে এই বিশাল পেটে পুরে নিয়ে বাস টা চলা শুরু করলো। বাসের যে হেলপার তার একটা হাত নেই। সে তাও অবলীলায় তার কাজ করে যাচ্ছে। তার উপস্থিতি অন্তত আমাকে পোড়ায় না।
বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছেটা তাকে দেখে আবার জেগে উঠে। আমি আবার বাসের রড টা জোরে আঁকড়ে ধরি। আমাকে যে বাঁচতেই হবে। বাস থেকে নেমে অনেক দূর হাঁটতে হয়। একটাই ছাতা আমাদের।
ভাইটাকে দিয়ে দিয়েছি। এই পোড়া শহরের রূপ যাতে তার সামনে না আসে। এই রূপ বড় ভয়ঙ্কর,হতাশার।
বাড়িতে ঢুকে আবার সেই একই দৃশ্য। এই মঞ্চের দৃশ্যের কোনো কিছুতেই পরিবর্তন নেই।
কিছু কি খাবো?নাকি বিস্কুট দুটো খেয়ে দুই গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে থাকবো কিছুক্ষন। ক্ষিদাটা তাহলে মরে যাবে। আবার বিকেলে বাচ্চা পড়াতে যেতে হবে। বাচ্চার পড়ার ঘর এয়ার কন্ডিশনড। আমি ঐখানে স্বার্থপরের মত ঠান্ডা বাতাস খাই।
ঐদিকে মা তালপাখা দিয়ে বাবাকে বাতাস করে। মাঝে মাঝে ভাবি যদি পারতাম কিছু ঠান্ডা বাতাস কৌটাতে করে ভরে বাড়ি নিয়ে আসতাম। একটু একটু করে সবাইকে দিতাম। তারা খাবার দিলে খাই। স্বার্থপরের মত খাই।
খেয়ে আর বাড়ি ফিরে রাতে কিছু খাই না। পানি গিলে ঘুমাই। এইসব ভাবতে ভাবতে সময় হয়ে এলো।
উঠে গিয়ে ভাঙ্গা আয়নাটার সামনে দাঁড়ালাম। এই আয়নাও আমাকে পোঁড়ায়।
আমাকে খোঁচায় তার ভাংগা কুৎসিত চেহারা দিয়ে। যারা ওর সামনে আসে তাদের চেহাড়াকে কুৎসিত করে সে ক্রুড় হাসি দেয়। এখন আর এসব গ্রাহ্য করি না। চুল আঁচরাতে আঁচরাতে ভাবলাম এই আমার মত মানুষটাকেও কি কেও পছন্দ করতে পারে? তাও ও কেনো আসে ? অসহ্য যন্ত্রনা।
বাড়ি থেকে বের হয়ে এলাম।
জোর পায়ে হাঁটছি। আজ বুঝি দেরীই হয়ে গেলো।
“এই যে শোন !! যাবি না বলছি !!”
ওর সেই ডাক। পিছন ফিরে দেখি ও দাঁড়িয়ে আছে। আর ভালো লাগে না কিছু।
তুই বুঝিস না?? তোর উপস্থিতি তে আমি পুড়ে যাই বার বার। আমার পোড়া হৃদয়, পোড়া আত্না আবার কষ্টে পুড়ে। তুই তাও অবুঝ শিশুর মতো রাগ করিস। বায়না করিস। বুঝিস না কিছুই।
তোকে কষ্ট দিয়ে আমি বার বার পুড়ি। তোকে ভালোবাসতে গিয়েও পারি না আমি। আমার ভয় করে। অনেক ভয়.........
“যাই রে। দেরী হয়ে গেলো”।
তুই আমি এই পোড়া শহরের রাস্তা দিয়ে হেটে যাই। তবে দুজন দুদিকে। ভালো থাকিস।
পোড়া শহরটা কি দীর্ঘশ্বাস ফেললো?!!!! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।