অভদ্র লোক বাসযাত্রীদের হয়রানি নতুন কোনো ব্যাপার নয়। এক্ষেত্রে বাসমালিক বা চালক-হেলপারের চরিত্র একই। তাদের লক্ষ্যই থাকে কি করে যাত্রীর কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করা যায়।
এ ব্যাপারে কারো কাছে অভিযোগ করে যে সুফল পাওয়া যাবে- তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কেউ পেয়েছেন বলে কারো জানাও নেই।
কোনো যাত্রী যদি এক্ষেত্রে প্রতিবাদ জানাতে যান, তাহলে তাকে চালক-হেলপার ও তাদের গুণ্ডাদের হাতে চরম হেনস্থা হতে হয়।
অথচ সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল আছে যাদের এসব দেখাশোনার দায়িত্ব। কিন্তু তাদের কাজ শুধু যেন মাস শেষে বেতন-ভাতা গোনা। আর বাসমালিক-চালকদের কাছ থেকে বাড়তি টু-পাইস আদায় করা। এ কারণেই বাসমালিক বা চালকরা এতো বেপরোয়া।
তাদের লাগাম টানার বিভাগ তো আগেই তাদের কাছে নিজেদের সঁপে দিয়ে বসে আছে।
নইলে পথে পথে এতো যে দুর্ঘটনা ঘটছে- জীবনহানি ঘটছে অহরহ- তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কয়জনাই বা পাচ্ছে। অন্যায়-অবিচার-বঞ্চনার বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার সেই সাংবাদিকদের পর্যন্ত বেপরোয়া বাস চালকদের হাতে জীবন দিতে হচ্ছে।
ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকার কারণে বাসচালকরা তাদের খেয়াল খুশিমতো রাস্তায় বাস চালাচ্ছেন। ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছেন।
অথচ সংশ্লিষ্টমহল এ ব্যাপারে কোনো তৎপরতা দেখিয়েছেন বলে কারো কিছু জানা নেই।
গত মঙ্গলবার সকাল পৌনে ৯টা থেকে রাত পৌনে ১১টা অবধি এমনি এক চরম তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে খোদ আমার নিজের।
অফিসের কাজে শুক্রবার রাতে বাসে করে রওনা হয়েছিলাম চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। এর আগে বহু চেষ্টা করেও ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হন বাংলানিউজের হেড অব নিউজ মাহমুদ মেনন।
ট্রেনের টিকিট না পেয়ে অগত্যা আমরা দু’জনাই টি আর ট্রাভেলস-এর বাসেই চেপে বসি।
বলতে দ্বিধা নেই--- এ বাসটায় করে বেশ স্বস্তির সঙ্গে ভোরে চট্টগ্রাম পৌঁছালাম। এর আগে অবশ্য আমি কোনোদিন এমন আরামদায়ক বাসে চাপিনি। এজন্য টি আর ট্রাভেলস কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানতেই হয়।
আগে আমার ধারণা ছিল গ্রিনলাইন বাসটাই বুঝি স্বস্তিদায়ক। কিন্তু কক্সবাজার থেকে ঢাকা ফেরার পথে ১৪টি ঘণ্টা চরম মূল্য দিতে হয়েছে গ্রিনলাইন বাসটির কারণে।
প্রতি মুহূর্ত কাটাতে হয়েছে চরম কষ্টের সঙ্গে দুঃসহ গরম হজম করে ।
সারাদিনের প্রচণ্ড তাপদাহ থেকে রক্ষা পেতে সাড়ে ১৩শ’ টাকা দিয়ে কক্সবাজার-ঢাকা টিকিট কিনলাম গ্রিনলাইনের। বাস ছাড়ার কথা সকাল ৯টায়। সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়ে আছি।
সকাল সাড়ে ৮টায় কক্সবাজার গ্রিনলাইন কাউন্টার থেকে রিং করে জানানো হল- বাস ছাড়বে সকাল পৌনে ৯টায়।
শুনে খুশিই হলাম এই ভেবে যে অন্তত ১৫ মিনিট আগে ঢাকা পৌঁছাব। রাত বেশি হবে না।
রাত মানেই তো ছিনতাইবাজ-লুটেরাদের কবলে পড়া। বিশেষ করে রাতের সময়টা শাহজাহানপুর থেকে ফকিরাপুল পর্যন্ত ছিনতাইকারীদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র।
যাই হোক, কক্সবাজার ঝাউতলা গ্রিনলাইন কাউন্টার থেকে বাস ছাড়ল।
কক্সবাজার শহরের মধ্যে ২ জায়গায় বাসটি বিরতি দিল ২০ মিনিট যাত্রীর আশায়। বাসে ৭/৮জন বাদে বাকি সবাই চট্টগ্রামের প্যাসেঞ্জার।
কিন্তু যেমন ভেবেছিলাম তেমন নয় বাসটি। নামেই কেবল ভলভো। বাসটি পুরনো হওয়ায় চলছে লোকাল বাসের মতো ধীর লয়ে।
তবু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম এই তাপদাহের মধ্যে এসি গাড়িতে উঠেছি। অন্তত প্রচণ্ড গরম থেকে তো রক্ষা পাব।
কিন্তু আমার এই চিন্তা দেখে ঈশ্বর বোধহয় মুচকি হেসেছিলেন। আনোয়ারা এলাকায় ঢোকার পর হঠাৎ বাস থেমে গেল- কী ব্যাপার? বাইরে তাকিয়ে দেখি একজন পুলিশ কর্মকর্তা চালকের কাছে বাসের কাগজপত্র চাইছেন পরীক্ষার জন্য ।
সব কাগজ আগেই পুলিশ নিয়েছে জানিয়ে চালক একটি স্লিপ ধরিয়ে দিল পুলিশ কর্মকর্তাকে।
তিনি কাগজটি দেখে বাস ছেড়ে দিলেন। ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম বাসটি দ্রুত ছেড়ে দেয়ার জন্য।
কেননা ঢাকার অভিজ্ঞতায় দেখেছি- বাসের কাগজপত্র পরীক্ষার নামে দীর্ঘক্ষণ বাস আটকিয়ে রাখছেন ট্রাফিক সার্জেন্ট। দর কষাকষি করে রফা না হওয়া পর্যন্ত নিস্তার মেলে না অফিসমুখি যাত্রীদের।
কেননা ওই যাত্রীদের তখন ভয় এসে ভীড় করেছে- ঠিক সময় মতো অফিসে পৌঁছাতে পারবো তো।
নইলে তো কপালে রয়েছে বড় কর্তার চোখ রাঙানি বা মাইনে কর্তন। অফিস টাইমে অথবা অফিস থেকে ফেরার সময়ে বাস আটকিয়ে কাগজপত্র পরীক্ষা বিশ্বের আর কোনো দেশে আছে বলে আমি শুনিনি।
অথচ ট্রাফিক সার্জেন্ট ও পুলিশের কাজ হলো রাস্তা যানজটমুক্ত রাখা। কিন্তু অধিকাংশের সেদিকে খেয়াল নেই। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে প্রত্যেক মোড়েই সার্জেন্টরা গাড়ি আটকিয়ে কাগজপত্র নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
এদিকে যে যানজটে নাকাল রাজধানীবাসী। তার প্রতি কোনো খেয়াল নেই সার্জেন্টদের। তারা সর্বক্ষণ ব্যস্ত বাসের কাগজ পরীক্ষা নিয়ে। প্রতিদিন সকাল ১০টায় প্রেসক্লাব থেকে গাড়িতে করে বসুন্ধরা-বারিধারা আবাসিক এলাকায় আসার পথে এক থেকে দেড় ঘণ্টা এ দৃশ্য দেখে আসছি।
রাতে এ কাগজ পরীক্ষার শিকারে পরিণত হয় ট্রাক চালকরা।
এসব দেখতে দেখতে সবার অনেকটা গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। এটা যেন একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে।
আনোয়ারায় সার্জেন্টের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে বাস ছুটে চলল চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। আধাঘণ্টা চলার পর হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল বাসের এসি চলার শব্দটা। গরমের কারণে যাত্রীদের চেঁচামেচিতে গাড়িও থেমে গেল।
ধারে-কাছে কোনো দোকান-পাটও নেই অন্তত ছায়ায় বসে বা চা পান করে সময়টা কাটাব। এরই মধ্যে জানা গেল ফিতা কেটে যাওয়ার জন্য এসি বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
প্রায় ঘণ্টা খানেক বাদে এসি চালু করা গেল। বাস চট্টগ্রামের পথে এগিয়ে চলল। আবার কিছুদূর গিয়ে বাস থামল।
কেননা এবার থামানো হয়েছে চা-নাস্তা-পানি বা মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিতে। বিরতি দেয়া হলো ২০ মিনিট সময়।
পাঁচঘণ্টা জার্নির পর পৌঁছালাম চট্টগ্রাম শহরে। কাউন্টারে আধাঘণ্টা পার করার পরও তেমন একটা যাত্রী পাওয়া গেল না। গরমে অতিষ্ঠ যাত্রীদের কয়েকবার প্রতিবাদের মুখে বাস ছাড়ল ঢাকার উদ্দেশ্যে।
সীতাকুণ্ড ঢোকার কয়েক মিনিট বাদে ফের বাসের এসি বন্ধ। এবার বাস থামল একেবারে জনমানবহীন একটি জায়গায়। ধারে কাছে কোন গাছপালাও নেই যে তার নিচে গিয়ে দুদণ্ড বিশ্রাম বা সময় কাটানো যায়।
এবার বিক্ষুব্ধ যাত্রীদের বোঝানো হল চট্টগ্রাম থেকে বাস আসছে। ধৈর্য ধরতে বলা হল।
পাশাপাশি এসি ঠিক করার কাজও এগিয়ে চলতে লাগল চালক ও হেলপারের মাধ্যমে।
সোয়া ঘণ্টা বাদে যাত্রী সমেত গ্রিনলাইনের এটি বাস এলো চট্টগ্রাম থেকে। বাসে ওঠা গেল বটে- কিন্তু আসন গিয়ে পড়ল একেবারে পেছনের দিকে। প্রতিবাদ করেও কোনো লাভ নেই। কেননা যারা চট্টগ্রাম থেকে এসেছেন তাদের তো আর উঠিয়ে দিয়ে আমাদের বসানো যায় না।
আর চট্টগ্রাম থেকে বাড়তি কোনো বাস আসার কোনো সম্ভাবনাও নেই। তাই বাধ্য ছেলের মতো পেছনের দিকে আসন গ্রহণ করলাম। কিন্তু এবার গ্রিনলাইনের এ বাসটির এসি চলছে বটে- কিন্তু স্বস্তিদায়ক নয়।
অর্থাৎ ভ্যাপসা গরম বোধ হচ্ছে না ঠিকই- তবে এসির শীতল পরশ অনুভব করতে পারছি না মোটেই। না শীতের পরশ, না গরমের তীব্র অস্বস্তি।
এ অবস্থায় গাড়ি এগিয়ে চলছে ঢাকার দিকে।
খানিকক্ষণ চলার পর বাস থেমে গেল। এবার চালকসহ ২/১জনও বাস থেকে নেমে গেলেন। জানা গেল নামাজ পড়তে নেমেছেন চালক।
১৫ মিনিট বাদে বাস স্টার্ট দিল।
চলা শুরু হল। আগের বাসটার মতো এ বাসটাও চলছে লোকাল বাসের মতো। যেন গতি নিয়ে চলতে কষ্ট পাবে। অথচ হুশ হুশ করে ডান পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সব বাস-ট্রাক।
এভাবে চললে ঢাকায় পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে এ ব্যাপারে সুপারভাইজরকে জানানো হলে তিনি বললেন, এভাবেই চলবে।
কি আর করা! চুপচাপ বসে থেকে নিজের কপালকে দুষলাম।
রাত তখন ৮টা। বাস থামল কুমিল্লায় রাস্তা সংলগ্ন একটি দামি হোটেলের সামনে। নৈশ আহারের বিরতি। পথে পথে দামি হোটেলের সামনে যে বাস থামে তা কিন্তু যাত্রীদের সেবার জন্য নয়।
কেননা এসব হোটেলে যে গলাকাটা খাবারের দাম রাখা হয় অনেকের কাছে তা কল্পনাতীত। অবশ্য যাত্রীদের চেয়ে হোটেলে ঢোকার ব্যাপারে বাস চালক ও সুপারভাইজর-হেলপারের আগ্রহটাই বেশি।
কুমিল্লা নূরজাহান হোটেলে একশ’ সোয়াশ’ গ্রামের একটি রুপচাঁদা মাছের দাম ২০০ টাকা, এক প্লেট ভাত ২০ টাকা, এক বাটি ডাল ৪০ টাকা, এক বাটি সব্জি ৬০ টাকা, গরু ১২০ টাকা, নান ২৫ টাকা, চা ২০ টাকা।
এসব হোটেলে প্রকাশ্যে খাবার মূল্যের কোনো তালিকা টানানো নেই। যাতে করে সবাই দেখে-শুনে খেতে পারেন।
আর আশপাশেও কোনো হোটেল বা চায়ের দোকান নেই যে যাচাই করে খাওয়া যাবে। আর বাস চালকরা বাছাই করে এভাবে বাস নিয়ে থামায়। যাতে করে বেশি দামে না খেয়েও উপায় নেই।
অথচ বাস চালকরা একটু চিন্তাও করেন না যে- কয়জন এদামে খেতে পারেন। পথে পথে তো কতো হোটেল পড়ে।
তারা নিজেরা দাম দিয়ে কি এভাবে খেতে পারতেন?
জনশ্রুতি আছে- পথে পথে এ ধরনের হোটেল মালিকদের সঙ্গে বাসচালক ও সুপারভাইজর-হেলপারের গোপন রফা করা আছে। তাদের জন্য সব খাবার ফ্রি অর্থাৎ তাদের কোনো টাকাকড়ি গুণতে হবে না। এজন্য তাদের নাকি নগদ বকশিসও দেয়া হয়। এক্ষেত্রে বাস ও হোটেলমালিকদের মধ্যেও গোপন রক্ষা থাকতে পারে।
যাই হোক আধাঘণ্টা বাদে বাস ছাড়ল ঢাকার উদ্দেশে।
এদিন পথে কোনো যানজট ছিল না। যাত্রাবাড়িতে একটু হালকা যানজটে পড়লাম। যা না পড়লেই নয়। রাত পৌনে ১১ টায় পৌঁছালাম রাজারবাগ গ্রিনলাইন বাস ডিপোতে।
পথে পীর জঙ্গী মাজারের সামনে নামতে চেয়েও পারা গেল না।
কেননা হাত ব্যাগটা রাখা ছিল বাসের বক্সের ভিতর। হেলপার অসুবিধার কথা বলে বক্স খুলতে রাজি হল না। রাজারবাগ ডিপোতে নেমে একটি রিকশা নিলাম। পথে ছিনতাইকারীর কবলে যাতে পড়তে না হয় সেজন্য ঈশ্বরকে স্মরণ করে রওনা দিলাম।
ঈশ্বরকে এবার কায়মনে ধন্যবাদ দিলাম রাজারবাগ-শান্তিনগর-মতিঝিল-ফকিরাপুল সিগন্যালবাতির আগে পুলিশ পাহারা দেখে।
ছিনতাইকারীর কবলে পড়া ভয়টা কেটে গেল।
আমার ১৪ ঘণ্টার দুঃসহ দুঃখ-কষ্ট-ক্লান্তি-অবসাদ সবই দূর হয়ে গেল ঠিকঠাক মতো ঘরে ঢুকতে পেরে। কক্সবাজারের সব স্মৃতিও এসে ভীড় করলো মনের গভীরে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।