আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চির দুখী জাতি নাম তার রোহিঙ্গা

চিন্তায় আছে আইজ উদ্দিন প্রাচীন সমৃদ্ধ আরাকানের বিপর্যয়ের শুরু মূলত ১০৪৪-১০৭৭ খ্রিষ্টাব্দে বার্মিজ রাজা আনাওরথার আগ্রাসনের সময় থেকে। তিনি হাজার হাজার স্থানীয় রোসাং, রোহাং এবং রেকং বা রাখাইনদের হত্যা করেন; দেশত্যাগী হয় লাখ লাখ আরাকানি। ঐতিহাসিকেরা সাক্ষ্য দিচ্ছেন, চট্টগ্রামে বসবাসকারী চাকমা, রাখাইন, মারমাসহ অনেক জনগোষ্ঠী সে সময়ই দেশত্যাগী হয়ে বাংলাদেশে বসত করে। রাজা আনাওরথাই প্রথম অহিংসার বৌদ্ধ ধর্মকে বর্ণবাদী ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন। স্থানীয় বৌদ্ধ মতবাদ হটিয়ে তিনি থেরাভাদা বৌদ্ধ মতবাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেন।

পঞ্চাশের দশকে বার্মার সামরিক সরকারও একে রাজধর্ম করে এবং দেশের ১৮০টির বেশি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ঔপনিবেশিক কায়দায় কোণঠাসা করে রাখে। এরই প্রতিক্রিয়ায় রোহিঙ্গারা ছাড়া বাকি আদিবাসীরা অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। সু চির বাবা অং সানের অন্যতম প্রধান সহযোগী ছিলেন মুসলমানদের নেতা উ রাজাক। তিনি সে সময় সেক্যুলার জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলমানদের অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত করেন। শিক্ষা ও পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে মুসলিম ও বৌদ্ধ বার্মিজদের কাছে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন।

সু চির বাবা অং সানের নেতৃত্বে সংবিধানে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বিশেষাধিকার অন্তর্ভুক্তির সময় উ রাজাকের কারণেই মুসলমানরা বাদ পড়ে। সু চি হয়তো ভুলে গেছেন, তাঁর বাবার সঙ্গে একত্রে উ রাজাকও নিহত হন। মিয়ানমারের মুসলিম জনগোষ্ঠীর জঙ্গি বা বিদ্রোহী হওয়ার রেকর্ড অন্য বার্মিজদের তুলনায় শতগুণ কম। অপরাধপ্রবণতার দিক থেকেও তারা পিছিয়ে। সুতরাং মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের মন্ত্রী যা বলেছেন, তা ঠিক নয়।

মানবসমাজ চিরকালই অভিবাসনপ্রবণ ছিল। অতীতে যখন রাষ্ট্র ও সীমান্তের প্রতাপ এত ছিল না, তখন হরহামেশাই এক সমাজের মানুষ অন্য সমাজে গিয়ে বসতি গেড়েছে এবং গৃহীত হয়েছে। মিয়ানমারের মগ ও রাখাইনেরা যেমন বাংলাদেশে বসতি করে, তেমনি অনেক বার্মিজ জাতিগোষ্ঠী কম্বোডিয়া-ভিয়েতনাম প্রভৃতি অঞ্চল থেকে আজকের মিয়ানমারে এসে থিতু হয়। ১৪৩৩ সালে আরাকান বাংলা সালতনাতের অধীন হয়। আরাকানের রাজারা একাধিকবার রাজ্য হারিয়ে গৌড়ের মুসলিম সুলতান অথবা মোগল দরবারে আশ্রয় নিয়েছেন এবং তাঁদের বাহিনীর সমর্থনেই হারানো রাজ্য উদ্ধার করেছেন।

মধ্যযুগ থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত অনেক আরাকানি রাজবংশের নামে মুসলমান পরিচয় পাওয়া যায়। এর অর্থ মুসলমানেরা সেখানে সংখ্যা ও সম্মানে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কবি আলাওল, সৈয়দ আশরাফ প্রমুখ আরাকানের রোসাং রাজসভারই মন্ত্রী ছিলেন। চট্টগ্রামের মানুষ যেমন আরাকানে গেছে, তেমনি অনেক আরাকানিও বিভিন্ন যুগে বাংলাদেশে বসতি গড়েছে। ১৪ শতকের ইতিহাসবিদ রশিদুদ্দীন থেকে শুরু করে, তুর্কি নাবিক সিদি আলী, আইন-ই আকবরি, বাহরিস্তান গায়েবি, সিয়ারুল মুতাখারিন-এর লেখকেরাও এর প্রমাণ দিচ্ছেন।

ষোড়শ শতকের ব্রিটিশ পর্যটক র‌্যালফ ফিচও আরাকানের নাম বলছেন রুয়ং, যা শুনতে রোয়াংয়ের মতো। ইতালীয় পর্যটক মানুচ্চি ফারসি সূত্র ধরে একে বলেছেন রেকন। চট্টগ্রামের শঙ্খ নদের তীরে বসবাসকারী একটি জনগোষ্ঠীর নাম রোওয়াঙ্গি বা রোয়াংয়ের মানুষ। ষোড়শ শতকে শায়েস্তা খাঁ চট্টগ্রামকে মগ বা আরাকান দখল থেকে মুক্ত করার আগে প্রায় এক শতাব্দী এলাকাটি আরাকানের অংশ ছিল। এই ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগের কারণেই আরাকান বিষয়ে বাংলাদেশের সজাগ থাকা প্রয়োজন।

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দেওয়ার কারণ সাম্প্রদায়িক মুসলিম বিদ্বেষ হলে তা লজ্জার ব্যাপার। মানবিক ও রাজনৈতিক কারণটিই বড় করে দেখতে হবে। কিন্তু কেন বাংলাদেশ সমস্যাটি ঘাড়ে নেবে? সরকার যে জাতীয় স্বার্থের অজুহাত দিচ্ছে, তা যদি তারা মানতেন, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের বিক্ষুব্ধ করে তুলতেন না। যারা স্বদেশবাসীদের নিজ ভূমিতে উদ্বাস্তু করে রাখতে পারে, তারা প্রতিবেশীদের আশ্রয় দেবে—এমন আশা বাতুলতা। তবে, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত, সমুদ্রসীমাসহ বহুবিধ সমস্যা রয়েছে।

সেসব সমস্যা সমাধানের চাপ হিসেবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া কৌশলগত চাল হিসেবে খারাপ হয় না। অন্যদিকে, দীর্ঘ মেয়াদে আরাকান অঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ বাড়ানোর ক্ষেত্রেও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ভূমিকা রাখতে পারে। আরাকান ও চট্টগ্রামের আরও কাছাকাছি আসা উভয়ের স্বার্থেই দরকার। আরাকানে যত দিন অশান্তি থাকবে, তত দিন আমাদের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে অস্থিতিশীলতার ঢেউ আছড়ে পড়বে। এবারে যেহেতু রোহিঙ্গা ইস্যুটি আন্তর্জাতিক মনোযোগে এসেছে, একাত্তরের ভারতের মতো শরণার্থী সমস্যা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ আরাকানে শান্তি কায়েমে ভূমিকা রাখতে পারে।

মিয়ানমারে নির্বাচনী গণতন্ত্র কায়েম হলে পূর্বাঞ্চলীয় আসাম-ত্রিপুরার মতো এই অঞ্চলটিও হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মিত্র ও ব্যবসায়িক অংশীদার। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের বিষয়ে একেবারে কঠোর হলে তিন লাখের মতো রোহিঙ্গা এ দেশে আশ্রয় পেত না। কিন্তু এই দায় একা বাংলাদেশের পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। জাতিসংঘ, আসিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে কেবল বাণী ঝাড়লে হবে না, মিয়ানমারের ওপর চাপ দিতে হবে, বাংলাদেশকে তহবিল ও রাজনৈতিক সমর্থন জোগাতে হবে। তার জন্য মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সঙ্গে দীর্ঘদিনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক হারাতে হতে পারে ব্রিটেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও অস্ট্রেলিয়াকে।

আমাদের সরকারের উচিত, বলটা আন্তর্জাতিক মুরব্বিদের মাঠে ঠেলে দেওয়া এবংবলা, আমরা গ্রহণে প্রস্তুত, কিন্তু তোমাদেরই আগে সদিচ্ছার প্রমাণরাখতে হবে। বাংলাদেশে আগমনকারী লাখ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনের স্বার্থেও বিষয়টির একটা আখেরি সুরাহা হওয়া দরকার। কয়েক হাজার শরণার্থীকে ফিরিয়ে এই সমস্যা এড়ানো যাবে না, মানুষ আসাও ঠেকানো যাবে না। অবশ্যই আমাদের রাষ্ট্রবুদ্ধি প্রয়োজন, কিন্তু তার জন্য অমানবিক হতে হবে কেন? সংকলিত  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।