আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কালি-কলম কাহিনী

এখনই, নয়তো কখনই নয়...। আবার কালি কলম ব্যাবহার করা শুরু করলাম। তবে প্রতিদিনকার লেখালেখির জন্য নয় অবশ্যই। এখন ব্যাবহার করি শখ করে। কাগজের সাদা পাতার বুক চিড়ে রোপন করে যাই বুকের ভিতর জমে থাকা অযুত নিযুত শব্দমালা।

কেমন যেন অন্যরকম একটা অনুভূতি। ভালোই লাগে। কেন জানি ঠিক এই একই কাজ বল পয়েন্ট কিংবা জেল পেনে আসে না। অরুচিকর লাগে খুব। বল পয়েন্ট আর জেল পেন আমার কাছে প্রানহীন কিছু একটা।

অন্যদিকে কালি কলম ঠিক তার উল্টোটা। লেখার সময় আমার মনে হয় কালি কলম আমার শরীরেরই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। একে অন্যের জন্য। হালকা গরম পানিতে কালি কলমটা ধুয়ে পরিষ্কার করা, তারপর দোয়াত থেকে কালি ভরা, ফোটায় ফোটায় অতিরিক্ত কালি আবার দোয়াতে ফেলা, সবশেষে কালিতে ভেজা কলমের সামনের অংশ টিস্যু/নিউজপ্রিন্ট পেপারে মুছে নেয়া, এসবই অনেকের বেশ বিরক্তির কারন হতে পারে। কিন্তু এই সবকটি ধাপই আমি উপভোগ করি।

দারুনভাবে। এখনও কালি কলম নিয়ে ছেলেবেলার কিছু স্মৃতি আধো আধো মনে পড়ে। মনে পড়ে মামা খালাদের কালি কলম ব্যাবহার করা। কাউকে দেখতাম হাত থেকে পড়ে ফেটে যাওয়া কলম তুলায় জড়িয়ে কত কষ্ট করেই না ব্যাবহার করতে। আবার কাউকে দেখতাম কালি ভরার পর কালি মাখা কলমের সামনের অংশ নিউজপ্রিন্টে না ঘষে ঝটপট নিজের মাথায় মুছে ফেলা।

প্রথম যে কালি কলম ব্যাবহার করেছিলাম তা ছিল ইওথের। পেয়েছিলাম এক দুবাই ফেরত আত্মীয়ের কাছে থেকে। খুব সম্ভবত ক্লাস টুতে পড়তাম। কলমটা ছিল গাঢ় মেরুন রং এর। এরপর সুদীর্ঘ বিরতীর পর পেয়েছিলাম জীবনের দ্বিতীয় কালি কলম উপহার।

যে বিরতীর কথা বললাম সেই সময়ে কালি কলম উপহার না পেলেও অন্যের উপহারে যে ভাগ বসাইনি তা কিন্তু নয়। আব্বা উপহার পেলেন পার্কার পেনের সেট। সেই সেটটি এ অধম কর্তৃক হালুম। অল্প কিছুদিন পর আবারো উনি পেলেন ক্রস পেনের সেট। যথারীতি আমার তরফ হতে সেটিও হালুম।

ক্রস পেনটা অবশ্য ব্যাবহার করা হয়নি। কারন পেনটার কোন টিউব ছিল না। আসলে ছোটবেলায় মাথায় এই ধারনাই ছিল না যে কোন কালি কলমে disposable টিউব থাকতে পারে। আর আমি এও জানতাম না যে টিউব দেখতে কেমন বা কোথায় তা পাওয়া যায়। কিন্তু এক পর্যায়ে নিউমার্কেটে তা ঠিকই আবিষ্কার করলাম।

কিন্তু দোকানদার সেই ছোট্ট টিউবটার দাম যা বলল তাতে ক্রস পেন ব্যাবহারের আশা উবে গেল নিমেষেই। তারপরও দোয়াতের কালিতে নিব ভিজিয়ে ব্যাবহারের চেষ্টা চালিয়েছিলাম। যদিও এভাবে কলম ব্যাবহার করার মানে ছিল কলমের সাথে সাথে ঢাউস সাইজের একটা কালির দোয়াতটাও বহন করা। পরবর্তীতে এই বাস্তবতার জন্যই কলমটা আর ব্যাবহার করা হয়নি। তবে যতটুকু ব্যাবহার করেছিলাম তাতেই বুঝেছিলাম যে কি জিনিষ ছিল সেটা।

ওটায় লিখে যে আরাম পেয়েছিলাম তা আজ পর্যন্ত অন্য কোন কালি কলমে পাইনি। কলমটা খুব মিস করি এখন, কারন ইচ্ছে সামর্থ্য দুইই আছে অথচ হাতের কাছে কলমটাই নেই। নেই মানে নেই। ঘরের পুরোনো জঞ্জালের মাঝে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। গাঢ় নীল রংএর পার্কার পেনটাও খারাপ ছিল না।

কোন খসখসে ভাব ছাড়াই বেশ সাবলীলভাবে লেখা যেত ঐ কলম দিয়ে। আরেকটা বিশেষত্ব ছিল এরকম যে এক ফোটা কালির কয়েকভাগের একভাগও যদি ঐ কলমে থাকত তো তা দিয়েই লেখা যেত বেশ কয়েক লাইন। দুঃখের বিষয় হলো ওটা বেশিদিন রাখতে পারিনি। বি.এ.এফ. শাহীন স্কুলের মাঠে হারিয়ে ফেলেছিলাম। খুব আফসোস হয় ওটার জন্য, এখনও।

একে একে হাতে এলো কমদামি উইং সাং, হিরো এইসব কলমগুলো। উইং সাং কলমটা ভালো ছিল। হিরো কলমটা প্রথম দেখি আমার চাচাত ভাইয়ের কাছে। উনি সগৌরবে আমাকে বলেছিলেন যে তার হিরো কলমটাই সেরা। প্রমান স্বরূপ আমাকে দেখালেন যে ওনার কলমটা আমার উইং সাং এর চাইতে ভারী।

একসময় স্কুলেও দেখলাম আমার বন্ধুদের হিরো ব্যাবহার করতে। তো কিনেই ফেললাম একটা ৭০ কি ৮০ টাকা দিয়ে। আত্মীয় স্বজন আর বন্ধু বান্ধবের কলমগুলো খুব আগ্রহ নিয়ে দেখতাম যখন বুঝতে পারতাম আমার কলমের চেয়ে তাদেরটা ভিন্ন। বড় খালার বাড়ী গিয়ে সেখানকার স্টেইনলেস স্টিলের পার্কার পেন হাতে নিয়ে ভাবতাম কলম এতো ভারী হয় কেন। ক্রস, শেফারস পেনগুলোও দেখতাম বেশ ওজনদার।

হতে পারে কষ্ট করে চাপ দিয়ে যাতে লিখতে না হয় সে জন্যই কলমগুলো এতো ভারী। আমার এক বন্ধুর কাছে প্রথম শেফারস পেন দেখেছিলাম। ও আবার ক্রস পেন দেখেনি। তো আমার কাছে থাকা ক্রস পেনটা তাকে দেখালাম। কলমগুলোর দিকে বিমুগ্ধ দৃষ্টিপাতের মধ্য দিয়ে দুজনেরই ইচ্ছাপূরন, অবশেষে।

যে কালি ছাড়া কালি কলম অচল সেই কালিও ছিল খুব গুরুত্বপূর্ন বিষয়। ছোটবেলায় বেশ অনেকদিন ধরে যে কালি ব্যাবহার করেছিলাম তা ছিল ইওথের। কালির রংটা ছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্ল্যাক বা ব্লু-ব্ল্যাক। একদিন স্কুলে এক বন্ধুর লেখাটা দেখলাম খুব গাঢ় কাল রংএর। জিজ্ঞাসা করায় বলল যে ইওথের ব্ল্যাক কালিই সে ব্যাবহার করছে।

বিশ্বাস হলো না কারন আমিও ব্ল্যাক কালিই ব্যাবহার করি কিন্তু ওরটার মতো অত গাঢ় কালো না। যাই হোক একপর্যায়ে জানালো যে তারটা হলো পিওর ব্ল্যাক। এরপরতো পিওর ব্ল্যাক ছাড়া অন্য কালি ব্যাবহারই করতাম না। বেশ অনেকদিন কালিটা ব্যাবহার করার পর আবিষ্কার করলাম উজ্জ্বল নীল রং এর কালি এবং সেটা ইওথেরই। সেটাও আমার বেশ পছন্দের কালি।

জানিনা এখন সেই নীল রং এর রয়েল ব্লু কালি বাজারে পাওয়া যায় কিনা। লাল রং এর কালি তখন ব্যাবহার করা হয়নি কারন লাল রং ব্যাবহারের একচ্ছত্র মালিক শুধুমাত্র শিক্ষকেরাই এই চিন্তাটাকে ছোটবেলায় উড়িয়ে দিতে পারিনি কখনই। ঠিক এই সময়ে আমার পছন্দের কালি হলো সবুজ। কেন যে এতো ভালো লাগে আমি নিজেই তা জানিনা। ইওথের পর ব্যাবহার শুরু করলাম পেলিক্যানের কালো কালি।

এখনও দোকানে পেলিক্যানের কালি দেখি। তবে কিনতে গেলে দোকানদাররাই বলে যে কালিটা আগের মত জেনুইন না। মানে জার্মানীর তৈরি না। ডলার নামের কালি এখন নজরে পড়ে। পাকিস্তানের তৈরি।

লেখাটা শুরু করেছিলাম অনেকদিন পর কালি কলম ব্যাবহারের কথা বলে। ঘটনার পেছনে কাজ করেছিল অনেকদিন পর নিউমার্কেটে এসে কালি কলমের দোকানে উঁকি দেয়াটা। দোকানদার ধরিয়ে দিল ডলার পেন। কলমের নিবটা বাদে পুরোটাই প্লাষ্টিকের আর খুব হালকা। ভাবলাম সস্তা এই কলমটা দিয়েই লেখার কাজ শুরু করি।

পুরো সেমিস্টারটাই ঐ কলমেই শেষ করলাম। এমনকি পরীক্ষার সময়ও কোন সমস্যা হয়নি। কালি কলম প্রীতি দেখে আমার বউ আমাকে দিল একখান কালি কলম। লেখার শুরুতেই আমার দ্বিতীয় কালি কলম উপহার পাওয়ার যে কথাটি বলেছিলাম সেটা নিশ্চয় আপনাদের মনে আছে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।