আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বদলা-২

চাপা মারাই আমার কাজ ১। ভোরের আলো মাত্র ফুটেছে। শীতের সকাল। প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। বিছানাটা চুম্বকের মত টানছে।

চলে যেতে মোটেও মন চাচ্ছে না। এর আগে অবশ্য যেসব দিন এরকম হয়েছে সেসব দিন আমি থেকেই গিয়েছি। সারা সকাল ঘুমিয়ে দুপুরে গোসল টসল করে, খেয়ে একেবারে গিয়েছি। কিন্তু আজ যেতেই হবে। ঘুম ঘুম চোখে টলতে টলতে বেরিয়ে এলাম সুমনদের বাসা থেকে।

ঘুম ভাবটা অবশ্য কাজে দিচ্ছে। পুরো মাতালের মত লাগছে আমাকে, অভিনয় করতে হচ্ছে না। কাল রাতে সবাই মদ খেয়েছে, কিন্তু আমি খাইনি। খাইনি মানে যেটুকু না খেলেই নয় সেটুকু। এক পেগ মত।

বাকিরা গলা পর্‍যন্ত গিলেছে। কেউ মাথাই তুলতে পারছে না। তবুও সুমনকে জোর করে তুলে আনলাম। বাইরের দরজা তালা মারা, আমার মোটর সাইকেল বের করতে হবে। সুমনদের এই বাড়িটা সাভারে দিকে।

কেউ থাকে না। জমির দখল নিতে ওর বাবা টিনশেড করে রেখেছে একটা। এটাই আমাদের মানে সুমনের বন্ধুদের ফুর্তির জায়গা। মদ, জুয়া, মেয়ে মানুষ হেন জিনিস নেই যা এখানে হয় না। যেহেতু প্রায়ই আসা হয়, তাই সুমন বাসাটা মনের মত মডিফাই করে নিয়েছে।

তাই বাইরে ইটের গায়ে সিমেন্ট না থাকলে কি হবে, ভিতরে ভালোই অবস্থা। ব্যটার অবস্থা দেখে মায়া হল। বসার ঘর থেকে বারান্দায় আসতে দুইবার ঢুস খেল। প্রতিবার-ই আমাকে অশ্রাব্য কিছু গালি দিল। - ‘শালা......... কি এমন কাজ যে তোমাকে যেতেই হবে?’ - ‘নারে দোস্ত, অন্যদিন তো থকি, আজ না গেলেই না।

’ - ‘.................. যেমনে ঢুলতেসিস, বাইক চালাইতে পারবি? ঢুস মেরে তো চ্যাগায় থাকবি। ’ তুমি তুই গুলিয়ে যাচ্ছে ওর। - ‘সমস্যা নাই। এই ভোরে গাড়ি নাই। আর চালানো শুরু করলেই ঠিক হয়ে যাবো।

’ ঢুলতে ঢুলতে তালা খোলে ও। আমি বাইক বের করি। - ‘ওকে দোস্ত, বাই। বলি আমি। ’ - ‘বাই, মাল জোগাড় হইলে খবর দিয়ো আবার।

’ মাল মানে দামি মদ। সুমনদের দামি মদের সাপ্ল্যায়ার আমি। এজন্যই তোয়াজ করে আমাকে। ওর অন্য যে কোনো বন্ধুর চেয়ে একটু বেশি-ই। কারন অন্য সবাই ওর কাছ থেকে শুধু নেয়ার ধান্দায় থাকে।

জুয়ার আসরে হেরে পকেট বেসির ভাগ সময় ফাকাই থাকে, বাপের পকেট আর কত মারা যায়। একমাত্র আমি-ই কোনো প্রতিদান ছাড়াই গত কয়েক মাস দামি দামি মদ খাইয়ে যাচ্ছি। তাই খাতিরতো একটু করতেই হয়। অবশ্য ওদের অন্য কোনো আসরেই থাকি না আমি। শুধু এই মদের আসরে।

আশা করছি আজকের পর এই আসরেও আর থাকতে হবে না। আমার ইয়ামাহা FZR স্টার্ট দিয়ে ভোঁ করে বেরিয়ে আসি। ভোরের স্নিগ্ধ বাতাসে সত্যি ঘুম চলে যায় পুরোপুরি। এত ভোরে বাইকিং আর আজকের দিনে কি ঘটতে পারে চিন্তা করেই রক্তে অন্য রকম একটা রোমাঞ্চ অনুভব করলাম। ২।

একেবারেই নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে আমি। বাসা ফরিদপুর। বাবা মা বোন সহ চার জনের সংসার। কোনোদিন না খেয়ে থাকিনি কিন্তু বিলাসিতার কোনো সুযোগ ছিল না। এরকম একটা মোটর সাইকেল কেনা তো স্বপ্নের ব্যাপার ছিল।

কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে জার্মানিতে গিয়েছিলাম চাকরি নিয়ে। বাবা মা সবাই খুশি। দিন বুঝি ফিরল আমাদের। প্রায় চার বছর ছিলাম আমি জার্মানি। হঠাত বাবা তাড়া দেয়া শুরু করলেন দেশে ফেরার জন্য।

আমার বিয়ে দেবেন। সাথে জুইয়েরও। জুই আমার ছোটবোন। ঢাকায় পড়ে। থাকে উত্তরায় আমার চাচার বাসায়।

ওকে নাকি কে ডিসটার্ব করে ইদানিং। এদিকে একটা ভালো পাত্র পাওয়া গিয়েছে। আবার আমি বড় হিসেবে আমাকে তারা আগে বিয়ে দিতে চান। তাই সব মিলিয়ে ঠিক হল কাছাকাছি সময়েই দুজনের বিয়ে হবে। আমার এই বোনটাকে আমি জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসি।

ভার্সিটিতে পড়ার সময় নিজে না খেয়ে থেকে হলেও টাকা জমিয়ে ওর সব আবদার পুরণ করেছি। সেই পুচকির বিয়ে! সত্যি কথা বলতে আমার চে ওর বিয়ে নিয়েই আমি বেশি উত্তেজিত ছিলাম। মাথা ভর্তি প্ল্যান নিয়ে দেশে ফিরলাম। জুইএর হবু বরকে দেখলাম। আমারও খুব পছন্দ হল।

আমার জন্যও পাত্রী দেখা চলছে। বাড়িতে মহা উৎসবের রেশ। এর মধ্যেই সব উলট পালট করে দিয়ে খবরটা আসল। জুইকে যে ছেলেটা ডিস্টার্ব করত সে জুইএর বিয়ের কথা শুনে ওর মুখে এসিড মেরেছে। পরীক্ষা বলে ও আমার সাথে দ্যাখা করে আবার ঢাকা চলে গিয়েছিল।

পুরো আনন্দময় পরিবেশটাকে যেন কেউ হাইড্রলিক ব্রেক চেপে থামিয়ে দিল। জুইএর মুখের যে ক্ষত, তার চেয়েও বেশি ক্ষতবিক্ষত হল আমার হৃৎপিণ্ড। আমার সারা দুনিয়া যেন এক মুহুর্তে বদলে গেল। পুলিশ কেস হল। জানি কাজটা কে করেছে কিন্তু কেউ করতে দ্যাখেনি ফলে কোনো সাক্ষী নেই।

পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারল না। দোষীরা প্রথম কয়েকদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকলেও আবার সদম্ভে চলাফেরা শুরু করল। এদিকে আমাদের বাড়িটা জাহান্নামে পরিনত হল। বাবা মা কথা বলা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। জুই আত্মহত্যার চেষ্টা করল একবার।

বহু কষ্টে ঠেকানো গেল। ওর কান্নারত মুখ বুকে চেপে সিদ্ধান্ত নিলাম, বদলা নেব এর। ৩। কথাটা সোজা হলেও কাজটা এত সহজ ছিল না। আমার সারাক্ষণ মনে হচ্ছিল সরাসরি গিয়ে ছেলেটাকে খুন করে আসি।

অনেক কষ্ট দিয়ে তিলে তিলে মারব। কিন্ত দিনে দুপুরে তা কি সম্ভব! প্ল্যান করে আগাতে হবে। উত্তরাতেই আলাদা একটা বাড়ি ভাড়া নিলাম প্রথমে। তারপর শুরু হল ফলো করা। কোথায় যায়, কি করে, কার সাথে মেশে? এর জন্য আমি একটা মোটর সাইকেল কিনে নিলাম।

কমন কেস। বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলে। নাম সুমন। নামকাওয়াস্তা একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ে। সারাদিনের উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে আছে গার্লস কলেজের মেয়েদের সামনে ডিউটি দেয়া, পাড়ার দোকানে সিগারেট খাওয়া, সন্ধ্যার পর থেকে তাস পিটানো আর সুযোগ পেলে গাজা খাওয়া।

মাঝে মাঝে একটা বার কাম নাইট ক্লাবে যায়। হঠাত বন্ধুরা মিলে মোটর সাইকেলে করে কোথায় যেন যায়। এভাবেই একদিন ছেলেটার পিছু নিয়ে উপস্থিত হলাম সেই নাইট ক্লাবে। সেদিন বেশ বিমর্ষ দেখলাম ছেলেটাকে। কাছে এগিয়ে গেলাম।

দেখি একটা বীয়ার কিনে খাচ্ছে। আলাপ করার ছুতোর জন্য বললাম, - ‘এমন জায়গায় এসে বীয়ার খাওয়ার দরকার কি? এতো যে কোনো দোকানেই পাওয়া যায়। ’ ছেলেটা অবাক হয়ে কিছুক্ষন আমাকে দেখল। ভয় ছিল ও আমাকে চিনে ফেলে কিনা! কিন্তু পুলিশি ঝামেলার পুরোটা সময় লুকিয়ে ছিল বলে আমাকে দ্যাখেনি, তাই আমি কে তাও জানে না। কিছুক্ষণ পর বলল, - ‘আসলে এখানে এসে আমি এসব খাই না বাট আজকে ভুল করে মানিব্যাগ ছাড়াই চলে এসেছি।

আর এসে কিছু না খাওয়াটা কেমন তাই পকেটে যা ছিল তাই দিয়ে এটা আরকি!’ - ‘তাই, ঠিক আছে আজ আমি আপনাকে ভালো কিছু খাওয়াই। ’ - ‘না না, সেকী। কোনো দরকার নেই। ’ মুখা বলল বটে, কিন্তু অর্ডার দেওয়ার পর ওর চোখে আমি স্পষ্ট লোভ দেখতে পেলাম। জার্মানিতে থাকতে ড্রিঙ্কস করতাম আমি, তাই ভালো ড্রিঙ্কস সম্পর্কে সবই জানা আছে।

দুই পেগ পেটে পড়তেই একেবারে জিগরি দোস্তের মত হয়ে গেল আমার। কত কথা বলে ফেলল নিজে থেকেই। আমার মত ভালো মানুষ নাকি সে তার জীবনে দ্যাখেনি। আজকে আসলে সে তার সব টাকা বন্ধুদের কাছে হেরে এসেছে জুয়ায়। বন্ধুরা সব নিমকহারাম।

টাকা নিয়ে ভাগসে আর খবর নাই, আবার ওর কাছে যখন টাকা হবে তখন তাদের দ্যাখা মিলবে। এখানে এসেছিল যদি কাউকে পায়। কিন্তু কেউ নেই। আমার কাছে নাকি সে ঋণী থাকবে না। পোষায় দিবে।

বলে একটা চোখ টিপ দিল। আমি শুধু হাসলাম। আমি মোটেও মাতাল হইনি। মনযোগ দিয়ে ওর সব কথা শুনেছি। আমার পরিচয় দিয়েছি ব্যাবসায়ী বলে।

নামও বলেছি অন্য। এভাবেই শুরু। মাঝে মাঝেই ভালো মদ খাইয়ে ওকে প্রায় কিনে ফেললাম আমি। এর মধ্যে ওর সহযোগীদের সাথেও পরিচয় হয়েছে আমার তাদেরকেও একই ভাবে আপ্যায়ন করেছি আমি। সম্পর্ক তুমিতে নেমে এসেছে।

ব্যাবসায়ের কথা বলে বাড়ি চলে আসি। এক দুই সপ্তাহ পর ঢাকায় যাই। ফোন দিয়ে ডেকে এনে মদ খাওয়াই। ওরা বাদে এলাকার লোকজন আমাকে কেউ চেনে না। ওরাও আমার পুরো পরিচয় খুজে দেখতে যায়নি, মদ পেয়েই খুশি।

এভাবেই গেল মাসখানেক। প্রথমে ভেবেছিলাম অতিরিক্ত মদ খাইয়ে গাড়ির নীচে বা পুকুরে ফেলে দেব, কিন্তু ওকে একা-ই পাচ্ছিলাম না। কারণ ও চলে দল বেধে। আমি একা ডাকলেও দলবল সহই চলে আসে। বুঝলাম অন্য রাস্তা ধরতে হবে।

তাই একদিন বললাম যে, এই হই হল্লার মধ্যে মদ খেতে ভালো লাগে না, একটা নির্জন জায়গা হলে ভালো হত। আমরা কয়জনই শুধু, নিজেদের মত করে ফুর্তি করতাম। ওরা সাথে সাথে রাজি হয়ে গেল। পরের দিনই আমাকে নিয়ে এলো ওদের এই আস্তানায়। সারা রাত মদ খেয়ে মরার মত ঘুমালাম দুপুর পযর্ন্ত।

দুপুরে গোসল করতে যাব, সুমন ডেকে নিয়ে গেল ওর এই বাসার বেড রুমে। সাথেই লাগোয়া বাথরুম দেখিয়ে বলল, ‘তুমি এখানে গোসল কর। ’ ভিতরে ঢুকে দেখি চমৎকার বাথরুম। বাথটাব পযর্ন্ত আছে। আরামে গোসল করে বের হয়ে বাথরুমের প্রশংসা করতেই ও জানাল, ওর এই একটাই শখ।

বাথটাবে গোসল করা। বাথ টাবে বা পুকুরে গোসল না করলে ওর কাছে গোসল-ই মনে হয় না। শহর এলাকায় পুকুর পাবে কই, তাই বাথটাব-ই ভরসা। আর কাউকে এখানে ঢুকতে দেয় না ও। শুধু আমাকেই দিল।

এক্সট্রা খাতির আরকি। সাথে সাথে আমার মাথায় বিদ্যুৎ ঝিলিক দিল। জুইয়ের জীবনটা ও যেভাবে ধ্বংস করেছে, আমিও ঠিক ওভাবেই ওকে মারব। ৪। এরপর আরো দুইদিন গেছি ওখানে।

শুধু মদ খেতেই। ওরা অবশ্য ওদের অন্যান্য আসরেও আমাকে ডেকেছে, আমি যাইনি। আমার জার্মানি ফিরে যাওয়ার সময় চলে এল। তাই আর দেরি করতে চাইলাম না। যা করার এই বাড়িতে পরের বার এলেই করব বলে ঠিক করলাম।

আমি ঠিক করেছি কুলাঙ্গারটাকে এসিডে চুবিয়ে মারব। খুব কঠিন হবে না কাজটা। আগের দুইবার দেখেছি শয়তানটা হ্যাং ওভার কাটার পর গিজার (পানি গরম করার যন্ত্র) ছেড়ে বাথটাবে আচ্ছাসে গোসল করে। টিনশেড বাড়ি, তাই বাড়ির পানির ট্যাঙ্ক মাটির কাছেই সামান্য উঁচুতে বসানো। এবার আসার আগে তাই ২০ লিটার ব্যাটারির এসিড কিনে এনেছি।

এতে আছে ৩৫% সালফিউরিক এসিড। চামড়ায় লাগলে খুব বেশি কিছু হবে না কিন্তু গরম করলেই বাষ্পীভবনের মাধ্যমে পানি সরে গিয়ে এটা পরিনত হবে কন্সেন্ট্রেটেড বা গাঢ় সালফিউরিক এসিড। এসিড এনেছি বিশাল দুটো কন্টেইনারে প্যাকেটে মুড়ে। ফলে ওরা দেখেও কিছু বোঝেনি। জিজ্ঞেস করেছে, আমি বলেছি ব্যাবসার জিনিস, ওরা আর মাথা ঘামায় নি।

রাতে যখন সবাই মদ খেতে ভয়ানক ব্যাস্ত, আমি একটু আসছি বলে বাইরে এসে পুরো এসিড পানির ট্যাঙ্কে ঢেলে দিয়েছি। যেহেতু ওই বাথরুমে আর কাউকে ঢুকতে দেয় না তাই আশা করছি আজও ও গিজার ছেড়ে গোসল করবে। গিজারের হিটে এসিড গাঢ় হবে। তারপর......... দৃশ্যটা চাক্ষুশ করার খুব ইচ্ছা ছিল কিন্তু সম্ভব না। ফাকা রাস্তা।

ঢাকা আরিচা হাইওয়েতে আমার বাইক উড়ে চলেছে। পরিশিষ্ট সুমনের গলিত লাশ পরে ওইদিন বিকেলেই উদ্ধার করা হয়। পানির ট্যাঙ্কে এসিড আসল কিভাবে এই রহস্যের কিনারা কেউ করতে পারেনি। সুমনের বন্ধুদেরকেই আটক করা হয়েছে। ওরা আমার কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু নকল নামটা বাদেতো আর কিছুই জানে না।

তাই ওদের আর্জি কেউ কানে তোলেনি। আমি আবার জার্মানিতে। সামনেই জুইএর প্লাস্টিক সার্জারী। দোয়া করবেন। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।