আমি একজন ব্লগ ভক্ত মানুষ।
একদা বাংলা-বিহার-ওড়িশার আকাশ বাতাস কেঁপে উঠতো যাদের হুংকারে, ভাগিরথীর তীরে মুর্শিদাবাদ নগরে আলোকোজ্জ্বল মহল সর্বদা সরগরম থাকতো যে দাপুটে নবাবের পদচারণায়, বাংলার সেই শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ দৌলার বংশধরেরা এখন ঢাকা শহরে বসবাস করছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে, নীরবে নিভৃতে। কেউ আজ আর তাদের খবর জানে না, খবর নেয় না।
এখন ঢাকা শহরের খিলক্ষেত এলাকার লেকসিটি কনকর্ড এর বৈকালী টাওয়ারের ছোট্ট ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন নবাব সিরাজ উদ দৌলার নবম বংশধরেরা। তাদের নবম বংশধর সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেব কাজ করেন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে।
বর্তমানে তিনি ড. ফজলুল হক সম্পাদিত সাপ্তাহিক পলাশী পত্রিকার সহ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। এখানেই আছেন তার বাবা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ গোলাম মোস্তাফা। তিনি নবাব সিরাজ উদ দৌলার ৮ ম বংশধর। তার প্রয়াত স্ত্রী সৈয়দা হোসনেআরা বেগম ছিলেন নবাবের স্ত্রী লুৎফুন্নিসা বেগমের রক্তের উত্তরাধিকার। সেখানেই বাস করেন তিনি এবং তার ২ ছেলে গোলাম আব্বাস আরেব ও ইমু এবং ২ কন্যা মাসুমা ও মুনমুন।
কিন্তু কিভাবে তারা নবাব সিরাজ উদ দৌলার বংশধর হলেন? বংশতালিকার সেই হিসাব দিয়েছেন গোলাম আব্বাস আরেব। ইরান থেকে ভাগ্য অন্বেষণে বাংলায় আসা নবাব আলীবর্দী খানের কোন পুত্রসন্তান ছিল না। তার ছিল ৩ কন্যা। ঘসেটি বেগম, ময়মুনা বেগম ও আমেনা বেগম। আলীবর্দী খানের বড় ভাই হাজী মির্জা আহমেদের ছিল ৩ পুত্র।
মুহাম্মদ রেজা, মুহাম্মদ সাঈদ ও মুহাম্মদ জয়েনউদ্দিন। আলীবর্দী খানের ৩ কন্যাকে বিয়ে দেন তার ভাই হাজী আহমেদের ৩ পুত্রের সঙ্গে। মুহাম্মদ রেজার সঙ্গে বিয়ে দেন ঘসেটি বেগমের। মুহাম্মদ সাঈদের সঙ্গে ময়মুনা বেগমের এবং আমেনা বেগমের বিয়ে দেন জয়েনউদ্দিনের সঙ্গে। জয়েনউদ্দিন ও আমেনা বেগমের ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে।
তাদের বড় সন্তান নবাব সিরাজ উদ দৌলা। অপর ২ ছেলে হলেন ইকরাম উদ দৌলা ও মির্জা মেহেদি। ২ কন্যা আসমাতুন্নেসা ও খায়রুন্নেসা। নবাব সিরাজ উদ দৌলা বিয়ে করেন ইরাজ খানের কন্যা লুৎফুন্নেসাকে। ইরাজ খানের পূর্বপুরুষরা ছিলেন মোঘল দরবারের কর্মকর্তা।
সিরাজ উদ দৌলার একমাত্র কন্যা উম্মে জহুরা বেগম। সিরাজ উদ দৌলার যখন মৃত্যু হয় তখন উম্মে জহুরা ছিলেন শিশু। সিরাজের কন্যা জহুরা বেগমের বিয়ে হয় সিরাজের ভাই একরাম উদ দৌলার পুত্র মুরাদ উদ দৌলার সঙ্গে। তাদের একমাত্র পুত্র শমসের আলী। তার পুত্র সৈয়দ লুৎফে আলী।
তার কোন ছেলে সন্তান ছিল না। তার একমাত্র কন্যা ফাতেমা বেগম। ফাতেমা বেগমের ২ কন্যা হাসমত আরা বেগম ও লুৎফুন্নেসা বেগম। লুৎফুন্নেসা ছিলেন নিঃসন্তান। বড় কন্যা হাসমত আরার ছেলে সৈয়দ জাকির রেজা।
তার ছেলে সৈয়দ গোলাম মর্তুজা। সৈয়দ গোলাম মর্তুজার ছেলে এই সৈয়দ গোলাম মোস্তফা।
২৩ শে জুন পলাশীর প্রান্তরে পরাজয়ের পর ২৫ শে জুন নবাব সিরাজউদদৌলা স্ত্রী লুৎফুন্নেসা ও শিশুকন্যা জহুরা বেগমকে সঙ্গে নিয়ে আবার সৈন্য সংগ্রহ করে বাংলাকে উদ্ধার করতে বিহারের উদ্দেশে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে ভগবানগোলায় ক্ষুধার্ত নবাব পরিবার দানা শাহ নামের এক লোকের বাড়িতে খাদ্য গ্রহনের সময় ওই ব্যক্তি মুর্শিদাবাদে খবর দিয়ে ধরিয়ে দেন নবাব সিরাজ উদ দৌলাকে। মুর্শিদাবাদে নিয়ে গিয়ে মীরজাফরের ছেলে মিরন বন্দি অবস্থায় ২ রা জুলাই ১৯৫৭ মোহাম্মদী বেগকে দিয়ে হত্যা করে নবাবকে।
নবাবকে হত্যার পর তার স্ত্রী শিশুকন্যা সহ দাদু আলীবর্দী খানের স্ত্রী আশরাফুন্নেসাকে নৌকায় করে ভাগীরথীর তীর থেকে বুড়িগঙ্গার পাড়ে জিঞ্জিরার একটি প্রাসাদে তাদের আটকে রাখা হয় ৮ বছর। সেখান থেকে আবার তাদের মুর্শিদাবাদে নিয়ে মুক্ত করা হয়। নবাব সিরাজ উদ দৌলার মৃত্যুর পর থেকে তার ৫ম বংশধর পর্যন্ত কাউকে সরকারি কোন চাকরি দেয়নি বৃটিশ সরকার। নবাবের ৬ষ্ঠ বংশধর সৈয়দ জাকি রেজা ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর কাছে এসে অনটনের কথা জানালে ১৯১৩ সালের ১৬ ই সেপ্টেম্বর তিনি বৃটিশ সরকারের কাছে তাকে একটি চাকরি দেয়ার জন্য অনুরোধ করে চিঠি লেখেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয় তিনি সিরাজ উদ দৌলার বংশধর।
সে অনুরোধের প্রেক্ষিতে বৃটিশ সরকার সৈয়দ জাকি রেজাকে মুর্শিদাবাদের ডেপুটি সাব রেজিস্টার পদে নিয়োগ করে। পরে তার পুত্র সৈয়দ গোলাম মর্তুজা চাকরি করতেন মুর্শিদাবাদের কালেক্টরেট বিভাগে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় তিনি নিরাপত্তার অভাব বোধ করে চলে যান পূর্ব পাকিস্তানে। প্রথমে যান রাজশাহী, সেখান থেকে খুলনা শহরে একটি বাড়ি কিনে স্থায়ী অধিবাসী হন। গোলাম মর্তুজার ছেলে সৈয়দ গোলাম মোস্তাফা পাকিস্তান আমলে চাকরিতে যোগ দেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী আধিকারিক পদে।
তিনি এখন তার দুই পুত্র সন্তান সহ বসবাস করছেন ঢাকা শহরে। তার বড় ছেলে সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেব সমাজের গুণীজন, সাংবাদিক ও লেখক। তিনি বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন তারা নবাব সিরাজ উদ দৌলার নামে একটি একাডেমী স্থাপন করতে চান। সে জন্য সহযোগিতা চান সরকারের।
ঢাকা শহরে বসবাস করা নবাব সিরাজ উদ দৌলার বংশধরদের বিষয়ে প্রকাশিত তার বই থেকে জানা গিয়েছে, তারা এখনও যেন এক ধরনের অজানা আতংকে ভোগেন।
সম্ভবত সেই আতঙ্ক থেকেই অন্তর্মুখী আর প্রচারবিমুখ হয়ে ছিলেন তারা। মিডিয়াকে তারা এড়িয়েই চলেন, সমাজে নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে রাখেন। ভারত সহ দুনিয়ার নানা দেশে মীরজাফরের বংশধরেরা যেন লুকিয়ে আছেন, সেই আতংকেই তারা এখনও ভোগেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।