এখন সবাই ঘুরে বেড়ায় , এটা ভালো... আমবাগান। দেশ জুঁড়ে বহু আম বাগান আছে। তবে আমার লেখা আমবাগানের বিশেষত্ব অন্যখানে। এ আমবাগান শুধু একটা আমের বাগান নয়, এবাগান আমাদের একান্ত। আর আম বাগানটি দিনদিন বিখ্যাত হয়ে উঠছে রসআড্ডাস্থল হিসেবে।
এখানে রস খেতে প্রতিবছর একত্রিত হয় একদল রসিয়াল। রসিয়ালদের জমজমাট রস আড্ডা বসে এখানে, আমরা বলি রসউৎসব। প্রতিবছর মে মাসের ১ তারিখ সে উৎসবের দিন। আমাদের মে মাস মিস হতে পারে কিন্তু রস আড্ডা নয়, এবারও তার ব্যতিক্রম ছিলনা। এবার ব্যাপ্তি ছিল অরও বেশী, প্রায় আশিজনের দল মিলিত হয়েছিলাম সাদুল্লাপুরের মৈস্তাপাড়ার মুসারবাড়ি এলাকার আমবাগান রসউৎসবে।
রস আড্ডায় আপনার অংশিদারিত্ব ছিলনা। যেতে পারেননি, তবু আড্ডা আপনাকে বঞ্চিত করবেনা। চলুন আপনাকে আমবাগানের সেই রসউৎসব থেকে বেড়িয়ে নিয়ে আসি।
উৎসবের দিন
রসউৎসবের দিন ভোর রাত থেকে শুরু হল প্রচন্ড ঝড়ের সঙ্গে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। সে বৃষ্টি রূপ নিল মুষলধারায়।
আস্তে ধীরে দিনের আলো ফুটে উঠলেও বৃষ্টি কমার কোনও লন ছিলনা। রসউৎসবের আয়োজক গোলাম রাব্বানীর মন খারাপ। শুধুকি রাব্বানী, আসরে অংশগ্রহন ইচ্ছুক সব বন্ধুরই মনখারাপ। দাউদ হোসাইন রনির একটু বেশীই যেন। এক বছর হয়েছে বিয়ে করেছেন।
নতুন বউ বিয়ের প্রথম বছরই রসআড্ডায় গিয়ে বুদ হয়ে দারুন মজা পেয়ে এবার সেই কাকডাকা ভোর থেকে প্রচন্ড ঝড় উপো করে উৎসব তৈরীতে ব্যাস্ত, চোখে-মুখে চিন্তার রেখা শেষ পর্যন্ত না আড্ডাটাই রসাতলে যায়। লাবু-লাবনী ফোনে কনফার্ম করছেন কে কে যাচ্ছেন আবার যাচ্ছেননা। কারো মুখে না নেই। শোনা গেল এবার আসরে নুতন অতিথি গামছা স্বপন, একলা পথিক (তুষার), শাওন(তিন)’র কথা। তায়েব মিল্লাত এক বছর বিরতী শেষে আবার উৎসবে সঙ্গি হচ্ছেন, তবু উদ্বেগ কমেনা।
আহারে সাধের বৃষ্টি। কত সুখ পাই তোকে নিয়ে, তোকে কতনা ভালবাসি। গুনগুন করে কখনও চিৎকার করে তোর জন্য গাই;আমি ছিলাম মগ্ন গহন স্বপন ঘুমের ঘোরে যখন বৃষ্টি নামল। কিন্তু আজ তোকে চাইনা, চাইনা! মন দিয়ে কিছু চাইলে নাকি পাওয়া যায়। সবার মনের কথা বৃষ্টি কমুক।
তাই তো বৃষ্টি একটু কমতেই দিয়াবাড়ির বটতলায় চলে গেলেন গোলাম রাব্বানী। আমি ঘুমঘুম চোখে রাব্বানীর পাঠানো ুদেবার্তায় চোখ বুলাই। তারপর বিছানা ছেঁড়ে উঠি। তৈরী হতে হতে দেখি বৃষ্টি থেমে রোদ হেসেছে। শুভমিতা আজ উৎসবে যাবেনা, তার এ্যাসাইনমেন্ট আছে।
তাকে ধলেশ্বরি জোড়া সেতুর রিপোর্ট করতে হবে, ছবিও তোলা লাগবে। আমার মেজাজ খারাপ, তাই তো শুভমিতার নাস্তা বানানো হলেও, না খেয়েই পথে নামি। তারপর খুব দ্রততার সঙ্গে বাইক চালিয়ে চলে আসি দিয়াবাড়ি বটতলা হয়ে দিয়াবাড়ি ল্যান্ডিং ষ্টেশন। এখানে রসিয়াল বন্ধুদের অধিকাংশ ইতিমধ্যে চলে এসেছেন।
নাও ছাড়িয়াদে পাল উড়াইয়াদে
যারা আগের রস আড্ডায় ছিলেন তারা জানেন, সকালের খবরের ক্রাইম রিপোর্টার নুরুজ্জামান লাবু রস আড্ডার প্রান, তার বউ মাসুদা লাবনী আড্ডার ভোমরা।
আর টিংকু ভাই হলেন আসরের মধ্যমনি। এরা সবাই চলে এসেছেন। অনেকেই পথে, মোবাইলে তাদের আকুতি যেন ফেলে চলে না যাই। এবার অনেক নতুন চেহারা, নতুন প্রানে পাগল হই। এভাবেই এক সময় প্রায় আশিজন রসিয়াল বন্ধু নিয়ে আমাদের ইঞ্জিন চালিত নৌকা তুরাগ বুকে ভাসে।
সে সময় কেউ একজন পাশ থেকে গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠে-
নাও ছাড়িয়াদে পাল উড়াইয়াদে
ধানকাটা, ধান মাড়াই
এখন বোরো ধান কাটার মরশুম। নৌকা চটবাড়ি পেছনে ফেলতেই ধানের মিষ্টি গন্ধে প্রান জুড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে আলোকচিত্রি বন্ধুরা ক্যামেরা সচল করে। ধান কাটা হচ্ছে, এগুলো আবার নৌকায় বোঝাই হচ্ছে এবার কৃষকের গোলা ভরে উঠবে বোরো ধানে। কৃষিভিত্তিক বাংলার এ এক অতীত ঐতিহ্য।
দুপাশে ধানের খেত আর মাঝে তুরাগ নদ ধরে আমাদের নৌকা এগিয়ে চলে। এর মাঝে এক ঝাঁক বকের দেখা মেলে। বক দেখে মনে হচিছল আমরা গ্রীস্মে নয়, শীতের তুরাগ নদে ভেসে চলেছি। দুরে একাকী হিজল গাছ অনন্য সৌন্দর্য ছড়িয়ে নিজেকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। এভাবেই আমরা ভেসে ভেসে এক সময় সাদুল্লাপুর ঘাটে চলে আসি।
গোলাপ কথা
এবার পায়ে হাঁটা পথ। ভোররাত আর সকালের বৃষ্টিতে সাদুল্লাপুর খেয়াঘাট কাদায় মাখামাখি। সে কাদায় ভর করে আমরা এগিয়ে চলি। কিছুদুর গিয়ে পেয়ে যাই পিচ পথ। এখানে পিচ পথের দু’ধারে আবার গোলাপ বাগান।
এখানকার লোকেরা ধানের পাশাপাশি গোলাপ চাষের ওপর নির্ভরশীল। সাদুল্লাপুরে এসব গ্রাম গুলোকে বলা হয় গোলাপ গ্রাম। রাব্বানীর ঘোষনা কেউ গোলাপ ছিঁড়বেননা। আপনাদের জন্য গোলাপের ব্যবস্থা আছে। গোলাপ দেখতে দেখতে আর খেজুর গাছে খেজুর শোভা দেখে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ এক অদ্ভুদ দৃশ্য চোখে এল।
দুরে এক লাইনে অনেক গুলো মহিষের গাড়ি আসছে। এরা চলেছে ধান বোঝাইয়ে। পাশেই সোনালু গাছের হলুদে দুটি ফিঙ্গে ল্যাজ ঝুলিয়ে দিবানিদ্রায় ব্যস্ত। এভাবেই আমরা চলে আসি মৈস্তাপাড়ার মুসারবাড়ি। এখানে আমাদের এবার বনপথ ধরে এগিয়ে চলা।
কিছুদুর গিয়ে বিশাল ধানখেত চোখে পরে। সে ধানখেতের আল ধরে পড়িমড়ি করে চলে আসি আমাদের উৎসবস্থল আমতলা।
নেশার লাটিম ঝিম ধরেনি
আমরা এখন প্রকৃতির শিক সবুজের মাঝে। চারিপাশটা অসাধারন সৌন্দর্যে ঘেরা। এখানকার আমগাছের গল্প আগে বহুবার করা।
তবু আরেকবার বলি, আমগাছ তলা কেবল একটি গাছ তলা নয়, এ যেন সুনিবিড় ছায়াঘেরা অসাধারন পরিবেশ! যে দিকে তাকাই মনে হয় এ যে দেখছি গাছেদের গড়া একেকটি অসাধারন শিল্পকর্ম। যা চোখে না দেখলে বোঝা সম্ভব নয়। জানিনা এসব পািকল্পিত কিনা। পরিকল্পিত বা প্রকৃতি প্রদত্ত যাই হোক, এখানে এসে যে কেউ বলতে বাধ্য হবেন - অসাধারন! পাশেই ধানের তে, তাল গাছের ঝোঁপ। সাথে আনা পাটি বিছিয়ে সবাই বসে পড়ি।
কারো যেন তর সইছেনা। রস কই বলে চিৎকার করে ওঠেন টিংকু ভাই। তুষার ব্যস্ত তাঁর হাতের কাঁকড়া আর মাছি নিয়ে। সেখানে আবার আলোকচিত্রিদের ঝাঁপিয়ে পড়া ভীড়। এর মধ্যে গরুর মাংস ভূনা চলে এসেছে।
এবারের রস গুরু গতবারের মতই টিংকু ভাই। সবার সঙ্গে পরিচয় পর্ব আর রস আড্ডার ইতিবৃত্ত বলা শেষ হতেই দুটি গ্লাসে রস ঢেলে আমার আর টিংকু ভাইর হাতে ধরিয়ে দেয়া হল, সে রসে চুমুক দিতেই শুরু হয়ে গেল দিনভর রসউৎসব।
শেষকথা
সবার হাতে রসের গ্লাস। রস খাচ্ছেন আর গান গাচ্ছেন। গিটার হারিয়ে গেছে কন্ঠ মাধুর্যে, মুড়ির বল রূপ পেয়েছে তবলায়।
আশিজনের কন্ঠ এক সুতোয় গাঁথা। মনে কারো কোন খচখচানি নেই, বাড়ি ফেরার তাড়া নেই। সবার চোখ আধবোঝা। নিশ্চিন্ত হয়ে গ্লাস ভরছে আর গিলছে। প্রতিবারের মতই লাবু লাবনীকে সাবধান করে দিয়েছে।
চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী। লাবনী হেসে কুটিকুটি। একটি রসের ড্রাম শেষ হতেই অরেকটি চলে আসছে। রস গিলছে আর চিৎকার করে গাইছে- রস খাবি তুই রস খাবি তুই তানানানা তানানানা তা!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।